চন্দনের গন্ধ / আফরোজা অদিতি

চন্দনের গন্ধ 14,15

শেষ দুটি পর্ব 

১৪

 

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাসায় ফিরতে রাত হয় তিমিরের। মনের ভেতরে রাগ থাকলে বাড়ি ফিরলে কারও না কারও সঙ্গে রাগ করে ফেলবে ঠিক! তাই নিউমার্কেট গিয়ে ঢোকে। এ দোকান সে দোকান করতে করতে একটা শাড়ি কিনে ফেলে; শাড়িটা কিনতে পেরে মনের মধ্যে একটু সুখ অনুভব করে। শাড়িটা ওর মনের সমস্ত রাগ-বিরক্তি উড়িয়ে দিয়ে সুখের বাতাস বইয়ে দেয়! ওর ভালো লাগে। প্রিয় মানুষকে কিছু দেওয়ার সুখ অনুভব করে। কাউকে কিছু দিতে পারা যে এতো সুখ কখনও অনুভব করেনি। এই সুখে সে মেয়ের জন্য ঝলমলে একটা জামা আর এক সেট খেলনা কিনে ফেলল। খেলনা কেনার পরে মনে হলো ওর মেয়ে তো খেলনা নিয়ে খেলে না। তখন বইয়ের দোকানে গিয়ে ছবিসহ গল্পের বই কিনে বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাইরে এসে দাঁড়ালো। রিকশা ঠিক করে একগুচ্ছ রজনীগন্ধ্যা আর টকটকে বড়ো একটা গেলাপ কিনে রিকশাতে উঠলো।

 

বাসার সামনে এসে কেমন খটকা লাগে মনে; বাড়ি কেন আবছায়া অন্ধকারে ঢাকা! কেন এতো নীরব! ডোরবেল বাজালো, অপেক্ষা করলো। একবার-দুইবার-তিনবার। প্রায় পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো; আবার বেল বাজাতে যাবে এমন সময় দরোজা খুলে গেল। তিসু খুলেছে। 

‘কী হয়েছে তিসু?’

তিসু কথার কোন জবাব না দিয়ে বাইরের দরোজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গেল। অবাক হলো তিমির। তিসুর রাগ কি এখনও কমেনি! ওর ওপর আবার রাগ উঠে এলো ভেতর থেকে। রাগে-দুঃখে মায়ের ঘরে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে মা?’

‘উর্মি নেই বাপ!’ বলেই তিমিরকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে।

‘উর্মি নেই মানে কি মা!’ চিৎকার করে ওঠে তিমির। হাতের জিনিসগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে যায়। 

‘তুই চলে যাওয়ার পর নামাজে বসেছি; তোর বাবা গেছে বাইরে হাঁটতে। উর্মিকে ডাকলো তোর বাবা কিন্তু গেল না; উর্মি বারান্দায় বসে ছবি আঁকছিল। তিসু ছিল রান্নাঘরে। তারপর কী হলো বুঝতে পারলাম না। চার রাকাত মাত্র নামাজ, বাপ এইটুকু সময় …।’ মায়ের কথা শেষ হয় না। কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে যায়।

‘খুঁজেছ কোথায়?’

‘সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি; রান্নাঘর-ওয়াসরূম কোথাও নেই। রাস্তায় খুঁজেছি, তোর বাবার সাথে তো যায়নি, তবুও জিজ্ঞেস করলাম। যায়নি।’

মায়ের কথা শুনে গতকালের কথা মনে পড়ে যায় তিমিরের। উর্মি আমার, আমার উর্মিকে নিয়ে যাব। কিন্তু কাউকে দেখতে পায়নি তিমির, তাই বুঝতে পারেনি, কার উর্মি, কোথায় নিয়ে যাবে? কে নিয়ে যাবে সব অজানা তিমিরের। ওদিকে তিসু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। কী এক দোটানায় পড়েছে তিমির নিজে তো বুঝতে পারছে না, কাউকে বুঝাতেও পারছে না।

‘তিসু দরোজা খুলে দিয়ে গেল কোথায় মা।’

‘সারাদিন তো ঐ ঘরে! খাওয়া-দাওয়া নেই, ঐ ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি, ডাকাডাকি করছি কিন্তু সাড়াও দিচ্ছে না, বেরও হচ্ছে না। আমি আর পারছি না বাপু।’ কাঁদতে থাকে মা।

‘কিন্তু মা এইমাত্র দরোজা খুলে দিলো তিসু; গেল কোথায়? আবার কি ঐ ঘরে ঢুকেছে? কেবল ঐ ঘর আর ঐ ঘর! ঐ ঘরে আগুন ধরিয়ে দিব আমি।’ রাগে গনগনে আগুনের মতো জ্বলে ওঠে তিমির। ও ঘরে গিয়ে দরোজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকে তিসুকে। তিসু জবাব দেয় না, দরোজাও খোলে না। তিমির পাগলের মতো তিসুকে ডাকছে আর দরোজায় ধাক্কা দিচ্ছে। এমন সময় ওর খোলা ঘাড়ের ওপর কারও নিঃশ্বাসের ভাপ লাগলো সেই সঙ্গে ভেসে এলো কথা।

‘দরোজা ধাক্কালেও তো ও শুনবে নারে।’

‘কেন শুনবে না!’

‘সে তুই বুঝবি না। ধাক্কাধাক্কি না করে ঘরে যা।’ তিমির কাউকে দেখতে পায় না। কাউকে দেখছে না কিন্তু কেউ তো আছে এখানে, না হলে কথা তো শুনতে পেতো না। তিমির অদৃশ্য কন্ঠের কথা না শুনে আবার দরোজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলে, ‘তুমি কে? কেন নিষেধ করছো?’

‘আমি কে?’ এবারে হাসির শব্দ শুনতে পায় তিমির। হাসি জোরে নয় তবে গা হিম করা হাসি। একসময় হাসি থেমে গেল। কথা ভেসে এলো। ‘ আমার কথা তোকে চিন্তা করতে হবে না, আমি কে সে কথাও তোকে জানতে হবে না। তোর নিজের কথা ভাব।’ তিমির অদৃশ্য কন্ঠের কথার কোন জবাব দেয় না। দরোজায় ধাক্কা দিতে থাকে। হঠাৎ শার্টের কলারে টান পড়ে ওর। কে যেন শার্ট টেনে ধরে রেখেছে ওর। ওর ঘাড়ে- হাতে ব্যথা লাগছে; চিৎকার করে ওঠে ব্যথায়। ওর চিৎকারে হাতের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। খুবই ব্যথা লাগছে। টনটন করছে। হাত ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকে তিমির। হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্রায় ক্লান্ত হয়ে গেছে ঠিক সেই সময় গমগমে অন্য একটি শক্তিশালী কন্ঠ শুনতে পায় তিমির। ‘অ্যাই ছেড়ে দে ওকে। আর তুই এখান থেকে চলে যা।’

‘আমি যাবো না। এখান থেকে কিছুতেই যাবো না।’ অন্য একটি কন্ঠ শুনতে পায় তিমির। একরোখা জিদ্দি সে কন্ঠস্বর। 

‘ভালো যদি চাস্ তো চলে যা; না হলে মরবি, এখানেই মরবি!’

‘আমি মরবো তবুও যাবো না।’

‘তবে মর।’ সপাং সপাং বেতের আওয়াজ শুনতে পায় তিমির কিন্তু ওর গায়ে লাগছে না! ওদিকে কে যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, টাল সাামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে চেতনা হারায় তিমির। চেতনা ফিরে আসে শেষ রাতে। চেতনা ফিরে দেখতে পায় মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মা। মাকে দেখেই প্রথম কথাই হলো ‘তিসু কোথায়?’

‘ঐ ঘরেই আছে বাবা।’ মায়ের চোখে পানি। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে মা। বাড়ির আবহাওয়া থমথমে। উর্মিকে পাওয়া যায়নি। জানে পাবে না, তবুও শহরের সব সম্ভাব্য স্থানে খুঁজেছে তিমির।

 

বাড়িতে কারও গোসল-খাওয়া-ঘুম নেই। দুই দিন পর দরোজা খুলে বের হয় তিসু। ‘উর্মি আসছে।’ শব্দ দুটি বুলেটের মতো ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল ঘরে। সকলে হতবাক। কারও মুখে কথা নেই। সকলের মুখে একই কথা ‘উর্মি আসছে, কোথা থেকে আসছে!’ 

তিমির চুপ। কোন কথা বলল না, বলছে না। ওদের সকলের অবাক করা দৃষ্টির সামনে এলো উর্মি। কেউ বুঝতে পারলো না, কী করে, কোথা দিয়ে এলো কেউ দেখল না বুঝতে পারল না। দাদি এসে কোলে  নেয় উর্মিকে। প্রশ্নের পর প্রশ্নের খই ফুটিয়ে চলে দাদি। কোথায় গিয়েছিলে? কেমন করে গিয়েছিলে? এলে কী করে? এতো প্রশ্নের মুখে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে উর্মি তারপর দাদির কোলে চেতনা হারিয়ে ঢলে পড়ে।

 

পরদিন অফিসে গেল না তিমির। বিকেলে শিশুপার্কে নিয়ে যায় উর্মিকে। মেয়েটা কথা বলছে না, খাচ্ছে না। পার্কে এসে ট্রেনে উঠালো। এরোপ্লেন, নাগরদোলা সবগুলির টিকিট কেটেছে। কিন্তু ট্রেনে ওঠার পরেই উর্মি বলল, ‘বাপী, আমার আর ভালো লাগছে না।’

‘কেন মা? তোমার শরীর খারাপ লাগছে।’ বাবা ব্যস্ত হয়ে গেল।

‘না বাপী। এমনি এসব খেলাধূলা ভালো লাগছে না।’

‘তাহলে এখানে বসি। দেখ কতো ছেলেপুলে এসেছে, ওদের মা-বাবা আত্মীয় স্বজনেরা এসেছে; ওরা আনন্দ করছে, খেলছে। তুমি না খেললে এসো দুজনে কথা বলি, গল্প করি।’ কোন কথা বলে না উর্মি। ওরা, বাবা-মেয়ে একটা বাঁধানো জায়গায় বসলো।

‘কি খাবে বলো?’

‘কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না বাবা।’

‘তা বললে কি হবে সোনা মা। একটু অপেক্ষা করো।’

উর্মি কোন কথা বলছে না। চুপচাপ বসে আছে। তিমির এদিক ওদিক দেখে একটা আইসক্রিম আর এক ঠোঙা বাদাম কিনে দিলো উর্মিকে। উর্মি কিছুই খায় না, হাতে নিয়ে বসে থাকে। তিমিরও সাধাসাধি করে না ওকে। চুপচাপ বসে আছে। দুজনের মনে দুই ধরণের চিন্তা ঘুরছে। তিমির ভাবছে ওর এই ছোট্ট মেয়েটা তিনদিনেই কতো বড়ো হয়ে গেছে। ওর বয়স যেন বেড়ে গেছে একলাফে; ও আর সেই ছোট্টটি নেই। বোধবুদ্ধি সম্পন্ন একজন বয়সী মানুষ হয়েছে। বেশকিছুক্ষণ বসে থেকে তিমির মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, ‘সোনা মা, চুপ করে বসে না থেকে তোমার বেড়ানোর গল্প বলো, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।’ উর্মিকে এই কথাটা বলার জন্য দুইবার বলতে হলো না। উর্মি বলতে শুরু করে। 

 

‘দুপুরবেলা উঠানে খেলছিলাম বাপী, লেখা লেখা, পড়া পড়া খেলছিলাম। খেলতে খেলতে দেখি একটি বইয়ের পাতা ছেঁড়া। ছেঁড়া পৃষ্ঠাটি বাপী উড়ে গিয়ে দাগের বাইরে ঘাসের ওপরে পড়লো।’

‘দাগ, কিসের দাগ?’ অবাক হয়ে মেয়েকে প্রশ্ন করে তিমির।

‘দাগ, বাপী। মা দাগ টেনে বলেছিল সাতদিন ঐ দাগের বাইরে যেন না যাই। আমি মায়ের কথা না শুনে বাপী দাগের বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আর যেই দাগের বাইরে গেলাম, সুন্দর গন্ধ নাকে এসে লাগলো, চন্দনের গন্ধ বাপী! তারপর আর মনে নেই আমার।’

 

এইটুকু বলে চুপ করে যায় উর্মি। উর্মির কথা অগোছালো নয়! এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে ঐটুকু একটা মেয়ে ভেবেও অবাক হয়ে যাচ্ছে তিমির। মেয়েকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ‘তারপর কী হলো সোনা মা।’

‘বাপী, তোমার মনে আছে একদিন আমরা, তুমি-আমি-মা প্রাচীন জমিদার বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে ঐ রকম একটা বাড়িতে নিয়ে রেখেছিল। ঐ ঘরে একজন বসে আছে ঠিক মায়ের লাইব্রেরি ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা ছবির মতো। তারপর আমাকে ঐ ঘরে নিয়ে যেতেই অন্য একটি মেয়ে এলো ঐ লাইব্রেরি ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা মেয়েটির মতো।’ এইটুকু বলেই চোখ বন্ধ করে উর্মি। ওকে দেখে তিমিরের মনে হলো উর্মি যেন দূরের কোন দৃশ্য দেখছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টে বুকের ভেতর ওলোট-পালোট হয়ে যায় বাবার। তিমিরের চোখ ভিজে ওঠে।

 

কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে চোখ খুললে। চোখ খুলে বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা, আমার নাম উর্মি কেন? আমি কি তোমার মেয়ে নই?’ 

‘এই কথা কে বলেছে মা, তুমি আমার মেয়ে নও। তুমি আমারই মেয়ে।’

‘তবে যে ওরা বললো, আমি তোমার মেয়ে নই!’

‘সুন্দর চেহারা একটি মানুষ ছিল, সেই নাকি আমার বাবা! ঐ মানুষটা যদি আমার বাবা হয় তবে, তুমি কে? বলো না বাবা।’

তিমির এই কথার কী জবাব দিবে, এইটুকু এক মেয়ের কাছে কী জবাব দেওয়ার আছে ওর। তিমির ওকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বললো, ‘তুমি কি বাড়ি যাবে উর্মি।’

‘না, বাপী।’

‘তাহলে, এই চৌবাচ্চার মধ্যে মাছেদের খেলা দেখ সোনা মা।’

‘তুমি চিন্তা করো না বাপী, আমার কিছু হয়নি, তুমি বসো।’

তিমির বসলো মেয়েকে নিয়ে; বসলেও ওর মনে দ্বন্দ শুরু হলো। বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করবে তিসুকে কে উর্মির বাবা। উর্মি যদি ওর মেয়ে না হয় তবে ওকে ঠকানোর জবাব তো দিতেই হবে ওকে। তিসুর কাছ থেকে এই কথা জানতে হলে আরও কথা উর্মির কাছ থেকে জানতে হবে। কিছুক্ষণ পর উর্মিকে বলে, ‘তারপর কী করলে মা, কী হলো?’

‘আমি কি বলছিলাম বাবা, আমাকে মনে করিয়ে দাও।’

‘ঐ যে মানুষটা বসেছিল ওখানে গেলে… তারপর’ তিমির মনে করিয়ে দিলো।

‘ও আচ্ছা। ঐখানে যাওয়ার সাথে সাথে বাপী, ঠিক মায়ের মতো দেখতে একজন মহিলা এসে আমাকে হাত ধরে অন্য এক ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে গোল করে দাগ টানা গন্ডির মধ্যে বসিয়ে নানারকম খাবার-দাবার এনে খেতে দিলো। আমি খেতে চাইনি বাবা। যতো খেতে চাই না ততো মারে। এই যে দেখ না বাবা আমার পিঠে।’

 

উর্মির জামা তুলে ওর পিঠে চাবুকের সুস্পষ্ট দাগ দেখতে পায় তিমির। তিমিরের  খুব কষ্ট হলো। রাগ হলো। ঘৃণা হলো। এতটুকুন একটা মেয়ের গায়ে এভাবে হাত তুলতে পারে ওরা! আশ্চর্য। হোক না পরের মেয়ে, তাই বলে এভাবে মারবে! তিমির এর প্রতিকার ভাবতে থাকে। উর্মিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা সোনা মা, যারা তোমাকে খেতে দিয়েছে তারা কী আমাদের মতো? মানে দেখতে কি আমাদের মতো। আবার যে বা যারা তোমাকে মেরেছে তারা কী রকম দেখতে?’

