সাপ নিয়ে নানান  কথা / রক্তবীজ ডেস্ক

 

সাপ আমাদের চেনা প্রাণী। সাপ শব্দটি  আমাদের মনে জন্ম দেয় ভয়ের, সঙ্কুচিত করে ফেলে আমাদের। খুব সাহসী লোকও সাপকে ভয় পায়।  যাদের জন্ম গ্রামে তারা শৈশব কৈশোরেই সাপের সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু যারা শহরে জন্মেছেন, তারা সাপ দেখার আগেই শাপকে চেনেন দাদি -নানির কোলে শুয়ে গল্প শুনে শুনে। ঠিক যেভাবে মানুষ ভূত চেনেন।  সাপ সম্পর্ক আমাদের ধারণা,  এই প্রাণীর বিষদাঁত আছে। আর একবার যদি সেই বিষদাঁত মানুষ বা কোন জীবজন্তুর দেহে বসিয়ে দিতে পারে তবে  তাদের মৃত্যু অনিবার্য। আতঙ্ক, ভয় থেকেই কিন্তু জন্ম নেয় নানা কুসংস্কার, রূপকথা, উপকথা, লোককাহিনি। তাই আমরা জানি সাপের মাথার মণি অমূল্য। সাপ মানুষ হয়। মানুষ মানে সুন্দরী নারী। সেই নারী আবার সাপ হয়। সেই চিন্তা থেকে নাগীন কন্যাসহ কত কত কাহিনি আর চলচ্চিত্রের জন্ম হয়েছে। এদেশে অসংখ্য ছায়াছবি নির্মত হয়েছে যেগুলির কেন্দ্রে আছে সাপ।  ভারতবর্ষে ‘সর্পপূজা’র প্রচলনও হয়েছিল। আজও অজগ্রামে এ পূজা  প্রচলিত আছে।

সাপ আকার-আকৃতিতে তেমন বড় নয়।  অজগর গ্রুপের দু-চারটা প্রজাতি কিছুটা বড়। এ ছাড়া বাকি সাপগুলি  দৈর্ঘ্যে ৬-৭ ইঞ্চি থেকে নিয়ে ৮-১০ ফুটের বেশি নয়। পৃথিবীতে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। বাংলাদেশে ৭৮টি প্রজাতির সাপের সন্ধান পাওয়া যায়। এই সাপগুলির  মধ্যে ৫২টি অবিষধর ও ২৬টি বিষধর সাপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ৪টি প্রজাতি যেমন গোখরা, কালকেউটে, সানকিনী ও চন্দ্রবোড়া কামড়ালে তা   রীতিমতো ভয়ের কারণ। এছাড়া  ঢোঁড়া, পাইন্না, মেটে সাপ একেবারেই নিরীহ। কিন্তু অন্ধকার বা আলোতে সাপ কামড়ালে তা বিষধর কিনা তা বোঝা যায় না । কারণ আমরা সব সাপ চিনি না। আর সাপ কামড়েই দ্রুত সরে যায়। আশপাশে যারা থাকে তারাও ভয়ে সরে যায়। তাই সাপ কামড়ালেই আমরা ধরে নিই বিষধর সাপ কামড়েছে, বাঁচার সম্ভাবনা আর নেই।   কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মাত্র কয়েকটি সাপের কামড়ে আমরা মারা যেতে পারি।

সাপের বিষ  অন্য দেহে প্রবেশ করে দুভাবে বিষক্রিয়ার সূত্রপাত করে। একটি কার্ডিও টক্সিন, যা হৃদ্যন্ত্র-রক্তসংবহনতন্ত্র ও অন্যটি স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে। তবে মুম্বাইয়ের ইফকিন্স ইনস্টিটিউটে এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতের যত লোক সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় বা মারা যায়, তাদের শতকরা ৮০ শতাংশই ঘটে অবিষধর সাপের কামড়ে। এসব মৃত্যুর মূল কারণ বিষক্রিয়া নয়, বরং ভয়ভীতি, আশঙ্কা থেকে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

আমাদের সমাজ  বিজ্ঞানে যথেষ্ট অগ্রসর নয়।  এই জাতীয় অনগ্রসর সমাজে যে কোন ভীতিকর জিনিস নিয়েই  তৈরি হয় নানান  গল্প , সংস্কার, কুসংস্কার। আমাদের দেশেও  সাপ নিয়ে চালু  আছে অনেক সংস্কার-কুসংস্কার, অপবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। এসব কাহিনিকে জিইয়ে রাখে সাপুড়ে আর বেদেরা। এই কুসংস্কারকে অবলম্বন করে তারা ব্যবসা করে বেঁচে থাকে। তাই কুসংস্কার ক্রমশ বিস্তার লাভ করে।

সাপ নিয়ে চালু আছে কিছু কথা। যেমন: ক. সাপ প্রতিশোধপরায়ণ খ. সাপ গরুর দুধ খায় গ. সাপের মাথার মণি আছে ঘ. সাপ গুপ্তধন পাহারা  দেয় ঙ. সাপুড়ের বিচিত্র বাঁশি সাপ টেনে আনে ইত্যাদি।

সাপ প্রতিশোধপরায়ণ!

আমাদের সমাজে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, সাপ অকারণে কাউকে কামড়ায় না।  যদি কখনও রাতবিরেতে চলার পথে সাপের গায়ে পাড়া দেয় বা সাপকে আঘাত করে সাপ তাকে চিনে রাখে। পরে তাকে কামড়ে প্রতিশোধ নেয়। অর্থাৎ সাপ প্রতিশোধপরায়ণ।  কিন্তু কথাটা সত্য নয়।  বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে জানা গেছে  এমন কাজ কেবলমাত্র  উন্নততর মেরুদণ্ডী প্রাণী  করতে পারে। সাপের মগজের আকৃতিগত ও বিবর্তনভিত্তিক যে অবস্থান তাতে বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। সুতরাং সাপ প্রতিহিংসা জিইয়ে রেখে প্রতিশোধ নেয় এই ধারণা ঠিক নয়।

সাপ গরুর দুধ খায়!

গ্রামীণ সমাজের একটি প্রচলিত ধারণা সাপ নিয়মিত সদ্য বাচ্চা প্রসব করা গরুর দুধ খেয়ে ফেলে। ফলে গরুর বাছুর বা গৃহস্থ দুধ পায় না। অনেক সময় গৃহস্থ দেখতে পায় গরুর পায়ে সাপ পেঁচিয়ে আছে। এতে তার বা তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয় সাপ গরুর দুধ খায়।  কিন্তু বাস্তব বিষয় তা নয়। সাপ রাতের বেলায় ইঁদুর বা ব্যাঙ ধরতে আসে। তখন যাতে  গরুর পায়ে পিষ্ট না হয় এই  ভয়ে এমনটা করে। সাপের দুধ খাওয়ার কাহিনি মানুষের কল্পনাপ্রসূত। কারণ  গরুর দুধ খাওয়া বা  সংগ্রহের  নিয়ম সাপ আয়ত্তে আনতে পারবে না। সেটি বেশ জটিল।   কেননা, অধিকাংশ সাপের দাঁতের গঠন বেশ সুঁচালো এবং মুখের ভেতরের দিকে বড়শির মতো বাঁকানো। সুতরাং সাপ যদি গরুর দুধ খেতে যায়, সেই দাঁত গরুর ওলান চুষতে গেলে আটকে যাবে এবং বিষ নির্গত হবে। ফলে গরুর মৃত্যুর সম্ভাবনা  আছে।  সাপ গরুর দুধ খাচ্ছে বাস্তবে এই দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এই কল্পনাকে ভিত্তি করে অনেক গল্প উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে সাপের গরুর দুধ খাওয়া  বা বাটিতে দুধ খাওয়ানোর কাহিনি দেখানো হয়েছে।

সাপের মাথার মণি!

সমাজে প্রচলিত একটা কথা আছে তা হচ্ছে সাপের মাথায় মণি আছে।  কেউ কেউ মেঘলা অন্ধকার রাতে সাপের মাথায় মণি দেখেছে।  এই মণি যে দেখতে পায় সে অতীব ভাগ্যবান। এসব গল্প  সাপুড়ে-বেদেরা বেশি করে থাকে।  সাপকেন্দ্রীক নানা ভয় ভীতি ও প্রলোভনের গল্প বলে তারা নিরীহ মানুষের পয়সা হাতিয়ে নেয়।  এ মণি নাকি  সাত রাজার ধনের সমান। এই   জাতীয় মণির কথাও সাপুড়ে – বেদেরা বলে থাকে। আমাদের জনগণের একটা অংশ একথা বিশ্বাসও করে।  তাই অনেক বোকা লোক এই মণি  সংগ্রহের স্বপ্ন দেখে।

