মাশুল: একজন পাঠকের দৃষ্টিতে / বিভূতিভূষণ মন্ডল

 

ভাদ্রের শেষ, আকাশে রোদ ঝলমল করছে। গোটা মছলন্দপুরের মাঠে সবুজ বরণ ধান ঝলমল করছে, বাঁশবনের পাতায়, গাছপালার ডালে-পল্লবে গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ থমথম করছে। রোদের ছটায় ঝিলিক মারছে, পুকুরগুলিতে বড় বড় পদ্মপাতা বাতাসের সাথে লুকোচুরি খেলছে। বড় পুকুরের অন্য পাশে নিরিবিলি পদ্মফুল ফুটেছে, আঙিনাতে স্থলপদ্ম, শিউলি ফুল ঝরছে শিউলিতলায়, মধুমতির পানিতে রং ফিরেছে; নীলপানি কাচবরণ হয়েছে। তাই সোনার মছলন্দপুর সবুজ হয়েছে, ধীরে ধীরে রুপোর বরণে নদীর কূলে কূলে কাশফুল ফুটেছে। ঝরঝরা সোনারঙা মাটি চিকচিক করছে কাচ বালির সংমিশ্রণে। আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি, জড়াজড়ি। মানুষের মনে কেন যেন আনন্দ থৈ থৈ করছে। কামারখালীতেও কি এক মিহি আনন্দধ্বনি , রাশি রাশি ফুলের পাপড়ির মতো আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়ছে যেন। [মাশুল]

শাহনাজ পারভীন রচিত ‘মাশুল’ উপন্যাসের এই অনুচ্ছেদটি যে কোন পাঠককে লেখিকার রচনাশৈলির শক্তিমত্তা সম্পর্কে আস্থাশীল করে তুলবে। ভালোলাগার একটি নিবিড় আবেশ যেন নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে যাবে পাঠকের ইন্দ্রিয়কে। এই আবেশ নিয়েই পাঠক অগ্রসর হতে থাকবেন উপন্যাসের কাহিনি ও গতিপথের সহযাত্রী হয়ে। 

মূলত তিনটি পরিবারকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের ঘটনাবলী আবর্তিত হলেও দুটি পরিবারই পাল্টাপাল্টি করে প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রাসঙ্গিক এবং অনিবার্যভাবেই আরও কিছু আপাতবিচ্ছিন্ন ঘটনা সংযুক্ত হয়ে উপন্যাসের বৃত্তপরিধিকে বিস্তৃত করেছে। উপন্যাসটি সম্পর্কে আত্ম কৈফিয়ত দিতে গিয়ে লেখিকা নিজেই লিখেছেন: ‘এটি আমার লেখা প্রথম উপন্যাস।… প্রথম লেখা উপন্যাসের জন্য রয়েছে হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা। আশির দশকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা…। উপন্যাসটিতে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি, ত্রিমুখী প্রেমের জীবনমুখী দ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কিছু বাস্তব চিত্রের বিচিত্রতা উঠে এসেছে।’ এর পরের বিষয়গুলো পাঠককে জানতে হবে উপন্যাসটি পাঠের মাধ্যমে। 

আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে উপন্যাসের কাহিনির সংক্ষিপ্ততম একটি আভাস জেনে রাখা জরুরি। কাহিনি এমনই: একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দাপুটে, চঞ্চল, সঙ্গীতপ্রিয় একটি মেয়ে মুমু। সে শিপলু নামের খানিকটা মাস্তান ধরনের এক ছাত্রনেতার প্রেমে পড়ে। চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যের বিচারে এই জুটির মধ্যে বিশেষ কোনো সাদৃশ্য না থাকলেও প্রজাপতির প্রদীপ শিখার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো মুমু আকণ্ঠ ডুবে যায় শিপলুর মোহবৃত্তে। মেয়ের এই মনোভাব আঁচ করতে পেরে পরিবার মুমুকে বিয়ে দেয় কায়েস নামে পুলিশের এক সাব-ইনসপেক্টরের সাথে। এই বিয়ে মেনে নিতে পারে না মুমু। দিন কয়েকের মধ্যেই সুযোগ মতো পালিয়ে গিয়ে সে বিয়ে করে শিপলুকে। উপার্জনহীন শিপলুর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে মুমু বুঝতে পারে জীবন জগতের রূঢ় বাস্তবতা। এর মধ্যেই দুটি কন্যা সন্তানের মা হয় মুমু। দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে শিপলু। বার বার পেশা পরিবর্তন করে কোথাও স্থিতিলাভ ঘটে না তার। ক্রমে সে প্রবেশ করে নিষিদ্ধ জীবনের কদর্য অন্ধকারে। শিপলুর উপেক্ষা জীবনের নানা টানাপোড়েন সইতে না পেরে মুমু আত্মহত্যা করে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, মুমুর লাশ থানায় নিয়ে যাবার জন্য তার পূর্বতন স্বামী কায়েসকেই আসতে হয় পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে। মুমু তার ভুলের মাশুল দিয়েছে অথচ এমনটি সে চায় নি, কল্পনাও করেনি, কায়েসের এই হৃদয় বিদারক খেদোক্তির মধ্য দিয়েই উপন্যাসের যবনিকাপাত ঘটে।

