দেশভাগ ও সাহিত্যিক মন/ প্রণব মজুমদার 

দেশভাগ ও সাহিত্যিক মন

দেশভাগ ও সাহিত্যিক মন

দেশভাগ ও সাহিত্যিক মন/ প্রণব মজুমদার 


ভাগ করে খাবার খাওয়া অপার আনন্দের! মনের বিনোদন! যাপিত জীবনে এই ভাগ মানে মিলেমিশে থাকা! কিন্তু আমরা মিলেমিশে থাকতে ভুলে গেছি! একত্রে থাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত প্রায়! কী তা সংসারে, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে! এর প্রকৃত কারণ হৃদয় বিদারক বাংলার ভৌগোলিক ইতিহাস – দেশ ভাগের ধারাবাহিক সংস্কৃতি।

দেশভাগ নিয়ে স্বল্প পরিসরে লেখা বেশ কষ্টকর। তাছাড়া কম প্রজ্ঞা শক্তি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশাল ক্যানভাসের সার্থক চিত্রাংকন দুরূহ তো বটেই! দীর্ঘ সময়ের লেখালেখির সম্পৃক্ততা এবং সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনা ও লোক আচরণ লেখায় আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলা সাহিত্যে বিষয়টি নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এ নিয়ে ৭৭ বছরে লেখা হয়েছে বহু উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা ও ছড়া। সংখ্যায় তা অজস্র। অগণিত লেখার মধ্যে প্রখ্যাত কবি ও ছড়াকার অন্নদাশংকর রায়ের বিখ্যাত ছড়া – ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো, তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো, তার বেলা? তার বেলা?’- বেশ মনে পড়ছে।

দেশভাগের নির্মম ইতিহাসের দিকে তাকাই! নতুন দু’টি দেশের গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত পরিবার পারস্পরিক গৃহ বিনিময় করে উভয় রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করলেও অধিকাংশ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় বাস্তবতার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অনেককে চলে যেতে হয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে। হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, হায়াৎ মামুদ, আনিসুজ্জামানের মতো অনেককে ভারত ছেড়ে আসতে হয় বাংলাদেশে। এই জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতের রক্তক্ষরণ, নির্মম সময়ের দাগ আমাদের বাংলা সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়। কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো, খাজা আহমেদ আব্বাস, ভীষ্ম সাহানী, খুশবন্ত সিংরা উর্দু এবং হিন্দিতে বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন। বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে। বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে দেশভাগ প্রধান বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক হর্ষ দত্ত একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘নিজের দেশ ও মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোঁয়া রয়ে গেছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টা ঘুরেফিরে এসেছে?’ সুনীল তখন উত্তর দেন, ‘দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সবসময় মনে পড়ে।’ সাতচল্লিশের ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এত বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে।’

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৫ অবধি ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্ত বিতর্কিত শাসক জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জন বা লর্ড কার্জনের আদেশে প্রথম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারনাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারী প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসন কার্যক্রম দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত ওই সময় থেকেই।

