করপোরেশনের লোক/ মিলা মাহফুজা
ঈদের গল্প
করপোরেশনের লোক/ মিলা মাহফুজা
আসলাতু খাইরুম মিনান নাউ
আসলাতু খাইরুম মিনান নাউ
মুয়াজ্জিনের গলাটা বড়ই সুন্দর। তাঁর আজান শ্রুতিমধুর। কানের ভেতর দিয়ে একেবারে মনের ভেতরে ঢুকে যায়। বড় মিঠা লাগে ডাকটা- ঘুম হইতে নামাজ উত্তম। ঘুম হইতে নামাজ উত্তম।
যেন আজান শোনার জন্যেই মোকারম হোসেন অন্ধকার থাকতেই জেগে ওঠে। ঘুম ভাঙার পর সে উঠে বসে বিছানায়। শান্ত হয়ে অপেক্ষা করে আজান শোনার জন্যে। খুব মন দিয়ে প্রতিটা শব্দ শোনে। সকালের এই আহবান তার ভেতরে অদ্ভুত এক শক্তি হয়ে ওঠে। নিস্পৃহ নির্বিকার থাকার শক্তি। জাগতিক মোহ থেকে দূরে থাকার শক্তি। মানসিক কষ্ট থেকে দূরে থাকার শক্তি।
আজান শেষ হলে সে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর প্রায় নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে বাথরুমে যায়। অজু সেরে বেরিয়ে এসে স্ত্রী হাজেরা বেগমকে ডেকে তোলে। দুজনে একই সাথে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে হাজেরা দ্রুত রুটি আর আলু ভাজি করে খেতে দেয়। নাস্তা খেয়ে সাইকেল নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়ে মোকারম হোসেন।
আজ আজান শেষ হওয়ার বেশ খানিক পরে বিছানা থেকে নামে মোকারম। নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে হাত বাড়িয়ে চেয়ার ধরতে গেলে চেয়ার উল্টে পড়ে যায়। চেয়ার পড়ার শব্দে হাজেরা বেগম ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে ওঠে। ততক্ষণে মোকারম সামলে নিয়েছে। শান্তভাবে বসে থাকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাজেরা বেগম জিজ্ঞেস করে, চ্যার পড়ল ক্যামনে?
মোকারম কোনো উত্তর দেয় না। হাজেরা বেগম চেয়ারটা তুলে রেখে পরনের বিস্রস্ত বসন গুছিয়ে পরে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়েও যায় না। সকালে সবার আগে উনিই বাথরুমে যাবেন এ যেন এক অলিখিত নিয়ম। সে তাই বিছানার কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে। কোনো কথা বলে না। এত সকালে কথা বলাবলি উনার পছন্দ না। একটু টেনশন নিয়েও চুপ করেই থাকে হাজেরা।
দুজনের নামাজ পড়া শেষ হলে হাজেরা নাস্তা বানাতে যায়। মোকারম শার্ট আর প্যান্ট পরে নেয়। ওটুকু করতে গিয়েই টের পায় জোর পাচ্ছে না। হাজেরা চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে, শইল কী খারাপ লাগতাছে?
মোকারম চায়ে লম্বা চুমুক দেয়। কাপে শেষ চুমুক দেয়ার আগে হাজেরা আবার বলে, আপনাগো টিকা দেওনের কী হইল?