উপন্যাসের এই যাত্রাপথের দু‘ধারে পথ চলতি মানুষের মতো কিংবা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের মতো আরও নানান ঘটনা দুর্ঘটনার সাথে পরিচয় ঘটে পাঠকের। পাঠক পথ হাঁটতে থাকেন। একটি একটি ঘটনা ঘটতে থাকে সিনেমার পর্দায় দেখা ছবির মতো। মুমু-কায়েস-শিপলু উপন্যাসের প্রধান এই তিনটি চরিত্রের পরিবার পরিজনেরা এক এক করে এসে হাজির হতে থাকে কাহিনির বাঁকে বাঁকে। অনেকগুলো চরিত্রের দেখা মেলে এই উপন্যাসে। কোনো চরিত্র দু‘ একবার উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়, কোনো চরিত্র কিছুটা পথ চলার পর অদৃশ্য হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছায় সেই মুমু-কায়েস-শিপলু। কায়েস মুমুর বিবাহিত স্বামী হলেও সে নায়ক চরিত্র হয়ে উঠতে পারে নি। শিপলুকেও নায়ক বলা যায় না। ‘মাশুল’কে একটি নায়িকা প্রধান উপন্যাস বলা যেতে পারে। 

শাহনাজ পারভীন পূর্বেই স্বীকার করে নিয়েছেন, এটি তার প্রথম লেখা উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস প্রথম সন্তানের মতোই। সে কারণে এই উপন্যাসকে ঘিরে লেখিকার বিশেষ আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালোলাগা ও ভালোবাসা রয়েছে। প্রথম উপন্যাস হলেও তিনি নিশ্চয়ই মনে মনে একটি পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই লেখায় হাত দিয়েছেন। প্রথম উপন্যাস হিসাবে এটি লেখিকার আত্মপরীক্ষার একটি নমুনাও। মূলত এই উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই তিনি পরবর্তী উপন্যাসগুলো লিখতে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রথম লেখা হিসাবে উপন্যাসে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘাটতি এবং দুর্বলতা রয়েছে। এবং সব লেখকের এটা থাকেও। তবু প্রথম লেখা লেখককে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে। অর্থাৎ  শুরু থেকে একজন লেখক কিভাবে নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, পরিবর্তন করেছেন, মত ও পথ বদল করেছেন এইসব বিচারের ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি তার প্রথম লেখা। এসব কথা স্মরণ রেখেই একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার দু‘একটি জিজ্ঞাসা এবং উপলব্ধি লেখিকা এবং অন্যান্য পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চাই। এটাকে মত বিনিময় বললেও ভুল হবে না। 

