আমার  সাতকাহন -৫ / ছন্দা দাশ

আমার  সাতকাহন -৫ / ছন্দা দাশ

 

এক একটি দিন আসে এক এক রূপে, এক এক অনুভূতি নিয়ে। একটি দিন কিছুতেই অন্যদিনের মত নয়। কাল যে ভালো লাগা ছিল আজ আর তা নেই। আজ ছিল আমাদের ভোঁ কাট্টার দিন।মাঠে জড়ো হই সবাই নাটাই হাতে। তার আগে থেকে সুতোয় মাঞ্জা দেয়া চলছিল। দাদা আমাকে আর বাবুকে নিয়ে মহাব্যস্ত। কোত্থেকে মুঠো ভর্তি  কাঁচের মিহি গুঁড়ো আর আঠা নিয়ে এসেছে। আমাদের লাগোয়া গ্রামবাসী লক্ষণ তো আছেই আমাদের সাথে সাথে। সেই কিভাবে যেন সেই গুঁড়ো সুতোয় লাগিয়ে দেয়।

আর ভোঁ কাট্টায় দূর থেকে আসা লাল,নীল,সবুজ ঘুড়ি সব আমাদের সুতোয় লেগে কেটে যায়। আমরা সাথে সাথে চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিই। আমাদের দলে নেহায়েৎ কম ছিলাম না। আমি আর ছোটভাই বাবু সবসময় দাদার অনুগত। দাদা যা বলে আমরা তাই মেনে চলি। আমার দাদা অরুনাংশু হোর (কাজল) বর্তমানে কানাডাবাসী। ওখানে ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেরঅধ্যাপক। Centennial college,Toronto.এখানে পি,ডি,পি তে পরে ড্যাশার একজন

জনপ্রিয় এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র ছিল। ঈশ্বর ওকে রূপ,গুণ দুইই ঢেলে দিয়েছেন। এখানে সে  বেতারে গান গাইত। ওখানেও সে গানের জন্য জনপ্রিয়। ভদ্রতা,সদ্গুণ, বিনয়ে সবাইকে সে কাছে টানবেই। আমরা  তিনজন সব সময় একসাথে থাকতাম। মা বলে দিয়েছেন যখনই কিছু খাবে কেউ কাউকে না দিয়ে খাবে না। আমরাও তাই করি। একবার সাগর আমাকে তার থেকে দুটো লালবুট দেয়।

আমি কি করি? একছুটে বাসায় এসে মাকে বললাম, মা সাগর বুট দিয়েছে খাব?  মা না দেখেই বলেন,

 তিনজন ভাগ করে খাও। আমি কি করি? উপায় না দেখে বুট দুটো ফেলে দিয়ে আবার মাঠে দৌঁড়।  এখন মনে পড়লে মহাভারতের পান্ডবদের বলা কুন্তীর ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের তিনজনের নিজেস্ব একটা ভাষা ছিল, সে দাদাই আমাদের শিখিয়েছে। ইংরেজি শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে বলতাম। দাদা ছোটবেলায় একা পুকুরে, বাথরুমে যেতে ভয় পেত। তাই আমরা দুজন দাদার সাথে পাহারাদারের মত সংগী হতাম। কখনো যেতে না চাইলে সবার সামনে তো বলতে পারত না। বলতো B,K.N.N। অর্থাৎ বিকেলে খেলায় নেব না। সে আমরা তিন ভাইবোন ছাড়া আর কেউ বুঝত না। আমরা দুজন তখন সুড় সুড় করে পিছু নিতাম। আমার মায়ের আর একটি মহৎ গুণ এখনো মনে দাগ কেটে আছে যা আমি এ যাবৎ আর কারো মধ্যে দেখিনি। যখন আমরা বন্ধুরা একসাথে কখনো আমাদের বাসায় খেতে বসতাম, মা আগে সবসময় বন্ধুদের পাতে খাবার দিতেন।  এমনকি আমাদের চারবোনের পর মায়ের বুকের ধন দাদাকেও না। কখনো মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে মা বলতেন, ওদের আগে না দিলে মনে কষ্ট নিয়ে ভাববে আমার মা দিলে আগে আমাকে দিত। আর সে কষ্ট তখন ঠাকুর তোমাকে দিয়ে দেবে। আমরা আর তখন কষ্ট  পেতাম না।

এক একদিন আমি একাই ঘুরি বাসার আশেপাশে। যেখানে খেজুর গাছে গোড়ায় যেসব পাতা থাকে

সব পাতা নিয়ে সুতো বেঁধে বাতাসে ছাড়লে বেশ ঘুড়ির মত উড়তে থাকে আমার মনের ভাবনাগুলো নিয়ে। যেখানে চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে দিনরাত। সিন্দুকে সে ভরে রেখেছে কত গয়নাগাটি।  সুখুর মত মেয়ে পেলে তাকে দিয়ে দেবে একটা সিন্দুক।

তখন আমার পথের পাঁচালীর সাথে পরিচয় হয়নি। আম আঁটির ভেঁপুও না। তবে সবার জীবনেই বোধহয় একবার অপুর জীবন আসে। একা একাই হাঁটতাম পুকুর ধারে যেখানে বেতফল থোকায় থোকায় লুকিয়ে আছে বেতের ঝোপে, ডুমুরের ডালে দোয়েল পাখী, সুপারী গাছ বেয়ে কাঠবেড়ালির লাফালাফি। হাতে কঞ্চি নিয়ে আসাম গাছের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছি। কারণ ঐ গাছ সমস্ত চলার পথ ঢেকে আছে। মনের ভাবনায় ওদের বানাই দৈত্য, রাক্ষস,দুষ্টু লোক। সেই কঞ্চি দিয়ে আঘাত করতে করতে তাই পথচলা। পরে যখন পথের পাঁচালী পড়ি তখন মনে হয়েছে অপু তো আমিই।

আমগাছে সবে গুটি এসেছে। ওই বয়সে গুটির স্বাদ অমৃত সমান। পুকুর ধারে জোড়া আম গাছ। দুটোগাছের আমের স্বাদ আলাদা। একটির রঙ হলুদ, অন্যটির লাল। গাছের নীচে রাজ্যের জংগলে ভরা।  জঙলে সাপ খোপের আড্ডাও আছে। বুকে ভয় নিয়ে গাছ বেয়ে সবে ডালে বসেছি, হঠাৎ অন্যডালের পাখী দেখতে গিয়ে পড়ে গেলাম একেবারে পুকুরের জলে। সাঁতার শিখিনি তখনো। আশে পাশে কেউ নেই। জল খেতে খেতে কোন রকমে পাড়ে আসতে পেরেছি। জলে আমার খুব ভয়। খুব ছোট বেলায় আমাকে মেজদি আর বাবুকে বড়দি স্নান করিয়ে দিত।মেজদি মগটা জলে ছেড়ে দিলে আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম। আমি ছাড়া সবাই তখন সাঁতার জানে। সবাই যখন পুকুরের এপার ওপার করে আমি ঘাটে বসে দেখি। তাই দাদা আমায় একদিন সাঁতার শেখাবে বলে পুকুরের অনেকখানি নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসে। দাদা আমার চেয়ে মাত্র এক কি দুই বছরের বড়। আমি মৃত্যুভয় নিয়ে প্রাণপনে ঘাটে আসতে আসতেই সাঁতার শিখে ফেলি। সাঁতার না জানলে আমার আর সামুদ্রিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়া হতো না। কারণ এ বিভাগে পড়বার প্রথম শর্ত, সাঁতার জানতে হবে। জীবন চলার পথে এত মানু্ষের মুঠোভর্তি ভালোবাসা কুড়িয়েছি, আজকের ভালোবাসাহীন পৃথিবী আমাকে খুব বেশি বিষণ্ন করে না। সকাল বা বিকেলে কিংবা স্কুলে যাওয়ার পথে রিক্সাওয়ালা সোনা দেখলেই রিক্সায় উঠিয়ে অনেকখানি বেড়িয়ে আনবে। টুনু মিঞা তার গরুর গাড়িতে তুলে নেবে। গ্রামের পথে গরুর গাড়ি চড়ার আনন্দই আলাদা। সব সময় তো আর এমন হয় না। ছোটকার সামনে যেদিন পড়ি রক্ষা নেই। তবে আমি আর বাবু ছোট বলে এতবেশি শাসন করতেন না। ছোটকার একটা শাসন ছিল ছোটদের দিয়ে বড়দের কান টানানো।

 (চলবে)

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