‘বাবা, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। একবার মনে হয়েছে আমাদের মতো আবার মনে হয়েছে আমাদের মতো না। তবে কথা বলে ওরা। কথা আমাদের মতো বলে, আবার কখনও অন্যভাবেও বলে।’

উর্মির কথা শুনে চোখ দিয়ে জল গড়ায় তিমিরের। উর্মি অন্য দিকে তাকিয়েছিল; বাবার চোখের জল হাতের ওপর পড়তেই চমকে ওঠে। তারপর বাবার চোখ মুছিয়ে দেয়।

‘কেঁদো না বাবা। কেঁদো না। আমি এখন ভালো আছি। তোমার কাছে আমি খুব ভালো আছি।’ উর্মি কথাগুলো বলে আবার চুপ করে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। পায়চারি করে। বেশকিছুক্ষণ পায়চারি করে বাবার পাশে এসে বাবার হাত ধরে। বলে,

‘বাবা, আমি এখন ভালো আছি। আমি মায়ের কথা ভাবছি। ওরা মায়ের কথা কী যেন বলছিল। আমি বুঝতে পারিনি। জানো, ওরা মায়ের কথা বলছিল আর আমার মুখে জোর করে খাবার ঠেলে দিচ্ছিল। খাবার মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ কী হলো বলতে পারি না বাবা, ওরা আর আমার মুখে খাবার দিলো না। খাবার দেওয়া বন্ধ করে খাবারের থালা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। তারপর এখানে আসার আগে পর্যন্ত আর আমাকে খাবার দেয়নি ওরা।’ আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে উর্মি। তিমির অপেক্ষা করে, জানে নিজে থেকেই পরের কথাগুলো বলবে উর্মি। তিমিরের ভাবনাই ঠিক। উর্মি আবার বলতে শুরু করে, ‘আমার মন বলছে বাবা, খুব খারাপ একটা কিছু হবে!’

উর্মির কথায় বুঝতে পারে তিমির সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে গেছে। কোথায় যেন একটা অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে রক্তাক্ত করে দিয়েছে ওর পৃথিবী, ওদের পৃথিবী। ওরা বদলে গেছে, উর্মি বদলে গেছে, বদলে গেছে তিসু, তিমির নিজেও কি বদলে যায়নি! ওদের উর্মি এখন আর ছোটো নেই, এখন অনেক দূরের, যেন সুদূরের কোন একটি নক্ষত্র। 

   

 

পর্ব  ১৫ ( শেষ পর্ব )

      

তিমির বসে আছে চুপচাপ। পাশে উর্মি। তিমিরের মনে তোলপাড়; এতো ঘটনা, এতো অঘটন এই সবের মূল খূঁজলে নিশ্চয় উর্মির পরিচয় পাওয়া যাবে। উর্মি কার মেয়ে? উর্মি কার মেয়ে মনে হতেই অনেকদিন আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় তিমিরের। বিয়ের পর পর মাঝেমধ্যে তিসুকে বিছনায় না দেখলে ভাবতো ওয়াসরূমে গেছে তিসু। আসবে, চলে আসবে। এই কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যেতো তিমির কিন্তু সেদিন ঘুম আসছিল না ওর। নিজেরও ওয়াসরূমে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। 

 

তিমির অপেক্ষা করেছে অনেকক্ষণ কিন্তু তিসু দেখা নেই। ওয়াসরূমে আলো নেই। তিসু গেল কোথায়। ওয়াসরূম সেরে তিসু কোথায় দেখতে বের হয় ঘর থেকে; বারান্দায় পা দিতেই মন ভরে যায় আনন্দে! জোছনাজলে ভাসছে পৃথিবী। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। সুন্দর রাত। এই সুন্দর রাতে অল্পক্ষণের জন্য হলেও বাঁশির সুর শুনতে পেলো তিমির। গুনগুন করে গান ধরেছিল সেদিন।

“চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো

  ও রজনীগন্ধ্যা তোমার গন্ধসুধা ঢালো…”

গানের সুর গুনগুনিয়ে উঠতেই তিসুর কন্ঠ শুনতে পায়। কথা আসছে লাইব্রেরি ঘরটা থেকে। পায়ে পায়ে ঐ ঘরের দিকে এগিয়ে যায় তিমির। দরোজা একটু ফাঁক করে দেখতে পায় তিসু শুয়ে আসে ইজিচেয়ারে। হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখা। বুকের আঁচল একটু সরে গেছে। 

তিসু কথা বলছে, আবার শুনছেও। ওর মুদিত চোখ, মুখমন্ডলে কথা শোনার আগ্রহের সঙ্গে অপূর্ব এক দীপ্তি খেলা করছে! তিমির অবাক হয়ে অন্য যে একজন কথা বলছে তাঁকে খুঁজছে কিন্তু ঘরে কাউকে দেখতে পেলো না! কার সঙ্গে কথা বলছে তিসু, ভেবে পেলো না তিমির। অদৃশ্য কেউ, সে কে? তিসুর কাছে জিজ্ঞেস করেও কোন জবাব পায়নি তিমির।

 

এখন, এইখানে বসে উর্মির কথা শুনে মনে হচ্ছে ঐ অদৃশ্য কন্ঠধারকই কি উর্মির জন্মদাতা!