-এহন তরি কিছু হয় নাই।
-সিটি করপরশন তো ম্যালা দিন আগে নাম লইয়া গ্যাছে, এহন তরি একবারও তো টিকা পাইলেন না! খবরে দেখলাম বহুত মাইনষের দুইটা টিকাই লওন হইয়া গ্যাছে। এমতে চুপ মাইরা থাকলে হইব না। খোঁজ লন, ক্যান দিতাছে না। হগলতের আগে তো আপনাগোরেই টিকা দেওন দরকার আছিল। পেত্যেক দিন দুইটা তিনটা লাশ ঘাটন লাগে আপনাগো। আপনাগো জানের ডর নাই? হাবিব স্যাররে আইজ কইবেন টিকার ব্যবস্থা করনের লাইগা। আপনেরা নায় লেহাপড়া জানেন না, হেয় তো জানে। কমপিটারে রেজিসটেশন না কি জানি করন লাগে, হেই কইরা দিক। করতে তো ট্যাহা লাগে না। সরকার ফ্রি কইরা দিছে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাজেরা খানিক হাঁপায়। মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার।
মোকারম তাকে শান্ত করতে বলে, আইজ হাবিব স্যাররে জিগামুনে। অতো চিন্তা করনের কাম নাই। এক বছর হইল, করোনা রুগি তো কম দাফনাইলাম না। আল্লাহর রহমতে কোন অসুবিদা তো হয় নাই। আল্লা রাখলে কিছু হইব না আমাগো। আমরা নেক কাম করতাছি। আল্লাহই আমাগো দেখবো।
হাজেরা এই আপ্ত্যবাক্যে শান্ত হয় না। সে বিরক্তভাবে বলে, আল্লাহ কপালে যা লিখছে সেই কাম করতাছেন সেইডা ঠিক আছে। কিন্তু আল্লাহ তো নিজের খেয়াল না রাখতে কয় নাই। এই রোগে মরলে পোলা-মাইয়াও বাপ-মায়ের লাশ ছুইতাছে না। আর আপনারা সেই লাশ দুইহাতে তুইলা কব্বরে নামাইতাছন। হয় নাই বইলা কুনোদিন হইব না- এমুন তো না। আপনি আমার লগে তক্কো না কইরা টিকা লওনের ব্যবস্থা করন। সিটি করপরশন না দিলে অন্য কোনহানে দেওন যায় তার খোঁজ লন। আপনারে আমার আল্লার কসম, পোলার বাপ।
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হাজেরা।
স্ত্রীকে কোনমতে শান্ত করে মোকারম সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গোরস্থানের দিকে। সাইকেল চালাতে আজ একটু কষ্টই লাগে। বুকে যেন হাফ ধরে যাচ্ছে। হাজেরা তাকে বারণ করেছিল । কিন্তু গোরস্থানে না গেলে তার খাওয়া হজম হবে না। মাত্র একুশ বছর বয়সে ঢাকা শহরে বেড়াতে এসে কিভাবে যেন নতুন গোরস্থানের গোরখোদক হয়ে যায় সে, তারপর গত একত্রিশ বছর সে একই কাজ করে যাচ্ছে। অন্য কোনো কাজ করার কথা ভাবেনি। করতে ভালও লাগবে না। সারাদিন গোরস্থানেই কাটে তার। অন্য কোথাও তার ভাল লাগে না। কাজ না থাকলেও সে গোরস্থানেই ঘোরাঘুরি করে রাত হলে বাড়ি যায়। দাফনের কাজ করতে তার ভাল লাগে।
একটা মানুষ কিছুক্ষণ আগেও যে জীবিত ছিল শুধু দমটুকু ফুরিয়ে গেছে বলে সে তখন লাশ। তাকে বেশিক্ষণ মাটির উপরে রাখা যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবরে নামিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দাও। আর কোনদিন সে ফিরে আসবে না। সেই মৃত মানুষটাকে পরম যত্নে শেষ বিছানায় শুইয়ে দেয়ার কাজ করে মোকারম অদ্ভুত এক ধরনের আরাম পায়। মায়ের সন্তানকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবার স্বস্তি তাকে ঘিরে রাখে।
গোরস্থানে পৌঁছে দেখে তার সাগরেদ কাসেম আর জসিম আগেই এসে কাজ শুরু করেছে। কবর ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করছে ওরা। এরশাদের আমলে কবর টাইলস দিয়ে বাধানো শুরু হওয়ার পর তা পরিষ্কার রাখার ব্যাপারটা আসে। মৃতের স্বজনদের সাহায্য করতে মোকারমরা সে দায়িত্ব নেয়। যার যেমন অভিপ্রায় সেইমতো কবরের উপরে গাছ, ঘাস লাগায়, নিয়মিত পানি দিয়ে সেগুলো বাঁচিয়ে রাখে। আগাছা তুলে ফেলে। টাইলস ঘষে ধুয়ে ঝকঝকে করে রাখে। প্রায় প্রত্যেকটা কবরের গায়ে ফলকে নাম পরিচয় জন্ম ও মৃত্যুর দিন লেখা আছে। জন্ম ও মৃত্যুদিনে মৃতের স্বজনরা