পুনর্জীবন / আফরোজা পারভীন

পুনর্জীবন
পুনর্জীবন / আফরোজা পারভীন
অনেকদিন ধরে কিছুই লিখতে পারছে না পলা। না গল্প, না কবিতা, না অন্য কিছু। খুব চিন্তিত সে। বিশেষ বিশেষ দিনে বন্ধুরা কত কত নতুন গল্প কবিতা লিখছে, খবরের কাগজে প্রকাশ হচ্ছে। ফেসবুকে পোস্ট করছে। অথচ পলার কলম দিয়ে একটা শব্দ গলছে না। তবে কী বন্ধ্যা হয়ে গেছে তার কলম!
এ কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয় সে। সামনে খোলা ল্যাপটপ। বহুদিন ধরেই কলমে লেখে না সে। ছেলেবেলায় একটা কলম পেলে কত যত্নে রাখত সে। আর এখন চারদিকে ছড়ানো গুচ্ছের কলম। কত তার রূপ, কত তার রঙ। অথচ তার বেশিরভাগেই লেখা হয় না। লেখা হয় না বলে লিখতে গেলে কালি থাকে না। কোনটার দেহ আছে ক্যাপ নেই,, কোনটার ক্যাপ আছে দেহ নেই। এ এক অদ্ভুত বিরক্তি! আজকাল কলমের ব্যবহার হয় শুধু ফোন নাম্বার বা দুই একটা টুকিটাকি লিখতে। বাজারের লিস্ট লেখারও এখন দরকার নেই । জিনিস আসে অনলাইনে। চিঠিপত্রের চল উঠে গেছে। কথা বলতে হলে হয় চ্যাট না হয় ফোন। কাগজের বালাই নেই, নেই কলমের, নেই খামের। ডাকপিয়নের অস্তিত্ব আজ আর বোধহয় নেই। আছে কী জানতে হবে। সুকান্তর কবিতা ‘রানার’ এখন আজকারলর ছেলে মেয়েদের কাছে অনেকটাই অচেনা। নেই ‘টেলিফোন, নেইরে পিয়ন, নেইরে টেলিগ্রাম বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পাঠাইতাম’ একটা গানের কলি । এই গানটা শুনলে আগে খুব হাসি পেত পলার। এখন পায় না। সত্যিই তো পিয়নও নেই, টেলিগ্রামও নেই। এখন আর কেউ আরর্জেন্ট টেলিগ্রাম পায় না। ‘মাদার সিরিয়াস কাম সার্প’। পড়িমড়ি বাড়ি গিয়ে দেখে না মাদার দিব্বি আছে, বাপ বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তবে পিয়ন টেলিগ্রাম না থাকলেও মনের কথা আদান প্রদানের সমস্যা নেই। প্রযুক্তি আছে হাতের মুঠোয়।
ল্যাপটপে কালো কালো অক্ষর ভেসে না উঠলেও ভাবনা থেমে ছিল না পলার। আজকাল ও বড় বেশি ভাবে। বয়স যত বাড়ছে তত ভাবনা বাড়ছে, এটা বোধহয় বয়সের সমস্যা। আগে তাদেও বাড়িতে চিঠি রাখার জন্য তার দিয়ে বানানো একটা রিং ছিল। চিঠি এলে পড়ার পর সেখানে গেঁথে রাখা হত। তারপর এলো আধুনিকতা। চটের ব্যাগ হল লেটার রাখার বক্স। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই থাকত লেটারবক্স। কোথায় গেল সে দিনগুলো! পুরোনো দিনের সবই কী খারাপ ছিল! নতুন নতুন করে আমরা হারিয়ে ফেললাম চিঠি ধরার, ছুঁয়ে দেখার, পড়ার, বুকের মাঝে লুকাবার আনন্দ!
ভেবে চলে পলা। পলার বয়স সত্তর। মেয়ে বিদেশে থাকে। ছেলে দেশে। সবাই ব্যস্ত। কত কাজ ওদের। পলার ব্যস্ততা কম নয়। লেখালিখি আছে। তাছাড়া শেষ বয়সে শরীরকেন্দ্রিক ব্যস্ততা অনেক। নিয়ম করে ওষুধ খেতে হয় । ব্যায়াম করতে হয়। সে ওষুধের কত রকম। খাবারের মধ্যে আগে পরে ঘন্টা ধরে। এই বয়সে কী এত মনে থাকে! বৌমা লাল নীল হলুদ রঙে তিনবেলা ভাগ করে চার্ট বানিয়ে দিয়েছে। তাতেও ভুল হয়। আগে বাক্সে রাখত ওষুধ। সুদৃশ্য বক্স বেরিয়েছে আজকাল। একবারে সাতদিনের ওষুধ রাখা যায়। কখনো ছেলে কখনো বউমা ওষুধ গুছিয়ে রাখত। একদিন এক বন্ধু বলল, ওতে নাকি গুণাগুণ নষ্ট হয়, বক্স এয়ারটাইট না। সেই থেকে বক্স বাদ। দু’দুটো বক্স পড়ে আছে অবহেলায়। আগে ওদের কত দাম ছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কারো দাম থাকে না। একদিন তারও কোন দাম থাকবে না। এখনও যে খুব একটা আছে মনে হয় না। থাক দাম দিয়ে সে করবে কী! কিন্তু দাম নেই এ কথা লেখা যাবে না কোন গল্পে। বেশিরভাগ পাঠক গল্পের নায়ক- নায়িকার সাথে লেখককে একাকার করে ফেলে। এ ব্যাপারে শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই এক। কাজেই সে যদি লেখে বয়স বাড়লে দাম থাকে না তাহলে চেনা পাঠকরা ভাববে, সংসারে তার বুঝি কোন দাম নেই। তার ছেলে মেয়ে বৌমা কোন দাম দিচ্ছে না। ব্যাপার সেটা নয়। ব্যস্ততা যেন কেমন সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। কে যেন বলেছে বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর! পলার মনে হয় একবছরও না। শোক করার জন্য সময় দরকার। সময় কোথায়!
রাত বেড়ে যাচ্ছে। প্রেসারের মারাত্মক সমস্যা পলার। রাত জাগা বারণ। ঘুমের ওষুধ খাবার পরও ঘুম হয় না। অথচ পলা নিশ্চিত কিছু না লিখে বেডে গেলে এমনিতেও তার ঘুম হবে না। এতো এক মহাবিপদ!
পলা একটা গল্পের প্লট ভারতে চেষ্টা করে। কোন কিছুই মাথায় আসে না। আচ্ছা ছেলেবেলায় যে দু’বাড়ি পরের ছেলেটা তার জন্য লিপস্টিক কিনে এনেছিল সেটা নিয়ে একটা গল্প লিখলে কেমন হয়! কিংবা ওই যে স্কুলে একটা ছেলে যে তাকে বড় বড় করে চক দিয়ে বোর্ডে ভালবাসি লিখে দিয়েছিল। আর পলা সাথে সাথে অঙ্কের দিদিমণিকে সেটা দেখালে দিদিমনি ছেলেটাকে কান ধরে বেঞ্চে দাড় করিয়ে রেখেছিল। সেটা লিখলে কেমন হয়! আচ্ছা কী যেন নাম ছিল ছেলেটার । কিছুতেই মনে করতে পাওর না পলা। তবে মনে পড়ে কর্মব্যস্ত ঢাকায় একবার দেখা হয়েছিল পলার সাথে। তখন সে একেবারেই বদলে গেছে। বদলাবারই কথা। ক্লাস সেভেনের ছেলের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কী কোন মিল থাকে, না একরকম থাকে! একটা মেয়ের হাত ধরে ঘুরছিল। পলাকে দেখে তার হাসি বেড়েছিল। ভাবখানা এমন ছিল যেন, দেখ দেখ আমি কিন্তু ঠিকই পেয়ে গেলাম। তোমার অহংকারে বারোটা বাজল।
বারোটা বাজেনি পলার। তার জীবনেও প্রেম এসেছিল। দুর্দান্ত প্রেম। তিনদিনের প্রেমে বিয়ে হয়েছিল তাদের। বাধা পড়েছিল সারাজীবনের মতো। শালকাঠের মতো কঠোর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে বলেছিল,
:আসাদকে ছাড়া বিয়ে করব না বাবা।
বাবা হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। সারাজীবন যে মেয়ে মুখের সামনে দাঁড়িয়ে একটি কথা বলেনি, কথা বলেনি সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে, সে কিনা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছে এভাবে। বাবা বিষয়ী মানুষ, বুদ্ধিমান। ভালবাসেন মেয়েকে। মেনে নিয়েছিলেন, তবে আসাদকে বাজিয়ে নিয়ে।
মাত্র পাঁচবছরের সংসার ছিল আসাদ পলার। ওটা কী সংসার নাকি প্রেমকানন। বিয়ে করলে নাকি প্রেম থাকে না, এটা বহুল প্রচলিত বাক্য। কিন্তু ওদের জীবনে প্রেম ছিল। দুর্মর প্রেম। পাঁচটা বছর যেন কেটে গেল এক লহমায়। অনিককে হাসপাতালে দেখে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে আসাদ বলল,
: আমাদের প্রেমের ফসল।
অনেকে বলে সন্তান নাকি জৈবিক ফসল। কিন্তু পলা আসাদের জীবনে কোনদিন প্রেমবিহীন যৌনতা আসেনি। দু’হাতে নার্সদের টাকা দিয়েছিল সাধ্যাতীত। শেষে হাত চেপে ধরেছিল পলা। ঘরে নতুন বাচ্চা এলো, অনেক খরচ। খুশি হয়নি মোটেও আসাদ। ভাবখানা এমন যেন সব খরচই কুলিয়ে যাবে তার পকেটের পয়সায়। কিন্তু পলা জানে কুলোবে না। তারপর নীল যখন এলো তখন পাগলের মতো বুকে জড়িয়ে নিয়ে আসাদ বলল,
: মেয়েই তো চেয়েছিলাম। ঠিক এমন একটা মেয়ে।
সেই মেয়ে বিদেশে সংসার করছে। সন্তান সম্ভবা। অন্য মায়েদের মতো পলারও তো এসময় তার কাছে যাবার কথা। পারেনি। শরীর সায় দেয়নি।
মেয়ের তখন দু বছরও হয়নি। এক সন্ধ্যায় বাড়িতে আসাদের বদলে তার বডি এলো। আস্ত মানুষটাকে বিকেলের স্বচ্ছ আলোয় বাস চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে একটা ডবলডেকার। সে রং সাইডে দাঁড়ায়নি বা হুড়মুড় করে উঠতেও চেষ্টা করেনি। হ্যান্ডেল ধরে ঝোলেওনি। দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক যেখানটায় দাঁড়াবার কথা। বাড়িতে পলার আর দু সন্তানের কাছে ফেরার অপেক্ষায়। বাসটা ছুটে এসে চাপা দিল ওকে। হয়ত ওদের গভীর প্রেম সহ্য হচ্ছিল না তার। যন্ত্র কী হিংসা করতে পারে! কে জানে!
আসাদকে আজিমপুরে শোয়াবার পর একা হয়ে গেল পলা। একেবারে একা। চারপাশে সবাই ছিল, তারপর ও ছিল ঘোরতর একা। কিন্তু দুটি সন্তানকে বড় করার লড়াইয়ে একা ভাবার সুযোগ তার ছিল না। চাকরিতে তখনই ঢোকে পলা। আর এইতো যেন সেদিন অবসরে গেল। তাও তো দেখতে দেখতে বিশ বছর।
পলা লেখক । খুব নামকরা নয়, তবে অখ্যাতও নয়। এখনও লেখাই ওর আশ্রয়। না আজ আর হবে না। পলা ওঠে। ওঠার সাথে সাথে মনে হয়, যেন চড় চড় করে নেমে যাচ্ছে প্রেসার। ধপ করে বসে পড়ে সোফায় । এখন ওঠা উচিত হবে না। কিন্তু বিছানায় যেতে হবে যে, শুতে হবে। তার আগে তো একবার বাথরুমে যেতে হবে। পলা ওঠে।
২
তিনদিন পর জ্ঞান ফেরে ওর। হাসপাতালের বেডে মুখের ওপর ঝুঁকে আছে ছেলে, পাশে বউমা। আত্মীয় স্বজন ঘিরে আছে ওকে। অবাক পলা সবাইকে দেখে। এখানে কখন এলো সে। ছেলে বলে,
: বেশি নড়াচড়া করো না। তুমি তিনদিন ধরে হাসপাতালে
ডাক্তারদের মুখে হাসির ঝিলিক। জ্ঞান ফিরেছে পেসেন্টের।
: কী হয়েছে বাপ। আমি হাসপাতালে কেন?
: কথা বলো না মা। তুমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। বাকিটা পরে শুনো।
পলা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সে মনে হয় আর বাঁচবে না। কিন্তু সন্তানের এই মততামাখা মুখ ছেড়ে সে যাবে কোথায়!
: বাবা আমি বাঁচব তো?
: বাঁচবে মানে, একশ বার বাঁচবে। তোমাকে তো বাঁচতেই হবে। তোমাকে ঘোড়া হতে হবে না।
: ঘোড়া!
: তোমার একটা নাতনি হয়েছে। নীলের মেয়ে।

Facebook Comments Sync