সময়ের কাহন – ৯ / অনুপা দেওয়ানজী
ধারাবাহিক স্মৃতিকথা
সময়ের কাহন – ৯ / অনুপা দেওয়ানজী
মরুভূমির বুক থেকে কয়েক হাত রুক্ষ মাটি তুলে ফেলে তাতে উর্বরা সারমাটি ঢেলে লনে রোপণ করা হয়েছে নরম, কোমল দুর্বাঘাস। বাগানে লাগানো হয়েছে বসরাই গোলাপ, ফল, ফুল আর সেই সাথে নানারকম সবজি।
মরুর রুক্ষ হাওয়ায় দুর্বাঘাস শুকিয়ে যাতে বিবর্ণ না হয়ে পড়ে এজন্যে নিপুণ করে ছাঁটা সবুজ ঘাসের আড়াল থেকে স্বয়ংক্রিয় সরু জলের ফোয়ারার জল সিঞ্চন ঘাসকে সারাক্ষণ স্নিগ্ধ ও সতেজ রাখছে।
কর্তার মুখে শুনেছি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই দুর্বা ঘাসের মূল নিয়ে আসা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। কারণ কোমল, মসৃণ দুর্বা ঘাস প্রতিকূল পরিবেশেও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার এক আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে।
দীর্ঘ জীবনের প্রতীকরূপে দুর্বা দিয়ে তাই প্রিয়জনকে আশীর্বাদ করা হয়।
সবুজ, কোমল সেই দুর্বাঘাসের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে ভাবছিলাম, আহা্ আমাদের দেশের মাঠে,ঘাটে,ঘরের আঙিনায়, উঠানের আনাচে- কানাচে এই দুর্বাঘাস অনাদরে,অবহেলায় আপনা থেকেই জন্ম নিয়ে জায়গাগুলিকে কী স্নিগ্ধ আর মনোরম করে তোলে!
আলাদাভাবে চাষের কোন প্রয়োজনই হয় না।
তোফাজ্জল সাহেবের বাংলোর সব্জীর ক্ষেতটিও ভারি সুন্দর! লনের একপাশের জমিকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে তাতে রোপণ করা হয়েছে কাঁচা লংকা, ছোট গোল বেগুন, কাঁকড়ি আর পুদিনাপাতা।
পুদিনার ঝাড়ের পাশেই মাচাবিহীন একটা লাউ গাছ লতিয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি তাতে তিনটে লাউও ফলে আছে। কিন্তু সে লাউয়ের আকার দেখে আমি একা একাই হাসতে হাসতে শেষ। যে লাউ ফলেছে তাকে লাউ না বলে বেল বলাই ভালো। কোথায় আমাদের দেশের বড় বড় লাউ আর কোথায় বেলের মতো এই লাউ!
এই লাউয়ের কি কাউকে বৈরাগী বানাবার আদৌ কোন ক্ষমতা আছে!
সবজির ক্ষেত পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফলবতী মাল্টা গাছটার কাছে গিয়ে দেখি গাছের গোড়ায় কাপড়ে জড়ানো একটা জলভরা মটকা। আল্লারাখাকেও দেখেছি রান্নাঘরের বারান্দার কোনের একটি তাকে কাপড় বাঁধা মটকায় করে এভাবে জল ভরে রাখতে। লম্বা হাতলওয়ালা একটি মগ দিয়ে মটকা থেকে সে জল তুলে নেয়।
মটকার কাপড়টা শুকিয়ে গেলে সে আবার তা জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয় ।
হাওয়া যখন চলে তখন সেই হাওয়া ভেজা কাপড়ের জন্যে শীতল হয়ে মাটির মটকার জলকে ঠান্ডা করে রাখে।
খুব সকালে ওঠা আমার অনেক দিনের অভ্যেস। জাগতিক কোলাহল তখন শুরু হয় না। এই সময়টাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে সবুজ গাছপালার ভিতর দিয়ে সূর্যের আত্মপ্রকাশ দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে আমার চোখের সামনে ছোট্ট এক সবুজ লন আর সব্জী বাগান ছাড়া আর কোথাও সবুজের বিন্দুমাত্র উপস্থিতি নেই।
ধূসর থেকে ক্রমশ আরো ধূসর এক দিগন্তের সামনে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আমার দেশের উপচে পড়া সবুজ শ্যামল লাবণ্যময় রূপের কথা।
এই রুক্ষ মরুময় জায়গাটিতে না আসলে আমার বুঝি এমন উপলব্ধি কখনোই হত না।
কবি কি আর সাধে বলেছিলেন,
“ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।”
নিজের অজান্তেই গুনগুন করে গানটি গাইতে গাইতে ঘরে ফিরে এসে দেখি বেচারা আল্লারাখা তখনো নাস্তা বানিয়ে উঠতে পারেনি। আহা্ কতটুকুই বা বয়েস ওর। তার মধ্যে আমরা আসাতে তার কাজ কিছুটা বেড়েছে বৈকি। আমিও তার সাথে হাত লাগালাম।
নাস্তা বানাতে বানাতে ভাবছিলাম মালি এলে বলতে হবে বাগান থেকে যেন কিছু কাঁচা লংকা,কয়েকটা গোল বেগুন আর অবশ্যই বেলের মতো লাউ তিনটিও যেন তুলে দিয়ে যায়।
পরোটার সাথে রাতের বেঁচে যাওয়া দুম্বার মাংস আর ডিমভাজা দিয়ে নাস্তা সেরে তোফাজ্জ্বল সাহেব আর আমার কর্তা আমার মেয়েকে আদর করে অফিসে চলে গেলেন।
নূতন জায়গায় এসে মেয়ে কিছুতেই আমার কাছছাড়া হতেই চাইছে না।সারাক্ষণ আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে।
নাস্তার পাট চুকে গেলে আল্লারাখাও নাস্তা সেরে বাজার করার জন্যে কোম্পানীর নিজস্ব শপিং সেন্টারে গেল।
বারোটার ভেতরেই রান্নাবান্না শেষ করতে হবে। কারণ বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত কোম্পানির বেঁধে দেয়া লাঞ্চটাইম।
সাহেবরা তখন খেতে আসবে।
আল্লারাখা চলে যেতেই ঠিকে কাজের বুয়া এলো রাতের বাসন আর কাপড় চোপড় ধুয়ে দেবার জন্যে।
আল্লারাখার কাছে রাতেই শুনেছি ওর নাম ছুমরি।
ছুমরি এসেই আমাকে সালাম দিয়ে কিযে সব বকবক করে বলতে শুরু করলো চুপ করে শোনা ছাড়া আমি কিছুতেই তার মর্মোদ্ধার করতে পারলাম না।
ছুমরি আসার সাথে সাথেই কোম্পানীর স্যুইপার এসে ঘর ঝাড়ু দিয়ে, মুছে,বাথরুম ধুয়ে বিনের আবর্জনা নিয়ে চলে গেলো।
ছুমরি কাপড়ে সাবান মাখিয়ে বাসন ধুয়ে কাপড় ধুতে বসলো। তার কাপড় ধোয়া দেখে আমি অবাক। সাবান লাগানো কাপড়গুলিকে ক্রিকেট ব্যাটের মতো ছোট একটা ব্যাট দিয়ে সে কিছুক্ষণ পিটিয়ে পিটিয়ে তারপর ধুয়ে শুকাতে দিলো।
তার কাপড় ধোয়া দেখে আমার কেন জানি খুব হাসি পাচ্ছিলো।
কাজ শেষ করে সে যখন চলে যাবে এমন সময় গতকালকে দেখা বাংলোর আধবুড়ো মালিটা এসে হাজির।
মালির এক হাতে খড়ের একটা ঝুড়িতে কয়েকটা কালো আঙুরের থোকা, তিন চারটে কাঁকড়ি, কয়েকটা বেগুন,কাঁচালংকা, পুদিনাপাতা, কুলপা শাক (নোনতা শাক) আর বেলের মতো সেই তিনটে গোল লাউ।
অন্য হাতে সে ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো একটা সরু ডাল ধরে আছে। ডালটাতে পাখির বাসার মতো ছোট্টমতো কী একটা জিনিস ঝুলে আছে।
সব্জীগুলি সকালেই বাগানে দেখেছি।
কিন্তু পাখির বাসার মতো জিনিসটা কী? নিশ্চয় সব্জী নয়। কিন্তু মালি ওটাকে এমন যত্ন করে আগলে ধরে আছে কেন?
মালি ততক্ষণে সব্জীর ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে আমাকে সেলাম দিতেই আমি খেয়াল করলাম, আজ সে বাঁ হাতে নয় ডান হাতেই সেলাম দিলো।
ঝুড়িটা রেখেই হাতের ছোট্ট ডালটা দেখিয়ে সে বললো, মেমসাব ইয়ে খোঁকি কা লিয়ে । বহুত আচ্ছা চিজ হ্যায়।বাগ সে লায়া।
মনে মনে বললাম, যাক বাবা মালিটা বুগটি হলেও উর্দু জানে। যদিও উর্দুভাষাটা আমার তখনও রপ্ত হয় নি। তাতে আবার বস্তুটা যে কী তাও জানি না। আমি তাই মালির মুখের ওপরেই বলে দিলাম, নেহি ও তুম লে যাও। ও চিজ খোঁকিকো নেহি চাইয়ে।
মালি আমাকে বললো, ” মেমসাব ইস্ মে বহুত আচ্ছা সেহেদ হ্যায়। আপ খোঁকিকো পিলাকে তো দেখিয়ে।
ছুমরি যেতে যেতে চুপ করে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিলো।
মালির কথা শুনে সে বলে উঠলো, ” মেমসাব নে কাঁহা দিয়া না ও মেমসাবকো নেহি চাইয়ে?তো ও আপ মুঝে দে দো।”
মালি কিছুটা পে গিয়ে ছুমরিকে বললো,আপকো দে দুঁ?পাগল তো নেহি হুয়ি?”
এরপর সে আমাকে অনেক কষ্টে বোঝালো যে বাগানে এক রকমের খুব ছোট ছোট পোকা আসে। তারা গাছের ডালে এই বাসা বানায় তারপরে বাগানের ফুল থেকেই মধু সংগ্রহ করে এই বাসাতে সঞ্চয় করে রাখে।
মালির কথায় আমি তার হাত থেকে সেটা নিয়ে দেখলাম সত্যিই এ যেন অবিকল ছোট্ট একটা মৌচাক। যাতে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠও। প্রকোষ্ঠগুলি সোনালী রঙের মধুতে টইটুম্বুর হয়ে আছে।
মধুকে ওরা তবে সেহেদ বলে!
ছোট্ট সেই মৌচাকটা দেখে আমার চোখে ভেসে উঠলো আমাদের দেশের উঁচু গাছের ডালে মৌমাছিদের বানানো বিশাল মৌচাকের দৃশ্য ।
এখানে তেমন বড় গাছই বা কোথায় যে অতবড় মৌচাক দেখা যাবে?
হাতে নিয়ে মনে হচ্ছিল এ যেন এক খেলনা মৌচাক।
মালি যখন আমার হাত থেকে নিয়ে মধুভরা সেই ছোট্ট মৌচাকটা আদর করে আমার মেয়ের হাতে তুলে দিলো তখন সেই লম্বা জোব্বা আর মাথায় পাগড়ি বাঁধা আধবুড়ো সেই বেলুচ মালির দিকে তাকিয়ে আমার কেন জানি “মিনি আর কাবুলিওয়ালা ” গল্পটার কথা মনে পড়ে গেলো।
মমতা বা স্নেহপ্রকাশের জন্যে মনে হয় দেশ বা কোন ভাষারই প্রয়োজন হয় না।
মেয়ের বাবাকে সেই ছোট্ট মৌচাক দেখালে সে বললো, এখানকার মৌমাছিরা নাকি মরুভূমির পাথুরে পাহাড়ের ভেতরে মৌচাক বানিয়ে মধু সঞ্চয় করে।
পরে পাথুরে গুহার সেই মৌচাক আমি নিজেও দেখেছি আর বিস্মিত হয়ে ভেবেছি, কি অসাধ্য শ্রমজীবন এই শ্রমিক মৌমাছিদের! মরুর দেশে না জানি কোথায় কোন সুদূর তেপান্তর থেকে ওদের ফুলের সন্ধান করতে হয়! কোন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে পাহাড়ের গুহায় মৌচাক বানিয়ে ওরা মধু সঞ্চয় করে!
