জীবনের ধ্রুবতারা / রফিক জামান

 জীবনের ধ্রুবতারা

 জীবনের ধ্রুবতারা

 জীবনের ধ্রুবতারা

 

‘ তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,

এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।

যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,

আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা। ’

– রবীন্দ্রনাথের বহু আলোচিত গানগুলির মধ্যে একটি। এটি তাঁর প্রথম জীবনের রচনা। ১২৮৭ সালে কার্তিক মাসে “ভগ্নহৃদয়” গীতিকাব্যের উৎসর্গে এটি প্রকাশ পায়। কবির বয়স তখন মাত্রই উনিশ বছর, অর্থাৎ একেবারেই তিনি তখন তরুণ কবি। গানটির শব্দ প্রয়োগ ও এর সুর রোমান্টিক মনে অপূর্ব সুর তোলে। প্রথমতঃ গানটির উৎসর্গ ও বিবর্তন, এবং দ্বিতীয়ত এটির অন্য আরেকটি ঐতিহাসিক মূল্য। গানটি মাঝে কয়েক দফায় কিছু কিছু পরিবর্তিত হয়ে বতর্মান রূপ লাভ করেছে। বারে বারে নানা আলোচনায় এই গান উঠে এসেছে।

গানটি  ভগ্নহৃদয়-এর  উৎসর্গপত্রে  উৎসর্গ করা হয়েছিল ‘শ্রীমতী হে’ কে। এই ‘শ্রীমতী হে’-র পরিচয় নিয়ে একসময় একটু দ্বিধা দ্বন্দ্ব হয়তো ছিল, তবে পরে মনে করা হয় ইনি প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী। আসলে উইলিয়াম শেকসপিয়রের  ম্যাকবেথ নাটকের প্রধান ডাইনি চরিত্রের নাম ছিল হেকেটি, রবীন্দ্রনাথও কাদম্বরীকে মাঝে মাঝে রঙ্গচ্ছলে এই নামে ডাকতেন। 

শেকসপিয়রের ‘ দি ট্যাজেডি অব ম্যাকবেথ ‘ একটি ট্র্যাজেডি। সম্ভবত ১৬০৬ সালে এই নাটকটি প্রথম মঞ্চায়িত হয়েছিল। যাঁরা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা কেড়ে নিতে চান, তাদের উপর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তব ও মানসিক প্রভাব এই নাটকে দৃশ্যায়িত হয়েছে। স্কটল্যান্ডের দুঃসাহসী সেনাপ্রধান ম্যাকবেথ একদা তিন ডাইনির ভবিষ্যদ্বাণী থেকে জানতে পারেন যে, একদিন তিনি স্কটল্যান্ডের রাজা হবেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রলুব্ধ এবং নিজের স্ত্রীর কৃতকর্মের দ্বারা তাড়িত হয়ে ম্যাকবেথ স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকানকে হত্যা করেন এবং স্কটল্যান্ডের সিংহাসন অধিকার করে বসেন। কিন্তু তারপরই অপরাধবোধ প্রসূত এক মানসিক বিকৃতির বশে শত্রুতা ও সন্দেহের হাত থেকে নিজেকে রক্ষে করতে একের পর এক খুন করতে বাধ্য হন তিনি। সেই সঙ্গে ম্যাকবেথ হয়ে ওঠেন এক স্বৈরাচারী শাসক। একের পর এক ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড এবং তার ফলে গৃহযুদ্ধের ফলে ম্যাকবেথ ও তার স্ত্রী দু’জনেই উন্মাদ হয়ে যান। অবশেষে লেডি ম্যাকবেথ আত্মহত্যা করেন এবং ম্যাকবেথ লর্ড ম্যাকডাফের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। ঐতিহাসিকভাবে ডাফের বংশধর ছিলেন ইংল‍্যান্ডে দশম শতাব্দীর রাজা।

অপরদিকে ‘অ‍্যামোরেটি’ ১৬ শতকে বৃটিশ কবি এডমন্ড স্পেন্সারের লেখা একটি সনেট চক্র। অ‍্যামোরেটি কবিতায় কবি এডমান্ড স্পেন্সার নিজের জীবনকে এমন একটি জাহাজের সাথে তুলনা করেছেন, যে জাহাজটি প্রশস্ত মহাসাগর দিয়ে যাত্রা করেছে, সে জাহাজ তারার নির্দেশনায় পথ দেখে।  কিন্তু যখন তারাটিকে ঝড় এসে ঝাপসা করে দেয়, তখন জাহাজটি তার পথ থেকে বিপথে চলে পথ হারায়। কবিও তাঁর জীবন জাহাজের তারা না দেখতে পেয়ে পথহারা; যে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি কবিকে সঠিক পথে পরিচালিত করত তা এখন মেঘের সাথে একাকার হয়ে গেছে এবং কবি অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর চারদিকে লুকিয়ে থাকা বিপদ নিয়ে তিনি হাতাশাচ্ছন্ন। তবুও কবি আশাবাদী যে, এই ঝড় শেষ হয়ে গেলে, কবির জীবনের মেরু তারকা আবার জ্বলবে এবং কবিকে মনোরম আলো দেখানোর সাথে সাথে তাঁর দুঃখের মেঘগুলি অদৃশ্য হয়ে যাবে।

যেহেতু দুটো কবিতার অর্থ হুবহু একই এবং এদের মধ্যে এডমন্ডের কবিতাটি ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত অর্থ্যাৎ কবিতাটি রচনাকালে প্রায় ২৫০ বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃথিবীতে আগমন সেহেতু পাঠকরা ভেবে থাকেন রবি ঠাকুরের এই কবিতাটি এডমান্ডের সনেট কাব্যগ্রন্থের ‘অ্যামোরেটি’ কবিতার বঙ্গানুবাদ মাত্র। বিষয়গুলি নিয়ে যদিও বিতর্ক রয়েছে। সে আলোচনায় নাইবা গেলাম। আসল কথা রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবন, আমাদের প্রাণ, আমাদের মনের কথা বলে।

রবীন্দ্রনাথ বঙ্গজীবনের অঙ্গই শুধু নন, তাঁকে ছাড়া বাঙালি কার্যত অচল। জীবনের যেকোন রঙে জড়িয়ে আছে তাঁর লেখনী। আনন্দের মুহূর্তে হৃদয়ে দোলা দেওয়া কিংবা দুঃখে ভেঙে পড়ার সময় বলিষ্ঠ হাত খুঁজে নেওয়ার অন্যতম ভরসা যে রবীন্দ্র-গানই। সমুদ্রে শয্যা পাতলে শিশিরের ভয়ও তুচ্ছ হয়ে যায়। রবির কিরণ শুধু সমুদ্রের অবাধ্য ঢেউয়ের পায়ে বেড়ীই পরায়নি, শিশির থেকে বাঁচতে বাঙালির মাথায় ছাতাও ধরেছে।

`চির নূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ !’ নিজের কলমেই জন্মদিন যাপন করা কবিকে যে কোন শিকলে  বাঁধা সম্ভব নয়, তাঁর বিরাজ সর্বদিকে। ফলে বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়া রবীন্দ্রনাথকে অচলায়তনের আগলে আটকানো অসম্ভব। প্রতিটি বয়সে, প্রতিটি মুহূর্তে সঙ্গী হন তিনি । তাঁর উপলব্ধিতে বাঙালি শুধু সমৃদ্ধই হয়নি, স্নেহের পরশ পেয়েছে প্রতিটি ক্ষণে।

রফিক জামান
রফিক জামান