‘না! না!’ স্থানকাল অবস্থান ভুলে চিৎকার করে ওঠে তিমির। মেয়ের কথাও ভুলে গেছে ও। 

‘কী হলো বাপী।’ বাবার চিৎকার করে ওঠাতে হাত ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে মেয়ে।

‘কিছু না, সোনা মা।’

মুখে কিছু না বললেও নিজের মনকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছে না। ওর মন মানতে চাইছে। যতোই ভাবছে উর্মি ওর মেয়ে, আর কারও নয়, ততোই আগের কথা মনে পড়ছে। কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছে না উর্মির বলা কথাগুলো; ঐ কথাগুলো মনের ভেতর ভীড় করে মনের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর। ওর কেবলই মনে হচ্ছে তিসু কেন এসব কথা বলেনি, কেন? কেন? কেন?

 

তিমির নিজের মনেই এর ব্যাখ্যা খুঁজে বের করে। তিসু যে ওকে এসব কথা বলেনি, তার একটিই কারণ তিসুর মধ্যে পাপ আছে, অন্যায় আছে, দ্বিচারিতা আছে। এসব কথা ভাবতেই আবার মনে পড়ে সেদিনের কথা। তিসু তো বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলতে পারেনি। উহ্ সেকী যন্ত্রণা, সে কী চিৎকার! তিমিরের সেদিনের কথা মনে পড়তেই শিউরে ওঠে। আহা! কী কষ্ট, কী কষ্ট! না, না তিসুর কোন দোষ নেই। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করো, ওর কোন দোষ নেই!

 

ওরা চুপচাপ বসে আছে। উর্মি কোন কথা বলছে না। নিজেও কথা বলছে না তিমির, ভাবছে উর্মি কার এ নিয়ে চিন্তা করে কোন লাভ নেই। তাছাড়া এই বিষয়ে কিছুই জানে না তিসু। তিসু এমন এক মেয়ে যে এসব কথা জানলে এক মুহূর্ত ওর সঙ্গে এই এক বাড়িতে, এক বিছনায় থাকতো না! ও সম্মোহিত ছিল। এসব কথা ভাবছে হঠাৎ পেছন থেকে আসা কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে।

‘কী ভাবছো?’

‘কে?’ লাফিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তিমির। 

‘ভয় পেয়ো না, আমি উর্মির বাবা।’

‘না, উর্মি আমার মেয়ে।’

‘তোমার আমার বলে এখন কোন পার্থক্য নেই! তুমিও যে, আমিও সে। তাছাড়া আমি উর্মিকে নেবো না। আমি নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম তিসুকে, কিন্তু ও যেতে চাইলো না; কিছুতেই তোমাকে আর উর্মিকে ছেড়ে যেতে চাইলো না! এই সংসার ছেড়ে যেতে কখনই আগ্রহী ছিল না ও। আমি ভেবেছিলাম ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুললে হয়তো যেতে আগ্রহী হবে; সম্মোহন করলাম, সম্পর্ক করলাম! কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না; তাই তো বাধ্য হয়ে ওকে…।’ অদৃশ্য কন্ঠ যেন কান্না ভেজা উদাস বাতাসের মতো বয়ে গেল তিমিরের চারপাশে। একটু চুপ থেকে আবার বলে অদৃশ্য সেই কন্ঠ,‘আমি ভালোবাসার খেলা খেলতে গিয়ে কখন ভালোবেসে ফেলেছি টের পায়নি।’ অদৃশ্য কন্ঠের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ে তিমির।

‘আমি ভালোবাসি তিসুকে। তিসু আমার বউ। ওকে যদি তুমি ভালোবাস তাহলে তা অন্যায়। এই ভালোবাসা ঠিক নয়! ভালোবাসা অন্যায় নয় তবে এতে যদি কোন ক্ষতি হয় তবে তা অন্যায়! এতে সংসার নষ্ট হয়, তুমি আমার সংসার নষ্ট করেছো!  সংসার কেন নষ্ট করলে, কেন?’ 

‘তোর এটাই নিয়তি। তোরা আমাদের সঙ্গে পারবি কেন? পারবি না। আর ঠিক কাজ, ভুল কাজ করার কথা বলছিস, তোরা কি সবসময় ঠিক কাজ করিস? তুই ভেবে দেখ যখন কলেজে ভর্তি হলি, আই.এ পড়তিস তখন কী করেছিলি?’

‘আমি কিছু করিনি।’

‘করেছিস’ ওর চুলে টান পড়ে। মাথা হেলে যায় পেছন দিকে! কপালের ওপর একফোঁটা পানি পড়ে। কান্না আর ক্রোধ মেশানো কন্ঠ শুনতে পায় তিমিরি। ‘আমরা মিথ্যা বলি না। তোরা মাটির মানুষ, তোরা মিথ্যা বলতে পারিস ইচ্ছা করলে, আমরা ইচ্ছা করলেও তা পারি না!’