 যে কোনো ঔপন্যাসিকেরই উপন্যাস লেখার পেছনে একটি উদ্দেশ্য এবং দায়বদ্ধতা থাকে। এই দায়বদ্ধতা নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি সর্বোপরি সময়ের প্রতি; কেবল কাহিনি বর্ণনা বা গল্প শোনানোই ঔপন্যাসিকের দায়িত্ব বা লক্ষ্য নয়। উপন্যাসের মাধ্যমে তাকে একটি বার্তাও পৌঁছে দিতে হবে পাঠকের কাছে। লেখককে হতে হয় কমপক্ষে সমকালীন এবং বিশেষভাবে সময়ের চেয়ে অগ্রগামী। অর্থাৎ কোনোভাবেই যেন পাঠক আগেভাগেই লেখকের মনোভাবকে আন্দাজ করে ফেলতে না পারেন। ‘মাশুল’ উপন্যাসে অনেক ঘটনারই সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু কাহিনির ঠাসবুনন বলতে যা বোঝায়, সেই বুননের গাঁথুনি সর্বত্র নিবিড় হয়ে উঠতে পারে নি। ফলে পাঠক কোনো ক্ষেত্রে পূর্বানুমান করার ফাঁক ফোকর খুঁজে পান। পূর্বেই বলেছি, এই উপন্যাসে নায়ক হয়ে উঠবার মতো কোনো বলিষ্ঠ পুরুষ চরিত্র নেই। পুরো উপন্যাসকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চরিত্র শিপলুও নয়, কায়েসও নয়। নায়িকা প্রধান এই উপন্যাসের নারী চরিত্র মুমু কিছুটা বেপরোয়া, দুঃসাহসী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং বাঁধনছেঁড়া মানসিকতার হলেও অধিকাংশ নারী চরিত্রই একরৈখিক, সমান্তরাল, প্রচলিত সমাজ ও জীবন ব্যবস্থায় আত্মসমর্পিত। গতানুগতিক জীবনপ্রবাহে অভ্যস্ত তারা। কোনো রকম পরিবর্তন বা ভাঙ্গাগড়ার প্রবণতা তাদের চিন্তা চেতনায় কাজ করে না। লেখকের কাজ সমকালীন অচলায়তনকে ভেঙে দেয়া। সে কারণে সমকালে তাঁকে নিন্দিত হতে হলেও পরিবর্তিত যুগব্যবস্থায় পরবর্তীকালে তিনি নন্দিত হয়ে ওঠেন। অচলায়তন ভাঙতে গেলে রক্ষণশীলদের সাথে বিরোধে জড়াতে হয়। তবু এই বিরোধ খুব জরুরি। উপন্যাসের নায়ক কিংবা নায়িকা লেখকের মানস সন্তান। অর্থাৎ লেখকের জীবনদর্শন, ভাবনাচিন্তার প্রতিফলন ঘটে নায়ক নায়িকার মাধ্যমে। রক্ষণশীলতা এবং প্রগতিশীলতার প্রতিষ্ঠাই সময়ের দাবি। 

উপন্যাসে দেখা যায়, লিমার এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার স্বামী বিয়ের রাতেই লিমাকে বোরখা উপহার দেয়। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক একটি জ্ঞানের ধারক এই ডাক্তার যদি লিমাকে নারীর দায়িত্ব, অধিকার, নারীর অজ্ঞতা, নারীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসমস্যা, নারীর পশ্চাদপদতা, নারীর স্বাবলম্বিতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যদি কিছু ইতিবাচক কথা বলতেন তাহলে সেটাই অধিকতর যথার্থ এবং যুক্তিসঙ্গত হতো। তবে এ কথা ঠিক, সাধারণত এই সামাজিক রীতিই সমাজের অধিকাংশে প্রচলিত রয়েছে। লেখিকা সেটির বাস্তব উদাহরণ টেনেছেন। 

স্বামী হিসেবে কায়েসের চরিত্রে লেখিকা এক ধরনের নির্মোহতা বা দৃঢ়তা আরোপ করেছেন। পাঠক জানেন, কায়েসের সাথে মুমুর কোনো পূর্বানুরাগ ছিল না। তারপর বিয়ের দু‘একদিনের মাথায় চরম অসম্মান করে পালিয়ে যাবার পর কায়েস তার প্রবল ব্যক্তিসত্ত্বা এবং পৌরষত্বের অপমানে চুপ থেকেছে, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কায়েস চুপ থেকেছে ঠিকই, কিন্তু মুমুর প্রতি তার প্রবল দুর্বলতাই প্রমাণ করে তিনি একজন যথার্থ প্রেমিক তথা ব্যক্তিত্ববান স্বামী। তথাপিও এই উপন্যাসে ঘটনার পরিপেক্ষিতে প্রবল ব্যক্তিত্ত্বের কারণে চুপ করে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না।  

