ধাওয়া (পর্ব ১৪-১৫) / শাহানাজ শাহীন

ধাওয়া 17-19

ধাওয়া

ধারাবাহিক উপন্যাস 

ধাওয়া (পর্ব ১৪-১৫) / শাহানাজ শাহীন

 

ক্লাস শুরু হবার ঘন্টা পড়েছে । ছাত্র ছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে ঢুকছে । কিন্তু শ্রেণিকক্ষে আমি পাঠে মনোনিবেশ করতে পারলাম না । আমার ভাবনা কেবলই মোতালেব চাচার চারপাশ ঘিরে দৌড়াচ্ছে ।

আমি ভেবে আশ্চর্য হই, দাদাজান কী ভয়াবহ অবস্থা মধ্য দিয়ে গেছেন মোতালেব চাচা কে নিয়ে যখন বাস্তবতা খামচে ধরেছে ।

সারা আমার সামনে এসে বসেছে । তার কাছে বিবিসির তাজা খবর আছে । আমাকে শুনতে হবে ।

আমি পাঠ্য বই বন্ধ করে তার কথা শুনতে শতভাগ মনোযোগ দিলাম ।

 

” লস্কর তোকে পছন্দ করে ।”

” কি ? লস্কর কে? “

” আরে মেঘ । “

” মেঘ না বলে লস্কর বলছিস কেনো? “

” ইচ্ছা করল । “

লাইব্রেরিতে সারা পড়তে আসে না । আসে বিবিধ খবর নিয়ে ।

” সে তোর প্রেমে পাগল প্রায় । ক্রাস খেয়েছে । “

” আবোলতাবোল কথা রাখবি? মেঘ আমার প্রেমে কোনো ক্রাস-ট্রাস খায়নি । “

” ওহ, তাই? বিজ্ঞান বিভাগে মৃদুল আর সে গল্প করছে তোকে নিয়ে । আমি নিজের কানে শুনে আসলাম। 

সে বলছিল, তোর চুলে নাকি একটি মৌমাছি বসেছিল । আয় আমার সঙ্গে । নিজের কানে শুনবি । “

সারা আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় যেদিকটায় মেঘ ও মৃদুল বসে আছে । তার বিবিসি খবর আমার স্বকানে শুনাবে । আমরা বিজ্ঞান বিভাগে এলাম । বইয়ের তাকের পিছনে আমি আর সারা দাঁড়িয়ে আছি ।

সারা কানে হাত দিয়ে ভালো করে শুনবার চেষ্টা করছে । আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম মৃদুলের গলা ।

সে বলছিল,

 

” তুই কি পাগল হয়েছিস? সুহাসিনী ! তুই তো তাকে ঘৃণা করিস ।

” আমিও বিস্মিত হয়েছি । আমারও মনে হয় আমি তাকে অপছন্দ করি । কিন্তু ওর চিন্তা আমার মাথা থেকে নামছে না । “

” বুঝতে পারছি তোর খারাপ লাগছে । “

” আমার কী করা উচিত বলে তুই মনে করিস? “

” সব চিন্তা পাছার মধ্যে ঢুকিয়ে দে । ভুলে যাবি সব । সুহাসিনীর জন্য তোর যে অস্থিরতা তা আসল আবেগ ন “ ।

” আসল আবেগ না? তাহলে কি?”

” না । তোর অস্থিরতা হলো ডিমের বিষয়টি নিয়ে ।”

” তা ঠিক আছে । কিন্তু আমি তো তাকে অপমান করেছি, ওদের বাড়ি নোংরা, ছোট এসব বলে । “

 

” তুই তো মিথ্যে বলিস নাই । ওদের কী এটা বাড়ি হলো! একটা আস্তাবলখানা । অস্বস্তিকর জায়গা । “

” ঠিক বলিসনি । কারণ ওর বাবার একজন প্রতিবন্ধী ভাই আছেন । আমি যতোদূর জানি বেশির ভাগ টাকা খরচ হয় ভাইয়ের জন্য । হাসপাতাল খরচ বাবদ । “

 

” একজন প্রতিবন্ধী ?” বেশ , সেটা তোকে বলা উচিত ।”

 

” কি সম্পর্কে?”

