আলোর প্রত্যাশায় আঁধারে সাঁতার / রানা জামান
আলোর প্রত্যাশায় আঁধারে সাঁতার / রানা জামান
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের গণহত্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মায়াকান্নায় দেশে প্রতিবাদ এবং বিদেশে নিন্দার তুফান বইতে থাকলে সরকার ৩০ জুলাই শোক দিবস ঘোষণা করে। তৎক্ষণাৎ আন্দোলনকারী ছাত্র–ছাত্রীরা তা প্রত্যাখ্যান করে ঐদিন মাথায় ও মুখে লাল কাপড় বাঁধার কর্মসূচি ঘোষণা করে। সারাদেশে সরকারের লেসপেন্সার ও পেটোয়া বাহিনীর মাঝে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের দমনের জন্য এক ধরনের উত্তেজনা এবং আন্দোলন সফল করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভিন্ন ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
ঐ রাতে খাবারের টেবিলে আবীর মাকে বললো, লাল কাপড় আছে আম্মু?
আবীর রেফায়েত শরীফ পরিবারের একমাত্র সন্তান। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনায় সম্মানে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ আছে তার। ওর মার নাম শম্পা রেফায়েত এবং বাবার নাম রেফায়েত শরীফ। রেফায়েত শরীফের বাংলামোটরে স্যানিটারি সামগ্রীর ব্যবসা আছে; আর শম্পা রেফায়েত নর্থ-ইস্ট ব্যাংকে ক্যাশ শাখায় কাজ করছেন।
শম্পা রেফায়েত ঢোক গিলে বললেন, নতুন কাপড় তো নাই বাপ!
রেফায়েত শরীফ বললেন, আমার জানামতে তোমার একটা লাল ওড়না আছে। ওটা আছে, না পুরনো হওয়ায় কাউকে দিয়ে দিয়েছো?
কাউকে দেই নি। আছে ওটা।
ওটাকে এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে উৎসর্গ করে দাও!
খেয়ে কেটে দিচ্ছি।
উত্তেজনায় খাওয়া সংক্ষিপ্ত হয়ে গেলো তিনজনের।
শম্পা রেফায়েত আলমারি থেকে লাল ওড়না বের করে মাথার তিনটি ফেট্টি বানালে রেফায়েত শরীফ বললেন, তিনটা কেনো?
শম্পা রেফায়েত বললেন, একটা আমার!
রেফায়েত শরীফ কিছু বললেন না; কিন্তু আবীর মুচকি হাসলো।
তিনটি মুখোশ বানানো হয়ে গেলে রেফায়েত শরীফ ফের বললেন, মুখে মাস্ক পরে মাথায় ফেট্টি বেঁধে ফটো তুলতে হবে। আমাদের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার হবে এই ফটো। ব্যাকগ্রাইন্ড হবে টকটকে লাল।
তিনজনের ছবি তুলে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে কক্ষের লাইট অফ করতে যাবে তখন বাইরে গাড়ির শব্দ পেয়ে রেফায়েত শরীফ ছুটে গেলেন জানলার কাছে। পুলিশের দুটো গাড়ি। একটি জিপ ও একটি পিকাপ। দুটো গাড়ি থেকে সাদা পোশাকে বারো জন পুলিশ দ্রুত নেমে ঢুকতে থাকলো ভবনের ভেতরে।
রেফায়েত শরীফ ওদের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ডিবির পুলিশ আসছে! আবীর দ্রুত ছাদে গিয়ে পানির ট্যাঙ্কির ভেতরে লুকিয়ে পড়ো! হারিআপ!
শম্পা রেফায়েত ফিসফিস করে বললেন, লাইট অফ করে দেই!
রেফায়েত শরীফ বললেন, নাহ! লাইট অফ করলে সন্দেহ করবে!
দরজা খুলে ছেলেকে ঘরের বাইরে ঠেলে দিয়ে ফের বললেন রেফায়েত শরীফ, জলদি যা বাপ! লিফ্ট নিবি না, সিঁড়ি দিয়ে যা!