আসলে, বিষধর সাপের মাথার ওপরে একটি ছিদ্র থাকে।  মুখবন্ধ অবস্থায় সাপ সেই ছিদ্র দিয়ে তার লকলকে  জিব বের করে এর চারপাশের পরিবেশ থেকে খাদ্যের কিংবা সাবধান হওয়ার সংকেত সংগ্রহ করে থাকে। সাপুড়েরা সাধারণত তাদের খাঁচা বা বাক্সে রাখা সাপগুলোর মাথার উপরের ছিদ্রে রংবেরঙের পাথর বসিয়ে রাখে। সে পাথর  দিনের আলো বা চাঁদের আলোয় ঝিলিক দিয়ে ওঠে । সেই আলোর বিচ্ছুরণকে তারা সাপের মাথার মণি বলে চালিয়ে দেয়।

সাপ সাপুড়ের বাঁশির সুর শোনে!

সাপুড়ের বাঁশির সুরের নাকি  সম্মোহনী শক্তি আছে।  সে শক্তি বা জাদুতে সাপ চলে আসে। এমন অনেক কাহিনি শোনা যায়। এগুলো আসলে গল্প। সাপুড়ে-বেদেরাই এসব গল্পের জন্ম দেয়  পয়সা সংগ্রহের কৌশল হিসেবে। তারা বলে, তাদের বাঁশির এমনই জাদু যে, সে বাঁশির সুরে সাপ গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসে সাপুড়ের হাতে ধরা দেয়।  এভাবেই সাপ তাদের বশে  আসে। বাস্তবে কথাটা ঠিক নয়।  সাপের কান নেই । তাই সুর বা শব্দ শোনার প্রশ্নই ওঠে না। সাপের চোয়ালের নিচে হাড়ে শ্রবণস্পন্দন গ্রহণের স্নায়ুতন্ত্রে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সেই ব্যবস্থাতেই সাপ  শব্দ বা বিপত্সংকেত শোনে। সাপুড়ে যখন  বাঁশি বাজায় তখন তার দেহে নানা ভঙ্গি খেলা করে। সুরের ওঠা নামার সাথে সাথে সাপের শরীরও ওঠানামা করে। তাই সাপুড়ে বাঁশি বাজালে আমরা গোখরা সাপকে ফণা তুলতে দেখি।  এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন সাপুড়ের  বাঁশির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আকৃতি ও সাপুড়ের ছন্দময় অঙ্গভঙ্গি ও তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত নাড়া সাপকে খেপিয়ে তোলে। তাই সাপ ফণা তোলে। এই ফলা তোলার সাথে সাপুড়ের বাঁশির কোনো সম্পর্ক নেই।

সাপের গুপ্তধন পাহারা!

অনেক গল্প-উপন্যাসে আমরা পড়েছি  সাপ গুপ্তধন মানে  লুকানো রৌপ্য, মণিমুক্তা  পাহারা দেয়। বিষয়টা আসলে তা নয়। অতীতে ব্যাংক ছিল না। তাই অনেকে পারিবারিক দ্বন্দ্ব কলহের কারণে , শরিকীয় বিবাদে সম্পদ রক্ষার  জন্য সম্পদ স্বর্ণ-রৌপ্য ও মুদ্রাভর্তি হাঁড়ি বা কলসি মাটির নিচে গর্ত করে লুকিয়ে রাখত। এতে সাপের বেশ ‍সুবিধা হত। সাপ নিজে কষ্ট করে গর্ত খোঁড়ে না। সে  অপরের খোঁড়া গর্তে বসবাস করে। সাপ স্বর্ণ, রৌপ্যমুদ্রা বা ধনরত্ন চেনে না।  এ ধারণা একেবারেই ভুল । স্বাভাবিকভাবেই ধনদৌলত লুকিয়ে রাখার জায়গাটি খুব নিরাপদ ও  সুরক্ষিত হয়। সাপের প্রিয় খাবার ইঁদুর-ব্যাঙও ওই গর্তে যাতায়াত করে। সুতরাং খাদ্যের প্রলোভনে সাপ সেসব গর্ত বাস করার জন্য বেছে নেয়। গৃহস্থের লুকিয়ে রাখা ধনরত্ন পাহারা দেওয়ার জন্য নয়।

এমন ধারার অসংখ্য মুখরোচক গল্প, কল্পকাহিনি আমাদের সমাজে ছড়িয়ে আছে। সাপের বিষ নামানো, সাপের পা দেখা, সাপে-নেউলে সম্পর্ক, সাপের বিষ হজম করা ইত্যাদি। এগুলো সবই কুসংস্কার যা থেকে জন্ম নেয় অপবিজ্ঞান।