আশির দশকের ঘটনা।  দিন তারিখ আজ আর মনে নেই। তবে মনে আছে সেদিনের ঘটনাটি। জীবন ও জীবিকার ব্যস্ততায় আশেপাশের মানুষদের সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুয়োগ ছিলো না। তারপরও সন্তানদের মাধ্যমে খবরাখবর পেতাম। প্রয়োজনে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও করতাম।

সেদিন বেশ রাত করেই আমরা ঘুমোনোর আয়োজন করছি। হঠাৎ আমাদের তিনবাড়ি পরের বাড়ির শোরগোলে পুরো এলাকা জেগে উঠলো। মাঝে মধ্যে তাদের কান্না আর চিৎকারে বুকের মধ্যে টান পড়ছিলো। বিছানার আয়েশ ফেলে ছুটে গেলাম ঘটনাস্থলে। ততোক্ষণে সেখানে অনেকেই পৌছে গেছেন। ছোট পরিবার। বলতে গেলে এ পাড়াতে তারা নতুনই। অনেকের সাথেই তাই তেমন চেনা পরিচয় হয়ে ওঠেনি। আমার সাথে আজই প্রথম সাক্ষাৎ।

যাকে কেন্দ্র করে এই রাত দুপুরে পাড়া সরগরম, তিনি ততোক্ষণে পৌঁছে গেছেন স্থানীয় হাসপাতালে। উপস্থিত সকলের চোখে মুখে বেদনার ছাপ। বসার ঘরে সোফার উপরে বসে কাঁদছে নয়-দশ বছরের একটি ছেলে। পাশের ঘরে খাটে বসে ফোঁফাচ্ছে তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় বোন। বেদনাবিধুর পরিবেশ!!

ঘটনাটি অতি সাধারণ। অহরহ বিদ্যুতের আসা যাওয়ায় পাড়াময় আলো অন্ধকারের জটলা চলে। অন্ধকারে জীবন থেমে যেতে পারে না ভেবেই হ্যারিকেনকে বিপদের বন্ধু করে নিতে হতো। আমরাও একই পদ্ধতিতে আঁধার তাড়িয়ে জীবন সচল রাখি। এই হ্যারিকেনকে নিয়েই সেদিন এই পরিবারে মারাত্মক ঘটনাটি ঘটে গেলো।

ঘটনাটি এমন-

সংসারের যাবতীয় কাজ শেষ করে ঘুমোতে যাওয়ার আগে গৃহিনী হ্যারিকেনের আলো নেভানো জরূরী মনে করলেন। কেরসিনের অপচয় তো সংসারে অর্থেরই অপচয়। তিনি আলো নেভানোর জন্য হাত বাড়ালেন। তিনি জানতেন বিকল পুরাতন হ্যারিকেনের ফিতা ওঠা নামা করে না। তাই কাঁচ উঁচু করে ফু দিয়ে নেভাতে হয়। সেদিন তেলের মুখটা কখন, কোথায় খুলে পড়েছে, তার চোখে পড়েনি। ঘুমোতে যাওয়ার আগে অনেকেরই এমন অনেক কিছু মনে পড়ে না। তিনি যেইমাত্র ফুঁ দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়েছেন, অমনি তেলের খোলা মুখ দিয়ে আগুন এসে পড়ে তার বুকে। জ্বলে ওঠে তার সিনথেটিক্সের শাড়ি। নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শরীরে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গৃহকর্তার ছোটাছুটি।।

হায়রে নিয়তি! কি ভাবে, কখন, কিযে হয় জানেনা মানুষ! কেবলই পুতুলসম আমরা বিশ্ববিধাতার হাতে। হাসপাতালে সকল চিকিৎসা আর সেবার মাঝেই তিনি মৃত্যুর সাথ পাঞ্জা লড়ে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন।তার অকাল মৃত্যুতে একটা সুন্দর পল্লবিত সংসার নিমজ্জিত হলো হতাশার অন্ধকারে।

এবার প্রসঙ্গে আসি-

প্রতিনিয়ত জীবন, জগত সংসারে এমন সব করুণ দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। ছোটখাটো বিষয়গুলোও হয়ে দাঁড়ায় মর্মান্তিক। সাধারণতঃ আমাদের অসাবধানতা ও অসতর্কতাই এমন সব দুর্ঘটনার মূল কারণ। আগুন ও পানি জীবন ও জগতের জন্য অপরিহার্য হলেও এদুটো আর সব মারাত্মক দুর্ঘটনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এরা অনেকটা বহুরুপীসম। বিশেষ করে আগুন। আগুনের ভয়াবহতা মাথায় রেখেই আমাদের আগুনকে ব্যবহার করা উচিত। সকলের জানা প্রয়োজন,  আগুনের ক্ষয়ক্ষতিকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার কৌশল।

প্রতিবছরই আগুনের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয় অনেককে। ক্ষয়ক্ষতিতে ধ্বংস হয় ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সম্পদ। এর জের গিয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। একারণেই আমাদের জানা প্রয়োজন আগুন নিয়ে আমাদের আচার, ব্যবহার কেমন হওয়া প্রয়োজন।

ঋতুর প্রভাবে চৈত্র, বৈশাখ মাসের উত্তাপ বিশ্বচরাচরে বাতাসের সখ্যে উন্মাতাল হয়ে ওঠে। আদিগন্ত বাউরী বাতাস আপন খেয়ালে লাগামহীন হয়ে উড়ায় ধূলো, খড়কুটো, জীর্ণপাতা, শীর্ণ বৃক্ষডগা। সাথে আগুনের নাচনও হয় উর্দ্ধমুখী। নাচতে নাচতে গ্রাস করে শান্তি, সম্পদ, জীবন। তাই প্রথম পদক্ষেপই হলো-

*আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত থাকা।

*আগুনের সকল সাবধানতা মেনে চলুন।

*বাড়ি, ঘরে ব্যবহৃত মোমবাতি, হ্যারিকেন, মাটির প্রদীপ ফুঁ দিয়ে নেভাবেন না।

*শিশুদের পারতপক্ষে আগুনের আশেপাশে ঘেঁষতে দেবেন না, আগুন নিয়ে খেলার বায়নায় পাত্তা দেবেন না।

*যারা পথে ঘাটে ধূমপান করেন তারা দয়াকরে আগুনের শলাকা নিভিয়ে নিশ্চিত হয়ে ফেলুন। আপনার চারপাশের আবর্জনায় দাহ্য উপকরণ রয়েছে। এখন এই আবহাওয়ায় এসব উপকরণ বারুদের মতোই স্পর্শকাতর ও দ্রুতগতি সম্পন্ন।

*শরীরে আগুন লাগলে পানি দিয়ে নেভানো থেকে বিরত থাকুন। পানির পরিবর্তে চট, কম্বল, ভেজা মোটা কাপড় চাপা দিয়ে আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই নেভানোর চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মাটিতে/মেঝেয় গড়াগড়ি দিয়ে আগুন আয়ত্বে আনুন। ঘটনা বা দুর্ঘটনার মুখে বিচলিত হবেন না, ধৈর্যধারণ করুন।

*বৈদ্যুতিক তার, লাইন, প্লাগ পয়েন্টে নজর রাখুন। প্রয়োজনে বদলে ফেলুন। আলস্য বা অবহেলা করার ঝুঁকি নেবেন না।

*পরিবারে আগুনের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করুন, সাবধানী হতে তাদের মনে সচেতনতা তৈরী করুন।

এবার আসুন সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় রান্নাঘর ও রান্না করার বিষয়ে। আমাদের দেশের সবঅঞ্চলে গ্যাসের সরবরাহ নেই। এখনো আমরা প্রাচীন পন্থায় বৃক্ষের কাছে হাত পেতে আছি। অনেকের সংসার টিকে আছে বৃক্ষের শুকনো ডালপাতায়। গ্রীষ্মের দাবদাহে ঋতুর সহজাত প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি পোড়ে। পোড়ায় অপ্রয়োজনীয় তরুলতা, পরগাছা, জমে থাকা আবর্জনার স্তুপ। মৃত্তিকা, ধরণীতল প্রস্তুতি নেয় জল শুষে নেয়ার, অঝর বর্ষণে আপন বক্ষে জলধারনের। বর্ষায় সংসারকে সচল রাখতে অনেকে রান্নার চূলোর আশেপাশে সঞ্চয় করে রাখে প্রকৃতির উচ্ছিষ্টসম বৃক্ষ, তরু, লতার জ্বালানী। জীর্ণ কুটির থেকে রাজপ্রাসাদ, গ্রাম থেকে শহরকেও আগুন ছাড় দেয় না। রান্নার সময় সতর্ক থাকুন এবং রান্নার পরে সবসময় নিশ্চিত হোন আগুন নেভানোর বিষয়টিতে।

শিল্প, কলকারখানায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্বের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ থাকুন। আপনার সামান্য আলস্য বা অবহেলায় যেমন কেউ কেউ অকালে নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে পারে, তেমনি আপনার সজাগ ও সচেতনতায় কারো কারো জীবন সুরক্ষিত থাকতে পারে। আসুন আমরা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্বের প্রতি সচেতন থাকি, আগুনের অপব্যবহার রোধ করি, শিশুদের আগুন থেকে সাবধান থাকতে শিক্ষা দেই ও আত্মসচেতনতাকে জাগ্রত করি। তাহলেই আমরা অনেকটা নিরাপদে থাকতে পারবো।

(একটি বাস্তবকাহিনীকে ভিত্তি করে লেখা)