নজরুলের গান / বেবী নাসরিন

 

তখন উনিশশো ঊনোসত্তর । চারিদিকে উত্তাল।

আন্দোলন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে।

তরুণেরা তাদের দাবি পোষ্টারে লিখতে ব্যস্ত।

সারা রাত লিখতো । আর সেগুলো দেয়ালে সেঁটে

দিত আবার লাঠির মাথায় টানিয়ে  মিছিলে 

ব্যবহার করত । আর মেয়েরা রণসঙ্গীত গাইত, 

ছেলেরাও কন্ঠ মেলাত। নজরুলের রণসঙ্গীত 

তাদের খুব পছন্দের তালিকায় প্রথম স্থানে ছিল। 

জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে

কারার ঐ লৌহ কপাট,শিকল পরা ছল মোদের 

এই শিকল পরা ছল ব্যবহার করেছেন। এইসব উদ্দীপনাময় গান 

অনুপ্রেরণা যোগাত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই

গান সকলের সব সময়ের সঙ্গী ছিল।

  চাঁপা নামে মেয়েটি। ফুলের নামে নাম ।সাত

ভাইয়ের একটি মাত্র বোন।ওর বয়স যখন চোদ্দ। 

ক্লাশ নাইনে উঠেছে । তখন ও গান করার জন্য

হারমোনিয়াম কিনল । কিছুদিন কাজিনের কাছে 

প্রশিক্ষণ শুরু হোল। ক্লাসিক্যাল সংগীত, পল্লী 

গীতি, নজরুল সঙ্গীত গাইত। বাগিচায় বুলবুলি 

তুই, দিসনে আজি দোল । সকালে চাঁপা খুব মধুর 

সুরে গাইত । বাসার সবাই আধো ঘুমে আধো

জাগরণে শুনত তার সঙ্গীত চর্চা। বেশ ভালো 

লাগতো সবার । এভাবে প্রতিবেশীরা তার প্রথম

 শ্রোতা । চাপার  মূল আকর্ষণ ছিল নজরুল সঙ্গীত। 

নজরুল ছিলেন একাধারে গীতিকার সুরকার 

ও গায়ক । তার বিদ্রোহী কবিতার জনপ্রিয়তা 

ছিল অতুলনীয় ।

 এসব কবিতা এবং রণসঙ্গীত

ইংরেজ হটাও আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ 

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সময় একটা কালজয়ী 

ভূমিকা পালন করেছে ।

মুক্তির গান গেয়ে পথে পথে  জাগরণ সৃষ্টি 

হয়েছিল। উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের 

মনে। নজরুলের গান অসম্ভবকে 

সম্ভব করেছিল। মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন 

করেছিল।এই বিদ্রোহের রণসঙ্গীত জাগিয়ে 

তুলল একটি জাতিকে। এনে দিলো স্বপ্নের 

স্বাধীনতা।

চাঁপার সঙ্গীত চর্চা এগিয়ে চলতে লাগল ।

মা বাবা ভাই প্রতিবেশীরা সকলে উৎসাহ 

দেয় ।এই উৎসাহ অনুপ্রেরণা দেয় তাকে।

স্বপ্নপুরণের ইচ্ছাগুলো অদম্য সাহস যোগায়।

নজরুল সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ রেখে চর্চা এগিয়ে 

চলে। বয়স মাত্র চৌদ্দ।বড় শিল্পী হবার স্বপ্ন 

দুচোখে। স্কুলে পুরাতন ছাত্রীদের বিদায়  অনুষ্ঠান ।

চাঁপাদের বিদায় অনুষ্ঠান। তারা একত্রিত হয়ে 

পরিকল্পনা করল । সুন্দর এবং উপভোগ্য একটা 

অনুষ্ঠান উপহার দিবো আমরা। গান,নাচ, কবিতা 

আবৃত্তি নাটিকা, কৌতুক সবকিছু থাকবে । শুরু 

হলো প্রশিক্ষণ। সঠিক প্রশিক্ষণ, উপভোগ্য 

অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান দেখে শিক্ষকরা 

ছাত্রীদের বাহবা দিতে লাগলেন। চাঁপাকে বললেন,

তোমার নজরুল গীতি অনেক সুন্দর হয়েছে, 

তুমি চর্চা চালিয়ে যাও। তোমার কন্ঠ চমৎকার!

শিক্ষকদের উৎসাহ সঙ্গে বান্ধবী, প্রতিবেশী 

সকলের উৎসাহ চাঁপাকে অনুপ্রাণিত করল।

 জোর অনুশীলন শুরু হোল। স্কুল শেষ করে

কলেজে পড়াশোনা করতে লাগলো। এক সময়

খুলনা বেতারে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করল।

প্রথমে দলীয় সঙ্গীতে বেশকিছু সময়, এক দুমাস পর

অনুষ্ঠান পরিবেশন হোত। দুবৎসর পর একক সঙ্গীত 

পরিবেশনের সুযোগ পেলো । সবাই খুশিতে অভিনন্দন 

জানাল  তাকে। অফুরন্ত ভালবাসা তার প্রশিক্ষণকে

বাড়িয়ে দিল। স্বপ্ন দেখে আরো বড় কিছুর। এভাবেই 

সে সুযোগ পেলো টি ,ভি তে গান করার ।

এমন সময় পঁচিশে মার্চের কালো রাত এলো।

সঙ্গীত চর্চায় ব্যাঘাত ঘটলে । জীবন বাঁচাতে গ্রাম 

গঞ্জে পালিয়ে বেড়াতে লাগল লক্ষ লক্ষ পরিবার ।

মানুষকে উজ্জীবিত করবার একমাত্র হাতিয়ার 

হিসাবে গর্জে উঠেছিল তারা।গানে কবিতায় আর

গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে। আমরা ভুলিনি ভুলবো না 

সেই প্রতিবাদী দিনগুলোর কথা।