দরজা আটকে দিয়ে স্বামী–স্ত্রী জানলার কাছে এসে পর্দা সামান্য ফাঁক করে তাকিয়ে রইলেন বাইরে। পিকাপের পাশে এক দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো নতুন দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে না। দরজা খুলে বাইরে তাকাবেন কিনা ভাবছেন রেফায়েত শরীফ। পরক্ষণে মৃদু মাথা নেড়ে নাকচ করে দিয়ে মনে মনে বললেন: দেখে ফেললে দাওয়াত দিয়ে বাঘ ঘরে আনার মতো হয়ে যাবে।
আনুমানিক পনেরো মিনিট পরে দুটো কিশোরকে নিয়ে ভবন থেকে বেরিয়ে গেলো সাদা পোশাকে পুলিশ নামের অসুরগুলো। পেছনে ওদের মা–বাবাদের ছুটে আসতে দেখা গেলো; কিন্তু নয় তলা থেকে চিনতে পারলেন না ওরা কারা। পিকাপে চড়ে পুলিশের একজন ওদের কিছু একটা বলে অভয় দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে চলে গেলো।
রেফায়েত শরীফ বললেন, আমি নিচে যাচ্ছি; তুমি ছাদে গিয়ে ছেলেটাকে পানির ট্যাঙ্কি থেকে বের করে নিয়ে আসো।
ভবনের সকল এপার্টমেণ্টের বাসিন্দারা বের হয়ে লিফ্ট না পেয়ে অধিকাংশ বাসিন্দা সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকলো নিচে। যে দুই কিশোরকে ধরে নিয়ে গেলো, ঐ দুই কিশোরের পরিবার ঘিরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকলো বাসিন্দাগণ।
দুই পরিবারের সবাই কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে যা জানালো তা এরকম: ভিডিও ক্লিপে দুই কিশোরকে মিরপুরের কাজীপাড়ায় মিছিল করতে দেখা গেছে। ওরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সরকারবিরোধী আন্দোলনে মিছিল মিটিং-এ অংশগ্রহণ করায় ওদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।
এপার্টমেণ্ট বাসিন্দাদের সমিতির সভাপতির আহ্বানে সবাই সম্মেলন কক্ষে এসে জড়ো হলো। একটু পরে কুড়ি জন কিশোর ও তরুণ ঢুকলো ভেতরে। অর্ধেক পানিতে ভেজা এবং অর্ধেক শুকনো। আলোচনা করে সকলেই ঐক্যমত্যে পৌঁছালো যে ভয় পাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে; এগিয়ে যেতে হবে সামনে; সামনে অপেক্ষা করছে স্বাধীনতা।
পরদিন অর্থাৎ ত্রিশ জুলাই সোমবার। আওয়ামী লীগের লেসপেন্সার ছাড়া প্রায় সকলেই ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে লাল করে ফেললো বিভিন্নভাবে। সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে ঢাকাসহ দেশের সকল রাজপথ হয়ে গেলো লাল। সরকারের লোকদেখানো শোকদিবসের কালো ব্যাচ ও পতাকা ঢাকা পড়ে গেলো লালের বন্যায়। শিশু থেকে বুড়ো সকলেই ধারণ করে আছে লাল কাপড়ের মুখোশ ও মাথায় ফেট্টি।
রেফায়েত শরীফ পরিবার প্রায় সারাদিন রাজপথে ছিলো। পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়ালেও ছাড়েনি রাজপথ। দুপুরের পরে এসে বসে গেলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্ত্বরে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্ত্বর লোকে লোকারণ্য। বক্তৃতা চলছে, কবিতা পাঠ চলছে। কবিতা বলতে কাজী নজরুল ইসলামের দ্রোহের বিভিন্ন কবিতা। মাঝে মধ্যে স্লোগান দিচ্ছে।
‘তুমি কে আমি কে
রাজাকার রাজাকার
কে বলেছে কে বলেছে?
স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!!’
‘চাইতে এসে অধিকার
হয়ে গেলাম রাজাকার!’
এগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের সরকারবিরোধী স্লোগান চলছে।
সন্ধ্যার আগে ওরা চলে এলো বাসায়। শ্রান্ত ক্লান্ত হলেও পরিতৃপ্ত আজকের কর্মসূচিতে। রাতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা ৩১ জুলাই–এর কর্মসূচি ঘোষণা করলো: মার্চ ফর জাস্টিস। রাতের খাবার খেয়ে তিনজন দশটায় শুয়ে পড়লো। গতরাতের মতো আজও ডিবি পুলিশের হানা হতে পারে, তা মনে এলো না কারো। কলবেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আঁতকে উঠলেন রেফায়েত শরীফ। মনে প্রশ্ন জাগলো: ডিবি পুলিশ চলে এলো নাকি! মোবাইল ফোনে সময় দেখলেন: রাত এগারোটা। কী করবেন এখন? শুধু আবীরকে নিয়ে যাবে? নাকি সবাইকে নিয়ে যাবে? নাদিম ও শ্রাবনকে আজো ফেরৎ দেয় নি ডিবির হারুন। ছেলেটাকে বাসায় রাখা ঠিক হয় নি।
ফের কলবেল বাজলে জেগে গেলেন শম্পা রেফায়েত। জিরো পাওয়ারের বাল্বের আলোয় স্বামীকে ভীত–সন্ত্রস্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো? তোমাকে এতো ভীত দেখাচ্ছে কেনো? গতরাতের মতো ডিবির পুলিশ এসেছে নাকি?
রেফায়েত শরীফ বললেন, বুঝতে পারছি না। ছেলেটাকে বাসায় রেখে এভাবে আমাদের ঘুমানো উচিত হয় নাই!
