আমার আমি / শাহিদা ইসলাম
আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের প্রতি মায়া বেড়ে গেল। আহারে অবুঝ মন,তোকে এত দিন অবজ্ঞা
করেছি,অবহেলা করেছি। আয়নায় চুমু খাই নিজের গালে চোখে মুখে চিবুকে।
নিজের জীবনের মুল্য আছে, বা থাকে এই কথাটাই জানা ছিল না আমার। সারা জীবন পরের কথা, আপন ভাই বোনের কথা চিন্তা করেছি।
বড় ভাই আমার বিয়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। ছেলে পক্ষ যৌতুক দাবী করায় আমার মাথায় রক্ত উঠে যেত। যৌতুক দিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে এটা কেমন কথা!
একজন ছেলে বাবা কাকার সাথে আমাদের বাড়িতে এলো, আমাকে দেখতে। মুখে রং মেখে সং সেজে আমি সামনে যেতে পারব না। তাতে বিয়ে না হোক!
ভাইয়া হাত ধরে অনুনয় বিনয় করে বলল,
:আপু সোনা, মুখে একটু পাউডার নাও, চোখে কাজল দাও।
চটপট চুল আঁচড়ে চলে গেলাম পাত্রপক্ষের সামনে। ছেলের বাবার সামনে একটা চেয়ার টেনে আমাকে বসিয়ে দেয়া হল।
: মামনি তোমার নাম কি? তোমার নামের অর্থ কি?
মা তুমি রান্না করতে পার?
আচ্ছা বলো তো ভাতের চাল ধুয়ে কতটুকু পানি দিয়ে বসাতে হয়?
আমি বললাম,
: কয় কেজি চালের ভাত? বসা ভাত, নাকী মাড় গালাতে হবে?
জবাব শুনে ছেলের কাকা বলে উঠল,
:ওরে বাবা মেয়ে তো নয়, মুখরা , বিয়ের পাত্রী এত কথা বলে না!
ছেলের বাবা বললেন,
:দাদা এসব দেখতে হবে না। মেয়ের দাদার সাথে কথাবার্তা বলাই আছে, বিয়েতে ছেলের জন্য পোশাক আশাক দেবে আর পাঁচ লাখ টাকা দেবে।
আমি বললাম,
: টাকা কেন?
ছেলের বাবা বললেন,
: ছেলে মানুষ করতে টাকা লেগেছে।
আমি গলার স্বর একটু উঁচু করেই বললাম,
:আমার বাবাও আমাকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাহলে আমাকে আপনার ছেলের বউ করে নিতে কত যৌতুক দিবেন?
ছেলের বাবা কঠিন রেগে গেলেন।
: এই মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেব না।
আমিও বললাম,
: যৌতুক নেয়া দেয়া আমাদের পরিবারে নেই। আপনারা কষ্ট করে এসেছেন। দুটো ভাত খেয়ে যাবেন।
তবে ছেলেকে বিক্রি করতে চাইলে গলায় একটা রশি লাগিয়ে বাজারে খুটির সাথে বেঁধে রাখবেন।
গলায় দামের একটা কার্ড ঝুলিয়ে রাখবেন,পাঁচ লাখ।
: চাচা, ছেলে কি পাশ?
:বি এ পাশ,ছেলের চাচা বললেন।
: আমি এম এ পাশ করেছি, বি সি এস দেব। তাহলে আমার দামের পরিমাণটা একটু হাই,কি বলেন আপনারা? ছেলে মেয়ের সমান মর্যাদা।
এর পর আমি ভাইয়ার সংসারে পার্মানেন্ট কাজের বুয়া, থুক্কু, কেয়ার টেকার, আরে ধুর, বাচ্চাদের ন্যানি, আসলে রান্নার বাবুর্চি ও বলতে পারেন হয়ে গেলাম। খারাপ ভাষায় বলে ফেললাম।
আপনারা খারাপ ভাববেন না। আমি ভাইয়ের সংসারে যখন পার্মানেন্ট থেকে গেলাম, জবের ধান্দা মাথায় আসে নাই।
ভাইয়ার কথা ছিল আমার বিয়ের পর বিয়ে করবেন।
আমি ঘোষণা দিয়ে দিলাম,
: এই বেচা কেনার মধ্যে আমি নাই। তুমি বিয়ে করে নিয়ে এস।
ভাবী বিয়ের আগে থেকেই সরকারি চাকরি করতেন। বিয়ের পর ছাড়ার প্রশ্নই আসে না।
আমাকে দুজনই ভালোবাসে, সন্মান করে। আমাকে ছাড়া তারা কোথাও একা বেড়াতে যায় না। বাচ্চারা আমার হাতে খায়। ভাবী আফিসে চলে যায়, আসে রাতে।
মায়ের অভাব ফুপুকে দিয়ে পূরণ করে।
অনিমা আর অমি আমার কলিজার টুকরা। সকালে চোখ খুলেই ফুপুমনি বলে ছুটে আসে, গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। আমার বয়স এখন দুই কুড়ি দশ। বিয়ের চিন্তা আমার মাথা থেকে উড়ে গেছে। বিয়ের কথা ভাবলে মাথা ভোঁ ভোঁ করে।
আকাশের নীল রঙের গুটি গুটি কষ্ট আমার বুকের মধ্য সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে।
আমি কষ্ট পেতে ভালবাসি, সুখের আশায় থাকি। যদি আসে সুখ, তবে আসুক বাধা নাই।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়ে গেল। বয়সের সাত রং আর দেখা হলো না।
ভাইয়ার সন্তান দুটি আমার পৃথিবী।
মানুষের মায়া মমতা যা পেয়েছি বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।
মনে মনে স্বপ্নের জ্বাল বুনি, আমার জন্য না ; অনিমার জন্য। এখন অনিমার বয়স ১৬, চোখের তাঁরায় আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়। আমি ওকে আমার শিক্ষা দীক্ষায় গড়ে তুলেছি।
ছেলেদের সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি, ছেলেরা নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে না পারলে বুঝবে বাবার লেজুড়, ব্যাক্তিত্বের অভাব আছে।
অনিমা ছেলেদের একদম পছন্দ করে না। আমি বলেছি,বড় হলে ভাল মন্দ বুঝতে পারবে।
অমিকে নিজের মত করে বড় হতে শেখাচ্ছি। যাতে বিয়ের সময় নিজের ডিসিশন নিজেই নিতে পারে। যদিও আমার ভাইয়ার মেন্টালিটি এত ছোট লোকের মত হবে না।
চুলে সাদা কালো কম্বিনেশন হচ্ছে,ইদানীং । চোখের পাওয়ার বেশ ঝামেলা করছে। দূরের জিনিস দিব্বি দেখি, কাছেই যত বিপত্তি। অনিমার কলেজ এডমিশন টেষ্ট,। আর কি আমি সব জায়গায় ফিট, ভাংগা কূলো।সব কাজেই লাগে।
ভাইয়া ছেলে মেয়েকে আমার কাছে দিয়ে ঝঞ্ঝাটমুক্ত হয়েছে। কে কখন কোথায় যাচ্ছে, কি করছে এসব তার সাবজেক্ট না।
অগত্যা আমি নিয়ে গেলাম ভিকারুননিছা কলেজে। বেইলি রোড়ের মোড়ে পিঠা ঘর, নেমে কিছু পিঠা আর পানি নিয়ে নিলাম।
অনিমা কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
আমি গার্ডিয়ানদের বসার জন্য যেখানে ব্যবস্থা করেছে ওখানেই বসে রইলাম।
আজকের পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, একজন ভদ্রলোক আমার সাথে কথা বলার জন্য কেমন উস্খুস করছেন।
আমার গায়ে পড়ে কথা বলার স্বভাব নেই, কেউ বলে এটাও পছন্দ করি না।
ভদ্রলোক নিজের চেয়ার ক্রস করে আমার চেয়ারের পাশে এসে বসলেন,
:এক্সকিউজ মি
আমি না শোনার ভাল করেও পারলাম না।
: জি আমাকে কিছু বলবেন?
:জি আপনার কে পরীক্ষা দিচ্ছে?
: আমার মেয়ে,
:ওহ,
আমি পাল্টা জানতে চাইব ভেবেছিল। হলো না। আমি আবার পেপারে মুখ গুঁজে পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
উনি যেচেই বললেন,
: আমার ও মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। মাথা উঁচু করে দেখে আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।
:আচ্ছা ম্যাডাম, আপনাদের বাড়ি কোথায়?
আমি বললাম,
: চামেলি বাগ।
: ওহ যা ভেবেছিলাম, রেজাভাই,আপনার কেউ হয়?
:আমার বড় ভাইয়া
:একদম চিনেছি
: কি চিনেছেন?
:আপনি বেলা?
: জি,
:অহ, আমাকে আপনি চিনতে পারেন নাই? আমি কিন্তু চিনেছি। এমন চেহারা ভুলে যেতে পারি!
আমার ধৈর্য সহ্যের বাঁধ ভেংগে যাচ্ছে। বেশ কর্কশ সুরে বললাম,
:নাহ্ আমি চিনতে পারছি না।
:আমি আপনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমার বাবা আপনাকে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু যৌতুক চেয়েই বিপদ ঘটলো।
হায় কপাল,যে পাপে পাপী হয়ে নিজের জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিলাম সেই সামনে!
রাগে নিজের দেহের ভিতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো।
:তো মিস্টার কত টাকায় বিক্রি হয়েছিলেন?
আমার পাশে বসা এক ভদ্রলোক এই কথা শুনে হেসে ফেললেন।
ভদ্রলোক বললেন,
:আমি আপনাকে আজও ভুলতে পারি নাই। এভাবে বলে লজ্জা দেবেন না। বাবার কথা অমান্য করি কি করে?
: তো বাবার যোগ্য পুত্র! আপনাকে বাহবা বাহবা দিতে হয়। যোগ্য সন্মান করে বউ কি ঘরে তুলেছেন?
আমার মুখে কিছু আটকায় না।
: চুরি তো করি নাই আমি।
এই পুরুষ নামের লোকটির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি! আল্লাহ্র কাছে লাখ কোটি শুকরিয়া, আল্লাহ আপনি আমার জীবনকে রক্ষা করেছেন!
Facebook Comments Sync