বিদেশীদের চোখে বাংলাদেশের গণহত্যা
দৃষ্টিগোচরে শোণিত ধারা
পরমুহূর্তে রাথোর আবার বললো, অবশ্যই আমরা শুধু হিন্দুই মারছি। আমরা সৈনিক। বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই। ওরা আমাদের নারী এবং শিশুদের হত্যা করেছে।
পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ সবুজ ভূমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শোণিত ধারা দেখতে পেলাম। প্রথম দেখি অবাঙালিদের উপর পরিচালিত হত্যাকান্ড। সেটা ছিল তাদের উপর বাঙালিদের একই ধরনের বন্য ঘৃণার প্রকাশ। আর এখন দেখছি আরেকটি হত্যাযজ্ঞের শিকার হিন্দুরাই শুধু নয়-যারা এখানকার পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ১০ শতাংশ, হাজার হাজার মুসলমানও। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং ১ লাখ ৭৬ হাজার বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ যাকেই ধরতে পারছে, হত্যা করছে। এই সৈনিক ও পুলিশরা ২৬ মার্চ স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্রোহ করে। সেটা দৃষ্টি আকর্ষণ হলেও ছিল অসময়োচিত এবং শুরুটাও ছিল অপরিকল্পিত।
এপ্রিলের শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় দশ দিন অবস্থানকালে যা শুনি এবং দেখি, তা ছিল অবিশ্বাস্য। এবং আমার কাছে অতি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই হত্যাযজ্ঞ মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কমান্ডারদের কোন বিচ্ছিন্ন কাজ নয়।
পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা কেবল পূর্ব বাংলায় হত্যাকান্ড চালাচ্ছে না। ২৫ মার্চ বাঙালি সৈনিক ও আধা সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালিদের উপর হামলা চালায়। নৃশংস ও বর্বর ধরনের ছিল সে হামলা। এই রিপোর্টটুকু কাটছাট করে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ছাপাতে অনুমতি দিয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হবার সময় হাজার হাজার দুর্ভাগা মুসলিম পরিবার পাকিস্তানকে তাদের আবাসভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিল। নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। তাদের নারীরা ধর্ষিতা হয়েছে। বিশেষ ধরনের ছুরি দিয়ে তাদের স্তন কেটে নেয়া হয়। সেই নৃশংসতা থেকে শিশুরাও রেহাই পায়নি। যারা ভাগ্যবান, তারা তাদের মা বাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছে। আর এ ধরনের হাজার হাজার বেঁচে আছে, যাদের চোখ তুলে দেয়া হয়েছে, হাত পা কেটে ফেলা হয়েছে। চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোর শহরে ২০ হাজারের অধিক অবাঙালির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পূর্ব বাংলার সর্বত্র আমাকে বলা হয়েছে, নিহতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। কেননা হাজার হাজার অবাঙালি নিখোঁজ রয়েছে। পাকিস্তান সরকার প্রথম নৃশংসতার সংবাদটি বিশ্বকে জানিয়েছে। আর দ্বিতীয় হত্যাযজ্ঞটি যা নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে ভয়ঙ্কর রকমের ভীতিপ্রদ এবং যে হত্যাকান্ডটি পরিচালনা করছে তাদেরই সৈন্যরা, সেটার কথা চেপে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা গোপনে হিসেব করছে যে, উভয়পক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার লোক নিহত হয়েছে। দুর্ভিক্ষ আর আর রোগ ব্যাধিতে যারা মারা গেছে এ তালিকায় তারা আসেনি।
দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা অধ্য্যুষিত প্রদেশের সফল বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার পূর্ববাংলার সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে নিজস্ব পদ্ধতিতে এগিয়ে চলেছে।
আমাকে ঢাকা ও কুমিল্লার পদস্থ সামরিক কর্মকার্তারা বার বার বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদের হুমকি আমরা চিরকালের জন্যে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাই। এর জন্যে যদি ২০ লাখ মানুষ হত্যা করতে হয়, এই প্রদেশকে যদি ৩০ বছর ধরে উপনিবেশের মতো করে শাসন করতে হয় তাও করবো।
পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার আগাগোড়া সর্বব্যাপী সন্ত্রাস করেছে। এখনও অবিকল সেটাই করছে। চাঁদপুর পরিদর্শন শেষে আমরা অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিলাম (রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ঘরের ভেতরই থাকে, এক্ষেত্রে তারা বিচক্ষণই বটে।) এ সময় টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পেছন সিটে বসা একজন জওয়ান চিৎকার করে উঠলো, একটা লোক দৌড়াচ্ছে সা’ব।
মেজর রাথোর ঝট করে গাড়ি থামিয়ে দিল এবং গাড়ির দরজার সঙ্গে ঠেক দিয়ে রাখা হালকা চীনা মেশিনগানটা তুলে নিল। দু’শ গজ দূরত্বে হাঁটু সমান উঁচু ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে লোকটা দৌড়ে পালাচ্ছিল।
“তোমার ঈশ্বরের দোহাই, গুলি করো না।” আমি চিৎকার করে উঠলাম, “ও নিরস্ত্র, গ্রামের সাধারণ মানুষ।” রাথোর আমার দিকে নোংরা দৃষ্টি হেনে হুঁশিয়ারিসূচক গুলি ছুঁড়লো। লোকটি কার্পেটের মতো বিছানো সবুজ ক্ষেতের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো। দুজন জওয়ান এগিয়ে গেল তাকে ধরে আনতে। প্রথমে ঘাড়ের ওপর রাইফেলের কুঁদো দিয়ে বাড়ি মারা হল। তারপর শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ:
“কে তুমি?”
“মাপ করে দেন সাব। আমার নাম আবদুল বাকী। ঢাকার নিউমার্কেটে দর্জিগিরি করি।”
“মিথ্যা বলবে না। তুমি হিন্দু। দৌড়াচ্ছিলে কেন?”
“সান্ধ্য আইন বলবৎ হবার সময় হয়ে গেছে। নিজ গ্রামে যাচ্ছিলাম।”
“সত্য কথা বল। দৌড়াচ্ছিলে কেন?”
জবাব দেয়ার আগেই একজন জওয়ান অস্ত্রের সন্ধানে ঝট করে তার শরীরে তল্লাশি চালাতে শুরু করে দিল। আরেক জন ঝটকা টানে তার লুঙ্গি খুলে ফেললা। তার চর্মসার দেহটি এখন পুরোপুরি নগ্ন। খৎনার চিহ্ন স্পষ্ট দৃশ্যমান। খৎনা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক।
পরিষ্কার দেখা গেল যে, বারী হিন্দু নয়। জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রইল।
“বল, দৌড়াচ্ছিলে কেন?” এবার ভয়ে বারীর চোখ বড় হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। হাঁটু মুড়ে বসে মিনতি শুরু করলো। এক জোয়ান তাকে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজের পায়ের ওপর এনে ফেললো। বললো, “স্যার, ওকে ফৌজি বলে মনে হচ্ছে।” (ফৌজি একটি উর্দু শব্দ। অর্থ সৈনিক। সেনাবাহিনী যে সব বাঙালি বিদ্রোহীদের খুঁজে ফিরছে, তাদের বেলায় এ শব্দটি ব্যবহার করে।)
“হতে পারে,” বিড় বিড় করে রাথোর। চোখে মুখে হিংস্রতা।
রাইফেলের কুঁদো দিয়ে আবদুল বারীকে বেশ কয়েকবার বাড়ি মারা হলো। এরপর এক অশুভ উদ্দেশ্যে তাকে দেয়ালের সঙ্গে ঠেক দিয়ে দাঁড় করালো। এবার সে করুণা ভিক্ষার স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। এ সময় কাছাকাছি একটি কুঁড়ে ঘরের পাশ থেকে এক কিশোরকে উঁকি মারতে দেখা গেল। বারী চিৎকার করে বাংলায় তাকে কী যেন বললো। তরুণ অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কুঁড়ে ঘর থেকে পা টেনে টেনে হেঁটে দাঁড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ এসে হাজির হলো।
রাথোর তাকে জিজ্ঞেস করলো “তুমি চেন লোকটাকে?”
“হ্যাঁ সাব। ও আবদুল বারী।”
“সে কী সেনাবাহিনীর লোক?”
