আব্বার মৃত্যু সংবাদ/  কাজী মুজাহিদুর রহমান 

আব্বার মৃত্যু সংবাদ

আব্বার মৃত্যু সংবাদ

আব্বার মৃত্যু সংবাদ/  কাজী মুজাহিদুর রহমান 

 

রক্তবীজের সম্পাদক টেলিফোন করে বললেন, এ মাসে বাবা দিবসের জন্য একটা লেখা দিতে। রাজী হলাম লেখা দিতে, কিন্তু কি লিখব তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। যে জন্মদাতা পিতার একান্ত স্নেহে লালিত হয়ে বড় হয়ে ওঠা, এক সময় যার পাশে দাঁড়িয়ে নতুন কাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য রাত তিনটা বাজলেও রাজধানী ছেড়ে বাড়িতে যেয়ে পৌঁছাতাম, তিনি এক দিন অতি কষ্টে গড়ে তোলা তার ঘর-বাড়ি, সংসারের মায়া, সন্তান সন্ততিকে ত্যাগ করে চলে গেলেন পরপারে। পিছনে পড়ে থাকল জীবনের সমস্ত কীর্তি, অর্জন ও সম্পদ। সাদা কাপড়ে মোড়ানো তার নিথর দেহটাকে আমরা পৃথক পালঙ্কের ওপরে তুলে বয়ে নিয়ে মাটির বিছানায় রেখে এলাম। কবরে নামানোর পর শেষবারের মতো তার মুখটা দেখলাম। কেননা এই জীবনে আর কোনোদিন দেখা হবে না। মুখটা তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। আমি ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরবো বলে এক সময় যিনি দরজা খুলে আমার অপেক্ষায় বসে থাকতেন। পৌঁছালে বলতেন, বাবা এসেছিস? আজ তিনি সকল স্নেহ-মমতা রং উর্দ্ধে চলে গেলেন। আজও প্রতিক্ষণে তার অভাব বোধ করি। সৃষ্টিকর্তার কাছে তাই দুই হাত তুলে তাঁর জন্য জান্নাত কামনা করার পর বলি ‘রাব্বির আরহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগিরা’। 

 