 

” সুহাসিনী সম্পর্কে ।”

 

” কি বলতেছিস এসব ? “

 

” বন্ধু , আম গাছ থেকে ঝরে পড়ে । শূন্য থেকে পড়ে না । “

 

” আচ্ছা , হুম । ঠিকই বলেছিস । “

” হুম ।”

 

” আচ্ছা ঠিক আছে । পরে কথা বলছি ।”

মেঘ কথা শেষ করে । সুহাসিনী একবার সারার দিকে তাকাল । তার মুখ ভার । গায়ে পড়ে এসে নিজের মন্দ কথা শুনতে হলো । সারা বেকায়দায় পড়ে যায় । সে ইতস্তত হয়ে বলে,

” আমি দুঃখিত দোস্ত । তোকে মন খারাপ করিয়ে দিলাম । “

” বাদ দে । আমি কিছু মনে করিনি । “

সারা চলে যায় । আমি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম একই জায়গায় । এটাই বাকি ছিল ।

এখন আমার বিভ্রান্তি দূর হয়েছে । আমি নিশ্চিত ছিলাম তাকে আর আমার ভালো লাগবার কোনো কারণ নেই ।

 

বাকের পরিবারে আজ অনেক ব্যস্ততা । মিসেস ফাহমিদা খাওয়ার টেবিলে একটি ফুলদানি রাখলেন ।

বাগান থেকে তুলে আনা রজনীগন্ধা । সবুজ পাতায় হলুদ রঙের ফুল । অসাধারণ লাগছে । মেঘ মায়ের পাশে একটি চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ।

সে মাকে বললো,

” মা তুমি কি শওকত মিয়াকে মূল্যহীন করার চেষ্টা করছ না ? “

” মূল্যহীন কেনো ভাবছ । আমি এটিকে মনোরম করতে চাইছি । “

মিসেস ফরিদা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

” তুমি ভালো কাপড় পরছ না কেনো? “

” যাচ্ছি ।”

মেঘ তার রুমের দিকে যায় । সে আলমারি খুলেছে ।

একটা খয়েরি রঙের শার্ট হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে । মনে মনে চিন্তা করে,

নিজেকে সুহাসিনীর কাছে দেখতে প্রশংসনীয় করতে চায় ।

কিন্তু সে যাতে না বুঝতে পারে, আমি তার জন্য সাজগোজ করেছি । মেঘ হাতের খয়েরি রঙের শার্টটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে । সে খুঁজে খুঁজে আরেকটি শার্ট নিল । এটির রঙ বেগুনি । হুম এটি ঠিক আছে । শার্টের মধ্য এক হাত ঢুকিয়েছে , এমন সময় তার চোখ গেল জানালায় । সে দেখতে পেল সুহাসিনীরা বের হচ্ছে । তার হাতে কিছু একটা ধরা । মেঘ শার্টের হাতা থেকে দ্রুত হাত বের করে এটিও বিছানায় ছুড়ে মারল । সে আবার আলমারিতে খুঁজছে । তাড়াতাড়ি করে একটা শার্ট পরে নিল । মিসেস ফাহমিদা ছেলেকে ডাকছেন, সে শার্ট পরতে পরতে বললো,

” আসছি মা। “

বাকের সাহেবের বাবা দরজা খুলে দিলেন ।

তিনি অত্যন্ত সন্মানের সাথে বললেন,

” আসুন আসুন ভেতরে । ফরিদা বেগম ও তাদের মেয়ে সুহাসিনী প্রথমে ঘরে ঢুকলেন । মায়ের হাতে, হাতে বানানো দই । সুহাসিনীর হাতে গাজরের হালুয়া ।

ফরিদা বেগম নিজেই তৈরি করেছেন ।

পিছনে পিছনে ঢুকলেন শওকত মিয়া ও তাদের দুই ছেলে সিপন, রিপন ।

মিসেস ফাহমিদা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসলেন হাত মুছতে মুছতে । তিনি হাসিমুখে অতিথিদের বরণ করে নিলেন ।

” আমি ভীষণ খুশি হলাম আপনারা কথা রেখেছেন ।

ভালবাসা, মেঘ, তোমরা আস । গল্প কর । বাবা আপনিও বসেন । কথা বলেন উনাদের সাথে ।

মেঘ তোমার বাবাকে আসতে বল ।

 

ফরিদা বেগম তার হাতের দৈয়ের হাড়িটি মিসেস ফাহমিদার কাছে এগিয়ে দিলেন। ফাহমিদা কৃতজ্ঞতা ভরে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি আছে এতে ভাবি ? ঘরে বানানো নিশ্চয়ই? “

” তেমন কিছূই না ভাবি । একটু দই বানিয়েছিলাম, আর গাজরের হালুয়া ।”

তিনি মেয়ের হাত থেকে গাজরের হালুয়ার বাক্সটি নিয়ে মিসেস ফাহমিদার কাছে দিলেন ।

” ভাবি এটা গাজরের হালুয়া ।”

” খালাম্ম আমার কাছে দেন । ফ্রিজে রাইখা দেই । “

অমরিতা । হিন্দু মেয়ে । এ বাড়িতে কাজ করে ।

মেঘ ও ভালবাসা তার কাছেই বড় হয়েছে। এ বাড়িতে তার ক্ষমতা অনেক । খালুজান, খালাম্মা দুজনেই তাকে ভালবাসেন । অমরিতা মনে করতে পারেন না তিনি এ বাড়িতে কাজ করেন ।

ভালবাসা এগিয়ে আসে । সুহাসিনীর দুই ভাইয়ের সাথে তার খুব ভালো বন্ধুত্ব । তারা এক সাথেই গান বাজনা করে । অবশ্য বাকের সাহেবের একদমই তা পছন্দ না । তিনি চান না মেয়ে গান বাজনা করুক ।

ভালবাসা এগিয়ে আসল । শওকত মিয়াকে সালাম দিয়ে বলল,

” চাচাজি কেমন আছেন? “

” খুব ভালো লাগছে মা । অবশেষে তোমাদের বাড়িতে এসেই গেলাম । “

” এখন থেকে যখন তখন চলে আসবেন চাচা । “

” আরে মা সময় কোথায় । কাজ করে খেতে হয় । “

 

ভালবাসা সুহাসিনীর দুই ভাইয়ের সাথে উপরের তলায় উঠে গেল ।

বাকের সাহেব স্যুট টাই পরে সামনে এলেন । আভিজাত্যের প্রতীক তিনি । তার বেশভূষায় তা জানান দেয়া চাই । তিনি শওকত মিয়ার সাথে হাত মেলালেন । বললেন,

আপনাদের কতো আগেই বলা দরকার ছিলো ।

অনুগ্রহ করে বসুন ।

খুব সুন্দর বাড়ি আপনাদের । মেঘের দাদাজান দরজা ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন ।

মেঘ সুহাসিনীর সামনে এসে দাঁড়ায় । সে নীচু করে বললো,

” কি খবর সুহাসিনী?”

 সুহাসিনী মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল ।

” তোমাকে সুন্দর লাগছে ।”

সুহাসিনী এ কথায় খুশি হতে পারল না । সে সোজা বললো,

তুমি ও মৃদুল লাইব্রেরিতে বসে যেসব কথা বলেছ আমার আর আমাদের পরিবার সম্পর্কে তা শুনেছি ।

সুতরাং আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না ।

এখনো,  কখনোই না । সে দ্রুত চলে যায় ।

মেঘ একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে ।

 

সুহাসিনীর বাবা ও মেঘের দাদাজান কথা বলছেন দাঁড়িয়ে । সুহাসিনী সদ্য এসে যোগ দিল । এ বাড়িতে তার এখন করার মতো তেমন কিছু নেই ।

 

” আমার কাছে মনে হয় তুমি এটি করতে পার ।”

” বেশ , কি বিষয়ে পরিষ্কার করে বললে বুঝতে সহজ হতো ।”

শওকত মিয়া বললেন মেঘের দাদাকে ।

সুহাসিনী যুক্ত হলো তাদের মাঝে । সে আলোচনার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না । দুই হাত বুকের মধ্যে ভাঁজ করে একেবারে বয়স্ক নানির মতো দাঁড়িয়ে আছে । কথা শুনছে না গিলছে । বাবা কি সব অবিরাম গতির মেশিনের কথা বলছেন । যা তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় । মেঘ নীরব দর্শকের ভূমিকায় দোতলায় উঠার সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে । একটু আগে সুহাসিনী ধামকি দিয়ে গেল ।

এ অবস্থায় বেহায়ার মতো তাদের মাঝে যাওয়া ঠিক হবে না । তবে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ।

তার বাড়িতে সে যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে । সে মনে মনে ভাবছে ,

” অবিরাম গতি ? এখানে আমি ভিতরে মরে যাচ্ছি, আর তারা সেখানে কথা বলছেন অবিরাম গতি নিয়ে । এবং সুহাসিনী কি করে জানলো এসব কিছু?

 

মিসেস ফরিদা টেবিলে খাবার রেডি করছেন । তিনি হাতের পায়েশের বাটিটি টেবিলের উপর রাখলেন ।

 

” এই যে খাবার তৈরি । চলে আসুন সবাই । এই এই!

ভালবাসা, রিপন, সিপনকে নিয়ে নীচে আস খেতে ।

বাবা চলে আসেন টেবিলে উনাদের নিয়ে ।

খাবার! সুহাসিনী সিঁড়ির পাশ দিয়ে যেতেই মেঘ কিছু একটা বললো । সুহাসিনী ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল । আহ, মেঘ । সে বললো, সুহাসিনী একটু কথা বলতে পারি ?

সুহাসিনী ফিরে আসে সিঁড়ির কাছে ।

মুখোমুখি দাঁড়ায় ।

মেঘ কোনো ভণিতা না করে সোজা বললো, ” মৃদুল যা বলেছে , তা ঠিক নয় । আমি জানি সেটা । “

 

” সে যখন বলেছিল তুমি তখন জানতে এটা সঠিক ছিল না? “

 

” জানতাম । আমি তাঁকে থামাতে চেয়েছিলাম ।

কিন্তু আমরা ছিলাম লাইব্রেরিতে । “

 

” সুতরাং তুমি তাকে সায় দিয়েছ আর হেসেছ । “

 

” হুম ।”

 

” তাহলে এখান থেকেই বুঝতে পারলাম তুমি একটা ভীতু । “

সুহাসিনী আর দাঁড়ায় না । সে সোজা খাবারের টেবিলে চলে গেল । মেঘ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ।

তারপর ক্লান্ত মনে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে একটি চেয়ার টেনে বসল ।

 

পুরো খাওয়ার সময়টা জুড়ে আমি সুহাসিনীর কাছাকাছি বসেছিলাম । আমার বাবা ঠিক বলেছেন ।

আমাদের উচিত ছিল বাড়ির বাইরে পিকনিকের আয়োজন করা ।

 

লম্বা টেবিল । এক মাথায় বাকের সাহেব বসেছেন । তার বাম দিকে পর পর চারটি চেয়ার । মিসেস ফাহমিদা স্বামীর পাশের চেয়ারে বসেছেন । তার পাশে বসেছেন শ্বশুর । মেঘ । অতঃপর ভালবাসা ।

অপর পাশে বসেছেন শওকত মিয়ার পরিবার ।

 

বিরাট আয়োজন করেছেন মিসেস ফাহমিদা । নানান পদ রান্না করেছেন । দেশী পদের সাথে বিদেশী পদ । শওকত মিয়া এই সব পদ দেখেন নাই কোনোদিন । ধনী মানুষ শুনছেন বিলিতি খাদ্য বেশি খেতে ভালোবাসেন । শওকত মিয়া দ্বিধান্বিত । কোন পদ দিয়ে শুরু করবেন ।

মিসেস ফাহমিদা সকলের উদ্দেশ্য বললেন, ” আমার খুব ভালো লাগছে এক সাথে সবাই খাচ্ছি । “

বাকের সাহেবের মুখ গম্ভীর । তিনি স্ত্রীর সাথে সুর মেলাতে পারলেন না । তিনি চাননি শওকত মিয়ার পরিবার এ বাড়িতে আসুক ।

কিন্তু তার গোয়ার গোছের স্ত্রীর সাথে তিনি পেরে ওঠেননি । তার রাগে এখন মাথা খারাপ অবস্থা ।

ইচ্ছা করছে ফাহমিদার মুখে এক গ্লাস পানি ছুঁড়ে মারতে । ফাহমিদা আবার বললেন,

” আমাদের বাড়িতে এই প্রথম খাবার টেবিলে এক সাথে অনেকে ।”

স্ত্রীর কথা শুনে বাকের সাহেব গলায় খাবার আটকে গেল । তিনি পানি খেলেন । বুকের মধ্যে হাত দিয়ে চাপ দিতে থাকেন । টেবিলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,

” ভুল জায়গা ।”

ফরিদা বেগম বললেন,

” ভালো কথা, আমরা কিন্তু খুশি হতে পারলাম না ভাইসাব । আমরা সবাই খুব রোমাঞ্চিত আপনাদের বাড়িতে এসে । “

শওকত মিয়া তার স্ত্রীর দিকে আড়চোখে দেখলেন । ফরিদা বেগমের কথায় বাকের পরিবার খুব আনন্দ পেল । তাদের হাসির ধরন দেখে তা অনুমান করা গেল ।

 

” সুহাসিনী তুমি তো খুব ভালো কাজ করতে পার ।

তোমাদের বাড়ির সামনের জায়গাটিতো এখন চেনাই যায় না । জংলা ঘাস কেটে দারুণ বাগান করলে । “

 

এই প্রথম বাকের সাহেব কথা বললেন । সুহাসিনী খুশি হয়ে বললো,

” ধন্যবাদ চাচা । দাদু আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন বাগানের কাজে । “

মেঘের দাদাজান সুহাসিনীর কথা শুনে, বাম হাত তুলে বুড়ো আঙ্গুল দেখালেন । এর মানে তিনি তেমন কিছুই করেননি ।

 

বাকের সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,

” আমি জানি । এর রহস্য কী বল দেখি ? বাড়িতে তো আব্বা কিছুই করতে চান না । এমন কি মেঘের সাথেও না ।

বাকের সাহেবের বাবা ছেলের কথায় কিছুই বললেন না । শুধু মাথা নাড়লেন । মুচকি হাসছেন । ফাহমিদা স্বামীকে থামাতে চাইলেন । তিনি স্ত্রীর দিকে অগ্নি চোখে চাইলেন একবার । তারপর হাত উঁচু করে বললেন,

” রসিকতা করছিলাম । “

সবাই এক সাথে হেসে উঠলো । কিন্তু শওকত মিয়া ও তার স্ত্রী বিষাদের হাসি হাসলেন ।

 

বাকের সাহেব শওকত মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” একটা বিষয় হলো, প্রতিবেশি জীবনে সত্যিই এসে পড়ল । এর অর্থ হলো, নতুন ঘরের আদল নিল । “

স্বামীর কথায় ফরিদা বেগম বললেন,

 

” কোন বিষয়ে ?”

 

” ঐ যে রাস্তার মোড়ের জঘন্য গাছের কথা বলছিলাম । গাছটা কাঁটার পর সেখানে সুন্দর ঘর উঠলো ।”

 

ছেলের বেফাঁস কথায় বাকের সাহেবের বাবা বললেন,

কি বলতেছ? গাছ কি করে জঘন্য হয়?

বাকের তুমি কথা শিখনাই । তোমার মা বেঁচে থাকলে এই বুড়া বয়সে একটা চড় খেতে ।

মেঘ দাদার কথা শেষ না হতে বললো, ” আমি বলবো ঐ গাছটি সবাই পছন্দ করত আমি ছাড়া । “

সে এটি ইচ্ছা করেই বলেছে । সে চায় না তাঁর বাবার বিপক্ষ নিতে ।

 

শওকত মিয়া পানির গ্লাস হাতে নেন । তার গলা শুকিয়ে আসছে । তিনি এক ঢোক পানি গেলেন ।

তারপর ভ্রু কুঁচকে বাকের সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আশেপাশের অনেক মানুষ মনে করত নিম গাছটি ছিল এই এলাকার জন্য রত্ন স্বরূপ । “

” হুম, বেশ, স্বাদের কোনো হিসেব হয় না । “

বাকের সাহেব দৃঢ়তার সাথে বুঝতে চাইলেন ।

এবার তিনি সুহাসিনীর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন । এখন তার নিশানা শওকত মিয়ার দুই ছেলে ।

 

ভালো কথা রিপন সিপন —

” তোমরা দুইজনে অতি শিগগিরই কলেজ শেষ করতে যাচ্ছ? “

” হুম, আল্লাহুর কৃপায় । “

দুই ভাই এক সঙ্গে উত্তর দিল ।

” যেভাবে বললে মনে হচ্ছে পড়া লেখা ভালো লাগে না । তাই কি? বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই? “

” আপনি কী রসিকতা করে বললেন চাচা? “

সিপন বললো ।

” না । বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমার জীবনে সব চাইতে মধুর সময় । “

” না , আমাদের কাছে তেমন কিছু মনে হয় না । “

হুম, আমরা কলেজেই সে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি ।” রিপন ছোট ভাইকে সমর্থন করে বললো ।

বাকের সাহেব একটু অপমান বোধ করলেও মনে মনে খুশি হলেন । মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরা অতি বিদ্যান শুনলে তার ভালো লাগে না ।

গরিব ধনী হয়ে গেলে, ধনীদের সন্মান দেখানোর মানুষ কই ।

” আচ্ছা । তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় আউট অফ সিলেবাস? “

” জি । তবে আমদের সূযোগ আছে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার । “

শওকত মিয়া গর্বের সাথে বললেন,

” ওরা দুই ভাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে । কিন্তু ওরা মনে করে গতানুগতিক শিক্ষার কদর কম । পাশ করার পর অনেক ছেলে মেয়ে বেকার থাকে । তারা তখন কেবল অপেক্ষা করে । ওরা দুজনেই সঙ্গীতে অতি মেধাবী । তাদের ইচ্ছা সঙ্গীত দল গঠন করা । আমরা তাদের পক্ষে আছি ।”

” ওহ ,তাই নাকি? তাহলে তো ভালোই । “

” দোয়া করবেন চাচা । মাস দুয়েকের মধ্যে আমাদের প্রথম এলবাম রিলিজ হচ্ছে । আধুনিক সময়ে দেশের জন্য সেরা গানটি আমরা উপহার দিতে চাই ।”

” সত্যি ?

জি ভাইসাব , ওরা আসলেই মেধাবী । দোয়া করবেন । ” ফরিদা বেগম বললেন ।

” ওরা তো এখনই সুপরিচিত বাবা । ওরা অসাধারণ কিছু গান রচনা করেছে । যা ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে । আসলেই ওরা গুণী শিল্পী তাতে সন্দেহ নেই। “

ভালবাসা ফরিদা বেগমের কথায় সায় দিয়ে বললো।

দুই ভাই খুশি হলো ভালবাসার কথায় ।

” ধন্যবাদ ভালবাসা ।”

 

” আমার বিয়ের পর দেখেছি, ওদের বাবাও ভালো গান গাইতেন । আমার ছোট দেবরের জন্মের পর শ্বশুর মশাইয়ের মন ভেঙ্গে যায় । ওদের বাবা তখন গান বাজনা ছেড়ে বাবার সাথে সংসারের হাল ধরেন । ” ফারিদা বেগম আক্ষেপ করে বললেন ।

ভালবাসা আশ্চর্য হয়ে বললো,

” আপনি গান গাইতেন?

ফরিদা বেগম মুখ এগিয়ে কিছুটা সামনের দিকে আসলো । যাতে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন । তিনি বললেন,

শুধু গান না । উনি ভালো তবলা বাজাতেন।

” তোমরা কি মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছ ? “

ফাহমিদা ছেলেদের কাছে জানতে চাইলেন ।

” বহুবার করেছি চাচি । ” সিপন উত্তর দিল ।

মেঘের একদমই ভালো লাগছে না এসব আলোচনা ।

সে দেখছে রিপন, সিপন এক নাগাড়ে তাদের বাদ্য বাজনা শোষণ করেই যাচ্ছে । এতে করে তার বাবার আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করা কমেছে । তিনি বেকায়দায় পড়ে শান্ত হয়েছেন । জোর করে মুখের হাসি বন্ধ রেখেছেন । কৃত্রিম গাম্ভীর্য । তলে তলে তিনি দুঃখ বোধ করছেন । দুঃখ করছেন আমাদের নিয়ে ।

ভালবাসা ও আমি । আমাদের বিশেষ কোনো প্রতিভা নেই ।

মিসেস ফাহমিদা বললেন,

” মেঘের বাবাও গান বাজনা করতেন আমার বিয়ের আগে । তিনি গিটার বাজাতেন । কিন্তু আমার আব্বা আম্মা খুব একটা পছন্দ করেননি । “

সেদিন আমাদের বাড়িতে দাওয়াতে সুহাসিনীর সাথে আমার তেমন কোন কথাই হলো না। পুরো সময়টা আমরা নিরব ছিলাম। যাওয়ার সময় সুহাসিনী সৌজন্য দেখিয়ে বললো,

” ধন্যবাদ মেঘ। তোমার আম্মুর নিমন্ত্রণ আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমরা সবাই অভিভূত তোমাদের আপ্যায়নে। দেখা হবে “

তার এই ক্ষমা প্রদর্শন আমাকে অধিকতর অস্বস্তিতে ফেলে।

সুহাসিনী একটু পিছনে পড়ে যায়। তার ভাই, বাবা মা বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। সে মেঘের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত দৌড়াতে থাকে বাকিদের নাগাল পেতে।

” এই আমার জন্য অপেক্ষা কর। “

মেঘ ভাবে সুহাসিনী তাকে এখনো ক্ষমা করতে পারেনি। সে নিজেকে খুব গুরুত্বহীন মনে করে।

সে অযোগ্য সুহাসিনীর জন্য। এমনকি তার বন্ধু মৃদুলের চাইতেও। মেঘের মা অথিতি চলে যাবার পর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত। তিনি টেবিল থেকে বেশি হওয়া খাবার বক্সে ভরে ফ্রিজে তুলে রাখছেন।তিনি স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” আমার মনে হল উনারা খুব আমোদে মানুষ। পরিবারের মধ্য একটি মধুর সম্পর্ক আছে। তুমি কি মনে কর? ছেলে দুটোতো অসাধারণ। আমি রীতিমত হতভম্ব। অসম্ভব রকমের মেধাবী। “

ফাহমিদার শ্বশুর পুত্রবধূর সাথে গলা মিলালেন,

বিশেষ করে ছেলে দুটি। বাকের সাহেবের মুখ গম্ভীর।

তিনি রাগান্বিত ভাবে বললেন , “হুম, মেধাবী না আড্ডাবাজি।”

পুত্রের মুখে এরকম কথা শুনে তিনি আঁতকে উঠলেন।

“কি? “

ভালবাসা বাবার দিকে আশ্চর্যের ভঙ্গিতে তাকাল।

সে জানে বাবা ভীষণ রকমের বিব্রতকর মানুষ। তিনি অন্যের প্রশংসা নিতে পারেন না।

অস্থিরতায় ভোগেন। মাথায় যন্ত্রণা করে। বাকের সাহেব এখন যন্ত্রণার মধ্যে আছেন।

নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে তিনি ছেলেকে বললেন,

” পৃথিবীর উৎকৃষ্ট মানুষ কেবল তুমি। যে অন্যের ভালো নিতে জানে না।”

 

তোমাদের টেপরেকর্ডার বাজানো বন্ধ হলে শান্তি পাই। আর আব্বা শোনেন, নিজের ছেলের নাতিপুতির প্রশংসা করেন। শওকত মিয়ার গুণগান করে লাভ কী? থাকবেন খাবেন তো আমার সাথে। “

” মেঘের বাবা তোমার মাথা ঠিক আছে? কী বলছো খেয়াল আছে? বাবা তো ঠিকই বলেছেন, তুমি মানুষকে দোষারোপ করাই শিখেছ। মানুষকে ভালোবাসতে শেখো। “

” অতি সরল মানুষের ভাব দেখাতে এসো না ফাহমিদা। তুমি কি জিনিস আমিও জানি।

তোমার কোনো ধারণা আছে গান রেকর্ডিং করা কতোটা ব্যয়বহুল? আমার ধারণা ছেলেরা কোনো অবৈধ কাজে নিযুক্ত । “

ভালবাসা ভয়ানক রেগে গেল। সে মুখ ফসকে বলে বসল,” তুমি একটা অশ্লীল নীচুস্তরের মানুষ বাবা। ছিঃ,”

বাকের সাহেব মেয়ের গালে ঠাস করে চড় মেরে বললেন, “তোমার কী সমস্যা? হুম। “

ভালবাসা হতভম্ব। জীবনের প্রথম চড় বাবার কাছ থেকে। তাও এই বয়সে।

মিসেস ফাহমিদা টেবিল থেকে গ্লাস তুলে ছুঁড়ে মারলেন মেঝেতে। কাচেঁর টুকরো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। মেঘ নিশ্চুপ। তাঁর কথা বলার শক্তি নেই।

সুহাসিনী ঠিক বলেছে। সে কাপুরুষ!

ভালবাসা রক্তাক্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ । তারপর দোতলায় উঠতে উঠতে বললো, “তোমার মরা উচিত। “

বাকের সাহেব পিছন পিছন সিঁড়ি পর্যন্ত যান।

তিনি চিৎকার করতে থাকেন। বলতে থাকেন, বেয়াদবির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি মেয়ে।

তিনি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ান । মিসেস ফাহমিদা স্বামীর শার্টের কলার চেপে ধরলেন।

” থাম তুমি! উপরে যাচ্ছ কেনো মেয়ের পিছন পিছন? “

” তোমার মেয়ে কী বললো শোনোনি? আজ পর্যন্ত কোনো মানুষের সাহস হয়নি এমন কথা বলার।

 আমার খেয়ে পরে পরের জন্য দরদ দেখাও?”

মেঘ তার দাদাজান কে নিয়ে চলে গেল তার রুমের দিকে। গণি সাহেবের মুখ মলিন। ছেলের বদমেজাজ ছোটবেলা থেকেই। আদর যত্ন করে বড় করেছেন। বিদেশে পাঠিয়ে থেকে শিক্ষিত করেছেন। বৃদ্ধ বয়সে এসব দেখতে হয় এখন ।

ওদিকে মিসেস ফাহমিদা স্বামীকে থাম থাম বলেই যাচ্ছেন। কিন্ত থামাথামির নাম নেই। মেঘ তার বাবার বদমেজাজ দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

এসব তার গায়ে লাগে না। বাবা যখন মেজাজ দেখান মেঘ কানের কপাট বন্ধ করে দেয়। সে তখন বধির।

ভালবাসা কপাট বন্ধ করতে জানে না। তাই বরাবর তাদের যুদ্ধ বাধে। তবে এবারের যুদ্ধ ভয়াবহ।

মেঘের ধারণা বাবার আজকের রাগ আগের সকল রাগের রেকর্ড ভেঙেছে। নয় নম্বর সংকেত চলছে বাড়িতে।

সে রাতে আমি বিছানায় শুয়ে অনেক ভেবেছি। আমার প্রতিবার মনে হয়েছে বাবা অত্যন্ত কায়দা করে শওকত মিয়ার পরিবারকে ছোট করেছে। সুযোগ পেলেই তিনি করেন। বাবা মনে করেন শওকত মিয়া হলো ময়লার রাখার পাত্র । আর তাদের সন্তানরা সেই পাত্রের আবর্জনা ।

তিনি ময়লার পাত্র ও আবর্জনা বাড়িতে অতিথি হিসেবে দেখতে চাননি। তাছাড়া শওকত মিয়ার দুই পুত্র রিপন ও শিপনের সাথে ভালবাসার বন্ধুত্ব বাবার অপছন্দ। তিনি চান না ভালবাসা ওদের সাথে মিশুক।

এক সাথে গান বাজনা করুক।

শওকত মিয়া যখন মেয়ের জন্য ছবি আঁকছেন বাড়ির সামনের উঠোনে বসে। বাবা তখন উপহাস করছিলেন। বাবা আসলে একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ। কিন্ত কেনো? সুহাসিনী আমাকে ভীরু মনে করে। তাহলে সম্ভবত বাবাও কাপুরুষ, ভীতু। ভয় তাকে অন্যের প্রতি নির্দয় হতে আগ্রহী করছে।

আসলেই কি? আমি ঠিক জানি না। ঠিক বুঝতে পারি না । কি পার্থক্য আছে এর মধ্যে?

সুহাসিনী ছিল না আমার জীবনে। অথবা সুনির্দিষ্টভাবে। আমি তার থেকে দৃরেই ছিলাম

সব সময় ।

 

১৫//

যখন আমি মেঘেদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম ,আমার চোখের সামনে ছিল দেয়ালে টানানো

বাবার আঁকা বাধাই করা নিমগাছের ছবিটি। কী উজ্জ্বল দেখতে লাগছে। জীবন্ত গাছের মতোই।

মনে হচ্ছিল মেঘ কখনোই আমার বন্ধু হতে পারেনি।

কখনোই না। গাছ রক্ষা করার জন্য যখন আমি অস্থির ছিলাম। কাউকে খুব শক্ত করে পাশে পেতে চেয়েছিলাম। মেঘ তখন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। আমার দেয়া মুরগির ডিম সে আবর্জনার মধ্যে ফেলেছে। আর সে আমার প্রতিবন্ধী চাচাকে নিয়ে হাস্যকর কথা বলেছে মৃদুলের সাথে গ্রন্থাগারে বসে।

যেহেতু মা চাইছেন আমরা সবাই সে বাড়িতে যাই। তাই না গিয়ে উপায় ছিল না। মা ডাকাডাকি শুরু করলেন। সুতরাং যেতেই হবে। আমার মনে হল মাকে বলা দরকার কেনো আমি যেতে চাইছি না সে বাড়িতে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মাকে সব কিছুই খুলে বলবো। কিন্ত মা ততক্ষণে প্রস্তুত। তিনি নিজের হাতে তৈরি করা দইয়ের হাড়ি বাবাকে দিচ্ছেন। মা বাবাকে বলছেন ,

” জলদি ধর । আমার খোপা ঠিক করতে হবে ।”

আমার দুই ভাই নিজেদের সাজগোজ নিয়ে পড়ে আছে। ঐ বাড়িতে কি নিতে হবে না নিতে হবে এসব বিষয় তাদের নয়। তাদের বড়লোক বান্ধবীর বাড়িতে দাওয়াত সেই খুশির আমেজে বিভোর তারা। মায়ের দিকে নজর নেই। বাবা মাকে বলছেন, ” তোমার চুল একদম ঠিক আছে। আসলেই ঠিক আছে। “

” তাই ,ঠিক বলছো?

বাবা আমাকে ডাকলেন। সুহাসিনী দেখতো মা তোর মায়ের চুল ঠিক আছে না? আমি দেখলাম মায়ের সেকি আনন্দ! মনে হচ্ছিল আমার বিয়ে লেগেছে। শুনেছি মায়েরা মেয়ের বিয়ের সময়

আনন্দে অস্থির থাকে। আমার মাও এখন অস্থির আছেন। আমি দেখছি মা দইয়ের পাতিল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। আমি আর পারলামনা না ধরে।

” ও, ওহ , ও আল্লা। ধর ধর । পড়ে যাচ্ছে। “

মা বাঁচলেন পাতিল আমার হাতে দিয়ে।

বাবার হাতে গাজরের হালুয়ার বক্স দিতে চাইলেন।

আমি এসব নিতে পারবো না । তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন।

অবশেষে মায়ের কাছেই থাকল। মা তাড়া দিচ্ছেন সবাইকে বের হতে।

” কই ছেলেরা বের হও ” । এতকিছু ঘটে যাবার পরেও আমি স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করেছি মেঘের সাথে। আমি শুধু এটুকুই বলেছি, ” আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না মেঘ। এখন এমনকি আর কখনোই না। আমি খুশি হলাম বলে। নিজেকে হালকা লাগছে এখন। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।

নিজের অনুভূতিকে শান্ত করলাম। যা বলেছি ভেবেই বলেছি। অতএব আমাকে শক্ত থাকতে হবে মেঘের সামনে। যে করেই হোক । এবং আমি নিজের মনকে স্থির করলাম। আশ্বস্ত করলাম পুরো সময় তার সাথে কথা বলব না। খাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যেনো একদল অপরিচিত মানুষের সাথে বসে আমি খাচ্ছি।

অনেকগুলি বছর ধরেই আমরা পাশাপাশি বাড়িতে বসবাস করে আসছি। কিন্ত তার দাদাকে ছাড়া বলতে গেলে এ বাড়ির অন্য কাউকেই তেমন জানা নেই। মেঘের বাবা বাকের সাহেব বাইরে থেকে দেখতে পরিপাটি শান্ত স্বভাবের মানুষ।

কিন্ত তার মুখ দেখে মনে হলো , ভিতরে কিছু একটা ঘটছে উনার। পৃষ্ঠতল থেকে পচা গন্ধ বাইরে ঠেলে বের হতে চাইছে। আমার অনুভূতি থেকে সেদিনের সময়গুলো বিচ্ছিন্ন করেছি, থেকেছি অতি সাধারণভাবে। আনন্দদায়ক কিছু নেই। অবশিষ্ট রাগ নেই। কিছুই নেই এখন।

মেঘদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একথাগুলোই বলেছিলাম। সে রাতে আমার

নিষ্কন্টক ঘুম হয়েছিল। আমি প্রশান্তি নিয়ে বিছানায় গিয়েছিলাম। মেঘের সাথে কথা শেষ করে যখন আমি দৌড়ে বাকিদের নাগালে যেতে চাই বাবা তখন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। বাবা আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন,

“মন ভালো গো মা?”

আমি কৃতজ্ঞ এমন পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ।

মেঘ আমার প্রতি মনোযোগী নয় এই ভেবে দুঃখ হলো না। আমি বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

শাহানাজ শাহীন
শাহানাজ শাহীন