অদৃশ্য কন্ঠের ভাবান্তর ঘটে। কন্ঠ থেকে ক্রোধ আর কান্না দুটোই চলে গিয়ে সেখানে বিষণ্নতা জায়গা করে নেয়। বিষণ্ন কন্ঠের কথা তখনও শুনতে পাচ্ছে, কন্ঠধারককে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে। আর বুঝতে পারছে কথাগুলো ওকে উদ্দেশ্য করেই বলছে ঐ কন্ঠ।

‘মনে করে দেখ তো আই.এ পড়ার সময় রাজনীতিতে জড়িয়েছিলি। রাজনীতির ক্যাডার! পালিয়েছিলি সোনারগাঁয়ে।’

‘আর বলো না, আর বলো না।’

তিমির মাথা নিচু করে ফেলে। ওর মনে পড়ে যায় তখনকার সব কথা। কলেজে একটা খুন হয়। কারা খুন করে, কেমন করে খুন করা হয় তা ওদের গ্রুপ জানে না। কিন্তু হুলিয়া বের হয় ওদের নামে। ওরা তখন সোনারগাঁয়ে লুকিয়ে ছিল। এক একজন এক এক বাড়িতে। ও যে বাড়িতে লুকিয়ে ছিল সেই বাড়ির মেয়ের বান্ধবী ছিল মিমি। মিমি খুব সুন্দরী ছিল। অদ্ভুত অসম্ভব সুন্দরী যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিমির ওখানে প্রায় আটমাস ছিল। এই সময়ে ওদের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে যায়। ওরা ভালোই ছিল। এই বিয়েতে প্রথমে রাজী হয়নি মিমি। মিমি বলেছিল, ‘আমাদের সঙ্গে তো তোমাদের মিল হবে না তিমির। তাছাড়া আমাদের সমাজ তোমাকে মেনে নিবে না, আর তোমাদের সমাজ আমাকে!’

‘ওসব নিয়ে ভেবো না। কেউ মানুক বা না মানুক, আমরা দুজনে দুজনকে মেনে নিবো। আজীবন দুজন, দুজনকে ভালোবেসে বেঁচে থাকবো।’ মিমির কথা শুনে বলেছিল তিমির। কিন্তু চুপ করে থাকে মিমি। ওর চুপচাপ থাকা দেখে তিমির বলে, ‘কি বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি!’

‘না, না, তা নয়!’

ওদের বিয়ে হয়। ওখানে ভালোই ছিল। ঢাকার পরিস্থিতি শান্ত হলে, ওদের হুলিয়া উঠে গেলে, নির্দোষ প্রমাণ হলে ঢাকায় চলে আসে তিমির। ঢাকায় এসে ভুলে যায় মিমিকে। ব্যস্ত হয়ে যায় লেখাপড়া নিয়ে। লেখাপড়া শেষে চাকরি নেয়, বিয়েও করে ফেলে তিসুকে। সেদিনের সেই আটমাসের সংসার ভুলে গিয়েছিল; আজ আবার মনে পড়ছে। 

‘মিমি কে হয় তোমার?’ অদৃশ্য কন্ঠকে প্রশ্ন করে তিমির।

‘মনে পড়েছে তাহলে। মিমি আমার ছোটো বোন। তোর সন্তান ধারণ করেছিল সে। এক সময় মিমির অসুস্থতার কারণ তুই। ইস্ কী কষ্ট, কী ভোগান্তি, কী অপমান তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অদৃশ্য সেই কন্ঠ। তারপর উদাস কন্ঠে বলে, ‘ও বেঁচে থাকতে আসতে পারিনি। যেদিন মারা যায় সেদিন এসেছিলাম। তোর বউকে দেখলাম। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো বুকের ভেতর! তোর বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে মেরে ফেলবো ওকে স্থির করলাম। কিন্তু তিসু খুব ভালো মেয়ে! জ্ঞানত ওর সঙ্গে কোন সম্পর্ক হয়নি। ওর…’ কথা শেষ করতে দেয় না তিমির। বলে,

‘চুপ-চুপ করো তুমি। আমি শুনতে চাই না এসব। দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে তিমির। তিমিরের অবস্থা দেখে অদৃশ্য কন্ঠ হেসে ওঠে শরীর হিম করা সেই হাসি! ‘হা-হা-হা-!’ হাসি থামার পর আবার শুনতে পেলো, ‘তোর বউ গেল না। সম্পর্কও করলো না। ভালো তো বাসলোই না। সেই রাগে উর্মিকে নিয়ে গেলাম। কিন্তু উর্মি ওখানে থাকতে চায়ছিল না। শুধু দাদু, দাদু! আসলে শরীরে তো মাটির গন্ধ!’  তিমির অদৃশ্য কন্ঠের কথায় কোন কান দেয় না। ওর কন্ঠে আর্তি। ‘তুমি কোথায়? দেখা দাও। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না, দেখা দাও।’ 

‘আমার দেখা তো পাবি না।’

‘দেখা না পাই, তুমি বলো আমার ছেলে না মেয়ে হয়েছিল।’

‘এখন শুনে কি করবি?’

‘তবুও বলো।’

‘ছেলে।’

‘ তোর ছেলে নেই! তাছাড়া যাকে তুই ভুলে গেছিস তার খবর নিয়ে কী করবি?’