সরল দৃষ্টিতে এবং প্রচলিত বিধিবিধানের নিরিখে বিচার করলে মুমুকে ভ্রষ্টা নারী বলা যেতে পারে এবং বলাও হবে তাই। কিন্তু আরেকভাবে বিচার করলে বলা যাবে, মুমু প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মূল সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের সমাজে এখনো নর নারীর প্রেমকে সম্মান জানানো হয় না, প্রেমের পরিণতি ভালোমন্দ যাই হোক না কেন। এখনো বহু ছেলেমেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গ এলে তাদের পছন্দের পাত্র-পাত্রীকে সহজে মান্যতা দেওয়া হয় না। বাবা-মায়ের ইচ্ছেটাই প্রাধান্য পায়, তাদের ইচ্ছেটাই চাপিয়ে দিতে চান সন্তানদের ওপর। বিয়েটা যতখানি না সামাজিক তার চেয়ে বহুগুণে বেশি মানসিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক। অর্থাৎ মনের বিরুদ্ধে বিয়ে দেবার বা বিয়ে করার প্রবণতা বা বাধ্যবাধকতা থেকে এখনো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। ফলে ভালো না লাগরেও, পরস্পরকে পছন্দ না হলেও এখনো বহু দম্পত্তিকে প্রেমহীন, ভালোবাসাহীন দাম্পত্যজীবন যাপন করতে হয়। মুমু এই প্রথার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেতে চেয়েছে। যদি মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটার নাম হয় ভালোবাসা তাহলে বলা যাবে ভালোবাসার মানুষকে পেতে চেয়ে মুমু যা করেছে সেটা সমাজের চোখে নিন্দনীয় হলেও এটাই সত্যি। তারমধ্যে কোনো কপটতা নেই। আমরা অধিকাংশ মানুষই মনের কথা এবং মুখের কথা এক করতে পারি না। মুমুর এই বিদ্রোহী সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে লেখিকা প্রথাভঙ্গের দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। তবে মুমুকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়ে লেখিকা আবার তাকে প্রচলিত জীবনব্যবস্থার কাছেই সমর্পন করেছেন। যে মুমু সমস্ত সমাজ ব্যবস্থার বিপক্ষে প্রেমের অধিকার পেতে বিবাহিত স্বামীকে ছেড়ে পুরনো প্রেমিককে বিয়ে করার দুঃসাহস দেখাতে পারে, প্রেমিক-স্বামীর মিথ্যাচার, ভণ্ডামির প্রতিবাদ করতে পারে, স্বাবলম্বী হবার জন্য সেলাই-বুননের কাজ করতে পারে, সেই মেয়ের তো জীবন যুদ্ধে পরাজিত হবার কথা নয়, তার তো জয়ী হবারই কথা। কিন্তু না, আমরা জানি, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং সাহসীরাই কেবল আত্মহত্যা করে। সে যখন তার জীবনের ক্রান্তিকালে নানা জনের কাছ থেকে অসম্মানজনক কটু কথার বাণে জর্জরিত হতে থাকলো এবং সেই কটু কথার কোন প্রতিবাদ না করে যখন তার স্বামী শিপলুও এতে সায় দিয়ে উপরন্তু আরও বাজে, আপত্তিকর, অসম্মানজনক কথা ও কদর্য কাজ করতে থাকে, তখন এক পর্যায়ে সাহসী মুমু আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই আত্মহত্যার মাধ্যমে করুণ বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে এবং একটি রেঁনেসা নারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়েই মুমু হেরে গেল। 

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালকে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখিকা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কিছু চিত্র উপন্যাসে বিধৃত হলেও এই ছাত্র আন্দোলনের কোনো ইতিবাচক সম্ভাবনার আভাস উপন্যাসে মেলে না। এরশাদের শাসনামলের প্রসঙ্গ যখন লেখিকা আনলেনই তখন এরশাদের মৌলিক কিছু অপকর্মের উদাহরণ টেনে আন্দোলনের সঠিক গতি প্রকৃতি নির্দেশ করতে পারতেন। উপন্যাসে তার শিক্ষানীতির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেও সংবিধানকে কাঁটা ছেঁড়া করে তিনি যেভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন, কোনো কোনো কবি, বুদ্ধিজীবীকে কিনে নেবার চেষ্টা করেছেন, পরীক্ষা পদ্ধতির মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছেন, নির্বাচনের নামে প্রহসন করেছেন ইত্যাদি বিষয় তুলে সময়টিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলা যেতো। তবে অন্য দৃষ্টিকোন থেকে বলা যায়, এটা তো একটি মনো-সামাজিক উপন্যাস। তাই রাজনীতির বিশদ আলোচনা না করে লেখিকা এখানে রাজনৈতিক আবহে রাষ্ট্রের সমসাময়িক সময়টাকে ধরতে চেয়েছেন, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদিক থেকে লেখিকাকে সার্থক বলা যায়।

উপন্যাসে ছোট ছোট অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে একের পর এক। একটি ঘটনার পর আরেকটি ঘটনা ঘটার মধ্যে সাহিত্যের পরিভাষায় যাকে উল্লম্ফন বলে, সেটার গতি সর্বত্র রক্ষা পায় নি। সংলাপগুলো আরও পরস্পর ঘনিষ্ঠ হওয়া দরকার। তাছাড়া দুটি চরিত্র যখন পর পর সংলাপ বিনিময় করছে তখন তাদের পারিপার্শ্বিক আবহ, চোখের চাহনি, মুখের ভঙ্গিমা, আবেগের উচ্ছ্বলতা, দুঃখের বিষণ্নতা, ক্রোধের উন্মত্ততা কীভাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে সেই সম্পর্কে লেখিকার বিবরণ, বিশ্লেষণ এবং বিশদ মন্তব্য থাকলে সংলাপগুলো আরও প্রাণবন্ত হতো বলে আমার ধারণা। 

উপন্যাসের একটি চমৎকার ইতিবাচক দিক, বিবরণটি সংক্ষিপ্ততম পরিসরে হলেও, মছলন্দপুর গ্রামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বর্তমান সময়ের অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক ভেদজ্ঞানের অভিশাপে সমাজ যখন বিষাক্ত এবং বিদীর্ণ তখন মছলন্দপুরের এই উদাহরণ আমাদের মনে আশার সঞ্চার করে। লেখিকা লিখেছেন: ‘এখানে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মতো সামাজিক কর্মকান্ডেও সকলে মিলেমিশে একসাথে কাজ করে। স্থানীয় স্কুলগুলোতে পূজা পার্বণে চাঁদা তোলা হয়।… স্থানীয় সুধীজন, ফেরিঘাটের ইঞ্জিনিয়ার, বিভিন্ন অফিস, ব্যাংক, বাজারের দোকানে তারা চাঁদার রসিদ তুলে ধরে। যে যা পারে দেয়, ফেরায় না কেউ।…সব সময় হৈচৈ হয় হিন্দু মুসলমান মিলেমিশে। আনন্দ করে। পূজা শেষ হয়। আবার বছর ঘুরে যখন ঈদে মিলাদুন্নবী আসে তখনও বাজারে চাঁদা তোলা হয় (পৃ. ১৮-১৯)।

উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কোনো কোনো বাক্যের অলংকৃত সৌন্দর্য পাঠকের চোখ টেনে ধরে। সকালের বিবরণ দিতে গিয়ে লেখিকা লিখেছেন, ‘অথচ সকাল হচ্ছে অতি ধীরে কেন্নোর মত বেয়ে, খোঁচা খেয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে,  কিছুক্ষণ পর আবার চলতে শুরু করে (পৃ. ৭)। মুমুর মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে, তিনি বলেছেন, ‘ ফুঁ দিয়ে বাতাস ভর্তি বেলুন যেমন কোনো কিছুর আঘাত পেতে না পেতেই চুপসে যায়, তেমনি ঘন বৃষ্টির সাথে সাথে মুমুর মনটাও হঠাৎ চুপসে যায় (পৃ. ৮)। কবিতায় চিত্রকল্প নির্মাণের মতো লেখিকা উপন্যাসেও চমৎকার চিত্রকল্পের উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

প্রথম উপন্যাস হিসেবে ‘মাশুল’ এ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই আছে এবং সেটা থাকাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা লেখিকা তার পরবর্তীকালের উপন্যাসে পূর্ববর্তী ঘাটতি, দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা এবং পরিপক্কতা দিয়েই নিজেকে পরিমাপ এবং নির্মাণ করতে পেরেছেন। আমি যা বলছি তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধিজাত। অপর পাঠকের কাছে এগুলো সঠিক মনে নাও হতে পারে। কেননা, শিল্প সাহিত্য  মূল্যায়ন করার মতো কোনো গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক সূত্র নেই। তাই ব্যক্তিভেদে পরিমাপকের রদবদল ঘটে। একজন সমালোচক যে শিল্পকে উচ্চাঙ্গের মাহাত্ম্য দেন অপর কোনো সমালোচক তাকে খারিজ করে দেন। সুতরাং আমি যা বলছি তাই-ই ধ্রুব বা অকাট্য সত্যি নয়। সময়ই নির্ভুল এবং নিরপেক্ষ পাঠক এবং বিচারকও। পরিশেষে, আমাদের অর্ধেক আকাশ নারীদের মধ্য থেকে শাহনাজ পারভীন উপন্যাস লিখতে প্রয়াসী হয়েছেন এটি নিঃসন্দেহে আমাদের সাহিত্যের জন্য একটি শুভপ্রদ ইঙ্গিত। তাকে অভিনন্দন, ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা জানাই। জয়তু শাহনাজ পারভীন।