এই সময়ে আল্লারাখা বাজার নিয়ে ফিরলো। সাথে বিশাল একটা বরফের চাঙড় । চাঙড়টাকে সে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে টুকরো করে কিছুটা বাথরুমের স্নানের জলের ড্রামে ছেড়ে দিলো জল ঠাণ্ডা থাকার জন্যে। আর কিছুটা খাবার জলে মেশাবার জন্যে আলাদা করে রাখলো।
কোম্পানীর নিজস্ব আইসপ্ল্যান্টে এই বরফ তৈরী করা হয় শুধুমাত্র ফিল্ডের লোকদের জন্যে।
বরফ ভেঙে এসে সে বললো, মেমসাব শপিং সেন্টার মে মছলি আজ নেহি আয়া। ইসিলিয়ে ছোটে গোশত লে আয়া।
মাটন, খাসি বা দুম্বার মাংসকে ওরা বলে ছোটে গোশত আর বিফ কে বলে মোটে গোশত। তবে স্যুইতে বিফ খেতে কম লোককেই দেখেছি। গরুও দেখিনি। তবে আমি ছিলাম অত্যন্ত সংরক্ষিত একটি জায়গায় তাই হয়তো গরু দেখিনি। তবে উট,গাধা, ঘোড়া ,ছাগল আর দুম্বা দেখেছি। মাংসের মধ্যে দুম্বার মাংসই ওরা বেশি খায়।
গরুর মাংস অন্য প্রদেশ থেকে শপিং সেন্টারে আসতো। মাংসের সের ছিলো ছয় টাকা। কেজির হিসাব তখনো আসে নি।
মালি চলে গেলে আমি আল্লারাখাকে ভাঙা উর্দু আর বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম, মালি দুপুরে কোথায় খায়?
সে বললো,” ও তো আপনা রোটি লে আতে মেমসাব? কাঁচ্চে পেঁয়াজ সে খা লেতে।
আমি তাকে বললাম, এখন থেকে আমরা দুপুরে যা খাই তাই দিয়ে মালিকেও খাইয়ে দিও।
আল্লারাখা লক্ষী ছেলের মতোই মাথা নাড়লো।
দুপুরে আমি রান্না করলাম সর্ষেবাটা দিয়ে গোল বেগুনের চচ্চড়ি, মুসুরির ডাল, কুলপা শাক দিয়ে খাসির মাংস আর কাঁকড়ির সালাদ। শপিং সেন্টারে মাছ আসেনি তাই আগের দিনের মতো মাংসই রাঁধতে হল।
লাউ তিনটা রেখে দিলাম পরে রান্না করা যাবে ভেবে।
দুপুরে খেতে বসে তোফাজ্জ্বল সাহেব খুব খুশি হয়ে বললেন,” বউমা তুমি আসার সাথে সাথে খালি বাড়িটা যেন সত্যিই বাড়ি হয়ে উঠেছে।
কিছুদিনের মধ্যেই অনবরত উর্দু কথার ভিড়ে ভাষাটা আমার কিছুটা আয়ত্বে এসে গেলো। ভাতকে চালই বলতে শিখেছি। তবে মুস্কিল বাধে ব্যাকরণ নিয়ে।
বিশেষ করে উর্দু ভাষায় জেন্ডারের ব্যবহার কিছুতেই বুঝতে পারি না। আমাদের যেটা নিউটার জেন্ডার ওদের তা নয়।
যেমন রাস্তা বা কাঁচা লঙ্কা উর্দু ভাষায় ফেমিনিন জেন্ডার। পুংলিঙ্গ, স্ত্রী লিংগ আর ক্লীব লিংগের গোলকধাঁধায় পড়ে আমার বাক্যের পটা তখন গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে।
সে যাই হোক আমার কর্তা এখানে এসেছে মূলত ফিল্ডের গ্যাস প্রোডাকশান বাড়াবার দায়িত্ব নিয়ে।
মাঝে মাঝে বিকেল বেলায় তার সাথে আমিও চলে যাই কীভাবে গ্যাস লাইনের কাজ হয় তা দেখার জন্যে।
তখন বুগতিদের অবর্ণনীয় কষ্ট নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মানুষ কীভাবে এত কষ্ট সহ্য করে বাঁচতে পারে?
মরুভূমির রুক্ষ মাটির এবড়োথেবড়ো লম্বা নালার মধ্যে (যুদ্ধের সময়ে আপদকালীন আশ্রয় নেবার ট্রেঞ্চের মতো অনেকটা) গাদাগাদি করে থাকাকে কি বেঁচে থাকা বলে!
শুধু কি তাই? তাতে আবার যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড জলের কষ্ট। বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাB সেখানে মাত্র ২০০ মিলিমিটার।
মাঝে মাঝে তাই কোম্পানির পাইপলাইন ফুটো করে ওরা জল নিয়ে যেতে বাধ্য হত।
মনে মনে ভাবতাম ওদেরই জায়গা অথচ ওদের জন্যে সরকার পানীয় জলের কোন সুব্যবস্থাই করেনি!
সকাল হলেই ফিল্ডের সীমানা ডিঙিয়ে আমাদের রান্নাঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃস্ব অনেক বেলুচবাসীর আহাজারি শোনা যেতো,”আম্মা থোরা পানি অউর শুখা রোটি দে দে। “
আমার মনে হত আমার দেশেরই কোন ভিক্ষুক যেন বলছে,”আম্মা গো বাসি ভাত থাকলে আমারে দুইটা বাসি ভাত দেন।”
আল্লারাখাকে দেখতাম বেঁচে যাওয়া রুটিগুলিকে একটা পাত্রে জমিয়ে রাখতে। সেই রুটিগুলি আর এক মগ জল যখন সে জানালা গলিয়ে তাদের পাত্রে ঢেলে দিতো তখন রুটিগুলি ঠং ঠং শব্দে বেজে উঠতো।
ওই শুকনো রুটি আর জল পেয়েই ওরা খুব খুশি হয়ে চলে যেতো।
একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে অত শুকনো রুটি ওদের দাও ওরা কীভাবে খাবে?
আল্লারাখা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো কিঁউ মেমসাব পানি ভি দিয়া না? পানিমে ভিগাকে খা লেগা।
আমি তার কথায় অবাক হলেও পরে দেখেছি এখানে শুকনো রুটি সবাই রেখে দেয় ওদের জন্যে। অনেক গৃহিণী আবার সেই শুকনো রুটিকে গুঁড়ো করে ঘিয়ে ভেজে পেস্তা,কিশমিশ দুধ আর বাদাম দিয়ে হালুয়া তৈরি করতেন।
বেলুচিস্তানের আবহাওয়া এতই শুকনো যে ভাত খাওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া ভাতে ঢাকা না দিলে কিছুক্ষণ পরেই ভাতগুলি শুকিয়ে চাল হয়ে যেতো।
অনেকে এভাবেই ভাতকে শুকিয়ে চাল বানিয়ে বয়ামে ভরে রাখতেন।পরে তেলে ভেজে নিতেন।আমিও করে দেখেছি।খেতে তেলে ভাজা মুড়ির মতো লাগে।
একবার এক বেলুচ ভিখিরি এলো।সেদিন রুটি ছিলো না।আল্লারাখা বললো, আজ রোটি নেহি হ্যায়।মাপ করো জি।
আমি বললাম, কেন ভাত আছে তো।ওকে একটু ভাত আর তরকারি দাও।
আল্লারাখা তার থালায় ভাত আর তরকারি দিতেই সে খুব খুশি হয়ে বাঁ হাত দিয়ে সেই ভাত তরকারি খেতে শুরু করলো।
বাঁ হাতের ব্যবহার এখানে ডান হাতের মতোই। পরে দেখেছি আমাদের মালির মতোই বাঁ হাতেই অনেকে সালাম করতেন।
এইসব হতদরিদ্র মানুষগুলিকে দেখে দেখে প্রায়ই আমার মনে হতো পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় একটা প্রদেশ, জনসংখ্যাও যেখানে এত কম সেখানে তাদের এত অভাব কেন?
তারাই বা পাক সরকারকে মানতে চায় না কেন?
এও শুনেছি বেলুচিস্তানের মাটিতে গ্যাস ছাড়াও প্রচুর কয়লা,তামা,সোনা,রূপা,এলুমিনিয়াম, ইউরেনিয়াম এমন কি প্ল্যাটিনামেরও বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে।
এতসব সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েও বেলুচিস্তানে কোন অর্থনৈতিক উন্নয়ন নেই কেন?
দারিদ্র্যের এমন নির্মম কষাঘাত তাদের সইতে হচ্ছে কেন?
শুধু তাই নয়, শিক্ষা,স্বাস্থ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা কিছুই তাদের জন্যে নেই বললেই চলে।
অথচ এই বেলুচিস্তানেই যে যুগে যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতির পর্যটকরা এসেছিলেন তার চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে। যা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত করা হয় না।
বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান মহেঞ্জোদারো এখান থেকে বিমানে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ।
কথায় কথায় বেলুচিস্তানের প্রাচীন ইতিহাস আমি সেখানকার অনেক মানুষদের মুখে শুনেছি।
তাদের মুখেই শুনেছি আসিরিয়ার রাণী সেমিরামিস আর পারস্যের রাজা সিরুসের সেনাবাহিনী নাকি এখানকার মরুভূমিতেই হারিয়ে গিয়েছিলেন।
বেলুচিস্তানের আদিনাম নাকি গোদ্রেশিয়া।
সর্বপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আবেঁস্তাতে গোদ্রেশিয়ার উল্লেখ আছে।
এসব কথা শুনে বেলুচবাসীদের সম্পর্কে জানার ইচ্ছে আমার বাড়তে লাগলো। নিজের অজান্তেই আমি তাদের সাথে একটা একাত্মতা অনুভব করতে লাগলাম।
এর কারণ হয়তো পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যেমন সবক্ষেত্রেই আমাদের দাবিয়ে রেখেছে ঠিক তেমনি বেলুচবাসীদেরও দাবিয়ে রেখেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমাদের চেয়েও তারা অনেক বেশি উপেক্ষিত, বঞ্চিত, শোষিত আর নির্যাতিত হয়ে চলেছে।
নইলে খোদ বেলুচিস্তানের স্যুই গ্যাস ফিল্ড থেকেই যেখানে পাকিস্তানের সর্বাধিক আয় হয়,অর্থনৈতিক উন্নয়নে যার অবদান কিনা সবচেয়ে বেশি, শিল্প,বাণিজ্য, কৃষি,ডোমেস্টিক সাপ্লাই সব ক্ষেত্রেই স্যুই গ্যাস ফিল্ড যেখানে নিজেই একক ভূমিকা পালন করে আসছে সেখানে বেলুচবাসিরাই কিনা এর বিন্দুমাত্র সুবিধা পায় না!
পাক সরকারেরও কেনই বা তাদের ওপরে এত রোষ! তারাই বা পাক সরকারকে কেন মানে না!
(চলবে)
Facebook Comments Sync