‘আমার ছেলে চাই।’

‘চাইলেই কি পাওয়া যায়, যায় না। কোন কিছু পেতে হলে ভালোবাসতে হয়, মনোযোগ দিতে হয় সেই জিনিসের প্রতি।’

‘আমার ছেলে চাই, চাই।’ তিমিরের একরোখা কন্ঠ।

‘চাইলেই কি পাবি? এতোদিন কোন খবর নিস নাই এখন ছেলের দরবার।’ ক্রোধোন্মত্ত কন্ঠ শুনতে পায় তিমির। সেই ক্রোধ, সেই রাগ গায়ে মাখে না তিমির। ‘চাই, চাই, হ্যাঁ চাই, চাই’ বলতে থাকে। আকাশে বাতাশে ছড়িয়ে যায় সেই ধ্বনি। শুধু সেই ধ্বনি ছাড়া আর কোন কথা শুনতে পায় না তিমির। 

 

তিমির ভুলে গেছে উর্মির কথা; ভুলে গেছে কোথায় বসে আছে। সবকিছু ভুলে হাঁটুতে মুখ গুঁজে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দে  চমকে ওঠে উর্মি। এতোক্ষণ কোন কথা শুনতে পায়নি উর্মি।

‘বাপী, ও বাপী, কী হলো তোমার? কাঁদছো কেন?’

তিমির কথা বলে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে উর্মির মুখের দিকে। বাবাকে কথা বলতে না দেখে উর্মি বলে,

‘বাসায় চলো বাবা।’

বাসায় যাবো! কোথায় বাসা, কার বাসা! আর বাসায় কেন যাবো?’

‘হ্যাঁ, বাপী, বাসায় চলো। ঐ তো মগবাজারে আমাদের বাসা। মা ডাকছে বাপী।’

 ‘মা ডাকছে, কার মা, কোথায় মা?’ প্রলাপ বকতে থাকে তিমির। 

‘কি আবোল-তাবোল বকছো বাপী। মা ডাকছে, আমার মা। তোমার কি হলো বাপী? ওঠো ওঠো।’ উর্মি তাড়া দেয় বাবাকে, ওর যেন খুব তাড়া। ছটফট করতে থাকে উর্মি। 

‘উর্মি তুই এতো বেশি মা, মা করবি না। ও আমার কেউ না কেউ না। ও আমাকে ঠকিয়েছে।’ উর্মির হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলে তিমির। 

‘না, মিথ্যে কথা। তোকে ঠকায়নি তিসু। বর  তুই-ই ঠকিয়েছিস ওকে। ওকেও ঠকিয়েছিস্, ঠকিয়েছিস্ মিমিকেও।’ অদৃশ্য কণ্ঠ শুনতে পায় আবার। 

‘আবার এসেছো। যাও, চলে যাও। যাও… যাও।’

‘আমি তো যাবোই। কিন্তু একটা সত্য বলতে এসেছি, আমি তোর বন্ধু।’

‘আমার বন্ধু!’ ফুঃ, অমন বন্ধুত্বে কাজ নেই আমার!’

‘শোন তিমির আবদুল্লাহ।’ আবার অদৃশ্য কন্ঠ শুনতে পায়।

‘আবদুল্লাহ শোন। উর্মির মা, আমার মেয়ের মতো। ওর আজ খুব বিপদ। আমি তো ওকে রক্ষা করতে যেতে পারছি না, বাবা।’

ওর খুব বিপদ। তুমি বাড়ি যাও।’

‘বিপদ কিসের বিপদ? ওর বিপদ নাকি বিপদ আমার। তুমি চলে যাও, এসব কথা আমি শুনতে চাই না। এক একবার তুমি এক এক রকম কথা বলো। একবার বলো উর্মি তোমার মেয়ে, একবার বলো তিসু তোমার মেয়ে! আমি কোন কথাটা বিশ্বাস করবো।’

 

একটানা কথা বলতে বলতে তিমির হাঁফিয়ে ওঠে। উত্তেজিত হয়ে আছে বলে বুঝতে পারছে না, এই কন্ঠ আর আগেকার কন্ঠ এক নয়! অদৃশ্য কন্ঠ রাগ করে না, শান্ত কন্ঠে বলে, ‘আবদুল্লাহ শান্ত হও।’ অদৃশ্য কন্ঠ আরও কাছে সরে আসে। তিমির ওর মাথায় একটা শান্তির স্পর্শ পায়। সেই সঙ্গে পায় চন্দনের গন্ধ। ঐ হাতের স্পর্শে চন্দনের গন্ধ ছড়িয়ে যায় তিমিরের চারপাশে।

‘কথা শোন বাবা।’ অদৃশ্য কন্ঠ কথা বলতে শুরু করে। ‘আমার কথা মন দিয়ে শোন। মন দিয়ে যদি কথগুলো শোন তবে তোমারই মঙ্গল।’

‘আমার মঙ্গল! তোমার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে আমার।’ তিমির পাগলের মতো হেসে ওঠে।

‘হাসিস না। শোন। তুই রাগে অন্ধ হয়ে আছিস না হলে বুঝতে পারতিস আগের সেই কন্ঠধারক আর আমি এক না’

‘এক নও!’

‘না। তিসুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আমার; ওর নয়। ও সম্পর্ক করতে চেয়েছিল পারেনি। পারেনি আমার জন্য। তিসুর সঙ্গে আমার বাবা-মেয়ের সম্পর্ক। ও খুব ভালো মেয়ে। আর উর্মি তোদের সন্তান। আর তোর কোন ছেলেসন্তান নাই।’

‘তুমি জানলে কেমন করে? কীভাবে বুঝবো সত্যি বলছো তুমি!’