এখন তো আর ছাদে পাঠানো যাবে না। ওয়াশরুমের উপরে বক্সে লুকিয়ে রাখা যায়।
রেফায়েত শরীফ বললেন, আমি আবীরকে জাগিয়ে ওখানে রেখে আসছি। কলবেল বাজালেও তুমি দরজা খুলো না।
রেফায়েত শরীফ অতিদ্রুত আবীরকে ওর কক্ষের সংলগ্ন ওয়াশরুমের উপরের বক্সে ঢুকিয়ে রেখে চলে এলেন এই কক্ষে। জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে বললেন, বাইরে পুলিশের কোনো গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। চলে গেছে নাকি?
তখন ফের কলবেল বেজে উঠলে আঁতকে উঠলেন দু‘জনেই। রেফায়েত শরীফ স্ত্রীকে একবার দেখে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। এপার্টমেণ্টের প্রধান দরজায় যেতে হয় ড্রয়িংরুম দিয়ে। আর ড্রয়িংরুমটা মাস্টার বেডরুমের পরেই। শম্পা রেফায়েত স্বামীর পিছু নিলেন। উভয়ের মনে অজানা আশঙ্কা হৃৎপিণ্ডে আঘাত করে যাচ্ছে অনবরত। দরজার কাছে ছিটকিনিতে হাত দিয়ে শম্পা রেফায়েতের দিকে তাকালে শম্পা রেফায়েত সামান্য ইতিবাচক মাথা নাড়লেন। দরজা খুলে অত্যন্ত বিস্মিত হবার সাথে সাথে হৃৎস্পন্দনও স্বাভাবিক হয়ে গেলো আগন্তুকদের দেখে রেফায়েত শরীফের। ওরা ডিবির পুলিশ না! তিনজন মেয়ে ও একজন ছেলে; সবাই তরুণ।
রেফায়েত শরীফ মনে মনে বললেন: এরা কারা? এতো রাতে আমার বাসায় কেনো? ফ্লাট নাম্বার ভুল করে নয় তো?
রেফায়েত শরীফ কিছু বলার আগেই তরুণ ছেলেটি বললো, আমাকে চিনতে পারছেন না আঙ্কল? আমার নাম শাব্বির। আবীরের সাথে একদিন এই বাসায় এসেছিলাম। অবশ্য সেদিন আপনি বাসায় ছিলেন না। আমরা আবীরের ক্লাসমেট। আবীর কি বাসায় আছে?
তখন শম্পা রেফায়েত স্বামীর পাশে গিয়ে বললেন, আমি শাব্বিরকে চিনতে পেরেছি। তোমরা ভেতরে আসো।
শম্পা রেফায়েত স্বামীর বাহু ধরে সামান্য টান দিয়ে দরজা থেকে সরিয়ে আনলেন। চারজন ভেতরে ঢুকলে দরজার ছিটকিনি আটকে দিয়ে বললেন, তোমরা বসো। এতো রাতে তোমরা কোত্থেকে এলে?
চারজন পাশাপাশি সোফায় বসলো। শাব্বির ফের বললো, ডিবি পুলিশের ভয়ে আমরা বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। গতরাতে আমাদের ফ্লাট থেকে বেশ কয়েকজন স্টুডেণ্টকে তুলে নিয়ে গেছে। আমাদের মনে হয়েছে এই বাসাটা নিরাপদ হবে।
শম্পা রেফায়েত রেফায়েত শরীফের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলে রেফায়েত শরীফ চোখের মৃদু ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, খুব ভালো করেছো তোমরা। এখানে তোমরা নিরাপদেই থাকতে পারবে। আমি আবীরকে ডেকে নিয়ে আসছি। তোমরা কি রাতের খাবার খেয়ে বের হয়েছ?
তখন এক তরুণী বললো, খাবার লাগবে না আঙ্কল। আমরা এক গ্লাস পানি পান করে শুয়ে পড়বো।
শম্পা রেফায়েত বললেন, তা কী করে হয়! তোমার আমাদের ছেলের বয়সী। তোমাদের কি আমি রাতে না খাইয়ে রাখতে পারি? আমি ডিমের ওমলেট আর পাউরুটি টোস্ট করে আনছি। আবীর আসলে ওর সাথে গল্প করতে থাকো।
স্বামী–স্ত্রী দুজন ভেতরে গেলেন। নিজেদের বেডরুমে ঢুকে শম্পা রেফায়েত বললেন, এখন কী হবে?
রেফায়েত শরীফ বললেন, কী আর হবে! এতো রাতে কি ওদের আশ্রয় না দিয়ে বের করে দেয়া ঠিক হবে? আমাদের যা হবে, ওদেরও তাই হবে! আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে।
কিভাবে?
আমাদের পালাক্রমে রাত জাগতে হবে।
ঠিক বলেছ! তুমি আবীরকে বলো ও যেনো গতরাতের ঘটনা ওদের না বলে। আবীরকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে নিয়ে যাও। আমি ডিমের ওমলেট আর পাউরুটির টোস্ট করে আনছি। তোমরা কী খাবে?
আমি খাবো না। আবীরের জন্যও করো।
তখন গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়ে আঁতকে উঠে একে অপরের দিকে তাকালেন।
Facebook Comments Sync