কবর জিয়ারত করতে আসে। তাই বিশেষ করে এই দুদিন কবরগুলো সকালেই ভালভাবে পরিষ্কার করে তারা। টাকার বিনিময়ে কবরের যত্নের ব্যবস্থা করে মৃতের স্বজনরা আত্মতৃপ্তি পায়। মোকারমরা পায় মাস বা বছরওয়ারি পারিশ্রমিক। লাশ দাফনের পাশাপাশি এটাও তাদের আয়ের এক উৎস। গোরস্থানে লাশ আসা মানে মোকারমদের গোপন খুশি। আরও কয়েকজন গোরখোদক আছে। তাই লাশ আসার পর তা দখলে পাওয়ার একটা প্রতিযোগিতা চলে প্রকাশ্যেই। অবশ্য মৃতের স্বজনরা কাউকে দায়িত্ব দেয়ার পর আর কোনো বিবাদ হয় না। পরে ওই কবর দেখাশোনার দায়িত্বও আপনাআপনি তারই হয়ে যায়। আড়াই একর জমি নিয়ে তৈরি গোরস্থানটা তিরিশ বছরে প্রায় ভরে উঠেছে। নতুন কবর খোঁড়ার আর জায়গা নেই। এখন এক কবরে এক জনের পরে আরেক জনকে দাফন করা হয়। কোনো কোনো সময় লাশ ভালভাবে মাটিতে মিশে যাওয়ার আগেই অন্য লাশ চলে আসে। মোকারমরা মৃতের স্বজনদের তা বুঝতে না দিয়ে সংগোপনে মৃতের দেহাংশ তুলে ফেলে দিয়ে নতুন লাশের জায়গা করে দেয়। কোনো লাশ দাফনের পরে স্বজনরা নিয়মিত জিয়ারতে আসে। কোনো কবর বছরে একবারও দেখতে আসে না কেউ। কেউ কেউ মোকারমদের হাতে দায়িত্ব দিয়েই খালাশ।
ইদানিং ঢাকায় সরকার আর কবর বিক্রি করছে না। তাই কবর নিয়েও চলছে বাণিজ্য। কাগজ জালিয়াতি করে কোনো কোনো কবর অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে যে সব কবরের খোঁজ দীর্ঘদিন কেউ নেয় না। অফিস সুপার হাবিব স্যাররা গোপনে এসব করলেও মোকারমদের জানতে বাকি থাকে না। তবে তারা এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। হাবিব স্যার সিটি করপরশনের লোক। গোরস্থানের দেখভালের দায়িত্ব তার। সরকারের খাতায় তার নাম আছে। সরকারের লোককে ঘাটানোর ফল ভাল না তা তারা জানে।
কয়েকটা কবর দেখতেই ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসায় মোকারম একটা কবরে হেলান দিয়ে বসল। কপালে হাতের পিঠ ঠেকিয়ে তাপ পরীক্ষা করল। না জ্বর নেই। গলা ব্যথা কাশি কিছুই নেই। বসে না থেকে টিকার খোঁজ নেয়ার জন্যে সে উঠে অফিস ঘরের দিকে গেল। অফিস সুপার হাবিবুল্লাহ রুমেই আছে। লোকটাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে। মোকারমের মনে হলো আজ নিশ্চয় বড় পার্টি পেয়েছে কোনো। মোকারমকে দেখে হাসতে হাসতে হাবিবুল্লাহ বলল, বুঝলি টিকা দিয়া আইলাম। দুইডাই হইয়া গেল। আর চিন্তা নাই। শালা এতদিন কইলজাডা হাতে লইয়া কাম করলাম। এহন শান্তি। করোনার বাপ আর আমার ধারে ভিড়বার পারব না।
মোকারম হতভম্ব হয়ে বলল, আপনে টিকা লইছেন?
-হ, লইছি। আইজ দুই নাম্বারটা লইলাম।
কি জানি কি যেন হয়ে গেল মোকারমের মাথার ভেতরে। সে চিৎকার দিয়ে বলল, আপনে টিকা লইলেন, আমাগো কই। আপনে মুখে মাস্কের উপর শিল পইরা অফিস রুমে বইসা থাহেন আপনে টিকা লইলেন আর আমরা রোজ লাশ হাতে তুইলা কব্বরে নামাই আমাগো টিকা নাই? এইটা ক্যামনে হইল?
হাবিব আলী কিছুক্ষণ মোকারমের রুদ্র মূর্তির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর চেয়ারে গা ছেড়ে বসতে বসতে বলল, আমি সিটি করপোরেশনের চাকরি করি আমি টিকা পামু না তো কে পাইব? তুই? আগে সিটি করপোরেশনের একটা চাকরি জোগাড় কর তারপর টিকা লইস। যা ভাগ। বড় আমার টিকা আলা আইছে রে।
মোকারম হা করে হাবিব স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাজা কবর খুঁড়ে লাশ খাওয়ার আশায় ঘোরাঘুরি করা শেয়ালের মতো লাগে লোকটাকে।
তার মুখের ভেতরটা থুতুতে ভরে ওঠে। থুতুটুকু ওই লোকটার মুখের উপর ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করে।
পারে না। লোকটা করপরেশনের।
Facebook Comments Sync