জব্স সাহেবের পিন / নাসিমা আনিস

জব্স সাহেবের পিন / নাসিমা আনিস

জব্স সাহেবের পিন / নাসিমা আনিস

জব্স সাহেবের পিন / নাসিমা আনিস

 

 সাবিনাকে যখন ডাক্তারের কাছে নেয়া হয় তখন ওর বয়স ঊনপঞ্চাশ, দু’একটা জায়গায় চাকরি করে শেষ পর্যন্ত এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিনিয়ার কেমিস্ট। ঊনপঞ্চাশের সাথে পাগলামির যোগ আছে বলেই যে ঘটনাটা তার ঊনপঞ্চাশেই এসে ঘটলো তা কিন্তু বলা যাবে না। ঘটনার বীজ বপন ও বিকাশ বহু বছরের প্রক্রিয়া। অতি আবশ্যক হওয়ায় জানাজানিও হলো মাত্র কয়েকদিন।  বিয়ের বয়স ত্রিশ হয়েছে অতি সম্প্রতি, সে হিসাবে বলা যায় তার বাল্যবিবাহই হয়েছিল। বিয়ের আগে সে কেমিস্ট ছিল না, কেমিস্ট হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কেবল। মানে প্রথম বর্ষ অনার্স,  রসায়ন শাস্ত্র। স্বামীর ঘরে বসে শেষ পর্যন্ত কেমিস্ট হতে কী কী গঞ্জনা সইতে হয়েছে সে সব এ গল্পের অংশ নয় বিধায় উহ্য রইলো। তো এখন ডাক্তার তাকে প্রথমই ইনজেকশান দিবে, পার্কিনিল ট্যাবলেট দিবে, ভিটামিন দিবে, সঙ্গে আরো কী কী ওষুধ দিবে সে সব গল্পও পাঠকদের আদৌ কোন কাজে লাগবে না। সমস্যা হলে, মনোচিকিৎসকের কাছে গেলে, মানে যদি যেতেই হয় আপনাদের কারো, ডাক্তারই প্রয়োজন মত উপযুক্ত ডোজ দিবে। তবে, অসুস্থ হওয়ার আগে জানাই, গ্রিনরোডের বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় এই ডাক্তারের কাছে গেলে রোগী হিসাবে আপনার, থুড়ি, কারো তেমন কোন অসুবিধা নাই, যত অসুবিধা ঐ রোগীর সঙ্গে যারা ছয়টায় গিয়ে রাত সাড়ে দশটায় ডাক্তার দেখাতে পারেন তার। ক্লান্তিকর অপেক্ষা কাকে বলে! যদিও আপনি তিনদিন আগে সিরিয়াল দিয়ে জেনে নিয়েছিলেন সময়টা। যদিও আপনি ডাক্তারের পদবী প্রশ্ন না তুলেই জমা দিয়েছিলেন আটশত ত্রিশ টাকা। হ্যাঁ, ত্রিশ টাকা সরকারি কর, তিনি কষ্ট করে শতপাঁচেক রোগীও দেখবেন আবার আপনার করও দিবেন, এটা তো ঠিক না, তাই না! সে যাক্, বিনোদন খানেক আপনি নিতে পারেন যদি রোগী আপনার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন। আপনি নির্ভার অন্য সব রোগীদের পাগলামি দেখে কিংবা রোগীর আত্মীয়ের কাছ থেকে তার রোগীর ইন্টারেস্টিং কেস হিস্ট্রি নিয়ে  অতিবাহিত করে দিতে পারেন সময়টা । ভাবছেন কেন তারা বলবেন! বলবেন, কারণ তাদেরও তো খুব মন খারাপ আর হাতে অফুরান সময়। আরো একটা কারণ আছে, এই সব রোগ অন্য যে কোন রোগ থেকে আলাদা। এ রোগটা হল সেই রোগ, যা কিনা অনাত্মীয় বা অপরিচিতকে কিছুটা বলা গেলেও পরিচিত কাউকে বলাই যায় না বিলকুল। বললে কী হবে? সে আপনি বলেই দেখেন না, কী হয়! মানসিক সমস্যা নিয়ে অদ্ভুত আচরণ করুন, কিছ্ছু অসুবিধা নাই কিন্তু মানসিক চিকিৎসা নিতে গেছেন শুনলে আপনি পরদিনই পাগল অভিধা পেয়ে যাবেন, গ্যারান্টি!