‘আমি জানি। কেমন করে জানি তা পরে তোকে বলবো। এখন সময় নাই বেশি। আর একটা  কথা শোন, তুই যে জানিস তিসুর কারও সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে, তা সত্য নয়! আর হতেও পারে না। তাড়াতড়ি কর, আর হাত পাত।’

তিমির মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাত পাতে। হাতের তালুতে শূন্য থেকে একটি শিশি এসে পড়ে। শিশিতে ঈষৎ হলুদ রঙের তরল পদার্থ। তিমির শিশিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। একবার কাত করে, একবার উপুড় করে, একবার ঝাঁকায়। 

‘অমন করিস না, পড়ে যাবে! আর পড়ে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে।’

তিমির শিশিটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, ‘তিসুকে ঠিক করার আগে সব কথা জানতে চাই।’

‘কী জানবি তুই? কী জানার আছে তোর। যতো কম জানবি ততোই জীবন সহজ হবে, ততোই মঙ্গল হবে; যতো বেশি…’ অদৃশ্য কন্ঠকে আর কথায় এগুতে দেয় না। তিমির অবোধ বালকের মতো মাথা ঝাঁকায়। বলে, ‘হোক অমঙ্গল আমি শুনবো। সব শুনবো আমি।’ 

‘আর কোন কথা নেই তিমির। সব মিথ্যে সব সত্য সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছি এতোদিন আমি, সব কিছু করেছি তোদের জন্য কিন্তু এখন বোধহয় আর কিছু করতে পারবো না। তিসুর বড্ড বিপদ।’

‘কি হয়েছে তিসুর?’

অদৃশ্য কন্ঠ কিছু বলার আগেই তিমিরের হাত ধরে টানে উর্মি।

‘বাপী  চলো, চলো যাই। মা ডাকছে তোমাকে।’ তিমির এতক্ষণে উর্মির মুখের দিকে তাকায়। ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। এমনভাবে উর্মির হাত ধরে যেন ঐ একমাত্র অবলম্বন! আর এই অবলম্বন না হলে কিছুতেই চলছে না। উর্মির হাত ধরে উঠে দাঁড়াতেই বুকের ভেতর স্নেহের ফল্গুধারা এমনভাবে ছলকে ওঠে যে ওর বিশ্বাস দৃঢ় হয়, ওরই মেয়ে উর্মি আর কারও নয়। 

‘বাপী তাড়াতাড়ি চলো। বৃষ্টি হবে।’

 

ইতোমধ্যে তিমিরের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। আকাশে তাকিয়ে দেখে পরিষ্কার নীল স্বচ্ছ আকাশ কখন মেঘে ঢেকেছে বুঝতে পারেনি। পার্কও প্রায় জনশূন্য। বেশিরভাগ মানুষই চলে গিয়েছে। যারা আছে তারাও তড়িঘড়ি ছুটছে। চারদিক গুমোট; হাওয়া নেই। 

‘কখন মেঘ করলো?’ তিমির নিজেকেই প্রশ্ন করে। এতোটা আনমনা, এতোটা আপসেট! খেয়ালই করেনি কিছু। 

‘বাপী গো, বাড়ি চলো, তাড়াতড়ি। মা, চলে যাচ্ছে!’ উর্মি কেঁদে ফেলে। 

‘কোথায়, কোথায় যাচ্ছে তোর মা?’ তিমিরের বুকের ভেতর তোলপাড় করে কথাগুলো উঠে আসে।

‘ওরা নিয়ে যাচ্ছে বাপী। মায়ের গায়ে শক্তি নেই বাপী, মা ওদের সঙ্গে পারছে না।’ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল উর্মির কন্ঠ। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। ওরা গেটের দিকে এগুচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকালো, মেঘ ডাকলো। কোথায় যেন বাজ পড়লো। ভয় পেয়ে বাবার হাত চেপে ধরে উর্মি।

 

বৃষ্টির পানি আর চোখের অশ্রুতে মাখামাখি ছোট্ট উর্মির মুখটা দেখতে পেয়ে কোলে তুলে জাপটে ধরে বুকে। তিমিরের বুকের ভেতর দুঃখগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। ওর মন কেমন করছে! তিসুর জন্য হৃদয়ের সবগুলো দরোজা হুটহাট খুলে যাচ্ছে। তিসুর কাছে বড্ড যেতে ইচ্ছা করছে। খুব তাড়াহুড়া করছে তিমির। জোরে পা চালিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়।

 

একটা বেবী ট্যাক্সি (সিএনজি) দাঁড় করিয়ে উর্মিকে বসিয়ে উঠতে যাবে শিশিটা হাত থেকে সিটের ওপর পড়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল।

‘কি হলো বাবা?’

‘সব ওষুধ পড়ে গেল মা।’

‘তোল বাপী, তোল।’ আর্তনাদ করে ওঠে উর্মি।

তিমির যতোটুকু পারে ওষুধ তুলে হাতের তালুতে রাখে। কিন্তু তালুতে করে তো এতোটা পথ যাওয়া যাবে না, যায় না। আঙুলের ফাঁক দিয়ে টপটপ করে ওষুধ পড়ে যাচ্ছে নিচে। তিমির উর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্মি কাঁদছে শব্দহীন। তিমিরের বুকের ভেতর বিষণ্নতা খেলা করে; বিষণ্ন প্রকৃতি যেন ঢুকে গিয়েছে ওর বুকের ভেতরে; বাবা মেয়ে দুজনেই চুপচাপ। তিমির এমনভাবে বেষ্টন করে রাখে উর্মিকে যেন এক হয়ে মিশে যেতে চায় দুজনে; ওরা একে অপরকে অনুভব করতে চায়। বুঝতে চায়। নিবিড়ভাবে পিতা কন্যার, কন্যা পিতার দুঃখ শুষে নিতে চায়। ওদের সামনে অনেকটা পথ। ট্যাক্সি চলছে। 

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি