ঈদল আযহা: মানব মনের মনুষত্বের বিকাশ ও পশুত্বের বিনাশ / সুলতানা রিজিয়া

ঈদল আযহা: মানব মনের মনুষত্বের বিকাশ ও পশুত্বের বিনাশ

ঈদল আযহা: মানব মনের মনুষত্বের বিকাশ ও পশুত্বের বিনাশ

ঈদল আযহা: মানব মনের মনুষত্বের বিকাশ ও পশুত্বের বিনাশ / সুলতানা রিজিয়া

 

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ উৎসব। বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় বছরে দুইটি প্রধান আনন্দ উৎসব বা ঈদের আচার অনুষ্ঠান পালন করেন। একটি ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ, দ্বিতীয়টি পবিত্র হজব্রত পালন উপলক্ষে পশু কুরবানীর মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ।

 

ঈদুল ফিতরের উৎসব আনন্দ দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল আমিনের পক্ষ থেকে উপহার হিসাবে আসে। রোজাদারগণসহ বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় ঈদের আনন্দ উৎসবে খানা খাদ্য, নতুন পোষাকে আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে দীলখুশ আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। একই সাথে এই ঈদে মুসলিম জাহানে যারা সম্পদশালী, যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে তারা তাদের সঞ্চিত ধন সম্পদের জাকাত (আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দিষ্ট দান ) প্রদান করেন। এই জাকাত প্রদান আবশ্যিক বিধায় তারা জাকাতের মাধ্যমে নিজের ধন সম্পদের স্বচ্ছতা ( হালান / বৈধতা ) অর্জন  করার সুযোগ পান। একই সাথে  মহামহিমান্বিত আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম পালনার্থে জাকাত পেয়ে দুঃস্থ এবং  হতদরিদ্র আত্মীয়- স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশি ও অন্যান্য পরিবার উপকৃত হন। তারা এই জাকাতের অর্থে নিজেদের ঋণ পরিশোধসহ পরিবারের জরুরী প্রয়োজনও মিটাতে পারেন। ঈদুল ফিরত এই নামকরণে যুক্ত আছে প্রত্যেকে মাথাপিছু ফিতরা প্রদান। ঈদের আগেই সকলে ফিতরা পরিশোধ করে থাকেন। তবে ২৭ শে রমজানের মধ্যে পরিশোধ করা সুন্নত। তাতে হতদরিদ্র পাড়া প্রতিবেশিদের ঘরে ঈদের দিন ভালো কিছু রান্নার আয়োজন এবং নতুন পোষাকের ব্যবস্থা হয়। এমন জনকল্যাণমুখী নিয়মে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে ভ্রাতৃত্বের নজির সৃষ্টির পাশাপাশি পারস্পরিক সৌহার্দ, সম্প্রীতির মেলবন্ধন দৃঢ় হয়।

 

তদ্রুপ ইসালামের দ্বিতীয় আনন্দ উৎসব ঈদুল আযহা পালিত হয়ে আসছে জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ই জিলহজ্ব দুপুর পর্যন্ত। এই ঈদে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিরা তাদের সামর্থ অনুযায়ী পশু কুরবানী করে থাকেন। কুরবানীকৃত পশুর গোস্ত কিম্বা রক্ত কোনটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে কেবল মহামান্বিত আল্লাহর অনুশাসনের প্রতি কুরবানীদাতার আন্তরিক আনুগত্য ও অন্তর্নিহিত ত্বাকওয়া বা বিশ্বাস।

বিধি মোতাবেক কুরবানীর পশুর গোস্ত তিনভাগে বন্টন করা উত্তম। একভাগ দরিদ্র মিসকিনদের, দ্বিতীয় ভাগ পাড়া- প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনদের এবং তৃতীয় ভাগ কুরবানীদাতার পরিবারের জন্য। এমন বিধিমতে ভাগ বন্টনে ঈদুল আযহার উৎসব আয়োজনে প্রত্যেকের বাড়িতে বিশেষ খানা খাদ্যের আয়োজনের সুযোগ ঘটে।

 

ইসালাম শান্তির ধর্ম, সৌম্য বিশ্বভ্রাতৃত্বের সুমহান মানবতার ধর্ম। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলআমিন তাঁর সৃষ্টি আশরাফুল মাকলুকাতের সার্বিক শুভাশুভের কারণে যুগে যুগে প্রেরণ করেছিলেন তাঁরই মনোনীত নবী, রসুল,পয়গম্বর তথা তাঁর বার্তাপ্রচারক। আল্লাহর প্রেরিত রসুলগণ তাঁরই নির্দেশে, আদেশে নিজ নিজ মানবগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দিতেন মহান আল্লাহর বার্তা বা বাণী। সমাজিক, পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক ও জাগতিক জীবন যখনই ঘোর অজ্ঞানতার অন্ধকারে  নিপতিত হয়ে যাবতীয় শুভাশুভের চরম পরিপন্থী কর্মে লিপ্ত হয়েছে, তখনই আল্লাহ্ তায়ালা নিজ বান্দাদের ইহকালীন এবং পরকালীন জীবনকে শান্তির পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে বার্তাবাহকদের মনোনীত করে পাঠিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে ক্রমানুসার প্রেরিত হয়েছেন অগণন নবী ও রসুলগণ। তাঁদের দেখানো পথের অনুসারী হয়ে অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্’তায়ালার আনুগত্য প্রকাশে সরল সঠিক পথে অবিচল থেকেছেন এবং তাঁরই নির্দশিত সত্য সৎ আলোকিত পথের অন্বেষণ করে আসছেন।

 

হযরত আদম ( আঃ) এর সৃষ্টির মধ্য দিয়েই আল্লাহ্ সুবহানুতায়ালা মনুষ্যসমাজের গোড়পত্তন ( শুরু ) করেছিলেন। তাই  হজরত আদম ( আঃ ) ই এই বিশ্বসংসারে প্রথম মানুষ এবং আদিপিতা। তিনিই আল্লাহ্ রাব্বুল আলাআমিনের মনোনীত প্রথম নবী বা বার্তাবাহক। আল্লাহ্ তাঁর শেষ নবী হিসাবে মনোনীত করেন তাঁর প্রিয় হাবিব, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রিয় নবী রসুলে পাক হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) কে। শেষ নবীর অনুসারীরাই আল্লাহ্ সুবহানুতায়ালার মনোনীত দীন  ইসলামপন্থী তথা ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

 

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে অন্যতম করণীয় আবশ্যিক কর্তব্য নামায, রোজা, হজ এবং জাকাতের প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাসের ( ঈমান ) সাথে  অনুশীলন করা। ইসলামে হজব্রত পালন এবং পশু কুরবানী দেওয়া আর্থিক সামর্থবানদের জন্য আবশ্যিক, দরিদ্র বা অসামর্থ্যদের জন্য নয়।

 

পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিসের তথ্য অনুসারে পবিত্র ঈদুল আযহার সাথে জড়িয়ে রয়েছে নিগূঢ় ইতিহাস যার সূচনা হয়েছিল হযরত আদম ( আঃ ) এর পুত্র হাবিল ও ক্বাবিলের প্রতিযোগিতামূলক কুরবানী করার মাধ্যমে। একজন সফল হলেন আত্মিক পবিত্রতায় ও ঈমানের উপর দৃঢ় থেকে আর অন্যজন পথহারা হলেন লোভ ও প্রতিহিংসার ফলে। তখন থেকেই কুরবানীর নিয়ম শুরু হয়েছিল।

এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আছে –

‘ওদেরকে আদমের দুই পুত্রের (হাবীল ও ক্বাবীল) ঘটনা সঠিকভাবে শোনাও; যখন তারা (আল্লাহর উদ্দেশ্যে) একটি করে কুরবানী করেছিল। তাদের একজনের কুরবানী কবুল হল, অন্যজনের হল না। তখন দ্বিতীয়জন (প্রথমজনকে) বলল, ‘আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।’ প্রথমজন বলল, ‘আল্লাহ্ তো কেবল মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন।’

( আল মায়িদাহ-২৭)

 

এরই ধারাবাহিকতা পর্যায়ক্রমে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)  পর্যন্ত পৌঁছে। জীবদ্দশায় তিনি আল্লাহ্ কর্তৃক অনেক পরীক্ষার সন্মুখীন হয়েছিলেন। কুরবানীর পরীক্ষা ছিলো সুকঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় স্বীয় পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে আল্লাহর ইচ্ছাতে উৎসর্গ করার দৃঢ় মনোবল ও মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার অতুলনীয় ঈমানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তাঁর এমন দৃঢ়মনোবল ও আত্মত্যাগে মহান আল্লাহ্ সুবহানুতায়ালা এতোটাই সন্তুষ্ট হয়ে পড়েন যে, পরবর্তী মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর এই কুরবানীর বিধান আবশ্যক করে দেন।

 

ইব্রাহীম ( আঃ ) ও ইসমাঈল ( আঃ ) এর মাঝে ঘটে যাওয়া চমৎকার বর্ণনা পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছ-

” অতঃপর যখন সে বাবার সাথে ছুটোছুটি করার বয়সে উপনীত হল তখন (একদিন) ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবাই (আল্লাহর নামে কুরবানী) করছি। অতএব ভেবে বল, তোমার মত কি?’ তিনি (ইসমাইল) বললেন, ‘বাবা! আপনাকে যা করতে বলা হচ্ছে তাই করুন। আমাকে আপনি  ইনশাআল্লাহ  ধৈর্যশীল পাবেন”।

(আস সফ্ফাত : ১০২)

 

বিবি হাজেরাকে মক্কায় নির্বাসন:

ইব্রাহীম (আঃ)  মিসর থেকে ফিরে কেন‘আনে আসার বছরাধিককাল পরে তাঁর প্রথম সন্তান ইসমাঈল ( আঃ) জন্মগ্রহণ করেন।  এর কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে আল্লাহ্ কর্তৃক মক্কার বিজন পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার নির্দেশ পান। বস্তুত এটাও ছিলো এক মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে বর্ণনা নিম্নরূপ: 

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পান, তখনই তার অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এ নির্দেশের মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালার কোন মহতী পরিকল্পনা নিহিত আছে এবং নিশ্চয়ই তিনি ইসমাঈল ও তার মাকে ধ্বংস করবেন না। 

অতঃপর এক থলে খেজুর ও এক মশক পানিসহ তাদের বিজনভূমিতে রেখে যখন ইব্রাহীম (আঃ) একাকী ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন বেদনায় এবং বিস্ময়ে স্ত্রী হাজেরা ব্যাকুলভাবে তার পিছু নিয়ে স্বামীকে বার বার এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কিন্তু বুকে বিয়োগ বেদনায়  ইব্রাহীম ( আঃ ) এর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। তখন বিবি হাজেরা বললেন-,

আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদেরকে এভাবে ফেলে যাচ্ছেন?

ইব্রাহীম (আঃ) ইশারায় বললেন, হ্যাঁ।

তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে হাজেরা বলে উঠলেন ” তা হলে আল্লাহ্ আমাদের ধ্বংস করবেন না”’।

ফিরে এলেন তিনি শিশু সন্তানের কাছে। একান্ত মনে ভাবলেন দু’একদিনের মধ্যেই তো ফুরিয়ে যাবে পানি ও খেজুর। কি হবে উপায়? খাদ্য ও পানি ছাড়া বাচ্চাকে তিনি কিভাবে বাঁচবেন! দিশাহারা হয়ে মা হাজেরা মানুষের সন্ধানে দৌঁড়াতে থাকেন ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এ মাথা থেকে ও মাথায়। এভাবে সপ্তমবারে তিনি দূর থেকে দেখলেন যে, বাচ্চার পায়ের কাছে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ঝর্ণাধারা! হযরত জিব্রাঈল ( আঃ ) এর পায়ের গোড়ালি বা তার পাখার আঘাতে যা সৃষ্ট এই পানির নহরের কাছে ছুটে এসে তিনি বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলেন পরম মমতায়। অতঃপর শীতল স্নিগ্ধ পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ অদূরে একটি আওয়াজ শুনে তিনি চমকে উঠলেন। জিব্রাঈল ( আঃ) বলে উঠলেন- ” আপনারা ভয় পাবেন না। এখানেই আল্লাহর ঘর। এই সন্তান ও তার পিতা এ ঘর সত্বর পুনঃনির্মাণ করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না’”!

 

অতঃপর শুরু হলো ইসমাঈলী জীবনের নব অধ্যায়। পানি দেখে পাখি আসলো। পাখি উড়া দেখে ব্যবসায়ী কাফেলারা আসলো। তারা এসে পানির মালিক হিসাবে হাজেরার নিকটে অনুমতি চাইলো পানি সংগ্রহের। তিনি এই শর্তে মঞ্জুর করলেন যে, তাদের এখানে বসতি স্থাপন করতে হবে। বিনা পয়সায় এই প্রস্তাব সকলে আনন্দের সাথে কবুল করলো। এরাই হলো ইয়ামেন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। বড় হয়ে ইসমাঈল এই গোত্রে বিয়ে করেন। এরাই ক্বা’বা গৃহের খাদেম হন এবং এদের শাখা গোত্র কুরাঈশ বংশে শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমন ঘটে। 

ওদিকে ইব্রাহীম (আঃ) যখন স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে যান তখন হাজেরার দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এ বলে-

‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যকে তোমার মর্যাদামণ্ডিত ক্বা’বা গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। হে  প্রভু ! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। অতএব কিছু লোকের অন্তরকে তুমি এদের প্রতি ঝুঁকিয়ে ( আকৃষ্ট ) দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রুজি দান করো। সম্ভবতঃ তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে”।

 

ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে জনমানবশূন্য ও চাষাবাদহীন এক শুষ্ক মরু উপত্যকায় রেখে আসলেন, কোন সুস্থ্য বিবেকবান মানুষ এমন কাজকে সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তাদের জন্যই বিষয়টি মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। আর সেকারণেই মা হাজেরা গভীর প্রত্যয়ে বলে উঠেছিলেন- “তাহলে আল্লাহ্ আমাকে ধ্বংস করবেন না’”। আল্লাহ্ যে কেবল বিশ্বাসের বস্তু নয়, বরং তিনি সার্বক্ষণিক বান্দার তত্ত্বাবধায়কও! হযরত ইব্রাহীমের উক্ত কর্মনীতির মধ্যেই তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

 

ইব্রাহীম ( আঃ ) এর দোয়া আল্লাহ এমন দ্রুত কবুল করেছিলেন যে, দু’একদিনের মধ্যেই সেখানে সৃষ্টি হয় পানির ফোয়ারা, যা যমযম কূয়া নামে পরিচিত হয় এবং যার উৎসধারা বিগত প্রায় সোয়া চার হাজার বছর ধরে আজও সমভাবে প্রবহমান। কিন্তু এই পানির রূপ-রস-গন্ধ কিছুরই কোন পরিবর্তন হয়নি! এ পানির কোন হ্রাস-বৃদ্ধিও নেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পানিতে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা মানুষের জন্য খাদ্য ও পানীয় উভয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম। পৃথিবীর অন্য কোন পানিতে এ গুণ নেই। দৈনিক লাখ লাখ গ্যালন পানি ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও এ পানির কোন ক্ষয় নেই, লয় নেই, কমতি নেই। এর কারণ অনুসন্ধানে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও বৈজ্ঞানিকেরা ব্যর্থ হয়েছেন।

 

স্মরণ কর যখন ক্বা’বা ঘরকে মানুষের জন্য ইবাদতের ও শান্তির স্থান করলাম; আর আদেশ দিলাম তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে নামাজের জায়গা বানাও এবং আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী,  রুকু ও  সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।

( সূরা বাক্কারাহ্-১২৫ )

 

যখন ইব্রাহীম বললেন, হে প্রভু! এ শহরকে নিরাপদ কর এবং এর অধিবাসীদের যারা আল্লাহ্ ও কিয়ামতের বিশ্বাসী, তাদের ফল দ্বারা রিজিক দান কর; আল্লাহ্‌ বললেন- 

যারা অবিশ্বাসী, তাদেরও কিছুদিন ফায়দা ভোগের সুযোগ দিব; অতঃপর তাদের দোজখের আযাব ভোগ করতে বাধ্য করব, আর উহা অত্যন্ত নিকৃষ্ট।

(সূরা বাক্কারাহ্-১২৬)

ইব্রাহীম ও ইসমাঈল ক্বা’বা ঘরের ভিত তুললেন, আর বললেন-

হে প্রভু! আমাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন, নিশ্চয় আপনি শ্রবণকারী ও সর্বজ্ঞ।

( সূরা বাক্কারাহ্ -১২৭)

হে প্রভু! আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন, আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল করুন, আমাদের হজের নিয়ম বলে দিন, ক্ষমা করুন,নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

( সূরা বাক্কারাহ্-১২৮)

হে প্রভু! তাদের মধ্য একজন রাসুল প্রেরণ করুন-যে তাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দিবেন, পবিত্র করবেন, আপনিই তো মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।

( সূরা বাক্কারাহ্-১২৯ )

 

অতঃপর কা‘বা গৃহ নির্মাণ শেষে পিতা-পুত্র মিলে যে প্রার্থনা করেন, তা যেমন ছিল অন্তরভেদী, তেমনি ছিল সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক।

 

ইব্রাহীম ( আঃ ) ও ইসমাঈল (আঃ) এর উপরোক্ত দোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে তাদের বংশে চিরকাল একদল মুত্তাকী পরহেযগার মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তাঁদের পরের সকল নবীই তাঁদের বংশধর ছিলেন। ক্বা’বার খাদেম হিসাবেও চিরকাল তাদের বংশের একদল দ্বীনদার লোক সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। ক্বা’বার খেদমতের কারণেই তাদের সম্মান ও মর্যাদা সারা আরবে এমনকি আরবের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছিলো। আজও সঊদী বাদশাহদের লক্বব হলো ‘খাদেমুল হারামায়েন আশ-শারীফায়েন’ ( দুই পবিত্র হরমের সেবক)। কেন’আনের বাদশাহীতে নয়, হারামায়েন-এর সেবক হওয়াতেই গৌরব বেশী। 

 

ইব্রাহীমের দোয়ার ফসল হিসাবেই মক্কায় আগমন করেন বিশ্বনবী ও শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। তিনি বলতেন, আমি আমার পিতা ইব্রাহীমের দোয়ার ফসল ও ঈসার সুসংবাদ’।

ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন নবীগণের পিতা এবং পুত্র মুহাম্মাদ ( আঃ) ছিলেন নবীগণের নেতা, এ বিষয়টি সর্বদা মুমিনের মানসপটে জাগরুক রাখার জন্য দৈনিক ছালাতের শেষ বৈঠকে পঠিত দরূদের মধ্যে ইব্রাহীম  (আঃ ) ও মুহাম্মাদ ( আঃ) এর উপরে এবং উভয়ের পরিবার বর্গের উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণের জন্য দোয়া করার বিধান রাখা হয়েছে। ইব্রাহীম ( আঃ) এর বংশে বরকত হলো নবুঅত ও ঐশী কিতাবের বরকত এবং মুহাম্মাদ ( আঃ) ও তাঁর বংশে বরকত হলো বিজ্ঞানময় কুরআন ও হাদীস এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বরকত।

 

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-

অতএব, (কৃতজ্ঞতাস্বরূপ) তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে নামায পড় ও কুরবানী কর।  (আল কাউছার -০২)

এরই ধারাবাহিকতায় যথাযথ নিয়মে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে এবং উম্মতে মুহাম্মদীর সামর্থবানের জন্য ঈদুল আযহায় কুরবানী করা ওয়াজিব বা আবশ্যকতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

সহিহ বুখারির ‘কুরবানীর বিধান। ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন- কুরবানী সুন্নত এবং স্বীকৃত প্রথা’ পরিচ্ছেদে এসেছে।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সালাত (নামায) আদায়ের আগে যবেহ করল সে নিজের জন্যই যবেহ করল। আর যে ব্যক্তি সালাত আদায়ের পর যবেহ করল। তার কুরবানী পূর্ণ হলো এবং সে মুসলিমদের নীতি অনুসরণ করল।

[ হাদিস নং ৫১৪৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।]

 

ইব্রাহীম (আঃ)-এর প্রায় দু’শো বছরের পুরা জীবনটাই ছিল পরীক্ষার জীবন। সুখে-দুখে, আনন্দে-বিষাদে সর্বাবস্থায় তিনি ছিলেন আল্লাহর উপরে একান্ত নির্ভরশীল। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা তাঁকে তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। অবশেষে জন্মভূমি ত্যাগ করে হিযরত করে আসতেও তিনি পিছপা হননি। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় বৃদ্ধ বয়সের নয়নের মণি একমাত্র শিশু পুত্রকে তার মাসহ মক্কার বিজনভূমিতে নির্বাসনে দিয়ে আসতেও তাঁর হৃদয় টলেনি। অবশেষে ঐ সন্তানকে যবেহ করার মত কঠিনতম উদ্যোগ নিতেও তাঁর হাত কেঁপে ওঠেনি। এভাবে জীবনভর অগণিত পরীক্ষার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পূর্ণ-পরিণত ইব্রাহীম পেলেন ‘বিশ্বনেতা’ হবার মতো বিরল দুনিয়াবী পুরস্কারের মহান এলাহী ঘোষণা। হলেন ভবিষ্যৎ নবীগণের পিতা ‘আবুল আম্বিয়া’ এবং মিল্লাতে ইসলামিয়াহর নেতা হবার মত দুর্লভ সম্মান। আজও যদি পৃথিবীর দিকে দিকে ইব্রাহীমী ঈমানের জ্যোতি বিকীরিত হয়, আবার মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সে ঈমান ফিরে আসবে।