 তো সাবিনার গল্প করছিলাম। গত তিন বছর ধরে তার প্রায়ই মনে হয়েছে তার স্বামী তার গায়ের সঙ্গে একটা অতি সূক্ষ্ম ভিডিও রেকর্ডার লাগিয়ে রেখেছেন কিংবা তার মনে হয় কেন এমন একটা রেকর্ডার তার স্বামী লাগিয়ে রাখছেন না! রাখলেই তো সব সন্দেহের অবসান হয়। না, স্বামী তা করেন নি, মানে কোন ক্লিপ-টিলিপ লাগিয়ে রাখেননি। এমন কি তা করার চিন্তাও করেন নি। করবেন কি করে, এমন যন্ত্র আছে নাকি!  কাউকে না জানিয়ে তার গায়ে লাগিয়ে দিবেন আর সে বিলকুল টেরই পাবে না! ইস, আবিষ্কার বিষয়টা এখনও প্রাগৈতিহাসিক যুগেই রয়ে গেল, সাবিনা বার বার ভেবেছে। সামান্য একটা পিন তারা আবিষ্কার করতে পারল না! স্টিভ জব্সের অ্যাপল কোম্পানি নিদেনপক্ষে ভাবতে পারতো! তাঁর কোম্পানির তো ভাবনা আর কাজের মধ্যে সামান্যই তফাৎ! নাকি ভেবেছে এবং আবিষ্কারও করেছে শুধু তৃতীয় বিশ্বের ভোঁতা বধির লোকদের জন্য তা এখনও সাপ্লাই করা হয়নি! একটা পিন, আলপিনের মত, বা তারচেয়ে একটু বড়ো, কাপড়ের গায়ে আছে কি নাই বোঝার উপায় নাই, যেটা কিনা একটা শাড়ি বা কামিজে গেঁথে দিবে ভোরবেলা, সাবিনা অফিসে যাবার আগে। সাবিনা অফিসে গিয়ে কাজ করবে, ব্যাগ খুলে খাবার খাবে, হারুনকে ডেকে চা বা কফি বানিয়ে খাবে, বসের ঘরে গিয়ে বসের ধ্যাতানি খাবে, ওয়াশরুমে গিয়ে কষ্টকাঠিন্যের বর্জ্য ত্যাগ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলবে, বেরিয়ে এসে কুলকুল করে ঘামতে থাকবে, ঘামতে ঘামতে বসের ফাইলে মুখ গুজে পড়ে থাকবে, ইস্ শাড়িটা কি টাটকা রক্তে ভিজে যাচ্ছে! দু’একবার উঠে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টাও হবে।  খেতে গিয়ে জ্বর জ্বর লাগবে, জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে খেতে হবে, না খেয়ে উপায় কি, নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়েই তো এখনো আধাবেলা কাজ করে বাসায় ফিরে… যা হোক এখন যাবে মিটিং-এ, আনএন্ডিং মিটিং, ঘড়িতে সাতটা, খোদা, এরা একই কথা কতবার বলবে! আর সন্ধ্যায় কিংবা রাতে ও কাপড় ছেড়ে যখন রান্নাঘরে গিয়ে রুটি বানাতে শুরু করবে তখন নিশ্চিন্ত হয়ে সেই পিনটা খুলে নিবেন তিনি, নিক, দেখুক এক দুঃখী নারীর প্রাত্যহিক, অবিরাম শ্রম ঘাম…রক্তপাত। পরদিন যখন স্ত্রী অফিসে যাবে তখন আরাম করে ল্যাপটপে কিংবা ডেক্সটপে লাগিয়ে দেখে নিবেন, বাব্বাহ, বাসায় চেহারা বাংলার পাঁচ হলে কি হবে, কলিগদের সঙ্গে কি হেসে হেসে কথা! কিংবা ল্যাবে…, হ্যাঁ হ্যাঁ এর সাথেই তো বাসায়ও কথা বলে, কী যেন নাম… বাসার সাহেব। মেয়েছেলেদের মত চেহারা, না হিংসা না, এ নাকি সাবিনার ছেলের বয়সী, রীতিমত প্রেমিক চেহারা নিয়ে ল্যাবে বসে আছে মুখোমুখি, যত্তসব! ধোঁকা দেয়ার তো একটাই বুদ্ধি পেয়েছ, কিনা, ছেলের বয়সি সব কলিগ..। বছর দশেক আগে বলতো, বাপের বয়সি…। 

 বিকাল ঠিক পাঁচটায় একটা ফোন, ল্যাবে কাজ করছিল রিসার্চ এ্যসিসটেন্টরা, সাবিনা ফাইল দেখতে দেখতে গান শুনছিল মোবাইল ফোনে, কেন গো আপনও মনে, ভ্রমিছ বনে বনে, সুনীল দু’নয়নে কিসেরও দুঃখে, কমলা দিতেছে আসি রতনও রাশি রাশি, ফুটুক তবে হাসি মলিন মুখে,’ বন্যার বেদনা ঝরে পড়ার আগে রিং টোনটা বেজে ওঠে রিমঝিমিয়ে। সাবিনা ফোনটা কানে লাগিয়ে বলে উঠলো, হ্যালো, বলো। ওপার নিঃশব্দ। সাবিনা আরেকবার বললো, হ্যাঁ, বলো! ওপার নিঃশব্দ। সাবিনা ফোনটা কেটে দিয়ে ফোন করতে চাইল। তার মোবাইলে ঊনিশ টাকা আছে, কথা বলার জন্য যথেষ্ট। তার আগে গানটা বন্ধ করতে হবে, ফোনে ঢুকতে হবে তাড়াতাড়ি। ততক্ষণে আবার ফোন।  হ্যাঁ, বলো।  কোথায়! ল্যাবে, আমার বেরুতে বেরুতে ছয়টা বেজে যাবে, ল্যাবে কাজ চলছে, এখনও এক ঘন্টা থাকতে হবে। 

ওপার থেকে কোন কথা নাই, ফোনটা কেটে দিয়েছে। সাবিনা ভাবলো যাক বলা গেছে যে অফিস থেকে এক ঘণ্টা পর বেরুবে। সাবিনার অফিস থেকে বাসা এমন কিছু দূর না। রিক্সায় মাত্র পনের টাকা, হেঁটে গেলে পনের মিনিট। রিসার্চ এ্যাসিসটেন্ট ছেলেমেয়েগুলো কলকল করে গিয়ে লিফট ধরলো। ওরা চলে গেলেও সাবিনার নিচে গিয়ে তিনটা ফাইল বসকে দিয়ে বেরুতে বেরুতে যথার্থই ছয়টার কাছাকাছি বেজে যাবে নিশ্চিতভাবে। আবার ফোন।  হ্যাঁ, বলো। 

 প্রথমবার ফোনটা কেটে দিলে কেন! তখনই তো বলতে পারতে ল্যাবে কাজ করছো, বেরুতে ছয়টা বাজবে! 

 তোমাকে শুনতে পাচ্ছিলাম না তাই কেটে দিয়েছি।

 তুমি ফোনটা কাটলে কেন? ফোনটা আমি করেছিলাম, তাই না!

 এখন তোমার কথা শেষ হলে রাখো। 

সত্যি ফোনটা রেখে দিল। ল্যাবের কেয়ারটেকার ছেলেটা কাছে আসছিল কিছু জিজ্ঞাসা করতে, সে পিছিয়ে গেল। এই রকম ঘটনা গত তিন বছর। কয়েকদিন আগে আরেকটা ঘটনা। সারাদিন ম্যারাথন মিটিং ছিল। বাড়ি আসতে সাতটা। শীতের বেলা, সাতটা মানে অনেক রাত। বাসায় ফিরে রাতের রুটি সবজি রেঁধে খেয়ে আগে আগে শুয়ে পড়েছে সাবিনা। ফোন এলো একটা রাত সোয়া এগারটায়। স্বামীও কেবল ঘুমাতে এসেছেন। ঘুম ভেঙে গেলে সাবিনা বালিশের নিচ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে বসের ফোন। এত রাতে বসের ফোন! সাবিনা ফোনটা কেটে দিয়ে ফের বালিশের নিচে চালান দেয়। ফোন মাথার নিচেই থাকে কারণ এলার্ম দেয়া সকাল ছয়টায়। এই রুটিন তার, ভোরে না উঠলে সব এলোমেলো। তিনি বিছানায় শুতে শুতে জিজ্ঞাসা করলেন, কে?  সাবিনা নিরাসক্ত গলায় বলে, জানি না, কেটে দিয়েছি। 

এখন প্রশ্ন হলো সাবিনা কেন মিথ্যা কথা বললো! তাই তো! কারণ এর আগে বস যখন ফোন করতো তখন রাত হলেও কোন সমস্যা নাই। কারণ বস অবশ্যই সাবিনার স্বামীর সঙ্গে হ্যালো করতেন। ইদানিং তিনি তা করেন না। সাবিনা প্রলেপ দেয়, ‘বসের বয়স হয়েছে, মাথার ঠিক নাই’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে উনি আরো রেগে যান। বয়স হয়েছে মানে কী! চৌষট্টি বছর তো কী! হুমায়ুন সাহেব কী করলেন! আর রাতে কেন ফোন করে ফাইলের কথা জিজ্ঞাসা করবেন! অফিসের সময় কী করেন! যত্তসব, আমার কী কোন প্রাইভেসি থাকতে নেই! কত উটকো ফোন আসে!

 যদিও সে সব নিয়েও গবেষণা করেন তিনি। রিটায়ার মানুষ, ভালো একটা কম্ম জুটেছে বটে! কিন্তু সে রাতে বেশ কাণ্ড হলো। রাত তিনটার সময় সাবিনাকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসা করা হলো, তোমার বস ফোন করলো তুমি কথা না বলে কেটে দিলে কেন! আর আমাকে মিথ্যা কথা বললে, ব্যাপার কী? মিথ্যা কথা বলবে না সাবিনা! তুমি কিন্তু বলেছো তুমি মিথ্যা কথা বলা ছেড়ে দিয়েছো!

সাবিনা আজ মিথ্যা বলেছে এটা তো সত্যিই। উনি ফোন চেক করেছেন, স্বামী তা পারেনই। পারেন কি! পারেন, পারেন। একশ’ বার পারেন। তো এবার সাবিনা কী উত্তর দিবে স্বামীকে, কী উত্তর দিবে ফোন কেটে দেয়ার জন্য পরদিন বসকে! তিনি ভীষণ রেগে আছেন, চোখ দুটো করমচার মত লাল, কাঁপছেন। সাবিনা ভাবলো, এটা একটা চ্যালেঞ্জ, মোকাবেলা করতে হবে ভালোভাবে, না রেগে, না ভয় পেয়ে এবং সত্যি কথা বলে।

  দেখ, ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, কাল একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, হয়তো কিছু রিভাইজ ওনার মনে পড়েছে কিন্তু আমি অফিসে গিয়ে কাল শুনবো। আর এখন, প্রথমতঃ আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল, দ্বিতীয়তঃ এত রাতে উনি কেন ফোন করে কথা বলবেন, তোমার প্রাইভেসি নষ্ট করে, সে জন্য তুমি হৈচৈ করে আমার সারারাতের ঘুমটা নষ্ট করে দিতে। আমি ভাবলাম সব দিক থেকে রক্ষা পায় যদি বলি অপরিচিত নাম্বার, তুমি ফোন চেক করবে বুঝতে পারিনি।

 এ সব কবে থেকে শুরু করেছ?

 কোন সব?

 তুমুল মিথ্যা বলা!

 দেখ, মিথ্যা আমি ছোট বয়সে বলেছি।  বাচ্চাকে ওষুধ খাইয়েছ? আমি ভয়ের চোটে বলতাম, হ্যাঁ খাইয়েছি। তারপর দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে বাচ্চাকে ওষুধ খাওয়াতাম, তুমি এনকোয়ারি করতে, মিথ্যা বলার জন্য ভর্ৎসনা করতে। আমার বয়স তখন মাত্র তেইশ ছিল, তোমাকে ভয় পেতাম। এখন আমার পঞ্চাশ। আমি আর তোমাকে সেভাবে ভয় পাই না। মিথ্যা বলার দরকার নাই।

 তা হলে আজকে কী করলে? কেন মিথ্যা বললে?            

  আমি একটু ঘুমাতে চেয়েছিলাম, বিশ্বাস করো। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, ওরা শুনলে খারাপ হবে। প্লিজ, এ সব করো না।  

 অফিসে রাত সাতটা পর্যন্ত দেখা হয়, তাতে ব্যাটার হয় না!

 আমার বয়স পঞ্চাশ, আমার কলিগরা আমার ছেলের বয়সি, আমার বস বয়স্ক মানুষ, ছি ছি।

 ছেলের বয়সী! তো! তারা খুব সৎ, তোমাকে মায়ের চোখে দেখে, এই তো!

ঘুমাতে ঘুমাতে রাত শেষ হয়ে আসবে, তিনবার পানি পান, তিনবার জল বিয়োগ, একবার নিওটেক। শেষ রাতে ঘুমের মধ্যে আশরাফকে বকেই যাচ্ছে, আশরাফ সাহেব, ওষুধের কম্পনেন্ট জানেন কিন্তু বসের কম্পনেন্ট বোঝেন না! ফ্যাক্টরিতে গিয়ে একবার ঘুরে আসতে কী হয়! স্যার মহাক্ষাপ্পা হয়ে আছেন। তারপর আরো কথা, ঘুম খানেক পাতলা হয়ে এলে মনে আসে বেদনা, প্রাণের কান্নার স্রোত হেঁচকি দিয়ে বেরিয়ে আসে। কান্নায় ঘুম আরো একটু পাতলা হয়ে এলে মনে হয় উনি কী আমার গায়ে হাতটা দিয়ে একবার ডাকতে পারেন না, এই কান্না করছো কেন! না, কেউ ডাকে না। সাবিনার ঘুম পুরো ভেঙে গেলে দেখে তিনি পা নাচাচ্ছেন, মানে তিনি বিলকুল নিদ্রাহীন। মানে সাবিনার ঘুমের কথা, কান্না সবই তিনি শুনেছেন। তারপর সকালে কি সন্ধ্যায় মুড ভালো থাকলে বলবেন, রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে কতো কথা যে বলো! 

 কী বলেছি!

 বলেছো যা বলার। 

 একটা বলো!

নিশ্চুপ এড়িয়ে গেলেন, রেখে গেলেন খচখচ কাঁটা কয়টা। মানে কী! অফিসে যা ফস্টিনস্টি করি সেসব ঘুমের ঘোরে আবৃত্তি করি! তাহলে তো ঘুমের ঘোরেও সাবধান হতে হবে। কিন্তু সাবিনার ঘুমে কথা বলা অব্যাহত রইলো। ক্রমে তা বাড়লো এবং এক সময় জেগেও কথা বলা শুরু হলো এবং অফিস বন্ধ দেয় প্রায়ই।

 সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যখন রিক্সা খুঁজছে, দেখে পোর্চের ডানদিকে বাগানে ডেভলাপারের নাম খচিত চকচকে সিরামিকের নিচে সারারাত বৃষ্টিধোয়া ধবধবে বেলি ঈশারায় তাকে ডাকছে। তিনটি ফুল, দুইটা কুড়ি, দুইটা ঘনসবুজ পাতা।   দুই ডাঁটাসহ কেটে নিয়ে পন্টেলের গোড়ায় গুঁজে রিক্সায় পা ওঠাবে সে। রিক্সাওয়ালা তার ফুল গোঁজা দেখে, এ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার ফুল ছেঁড়া দেখে। এমনকি, কে জানে, তিন তলা থেকে তিনিও দেখছেন কিনা। রিক্সা চলতে শুরু করলে শুরু হবে একটা খঁচখঁচানি। ফুল ছেঁড়াটা তার ন্যায্যই হয়েছে তা নিয়ে নয়। কেননা গাছটা সে রুয়েছে, চায়ের পরিত্যক্ত পাতা বুয়াকে দিয়ে গাছের গোড়ায় পাঠিয়েছে, বৃষ্টিতে গোড়ার মাটি সরে গেলে গোড়ায় মাটি তুলে দিতে বলেছে কেয়ারটেকারকে। তো ফুলের অধিকার তার ষোলয়ানা। আর সব তো ছিঁড়ছে না, মোটে তিনটা। তো ফুলপাতা এখন পন্টেলে লটকে সুগন্ধময় প্রভা ছড়াচ্ছে রিক্সায়, সাবিনার মনে। কিন্তু মনে কিছু কীট, কিটকিট!

রিক্সাটা গলি ছেড়ে বড়ো রাস্তায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি ডালপালা মেলে,  কী, রোজ রোজ তুমি ফুল মাথায় দিয়ে কলিগদের দেখাও, প্রগলভতার চূড়ান্ত, না!  কে আমার ফুল দেখার জন্য বসে আছে বলত!  আছে, আছে, আমার চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টা করো না সাবিনা!

 ব্লাউজে, নাকি শাড়িতে, নাকি শাড়ির আঁচলে, কোথায় সেই পিনটা, কোথায়! পৃথিবীর আধুনিকতম পিন। ভোগে আবার তৃতীয় বিশ্ব কী, ভোগে সব সমান। গরিব তো দেশ, মানুষ তো ধনীই। জব্স সাহেব এ দেশে জব্স পিন পাঠাবেন না কেনো! 

কলিগরা ফুল দেখে বলবে, বাহ্ ম্যাডাম, কে বলবে নানি হয়েছেন! এখনো জ্বলজ্বলে ত্বক জেল্লা দেয়। বস কিছু বলবেনই না? বলবেন। গাড়ল গলায় বলবেন, বাহ্ সুন্দর তো জবা ফুলটা! কিংবা ফুলের রংটা কোন ঔষধের রঙ সেটা মনে করার চেষ্টা করে বোকার মত তাকিয়ে থেকে ত্বরান্বিত করবেন সাবিনার ভরাডুবি ।

আজকাল শাড়ির সঙ্গে টিপ দিতে গিয়ে মনে হয় তিনি তাকিয়ে আছেন, সাবিনা লাল কি কালো কিংবা রবিন লিকুইড ব্লু টিপ দিতে দিতে বহু দিন ভেবেছে তিনি টিপের গল্পটা কতদূর নিতে পারবেন! বাসার কী সাব্বির আমার কপালের দিকে তাকিয়ে বোকা হয়ে রবিন লিকুইড রং আসলে কী রং সেটা ভাবতে চেষ্টা করতে করতে যখন হয়রান হবে ঠিক তখনই পিনটা তাক করে ধরবে, আচ্ছা এই তাহলে! কম্পিউটারের পর্দা এতটাই বিশ্বস্ত যে এটাকে সত্যি না ভাবার কোন কারণ নাই, ….যতবার আলো জ্বালাতে চাই, নিভে যায় বারে বারে, আমার জীবনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে… এই গানটা বাজবে ঘরে ঢোকার পর! শাড়ির গভীর অন্ধকার থেকে জব্স পিনটা খুঁজে বের করাই যখন তার কাজ! সাবিনা এটাই এখন চেষ্টা করে যাচ্ছে। গাড়ল ডাক্তারকে বোঝানো কি তার পক্ষে সহজ হবে!

নাসিমা আনিস