দিনটি ছিল ফেব্রুয়ারী মাসের ১৪ তারিখ, আর ১৯৯৪ সাল। একই সাথে রমজান মাস। অসুস্হ হওয়ায় ওনাকে ৫/৬ দিন আগে যশোর সিএমএইচে ভর্তি করানো হয়েছিল। এর আগে দুই বার সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন। দুইবারই ভাল হয়ে বাড়িতে ফেরেন। কিন্তু তৃতীয়বার আর সুস্হ হয়ে বাড়ি ফেরা হলো না। আগের দুইবার আমি যশোর থাকলেও চার মাস আগে ইপিজেডে বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসি। আগের দিনও টেলিফোনে খবর নিয়েছি। অবস্হা যে খুব খারাপ তেমন শুনিনি। কিন্তু ঐ দিন কাজের প্রেশারে একবারও খোঁজ নেওয়া হয়নি।  অফিসে ইফতার সেরে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। আপন নিবাসে লিফটে উঠে পাঁচ তলায় বাসার দরজার সামনে আসতেই দেখি ভাগ্নী দীয়া দাড়ায়ে আছে। ও-ই আমাকে খবরটা প্রথম জানালো। দিন শেষে এমন একটা খবর পাবো, তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দরজার পাশে সোফার উপর বসে পড়লাম। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। চিন্তা, চেতনা কিছু সময়ের জন্য অন্ধকারাচ্ছান্ন হয়ে গেল। কাঁদতেও যেন ভুলে গেলাম। আব্বা, মা দুই জনের মধ্যে প্রথম এক জনের চলে যাওয়া। নবেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন যশোর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই, তখন আমার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কোম্পানির ডিরেক্টরকে টেলিফোন করে খবর দিয়ে জানাই যে, আমি ফ্যামিলি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। এর মধ্যে দুই ছেলেকে রেডি করে আমার বোনের গাড়িতে করে আমরা রওনা হলাম। মাথা খুব একটা কাজ করছে না তাই সঠিক সিন্ধান্ত নিতে পারছি না। তবুও প্রথমে গেলাম চট্টগ্রাম পুরাতন রেলস্টেশনের সামনে বাস কাউন্টারে। কিন্তু রাত বারোটার আগে ঢাকার কোন বাস নেই। এমতাবস্হায়, চিন্তায় এলো পতেঙ্গা এয়ারপোর্টে গেলে হয়তো ঢাকাগামী কোন ফ্লাইট পাওয়া যেতে পারে। তাই দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে পতেঙ্গার দিকে রওনা হলাম। আধা ঘন্টারও বেশী সময় পরে টার্মিনাল ভবনের সামনে পৌঁছালাম। কাউন্টারে বিমান কর্মীকে জিজ্ঞাসা করা মাত্র জানালেন যে প্লেনও আছে, টিকেটও আছে। দ্রুত চারটা টিকেট কিনলাম। বিমান কর্মী ওয়াকিটকিতে প্লেনের কাছে থাকা ট্রাফিকের সাথে কথা বলে আমাদেরকে মিনিটের মধ্যে প্লেনে তুলে দেওয়ার ব্যবস্হা করলেন। আমরা শেষ প্যাসেঞ্জার  হিসাবে প্লেনে ওঠলাম, আর সাথে সাথে কেবিন ক্রু দরজা বন্ধ করে দিলেন। সিটে বসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম এই বলে যে, তিনিই সুযোগ করে দিলেন যাতে আমি আমার আব্বার মুখখানা শেষবারের মতোৎদেখতে পারি। বিমানের পাইলট প্লেনটা ঘুরিয়ে রানওয়ের মুখে আনতেই দাঁড়িয়ে  গেল। কিছুক্ষণ পরে জানতে পারলাম অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে ভিজিবিলিটি একদম কম, তাই পাইলট ফ্লাই করতে পারছেন না। প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছে, আশা করা যাচ্ছে দ্রুত কুয়াশা কেটে যাবে, তারপর ফ্লাই করবেন। ঘড়িতে তখন রাত পৌনে ন’টা। প্লেনে ওঠার পর জানতে পারলাম আগামীকাল ঢাকায় সারাদিন হরতাল। অর্থাৎ দিনের বেলায় কোন গাড়ি চলবে না। তাই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো রাতে ঢাকা পৌঁছে, রাতেই ঢাকা থেকে বের হয়ে যেতে হবে। কিন্তু প্লেনতো নড়াচড়া করে না। রাত সাড়ে দশটার সময় পাইলট জানালেন, তিনি আজকে আর ফ্লাই করবেন না। সকল যাত্রীকে অফলোড করা হলো। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কী আর করা, সবাই নেমে  লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় যাত্রীদের আবার জানানো হলো , কুয়াশা কেটে গেছে। সবাই জলদি আবার প্লেনে ওঠেন। আবার সকলে দৌড়ে  প্লেনে ওঠলো, এবার সত্যি সত্যিই প্লেন টেক-অফ করলো। আমার মনে হলো, আল্লাহ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। আধা ঘন্টার কিছু বেশী সময় পরে ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার পর মনে আস্হা আসলো যে, এবার হয়তো যশোর যাওয়া সম্ভব হবে। 

 

এয়ারপোর্ট থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে সোজা আজিমপুরে বড় ভাই’এর সরকারী কোয়ার্টারে পৌঁছালাম। বড় ভাই দুই দিন আগেই আব্বার অসুস্হতার কথা শুনে যশোর চলে গিয়েছিলেন। আমি ঐ বাসায় সবাইকে নামিয়ে রেখে একটা বেবীটেক্সী নিয়ে জিপিওর পশ্চিমে মুক্তাঙ্গনে গেলাম। সে সময় ঐখানে কার ভাড়া পাওয়া যেত। ভাল দেখে একটা কার ভাড়া করে আবার যখন আজিমপুরে পৌঁছালাম, তখন রাত একটা বাজে। তখন ছেলেরা ঘুমিয়ে আছে। আমরা কোন রকমে সেহেরী খেয়ে নিয়ে পনের মিনিটের মধ্যে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যখন টেকনিক্যালের মোড় পার হই, ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো বাজে। রাত সাড়ে তিনটার সময় আরিচা ঘাটে পৌঁছালাম। কিন্তু ঐ সময় কোন ফেরি ছাড়বে না। প্রথম ফেরি ভোর হবার পরে ছাড়বে। পূর্ব আকাশে আলো ফোটার পর ফেরির দরজা খুললো। আমাদের গাড়িটা প্রথম দিকেই তাতে উঠলো। ফেরি পুরোপুরি লোড হবার পরে খুব ধীরে তা চলতে শুরু করলো। কিন্তু আধা ঘন্টা চলার পর একেবারেই থেমে গেল। জানা গেল, আবার সেই গতকাল রাতের সমস্যা। ঘন কুয়াশার কারণে ফেরীর চালক সামনে কিছুই দেখতে পারছেন না, তাই আপাতত সাইড করে রেখে দিয়েছেন। একটু রোদ উঠলেই কুয়াশা কেটে যাবে, তারপর চালাবেন। নিরাশ হলাম। আবারো সেই ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছি। এখনকার সময়ের মতো তখন মোবাইল ছিল না। মাঝ নদীতে আটকা পড়ে আছি, তা কাউকে জানানোর মতো উপায় ছিল না। এই অবস্হায় আমার সকল প্রচেষ্টা আল্লার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলাম কেননা তিনিই সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণকারী। কয়েক ঘন্টা এভাবে বসে থাকার পর বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ ফেরী চলতে শুরু করল। আধা ঘন্টার মধ্যে ঘাট পার হয়ে গেলাম। এবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম, পথে আর কোন অসুবিধা না হলে অন্তত দুই ঘন্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছাতে পারবো। 

 

বেলা একটা বাজলে আমরা বাড়িতে পৌঁছালাম। আমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছিলেন। তখন যে হৃদয় বিদারক পরিবেশহলো  তা আমার মতো লোকের পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি ওযু সেরে একা আব্বার ঘরে ঢুকলাম । যে ঘরে তিনি থাকতেন, সেই ঘরের মেঝেতেই কফিনটা রাখা আছে। ঢাকনাটা তুলে আস্তে আস্তে মাথার বাধনটা খুললাম। কাপড়টা সরিয়ে মুখটা দেখলাম। খুব কষ্টের চিহ্ন যেন সেখানে। ছোটবেলায় যেভাবে আমার মুখের দুই পাশে হাত দিয়ে আদর করতেন সেভাবে আব্বার  মুখের দুই পাশে হাত দিলাম। পাথরের মত শক্ত দুই চোয়াল। দাঁতের ওপর দাঁত চেপে আছেন। আত্মাটা যখন শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে, তখন যেন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছেন নিজেকে রক্ষা করার। কিন্তু মৃত্যুর পূর্ব নির্ধারিত সময় যখন আসে, তখন কী মানুষের সাধ্য আছে তা থেকে রক্ষা পাবার! যোহরের নামাজ শেষে বিমান অফিস মসজিদের সামনে জানাজার পর আমরা যশোর কারবালার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সেখানে পরম যত্নে তিনি শায়িত হলেন। শুরু হলো অনন্তের পথে কবরের অধ্যায়। 

আজো মাঝে মধ্যে মনে পড়ে সেই দিনের কথা। কী প্রচন্ড প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সকলকে নিয়ে রওনা হয়েছিলাম শুধু একটাই উদ্দেশ্যকে সাথে নিয়ে যে, আমাকে যেভাবেই হোক বাড়িতে যেতে হবে। এত বছর পরেও যখনই যশোর যাই, তখন কবরস্হানে যাই। চারদিক সুনসান নীরবতার মধ্যে শুধুমাত্র গাছের পাতাগুলো বাতাসে শব্দ করে। আর আমার কানে যেন আওয়াজ আসে, বাবা এসেছিস?

কাজী মুজাহিদুর রহমান
কাজী মুজাহিদুর রহমান
%d bloggers like this: