তিতির চশমা/ নাসরীন মুস্তাফা

তিতির চশমা

তিতির চশমা

তিতির চশমা/ নাসরীন মুস্তাফা

 

যত দিন যাচ্ছে, তিতির জন্য সবাই যেন একটা কথা-ই ঠিক করে রেখেছে, সেটা হচ্ছে—‘পড়’।

তিতি এখন টের পাচ্ছে, বড় হলে কেবলই পড়তে হয়। আর সে পড়া মজার মজার গল্পের বই পড়া নয়। ক্লাসের বই পড়া। তিতির ওসব বই পড়তে একটুও ভাল লাগে না। মা আর বাবা বলেছেন, না পড়লে তিতি মুর্খ হয়ে থাকবে। মুর্খদের দিন খুব খারাপ যায়, খু-উ-ব খারাপ!

তিতি ভ্যাঁ কান্না কেঁদে বলে, ‘কিছু একটা কর চা! কিছু একটা কর!’

তিতি ওর ছোট চাচা ইস্তিকে ছোট বেলা থেকেই ‘চা’ বলে ডাকে। বিজ্ঞানী ইস্তিও তিতির চোখের পানি দেখে কিছু একটা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর তখনি ঘটে যায় নতুন নতুন আবিষ্কারের ঘটনা। এবার তিতির চোখে উঠল দারুণ এক চশমা। যে কোন সাধারণ চশমার মতই দেখতে, কিন্তু কাজ করে অসাধারণ। 

ইস্তি ওর চোখের উপর চশমাটা পরিয়ে দিয়ে হাসল। বাম কানের উপর চশমার হাতলের সাথে থাকা একটা সুইচ টিপে দিল। এরপর বলল, ‘কি পড়তে চাস্, পড়।’

সায়েন্স হোমওয়ার্ক ছিল মশার উপর। ক্লাসের বইয়ে ইয়া বড় একটা মশার ছবি আঁকা। তিতির চোখ টের পেল, সাঁই সাঁই করে আলোর ঝলক যেন ছুঁয়ে গেল মশার ছবিটাকে। তিতি বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে আর চশমার কাঁচ-ফ্রেম সব যেন জেগে উঠেছে। সেকেন্ডের মধ্যেই তিতির মনে হ’ল, মশাটার পুরো জগত-ই যেন তিতির সামনে। মশা নিয়ে বইয়ের কঠিন কঠিন শব্দ মনে রাখা যায় না। কিন্তু মশাকে নিয়ে দেখা চলচ্চিত্র মনে রাখা যায়। তিতি এখন মশার সব খবর জানে। 

ইস্তি তিতির অবাক হওয়া দেখে হাসে। বলে, ‘বইয়ের ছবি আর তথ্য জেনে ফেলেছিল চশমাটা। ইন্টারনেটের কানেকশনও আছে এর সাথে। ফলে মশা নিয়ে দুনিয়ার সব তথ্য সংগ্রহ করে চশমাটা তোর মস্তিষ্কে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিল। তোর মস্তিষ্ক তো দারুণ শক্তিশালী কম্পিউটার। সব তথ্যকে সাজিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলল চট করে। যে সব তথ্য তোকে বেশি আনন্দ দিচ্ছে, সেসব গুরুত্ব পেল মশার চলচ্চিত্রে।’ 

আহা, তিতির দিন কাটে আনন্দে। ক্লাসের পড়া যদি লাগে ভাল, তার চেয়ে সুখি আর কে আছে, বল?

এক দিন স্কুল থেকে ফিরে তিতি খুব গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘চা! বত্রিশ নম্বর কি, তুমি জান?’

ইস্তি বিড়বিড় করে বলে, ‘বত্রিশ নম্বর! ধানমন্ডি?’

‘হুম! ঢাকার ধানমন্ডিতে বত্রিশ নম্বর রাস্তা। ওখানে একটা বাড়ি আছে, আমাদের স্যার আজ বললেন, ঐ বাড়িটা নাকি এখন ইতিহাস। আমি ইতিহাসের কাছে যেতে চাই।’

তিতির কোন কথা ওর ‘চা’ কি ফেলতে পেরেছে কখনো? কাজেই ‘চা’-এর হাত ধরে তিতি এক দিন পৌঁছে গেল ইতিহাসের কাছে—না না, একেবারে ইতিহাসের বুকের গভীরে। তিতি ওর চশমাটা চোখে দিয়ে দেখে বাড়িটার প্রতিটা দেয়াল। থরে থরে সাজানো রক্তমাখা কাপড়, ব্যবহারের জিনিসপত্র। আলোর ঝলক ছুটে যাচ্ছে সাঁই সাঁই করে, খুব জীবন্ত হয়ে গেছে চশমার কাঁচ-ফ্রেম। খুব ব্যস্ত এখন তিতির মস্তিষ্কও।

তিতির সামনে দাঁড়ানো এক বিশালদেহী মানুষ গর্জে উঠলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ 

তিতি খুব ভালবাসা নিয়ে ডাকল, ‘বঙ্গবন্ধু!’

বাংলাদেশ নামের দেশটির স্বপ্ন তৈরি হ’ল, স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ পেল—দেশটির জন্ম হওয়ার সোনালী দিন পেরিয়ে এক ভয়াল রাতে গিয়ে থামল রক্তমাখা চলচ্চিত্রটি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তিতির কানে বাজছে রাতের আঁধার ভেদ করে আসা ফজরের আজানের শব্দ। বত্রিশ নম্বরের এই বাড়িটার সবাই ঘুমাচ্ছেন। হঠাৎ গুলির শব্দে জেগে উঠলেন সবাই। তিতির সামনে এসে দাঁড়াল ওর বয়সী ছোট্ট একটি শিশু। ‘মা মা’ করে কাঁদছে। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে খুব। তিতি ছুটে যায় সেদিকে। সিঁড়ির উপরে দাঁড়ানো সেই বিশালদেহী মানুষটির বুক ভেসে যাচ্ছে রক্তে। তিনি গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন সিঁড়ি দিয়ে। তিতি দুই হাত দিয়ে আগলে ধরতে চায়, পারে না। ওর চোখের সামনেই রক্তাক্ত হন শিশুটির মা, তিতি তখনো কিছু করতে পারেনি। আশেপাশে রক্তের ভেতর শুয়ে আছেন শিশুটির কাছের মানুষগুলো, কেউ শুনতে পাচ্ছেন না ওর ‘মা মা’ ডাক!

তিতি চিৎকার করে ওঠে ভয়ে। যে ভয়ংকর খুনিগুলো সবাইকে খুন করছিল, তারা যে এখন শিশুটির হাত ধরেছে! তিতি শিশুটির হাত ধরে এক ছুটে পালিয়ে যেতে চায়। ওর বাড়ানো হাত কেটে যায় বাতাসে। ও কিছুতেই আটকাতে পারে না খুনীদের। ওর চোখের সামনেই শিশুটিকে নিয়ে যায় ওর মায়ের কাছে। সবার রক্তাক্ত শরীরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শিশুটি। ওর ভেজা চোখে ভয়াবহ আতঙ্ক দেখে তিতি। আর যখন মায়ের শরীরের উপর লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত শিশুটি, তখন তিতির বুকটা ফেটে যায় সীমাহীন কষ্টে।

বত্রিশ নম্বরে সেদিন যারা এসেছিলেন, তারা দেখলেন চশমা পরা একটা ছোট্ট মেয়ে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে চারিদিক। ও যেন বাঁচাতে চাইছে কাউকে। ও যেন থামাতে চাইছে খুনীদের। ও যখন কাউকে বাঁচাতে পারেনি, খুনীদের থামাতে পারেনি, তখন ওর অস্থিরতা দেখে অস্থির হয়ে ওঠে সব্বাই।

তিতি চোখ থেকে চশমাটা খুলে চোখ মোছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘চা, চশমা দিয়ে আমি সব দেখছি। কিছু করতে পারছি না। তুমি এমন কিছু কর, যাতে আমি কিছু করতে পারি। ধর, আমি সেই সময়টায় পৌঁছে গেলাম। খুনীদের হাওয়া করে দিলাম। রাসেল নামের ছোট্ট শিশুটি ওর বাবা-মায়ের বুকের মাঝখানে ঘুমিয়ে থাকল। আমি যেমন করে ঘুমিয়ে থাকি বাবা-মায়ের বুকের ভেতর—এমন কিছু—এমন কিছু যাতে হয়, তার জন্য কিছু একটা তোমাকে করতেই হবে চা!’

ইস্তি তখন নিজের চোখের পানিতে ভাসতে থাকে। তিতি যা বলে, তা না করতে পারলে ইস্তি যে ভাল থাকে না।

নাসরীন মুস্তাফা
নাসরীন মুস্তাফা