কিন্তু ১৯১১ সালে, প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ সালে। এর ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতে যুক্ত হয়। এই ঘটনা প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের এই ধারণা হয় যে নতুন প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যাবে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি। এ সময় প্রচুর জাতীয়তাবাদী লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন মজফ্ফরপুরে। সেখান থেকে সাময়িক প্রসঙ্গ শিরোনামে বঙ্গবিচ্ছেদ ও য়ুুনিভার্সিটি বিল – দু’টি বিষয়েই তার নিজস্ব মত প্রকাশ করেন। কার্জন কিছুদিন নীরব থাকলেন এবং প্রস্তাবটি পরিত্যক্ত হয়েছে ভেবে আন্দোলনকারীরাও নিরব হয়ে গেলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ সরব হলেন। এই নিরবতার সময়টিকেই কবি কথা বলার উপযুক্ত সময় মনে করলেন। তিনি নিজেই লিখলেন, ‘আন্দোলন যখন উত্তাল হইয়া উঠিয়াছিল আমরা তখন কোনো কথা বলি নাই; এখন বলিবার সময় আসিয়াছে।’ তিনি এই দীর্ঘ আন্দোলনমুখর সময়ে দূরে থেকে আন্দোলনের গতি প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়ছেন। নিজের লোকজনের কাছে খোঁজ খবর নেন। তিনি বললেন, এই বঙ্গবিচ্ছেদ আন্দোলন অপূর্ব! অর্থাৎ এ ধরনের আন্দোলন এ দেশে আগে হয়নি। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দেশে রাজনৈতিক উত্থান পর্বের সূচনা হয়েছে। দেশের মানুষের ঘুম ভেঙেছে রাজশক্তির তীব্র আঘাতে। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান – ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ লিখেন।
এই সকল রাজনৈতিক প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা আবার একত্রিত হয়। ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে হিন্দি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া অঞ্চলগুলো বাংলা হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়াদিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত জুড়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। জন্ম হয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র্র ভারত ও পাকিস্তানের। পাকিস্তান এবং হিন্দুস্থান। বিশ্বে এ পর্যন্ত বড় ধরনের যত দেশান্তরের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তান ভাগের ঘটনা অন্যতম। দেশভাগের সেই অগ্নিগর্ভ সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মারা যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ। কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। আজও দুটি দেশেই দেশভাগের ভয়ঙ্কর স্মৃতি দগদগে হয়ে আছে! একদিন যাদের ভিটেমাটি, গোয়াল ভর্তি গরু, ধান ভর্তি জমি ছিল, তারা রাতারাতি হয়ে গেলেন ‘রিফিউজি’! নিজের দেশ, লোকজন ছেড়ে, সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল শুধু প্রাণটুকু বাঁচাতে। কিন্তু বাঁচল আর কই? বহু প্রাণ নির্মমভাবে কেড়ে নিল দেশভাগ। যারা বাঁচল তারাও ধুঁকে ধুঁকে সেই স্বপ্নময় স্মৃতি নিয়ে বাঁচল। নিজের ভিটের, প্রিয়জনের স্মৃতি সারা জীবন তাড়া করে বেড়ালো।

রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল ভারতের উত্তরাঞ্চলের শহর অযোধ্যায়। ধর্মীয়ভাবে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত এই অঞ্চলে বহু বছর ধরেই হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। ভারত ও বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রভাবশালীরা একে অপরের ওপর আক্রমণ করে। অবিভক্ত ভারতবর্ষে একমাত্র ধর্মের কারণে দেশভাগের মাধ্যমে বিভাজন সচেতন মানুষ বিশেষ করে সৃজনশীল ব্যক্তিরা মেনে নিতে পারেনি। তাই সাতচল্লিশের বিভাজনের বিরোধিতা করে সৃজনশীল বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে।

দেশভাগের পর নিজের জমি ছেড়ে আমার সেজ কাকু পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার রানাঘাটে চলে যান। গ্রামে নিজেদের ভিটেমাটিতে না থাকার কারণে কাকার জমির মতো আমাদের জমিগুলোও দখলে চলে যায়! যা আজও উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়নি। ১৯৪৯ সাল থেকে মায়ের নামের বিশাল পরিমাণ জমি প্রভাবশালীদের দখলে। চৌষট্টিতে এ অঞ্চলে দাঙ্গার ভয়ে আমার বড় ও ছোট পিসির পরিবার নিজের বাড়ি ফেলে পশ্চিম বাংলায় চলে যান। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী আত্মীয় ও পরিচিত অনেকেই সাতচল্লিশের পর থেকে দেশে নির্যাতন, অত্যাচার এবং আতঙ্কে প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন। এটাও পরোক্ষভাবে দেশভাগের প্রভাব।

আমার জন্ম শহর বাংলাদেশের চাঁদপুর। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের সঙ্গে বড় হয়েছি মহকুমার ছোট এ শহরে। পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির পর স্বাধীন বাংলাদেশের এ শহরে তখন ছিল ৪৫ শতাংশ সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। ভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সঙ্গে নিজের বাড়িতে আমাদের বৈষম্যমূূলক আচরণ না থাকলেও বাইরে তা লক্ষ্য করতাম। পাড়ার ঠাকুরমা, মাসীমা, জেঠীমা, কাকীমা, পিসিমা, দিদি, দাদা, জেঠা, কাকা ও দাদারা ধর্ম ও জাত গেল দোহাই দিয়ে বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। পৌরসভার সরকারি বিশুদ্ধ জলের কলপাড়ে কোন মুসলিম ধর্মের লোক সনাতন হিন্দু ধর্মের কলস বা পাত্র স্পর্শ করলে অতিরিক্ত জল অপচয় করে তারা পাত্র ‘শুদ্ধ’ করতেন। অনেকে বলে উঠতেন ‘রাম রাম রাম রাম!’ মাটির কলস অনেকে ভেঙ্গে ফেলতেন তাও দেখেছি। মুসলিম ধর্মের মানুষ রক্ষণশীল সনাতন হিন্দু ধর্মের কোন পরিবারের বাড়ির সীমানা দিয়ে যাতায়াত যেমন নিষেধ ছিল, তেমনি প্রত্যক্ষ করেছি মন্দির বা উপসনালয় বা গৃহের সামনে মৃত গরুর মাথা বা হাড় রেখে যাওয়ার দৃশ্যও। পাড়ার অনেক ছেলেরা কেউ কেউ সনাতন হিন্দু ধর্মের মানুষকে গালি দিতো! বলতো ‘ডেডাইয়া’, ‘মালাউন’ বা ‘মালু’! হিংসা বা রাগে বলতো – ‘ইন্ডিয়া পাডাইয়া দিমু।’ নানা ধর্মের পার্বন ও উৎসব জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পালন ও উদযাপন করেছি। মাহে রমজান, ঈদ, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা এসবে সংপৃক্ত থেকেছি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে। ঈদের দাওয়াতে আনন্দ করা, ইসলাম ধর্মের বন্ধুদের ঘরে এনে পুজোর সন্দেশ, নাড়ু, মোয়া খাওয়ানো সম্প্রীতির এ দৃশ্য এখন আর নেই বললেই চলে। সোনার বাংলা থেকে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেকেই দেশত্যাগ করেছেন। দিনেদিনে কমে গেছে সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, নিকটবর্তী পশ্চিম বাংলায় বসবাসকারি ইসলাম ধর্মের লোকসংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৭ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারি সনাতন হিন্দু ধর্মের জনসংখ্যা সরকারের পরিসংখ্যান অনুয়ায়ি মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমছে, কিন্তু পশ্চিম বাংলায় বাড়ছে মুসলিম জনগাষ্ঠী। পশ্চিম বাংলায় চলে যাওয়া বাংলাদেশীদের ওখানকার স্থানীয়রা কটাক্ষ করে ‘বাঙ্গাল’ বলে!

অখণ্ড ভারতে প্রধানমন্ত্রী পদের দখলদারিত্ব নিয়ে সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ার পর পর সাম্প্রদায়িকতার তীব্রতা দেখা যায় ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে। হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।

বাংলাদেশে সনাতন হিন্দু জনগোষ্ঠী হ্রাসের কারণ শুধু দেশভাগই নয়, দেশের রাষ্ট্রনীতিও এ ক্ষেত্রে দায়ি। দেশের সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে – ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে আমরা বেরিয়ে গেছি। একাত্তরের সংবিধানে চার মূল স্তম্ভ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জাতীয়তা। এর কোনটাই কার্যকর হতে দেখিনি। ভোটের রাজনীতিতে জন সমর্থনের হারানোর আশংকায় কোন সরকারই সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামকে বাদ দেয়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তির সঙ্গে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই সম্পর্ক রেখেছে! ফলে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ধর্মীয় রাজনীতি ও মৌলবাদ। আমরা চাই দেশে সকল ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সমঅধিকার। শুধু জামাত-শিবির কেন, দেশ থেকে সকল ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা হোক।

সাড়ে চার দশক থেকেই শুরু হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুণ্ঠন ও ধর্মীয় উপসনালয়ের প্রতি আক্রমণ। ভারতেও ইসলাম ধর্মাবম্বলী লোকদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন হয়। অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের ওপর লাঞ্চনা ও নির্যাতন কোন অত্যাচার হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দুদেশেই।

দেশভাগ এবং ধর্মের সেই নেতিবাচক সংক্রমণ শুধু রাজনৈতিকদেরই স্পর্শ করেনি, সৃজনশীল লেখকদেরও জাপটে ধরেছে। সেটা দুই বাংলাতেই। লেখক বন্ধু সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের মেধাবী সন্তান কথাশিল্পী ও সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব আফরোজা পারভীন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। নড়াইলে বড় হয়েছেন সনাতন ধর্ম অধ্যুষিত সমাজ পরিমণ্ডলে। শুধু ধর্মের কারণে দেশ বিভাজনকে অসমর্থন করেন তিনি। ভ্রমণপিপাসু তিনি। বই কেনার জন্য সুযোগ পেলেই ছুটে যান কলকাতা। বেশ কয়েক বছর আগে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত এক উপন্যাসিকের বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য প্রিয় লেখকের সঙ্গে সময় কাটানো, পাশাপাশি বাংলাদেশের দৈনিক একটি সংবাদপত্রের সাহিত্যের জন্য সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা। চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ অনুযায়ি অসুস্থ আফরোজা বাইরের খাবার গ্রহণের নিষেধ রয়েছে! বিখ্যাত সেই সাহিত্যিকের দেওয়া খাবার খেতে আপত্তি জানান তিনি। কলকাতার বাসিন্দা কথাসাহিত্যিক ভাবলেন, তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বলে মুসলিম আফরোজা খেতে বাদ সাধেন। আফরোজা বলেন, প্রিয় লেখকের কথাবার্তা ও আচরণে তাঁকে গোড়া ও সাম্প্রদায়িক মনে হয়েছিল। সাহিত্যিকদের মন হবে উদার এবং মানসিকতা হবে অসাম্প্রদায়িক। ধর্মগত বৈষম্যে প্রিয় সেই লেখকের আচরণের বিষয়টি আফরোজাকে এখনও ভাবায়!

পশ্চিম বাংলার উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাতের চাপাডালি। এখানে বসবাস করেন আমার ঘনিষ্ঠ এক লেখক বন্ধুর একমাত্র বোন। পরিবারে সবার বড় তিনি। সেই দিদি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিষয়ের মেধাবী ছাত্রী। এখন ভারতের নাগরিক। বারাসাত এলাকার চাপাডালিতে কোন মুসলিম পরিবার নেই। দিদিদের বাড়ীর পাশে জমি কিনে তিনতলা বাড়ি করেছেন উদারমনা একটি মুসলিম পরিবার। বারাসাতের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলেদের অত্যাচারে ২ বছরের মাথায় বাড়িটা হিন্দু ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয় প্রতিবেশি পরিবার। সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে এলাকা ছেড়ে যেতে হয়েছে ভদ্র মুসলিম পরিবারটিকে। ৮ বছর আগের ঘটনা এটি। ৬ বছর আগেও কলকাতায় অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে মুসলিম সম্প্রদায় মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেখেছি।

২০২০ সালে আমার প্রথম কবিতার বই বের হয়। সুখ দুঃখের পদাবলি নামের কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। প্রগতিশীল সাহিত্য একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আমার এক মুসলিম বন্ধু। তার লিটল ম্যগাজিন প্রকাশনার জন্য মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে তিনি বিজ্ঞাপন সহযোগিতা নেন। সেই বন্ধু তখন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং কবি ও প্রকাশক। তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে ৪ ফর্মার বইটি প্রকাশের জন্য তিনি দাবী করে বসলেন ৪০ হাজার টাকা! ‘বললাম- অর্থ দিয়ে বই প্রকাশ করবো না।’ এই বক্তব্যের পর তিনি কমিয়ে অংক পুনঃনির্ধারণ করলেন ৩০ হাজার টাকা। পরে অনেকটা বিনামূল্যে পুথিনিলয় এর প্রকাশক শ্যামল পাল বের করলেন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ- সুখ দুঃখের পদাবলি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তা প্রকাশের পর একদিন নেড়েচেড়ে দেখেন ‘প্রগতিশীল’ বন্ধু। সামনে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক কবি এবং কবি ও সম্পাদক দুই ব্যক্তি। লেখক ও প্রকাশক বন্ধু তাদের বলে উঠলেন ‘দেখেন এটা কোন বই হলো? এক মালু (হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য সাম্প্রদায়িক গালি) আরেক মালুর কাছে গ্যাছে! নেতিবাচক মন্তব্য শুনে পাশের দুজন কিছুই বললেন না! বরং হাসলেন। বিবেক আমায় এখনও প্রশ্ন করে, ‘উদারমনা’ সৃজনী এই মানুষের রূপ? তাও আবার ‘বন্ধুর’ কর্মে সমাজতন্ত্রী তকমা! প্রগতিশীল লেখক!

দুবছর আগে বেসরকারি একটি স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের অর্থায়নে ২০ জন গল্পকারের লেখা নিয়ে প্রকাশিত ‘জলের গল্প’ বইটির প্রকাশনা উৎসবে গিয়েছি। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মুক্ত চিন্তাবিদ, জ্ঞানতাপস প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আলোচনায় স্যার উল্লেখ করলেন, সাতচল্লিশের আগেই বাংলায় ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায়। তা প্রকট হয়েছে দেশভাগের পর। সংস্কৃতসহ নানা ভাষার সমষ্টিগত রূপ বাংলা ভাষা। মৌলবাদী মুসলিম সম্প্রদায় বাংলা ভাষাকে এখনও অস্বীকার করে। ওপার বাংলায় হিন্দী ভাষার আগ্রাসন হয়েছে।  বাংলা ভাষা অবহেলিতই বলা যায়! অনুষ্ঠান আয়োজকদের বাংলা ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগের প্রশংসা করে প্রধান অতিথি অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করার পর সংস্থার পর্ষদ একজন সদস্য প্রশ্ন রেখে বললেন, বইটির নাম কেন ‘পানির গল্প’ হলো না? উত্তরে আমি প্রবীণ ভদ্রলোকটিকে বললাম- আংকেল পানি তো হিন্দী শব্দ! জল হচ্ছে প্রকৃত বাংলা। দর্শক ও শ্রোতা হিসেবে আমার উত্তর শোনার পর উনি তখন বেশ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন!

প্রগতিশীল শিশু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম দীর্ঘদিন। সাংগঠনিকভাবে পরিচিত বাংলা সাহিত্যে উচ্চতর শিক্ষায় দীর্ঘদিনের লেখক জ্ঞানবান এক বান্ধবী। তাঁর কাছে সাহিত্যের খুঁটিনাটি বিষয় জেনেছি। পাণ্ডিত্য আছে তাঁর। বিশুদ্ধভাবে বাংলা উচ্চারণ করেন তিনি। শুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে ছিল ওর পুরো পরিবার। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ওর ভাষাগত আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তোলে! বান্ধবীর পরিধেয় বসনে এখন বাঙ্গালিয়ানা নেই!  কুশলাদি বিনিময়কালে বাঙালিদের সঙ্গে সে উর্দু ও আরবী ভাষা উচ্চারণ করে। এক সময়কার প্রগতিশীল আরেক মুসলিম লেখক বন্ধু; যার বাড়ির অন্দরে দিনের অনেক সময় কাটাতাম, এখন সেখানে প্রবেশ নিষেধ আমার, আমি ভিন্ন ধর্মের লোক বলে।

লেখক সমাবেশের বিশাল এক অনুষ্ঠান! ২০১৯ সালের নভেম্বরের দৃশ্যপট। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। সভা শেষে নানা পদে বাঙ্গালি খানাপিনার আয়োজন। বাহারি খাবার। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ সকল সদস্য পরিবারের অতিথিরাও আমন্ত্রিত। এক টেবিলে ছিলেন ৭ মুসলিম  পুরুষ বন্ধু। বাকি ৩ জনের মধ্যে সৌম্য ও ব্যক্তিত্ববান সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ভদ্রলোক স্ত্রী ও পুত্র নিয়ে খেতে বসেছেন। গো মাংস তারা কেউই খান না। পোলাউয়ের সঙ্গে বেগুনী, ইলিশ মাছ ভাজা ও সবজি খাওয়ার পর মাংসের পাত্র পাশের বন্ধুকে দিতে অনুরোধ করেন ভদ্রলোক। পাত্রটি দিয়ে তিনি মিটিমিটি হাসছিলেন! খেতে শুরু করেছেন দাদা। জিহবায় মাংসের টুকরোটি মুখে দিতেই কেন যেন ওনার সন্দেহ হলো – এতো খাসির স্বাদ নয়! সঙ্গে সঙ্গে পোলাউয়ের পাত্র নিয়ে দাঁড়ানো পরিচারককে (ওয়েটার) তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তর -‘বিফ স্যার!’ দাদা অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। শেষ অবধি খাবারের পাত্রেই তার বমি আর বমি! অরুচিকর অবস্থা দেখে দাদার পাশে বসা ক’জন ঘৃণা ও অস্বস্তিতে উঠে পড়লেন। দাদার পুরো পরিবারও। ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছেন – ‘আরে কিছু হবে না দাদা!’

প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্য বই এবং প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি অনেকেই জানেন। শিশু কিশোরদের মন বিকাশ এবং আদর্শভিত্তিক জীবন গঠনে কার্যকর বিখ্যাত ও স্বনামখ্যাত সনাতন লেখকের লেখা পাঠ্য বই থেকে বাদ দেয়া হয়।
লেখক অঙ্গনেও সম্বোধনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখতে পাই। ধর্ম পরিচয় জানতে পারলে আজকাল দেশে স্যার ও ম্যাডাম ডাকের পরিবর্তে দাদা, দিদি বা বৌদি সম্বোধন প্রতিস্থাপিত হয়।

প্রচলিত প্রবাদ- জোর যার, মুল্লুক তার। অথবা বিচার মানি, তবে তাল গাছটা আমার। এমন বাক্যের বাস্তবতা লক্ষ্য করছি। স্বার্থটাই মুখ্য। যার প্রভাব বা শক্তি আছে তিনি আধিপত্য প্রদর্শন করবেনই। সেটা হোক বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা ভারতে। তাই যে কোন জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন নিয়ে নতুন করে বলার নেই। সৃজনশীল লেখক ও শিল্পীদের মন তো হবে উদার। কর্ম সম্পাদন করে থাকেন তারা, সকল বর্ণ ও শ্রেণির মানুষ এবং প্রাণির জন্য। সাম্প্রদায়িক লেখক মন আমার কাছে অপ্রত্যাশিত।

বিভাজন মেনে নিতে পারি না। লেখালেখি, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত কেউ যদি আমাদের বলে ‘আপনি মুসলমান, হিন্দু বা খ্রিষ্টান তখন নিজেকে অস্পৃশ্য ও ছোটই ভাবি। মনে হয় আলাদা হয়ে গেলাম দেশভাগের মতো! ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের শাসন ব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ইংরেজ শাসকরা তৈরি করেছিল বিভাজন ও শাসন (ডিভাইস এন্ড রোল) নীতি। এর প্রধান শিকার হয় মুসলিম জনগোষ্ঠী। ইংরেজরা বাংলা থেকে চলে গেছে ঠিকই, কিন্ত শাসনের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সেই নীতির অপশাসন ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রয়ে গেছে এখনও। সে ধারাবাহিকতায় এসব অঞ্চলে হিংসাত্মক ধর্মান্তর কর্মকাণ্ড এবং সাম্প্রদায়িক চিন্তা প্রাধান্য পেয়েছে। সংখ্যাগুরু প্রভাবশালীরা দুবাংলায় অত্যাচার, নিপীড়ন, লাঞ্চনা ও বঞ্চনা করছে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর। আর এর রেশ পড়ছে সাহিত্যিকদের মনেও। উদার থাকছেন না বাংলার সাহিত্যসেবিরাও।

প্রণব মজুমদার
প্রণব মজুমদার