 

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মাক্বামে ইব্রাহীমে দাঁড়িয়ে এবং কোন কোন বর্ণনা মতে আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দুই কানে আঙ্গুল ভরে সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে চারদিকে ফিরে বারবার হজের উক্ত ঘোষণা জারি করেন। 

ইমাম বাগাভী হযরত ইবনু আব্বাসের সূত্রে বলেন যে, ইব্রাহীমের উক্ত ঘোষণা আল্লাহ পাক সাথে সাথে বিশ্বের সকল প্রান্তে মানুষের কানে কানে পৌঁছে দেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, ইব্রাহীমী আহ্বানের জবাবই হচ্ছে হাজীদের ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা লাববায়েক’ (হাযির, হে প্রভু আমি হাযির) বলার আসল ভিত্তি। সেদিন থেকে এযাবত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে মানুষ চলেছে ক্বা’বার পথে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ উটে, কেউ গাড়ীতে, কেউ বিমানে, কেউ জাহাজে ও কেউ অন্য পরিবহনে।  আবরাহার মত অনেকে চেষ্টা করেও এ স্রোত কখনো ঠেকাতে পারেনি। পারবেও না কোনদিন

ইনশাআল্লাহ। দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে সর্বদা চলছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও ছাফা-মারওয়ার সাঈ। আর হজ্জের পরে চলছে কুরবানী। এভাবে ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ) এর স্মৃতি চির অম্লান হয়ে আছে মানব ইতিহাসে। এককালের চাষাবাদহীন বিজন পাহাড়ী উপত্যকা ইব্রাহীমের দোয়ার বরকতে হয়ে উঠলো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সম্মিলনস্থল । যেমন আল্লাহ বলেন – 

‘যখন  ক্বা’বা গৃহকে লোকদের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তিধামে পরিণত করলাম (আর বললাম,) তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর স্থানটিকে ছালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর। অতঃপর  ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই‘তেকাফকারী ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর।’

(বাক্বারাহ ২/১২৫)

 

ঈদুল আযহার উৎসব কেবল পশু কুরবানী করা এবং আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আমোদ প্রমোদকে বুঝায় না বরং ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আত্মোৎসর্গ, নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের বিনাশ ঘটানো এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায় করা। ঈমান আনয়নের মাধ্যমে সবাই মুমিন বা মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ঈমান গ্রহণের সাথে সাথেই প্রতিটি মুমিন ইসলামের সকল বিষয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে। সুখ দুঃখ, সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় ইসলামই একমাত্র অনুশাসন একথাটি নিজের মধ্যে দৃঢ় করে নেয়া। প্রকৃত মুমিনের মৌলিক চিন্তা চেতনা এমন হওয়াটাই কাম্য।

 

ঈদ মুসলিম এবং প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার অনন্য মাধ্যম। ইসলাম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্ম। এর প্রতিটি আদেশ নিষেধের সাথে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং প্রশান্ত করা ।  ঈদুল আযহা যেমনি আনন্দের বার্তা দিচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষা দিচ্ছে মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মন মানসিকতা, হিংসা বিদ্বেষ, অহংকারকে বিসর্জন দেওয়ার। বার্তা দিচ্ছে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর। সুপথ দেখাচ্ছে ন্যায় নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দিচ্ছে সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার। তাই আসুন ঈদুল আযহার প্রকৃত মহত্ত্ব ও তাৎপর্য নিজে লালন করি এবং উত্তম  মানবিকতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও অসহায়দের সেবায় পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি।

তথ্যসূত্র – গুগল

সুলতানা রিজিয়া
সুলতানা রিজিয়া