নির্ঘুম চক্র / ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়

নির্ঘুম চক্র

নির্ঘুম চক্র

নির্ঘুম চক্র / ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়

 

ইনসোমনিয়ার এক’শতম রাত পার হলো গতকাল।বিগত এক’শটি রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি—-ভেবেছি অনেক কিছু, ঘুরে ফিরে মাথার ভেতরে খেলা করেছে কতশত চিন্তা, কত মানুষের সুখ দুঃখের কাহিনি আমি এঁকেছি নিজের ভেতরে এসব রাতে। প্রথম দশটি পূর্ণ রাতে আমি শুধু একটি গল্পের প্লট নিয়েই ভেবেছি, নিজের ভেতরে সাজিয়েছি লাইনের পর লাইন। কিন্তু এগারোতম রাতে যখন আমি লিখতে বসতাম তখন সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। কী দিয়ে শুরু করব এটা ভাবতে ভাবতে সেই রাতটিও কেটে গেল। আজ একশতম দিন পর যখন আমার লেখার খাতাটি খুলে বসেছি তখন সেখানে শুধু লেখা,

 

 ‘বোয়ামভর্তি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলা একটি চিঠির    অবিন্যস্ত বর্ণগুলোকে কয়েকরাত ধরে সাজানোর চেষ্টা করছে সে—তার প্রেমিকার শেষ চিঠি এটি আর সম্ভবত সুইসাইড নোটও।’

 

এরপর আর এক লাইনও লিখতে পারিনি আমি। চোখ বন্ধ করলেই গল্পের নায়ক নায়িকারা এসে হাজির হয়, চিৎকার করে বলে,’আমাদের পূর্ণতা দাও, লিখে ফেলো’ কিন্তু আমার লেখা আর হয়ে ওঠে না।না লিখতে পারার যন্ত্রণায় আমি আরো কয়েকটি রাত নির্ঘুম কাটাই, সিগারেট খাই এবং একদিন দেখি আমার সিগারেট খাওয়ার টাকাও ফুরিয়ে গেছে।

 

যে রাতে যুদ্ধবাজ রাশিয়া ইউক্রেন হামলা করে বসল সে রাতে আমি ছাদে বসে আকাশ দেখছিলাম; ঝলমলে কয়েক কোটি তারকার ভেতর থেকে একটি তারকাকে টার্গেট করে তাকিয়ে ছিলাম বহুক্ষণ ধরে। হঠাৎ মনে হলো তারকাটি মিলিয়ে গেলো এবং তার দেখাদেখি আশেপাশের তারকাগুলোও হারিয়ে যেতে লাগল। ভেতরে ভেতরে  ভয়ানক অশুভ কিছুর আশংকা নিয়ে আমি ঘরে ফিরে মোবাইল ডাটা অন করতেই নোটিফিকেশন আসল, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা।’এরপরের কয়েক রাতে আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম বিশাল সব অট্টালিকা বোমার আঘাতে ভেঙে পড়ছে,কয়েক’শ মানুষের মর্মভেদী চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, ভাঙা দালানের ভেতরে চাপা পড়ে আছে দুজন মা আর তাদের শিশু সন্তানের নিথর দেহ।

 

আমি রাজনীতিবিদ নই,রাজনীতির প্রতি তেমন আগ্রহও আমার নেই।তবে ‘মানুষ স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণি’ আরিস্টেটলের এই উক্তিটি মাঝেমাঝে আমার ভেতরেও ভর করে।বিগত এক’শটি রাতের মধ্যে এমন অনেক রাত গিয়েছে যেসব রাতে আমি শুধু দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েই ভেবেছি।ইউটিউব ঘেটে টকশোর পর টকশো শুনে অবশেষে তিন রাত পরে যখন ভালো মন্দের হিসাব মিলাতে বসলাম তখন টিসিবির ট্রাকের পেছনে শতশত মানুষের ছুটে যাওয়ার দৃশ্যটাই কেবলই বারে বারে ঘুরে ফিরে মাথায় এলো।পরে আর কিছু ভাবতে পারিনি আমি, কোন হিসাবও মিলাতে পারিনি,মাঝখান থেকে আরো একটি রাত আমার হারিয়ে গেছে। 

 

সমস্ত রাত শেষে উঠবে উঠবে করা সূর্যের অদৃশ্য চাহনি দেখে আমি যখন ঘুমানোর জন্য বালিশে মাথা দেই তখন  দূর থেকে ফযরের আজান ভেসে আসে। তার কিছুক্ষণ পরেই পাশের বাসা থেকে ভেসে আসে শঙ্খের ধ্বনি।দুটোই প্রার্থনার ডাক—ভিন্ন ভিন্ন দুটো সম্প্রদায়ের কাছে তা পবিত্র সুর।এই সুর আমার ভেতরে গভীরভাবে বেজে ওঠে আর বারবার মনে হয়, আমরা বোধহয় ধর্ম নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করছি। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে পছন্দ করে না। যেখানে যে ধর্মের মানুষ বেশি সেখানে অন্য ধর্মের মানুষ তার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারছে না। বর্তমানে কতশত ঘটনাই না ঘটছে আমাদের এই উপমহাদেশে। এর সমাধান কী হতে পারে,কীভাবে ধর্মের সৌন্দর্যকে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করানো যায় এসব ভাবতে ভাবতে আমার কেটে যায় আরো কয়েকটি নির্ঘুম রাত। 

 

টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দস্তয়ভস্কি, বোলানিও, নেরুদা,দেয়ালে ঘুরে বেড়ানো টিকটিকি,তেলাপোকা আর মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকা বিক্ষিপ্ত চিন্তা নিয়ে বিগত একশটা রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছি।এখন মনে হচ্ছে সেসব রাতগুলো বোধহয় আলাদা আলাদা নয় বরং প্রতিটি রাত যেন তার পূর্বের রাতটি গিলে ফেলেছিল এবং সমান্তর ধারায় একটি বৃহৎ রাতে পরিণত হয়ে গতকালই তার জীবনচক্র সম্পন্ন করেছে। এটা বলছি কেননা এখন সবে রাত দশটা আর আমার ঘুম ঘুম পাচ্ছে।

 

তাহলে কি ইনসোমনিয়া খতম হলো!

আজ কি তবে শান্তির ঘুম হবে!

আগামী সকাল থেকে কি শুরু হবে আমার সুন্দর জীবন!

 

এইসব ভাবতে ভাবতে যখন ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন প্রেমিকার ফোন এলো। রিসিভ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে কান্নামেশানো কন্ঠে শুনতে পেলাম প্রেমিকা বলে উঠল “নিলয়,কাল আমার বিয়ে।” 

 

আমার ঘুম উবে গেল।মনে হচ্ছে আজ থেকে আবার শুরু হবে ইনসোমনিয়ার আরেকটি নতুন সার্কেল,

                ‘একশটি অথবা তার বেশি নির্ঘুম রাত।’

ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়
ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়