“না, সা’ব। ও ঢাকায় থাকে। দর্জিগিরি করে। খোদার কসম সা’ব ও একজন দর্জি।”
হঠাৎ করেই নীরবতা নেমে এলো। রাথোরকে কিছুটা অপ্রতিভ মনে হলো। আমি বললাম “ঈশ্বরের দোহাই, ওকে যেতে দিন। তার নির্দোষিতা প্রমাণের জন্য আর কী চাই আপনার?” কিন্তু জওয়ানটির বিশ্বাস হলো না, মারধোর করে চললো। তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম আবার এবং রাথোর তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিল। ততক্ষণে সে ভয়ে নির্বাক জড় প্রাণীতে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেল সে।
আর আর লোকেরা বারীর মতো ভাগ্যবান ছিল না।
চাঁদমারির জন্য ট্রাকভর্তি আদম সন্তান
কুমিল্লার নবম ডিভিশন সদর দফতরের অফিসারদের সাথে আমি ছ’দিন ধরে ঘুরেছি। হত্যালীলার ব্যাপকতা আমি কাছাকাছি থেকে দেখেছি। আমি দেখেছি হিন্দুদের গ্রাম থেকে গ্রামে, এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে তাড়িয়ে ফেরা হচ্ছে এবং ত্বরিত অনুসন্ধানে দেখা হচ্ছে খতনা হয়েছে কীনা। তারপর গুলি চালানো হচ্ছে। কুমিল্লার সার্কিট হাউজ চত্বরে (বেসামরিক প্রশাসনিক সদর দফতর) পিটিয়ে হত্যা করা মানুষের মর্মন্তুদ চিৎকার আমি শুনেছি। চাঁদমারির জন্য ধরে আনা মানুষ ভর্তি ট্রাক আমি দেখেছি এবং তাদের সাহায্যের চেষ্টা যারা করেছে, তাদেরকেও টেনে হিঁচড়ে তোলা হয়েছে ‘ব্যবস্থা’ করার জন্য- অন্ধকার এবং কারফিউর আড়ালে। “হত্যা এবং জ্বালাও পোড়াও” মিশনের নিষ্ঠুরতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। বিদ্রোহীদের উচ্ছেদের পর সেনাবাহিনীর ইউনিট শহর এবং গ্রামে একই হত্যালীলা ও লুন্ঠনের মিশন চালিয়ে গেছে।
‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নেয়ায় ধ্বংস হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। আমি স্বচক্ষে দেখেছি এগুলো। রাতে অফিসার মেসে দিনের হত্যাকান্ড নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প হয়। এমন সব লোকের মুখে এসব গল্প শুনেছি যারা অন্যদিকে সাহসী এবং সম্মানীয় হিসেবে বিবেচিত। “কতটা ফেলেছো?” জবাব আমার অনুভূতিকে বিবশ করে দেয়।
“এসব কেন করা হচ্ছে,” জিজ্ঞেস করলে পশ্চিম পাকিস্তানি মাত্রই বলবে, ‘পাকিস্তানের ঐক্য, সংহতি ও আদর্শ রক্ষার জন্যে।’ অবশ্য এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাঝখানে ভারতীয় ভূখন্ড দেশের এক অংশকে আরেক অংশ থেকে হাজার মাইলের দূরত্বে আলাদা করেছে। তাকে এক রাখার জন্য যে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, তা ইতোমধ্যে তার আর্দশিক ও ভাবাবেগের ভাঙনকে অনিবার্য করে দিয়েছে। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখা যেতে পারে কেবলমাত্র কঠোর সামরিক চাপের মধ্যে রেখে। আর সামরিক বাহিনীতে কর্তৃত্ব করছে যে পাঞ্জাবিরা তারা ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালিদের অপছন্দ করে, ঘৃণা করে।
ভাঙনটা এতই ব্যাপক যে স্বল্পসংখ্যক বাঙালি আজ পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকতে চাইবে। ঢাকা সফরকালে এক পুরোনো বন্ধুর বাড়িতে গেলে এ ব্যাপারে এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জন করি। ইতোমধ্যে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বললেন, “পরিস্থিতি বদলে গেছে। আপনি আর আমি যে পাকিস্তানকে জানতাম, তা আর থাকছে না। সেটা এখন পশ্চাতে ফেলে রাখতে পারি।”
এক ঘন্টা পর, সামরিক বাহিনীর এক পাঞ্জাবি অফিসার সেনাবাহিনী পৌঁছানোর আগে অবাঙালি নিধন সম্পর্কে বললেন, “১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তিকালে শিখরা আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছিল তার চেয়েও নৃশংস হয়েছে বাঙালিরা। আমরা কীভাবে ভুলে যেতে পারি অথবা ক্ষমা করতে পারি।”
Facebook Comments Sync