আমার মেয়েবেলা / শারমিনা পারভিন

শারমিনা পারভিন

শারমিনা পারভিন

স্মৃতি কাতরতা একটুও কমেনি। বরঞ্চ  দিনকে দিন বেড়েই  চলেছে। 

চারপাশ অবরুদ্ধ। শুধু  ভাঙনের শব্দ  শুনি।

আর মন ফাঁপর লাগে।

হারিয়ে  যাই ফেলে আসা  দিন, শৈশব, কৈশোর, যৌবনে। 

সময়ের  মূল্য, হারানো  দিন, আর কখনওই  ফিরে আসে না।

যে সময় জীবন  থেকে  হারিয়ে  যায়, শত চেষ্টা  করেও আর ফিরে  পাওয়া যায় না।ডানা মেলে চলে গেছে অমূল্য  শৈশব। 

কতকাল জোনাকি  দেখিনি।

কতকাল পাখিদের  কাকলি  আর শুনি না।

সময়ই  জীবন। জন্ম  মৃত্যুর  মধ্যে  অনির্ধারিত জীবন। 

এ জীবনের  একদিন অবসান ঘটবে। জীবন  গতিময়, কিন্তু দীর্ঘ নয়। বাস্তবে  খুবই  স্বল্প, খুবই  নগণ্য। 

আর সোনালী  মেয়েবেলা! 

নিমিষেই  চলে  গিয়েছে। 

 

আমি আমার মেয়েবেলা  সম্পর্কে  একটা  স্মৃতিচারণ করেছিলাম।  

আমার মেয়েবেলা  আমার শৈশবের  স্মৃতির সাথে মিলে মিশে আছে। আমার এ লেখা  নাকি অনেককেই  নিয়ে  গেছে তাদের সোনালী  মেয়েবেলায় বা ছেলেবেলায়।  তারা কিছুসময়ের জন্য হলেও  ফিরে  গেছে  তাদের  হারানো শৈশবে।

অনেকে  আমাকে লিখেছে, ফোন করে বলেছে আমি নেই  কেন তোমার মেয়েবেলায়? আমিতো তোমার মেয়েবেলায় ছিলাম।

তাই  নতুন  করে মেয়েবেলা  লেখার অবতারণা। 

 

বন্ধু  চল,বন্ধু  চল,
রোদ্দুরে  মন কেমন
মাঠ জুড়ে  খেলবো আজ
তোর দিকে, তোর পাশে
সাপলুডু, চিত্রহার
দুঃখদের গল্প বল
বন্ধু  চল, বন্ধু  চল
রাখবো হাত তোর কাঁধে।

সাপলুডু  সমাচার

ছোটবেলায়  সাপলুডু  খেলতাম। পারুল শিরীন,বুলবুল  মামার সাথে। মাঝে মাঝে মা,মেজদার সাথে। অনেক চেষ্টার পর গুটিটা যখন মাথায় এনেছি, ঠিক  তখনি অজগর গুটিটা গপ করে গিলে  ফোললো।
আহা !কীযে কষ্ট। সীমাহীন  কষ্ট!  খুব  কান্না  পেতো।
আবার লুডু খেলার সময় গুটি আর বের হয় না। পুট ( এক)  পড়ে না। যাই বা পড়লো, তারপর শুধু  পুটই পড়ে চলেছে। গুটি আর এগোয় না। মেজদা খুব  চিটারি করতো। চোখের নিমিষেই  গুটি কোথায় নিয়ে  যেতো। আর গোবেচারা  টাইপ মুখ  করে বলতো, কই আমিতো  কিছুই  করিনি। বলে অন্যদিকে চেয়ে  থাকতো।উল্টে  আরও মেজাজ করে বলতো, তোরা যদি এমন করিস আমি খেলবো না। পার্টনারের অভাবে আমরা চুপ করে সব সহ্য করে নিতাম।
আমি আর ছোট আপু উঠানে বাঁশের  মধ্যে  ছিদ্র  করে পয়সা জমাতাম। দাদা প্রায়ই প্রায়ই ওখান থেকে পয়সা নিয়ে  সিগারেট  খেতো। একবারতো আমি আর ছোটআপু গড়াগড়ি  দিয়ে  কেঁদেছিলাম। দাদা পরে চার আনা ঘুষ দিয়ে  আমাদের দুবোনের কান্না  থামিয়েছিল।কি বোকা ছিলাম!কোথায় গাদাগাদা  পয়সা,আর কোথায় চার আনা!
ছোটবেলায়  দাদা যখন ঢাকা থেকে বাড়ি আসতো,  আমার গায়ের জামাটা একটু উঁচু  করে, পেটে ঠাস ঠাস করে বাড়ি  দিয়ে বলতো,দেখি কাঁঠালটা পেকেছে কিনা? না পাকিনিতো।
আমি কত আশা করে ঢাকা থেকে আসলাম পাকা কাঁঠালটা খাবো। হলো না।এখনও কাঁচা। কবে পাকবে আল্লায় জানে।
মেজদা সব সময়ই  সৌখিন  ছিলেন। নতুন সার্ট পেলেই  ছোট মানুষের  মত ছোটাছুটি  করে পরে ঘুরে বেড়াতো। আয়নার  সামনে ঘুরতো ফিরতো।  আর বলতো,  দেখতো আমারে কেমন লাগে।
প্রচুর  পাউডার  মাখতো দাদা। মেজদার জন্য  পাউডার রাখা যেত না।
আমি আর মেজদা অনেকটা  সময় একসাথে কাটিয়েছি।
ছোটদা ঢাকায়, ছোটআপু যশোরে, আপা যশোরে।  বড়দা শহীদ হয়েছেন।
আমাদের  দু ভাইবোনের  অনেক স্মৃতি  রয়েছে, যা আমাকে ফিরিয়ে  নিয়ে  যায়  হারানো শৈশবে।

হায়রে আমার মেজদা! অসুস্থতা দাদাকে ভর করেছে। রোগে শোকে দাদা বিধ্বস্ত।

ছোটদা


ছোটদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তুখোড় মেধাবী  ছাত্র। সাহিত্যের  এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে দাদার পদচারণা  ছিল না বা আছে। দাদা সবসময়ই  ত্যাগী একজন মানুষ। নিজের ভাল মন্দর দিকে  কোনদিন  তাকাননি।
শুধুই  পরিবারের  চিন্তা, মানুষের  ভাল দিকগুলো  দেখেছেন। মানুষের  ভালবাসাও পেয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন  একজন অতি সফল শিক্ষক।
ছোটদা যেমন কবিতা লেখেন, তেমন গদ্য,  পদ্য,প্রবন্ধ, রম্য রচনা। ছোটদার অনেকগুলো  পাঠ্যবই, কবিতার  বই রয়েছে।
বিভিন্ন  বিশ্ববিদ্যালয়ে  দাদার বই পড়ানো হয়।
যখন বাংলাদেশে কেউ কৃষিকথা লিখতো না, তখন ছোটদা ইওেফাকে নিয়মিত  কৃষিকথা  লিখতেন। যদি  লেগে থাকতেন শায়িখ সিরাজের  জায়গাটা  ছোটদারই থাকতো।

আমাদের  প্রচুর আম গাছ ছিল। মৌসুমে প্রচুর আম হতো ।খাটের তলা ভরা থাকতো আমে। ছোটদা বেছে বেছে ভাল আমগুলো  আমাদের  দুবোনকে ছুলে দিতেন। আর সবচেয়ে  খারাপ  আমটা নিজে খেতেন। সারাটা জীবন  শুধু  করেই গেলেন।
ছোটদা আমাদের  দুবোনকে আপনি করে বলতেন।
আমাকে,  ছোট আপুকে বিভিন্ন  সময়ে এক এক নামে ডাকতেন।
আবদুল  হ্যাপী, আবদুল পপী
ব্যাঙ্গাচী
দেড় ব্যাটারী,দুই  ব্যাটারী
ছোটদা যখন ঢাকা থেকে যেতেন, আমাদের  দুবোনের কাজই ছিল, কে আগে ছোটদার কাছে শুতে পারবো।
হায়রে আমার প্রাণের ছোটদা !

আমার মেয়েবেলা
তখন আমার সবই ছিল
বন্ধু  বান্ধব  সব পেয়েছি
খাটি ছিল
কতজন এলে গেলো
কত জন আসবে যাবে
দিন শেষে ওরাইতো রয়ে গেল।

পুতুল খেলা পুতুল  বিয়ে

ছোটবেলায় আমি প্রচুর পুতুল  খেলেছি। পুতুল ছিল  অনেক।
পুতুলের  নামও ছিল  হরেক রকম। ডায়না,জেরিন  হ্যারী পিটার।  ওরা বিদেশি  পুতুল। হেলেনা, জরি  ছবি কতনা  নাম। কাজের  ছেলের নাম আবদুল। মেয়ের নাম রহিমা।
জুতার বাস্কে পুতুলের  ঘর বানাতাম। বর বউ পুতুলের  জন্য  আলাদা ঘর, বাচ্চাদের আলাদা ঘর। বাসায় পড়া কাপড়, তোলা কাপড়। দরজির দোকান থেকে টুকরো টুকরো  কাপড় নিয়ে  আসতাম। পুঁথি  দিয়ে  গহনা বানাতাম। কালো সুতো দিয়ে  কালো চুল, সাদা সুতা দিয়ে  মা পুতুলের  সাদা চুল।
এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় পুতুলের  বিয়েও হতো।
বাসার সবাই  বরযাত্রাী যেতো। আব্বা মিষ্টি  আনতেন।
নাতনীর বিয়ে  বলে কথা। এলাহি বিলাহি ঘটনা!
সাজ সাজ রব। কত রকম প্রিপারেশন। পুতুলের  বিয়েতে গেট ও সাজানো হতো। পাড়ায় পাড়ায় আত্মীয়তা হতো।
ভাবা যায়!
পুতুলের  বিদায়ের সময় কান্নাকাটি। পুতুলকে ফিরানি আনা হতো।
আর পুতুলের  বাচ্চা  হলেতো বিশাল ঘটনা।

এমন মজা হয়না
গায়ে সোনার গয়না
আজ পুতুলের  বিয়ে হবে
বাজবে কত বায়না।

টাক মাথায় পাউডার  দেয়া

ছোট  বেলায় মা মাঝে মাঝেই মাথা টাক করে দিতেন। সেই  একই ধারণা। যত টাক হবে, তত চুল গজাবে, লম্বা  হবে।
ঐ সময়ে আমাকে কে যেন একজন বলেছিল, টাকে পাউডার দিলে চুল তাড়াতাড়ি  বাড়ে। আমিতো ছোট। কথা বিশ্বাস  করেছিলাম। সেতো মজা করেছিল, আজ বুঝতে পারি।
আমি মাথায় পাউডার  দিয়ে  মাথা সাদা  করে রাখতাম।
আমাদের  একটা আয়না ছিলো। আয়নার  উপরে লেখা ছিলো, মনে রেখো ।আমি ঘুরতাম,ফিরতাম,আর দেখতাম চুল কতটুকু  উঠলো। সাদা পাউডারের যন্ত্রণায় কিছুই  বোঝা যেত না।
মা বলতেন, হ্যাপু পাগল হয়ে গেলে নাকি!
হায়রে! কি হাস্যকর।

গিনি আপা সমাচার

আমাদের  বাড়িতে  মামা বাড়ির একজন আত্মীয়  গিনি আপা প্রায়ই আসতেন। উনি খুব  সিনেমা দেখতেন। আমি আশা করে বসে থাকতাম, উনি কখন এসে সিনেমার গল্প বলবেন। প্রেমের গল্প বলার ব্যাপারে ছিল  অতি উৎসাহ।
যদি ও ওনার এমন গল্প করা উচিৎ  না, তবুও উনি করতেন। আমি তখন খুব  ছোট।  কিন্তু  ঐ যে আমার সিনেমা দেখার নেশা।আমি অধির হয়ে গল্প শুনতাম। ঐ বয়সে ওসব শুনার আকর্ষণই ছিলো  আলাদা।
মলুয়া সুন্দরী, মধুমিতা, পাতালপুরীর রাজকন্যা, সোনার চেয়ে দামী।
কথা বলো, না বলো ওগো বন্ধু
ছায়া হয়ে তবু পাশে রইবো।
মনে হতো শাবানার দুঃখে গাছ, লতা, পাতা,সব কাঁদছে।
সেই  সাথে আমি ও।
ঢেউ  দিও না,ঢেউ  দিও না জলে,ওগো প্রাণ সজনী
অথবা
আমি রূপনগরের রাজকন্যা, রূপের যাদু এনেছি
আমার  মন বলে তুমি আসবে।
আহা! কী  গান! কীসিনেমা!
ছোটবেলা  থেকেই  নাটক, সিনেমা, গল্পের  বই পড়ে আমার ফ্যান ফ্যান করে কান্না  স্বভাব।
আমার এক বন্ধু,   নাম বেলী,  আমেরিকায় থাকে। আমার বন্ধুরা সবাই  ওকে চেনে।
আমি সিনেমা দেখতে বসলে রাগে রাগে বলতো, হ্যাপী তুই  একটা গামছা নিয়ে বস। আমার এ ফ্যান ফ্যান কান্না  ভাল লাগে না। তোরে সিনেমা দেখতে কে বলেছে?

পৌষের  কাছাকাছি  রোদ মাখা সেইদিন
ফিরে  কি আসবে কখন ও?
ফিরে  আসে কি কখনও?
দেখা আর না দেখার কোন রং
চোখে আর ভাসবে কি কখনও?

শৈশব  মানে হরেক রকম খেলা

শৈশবে  হরেক রকম খেলায় মেতে উঠতাম। ওপেনটি বাইসকোপ।
তোর নাম বেগুনবালা
ঝিকির ঝিকির ময়মনসিংহ, আইতে যাইতে কতদিন।্  লুকোচুরি,  গোল্লাছুট, ছোঁয়াছুঁয়ি, চোর পুলিশ  কানামাছি, হাড়ি পাতিল খেলা।
কানা মাছি ভো ভো,যারে পাবি তারে ছো।
বালি মাটি ঘর বানানো, পুতুল  বানানো। আমার মা মাটি দিয়ে  খুব ভাল  পুতুল  বানাতে পারতেন।
আমার মনে হয় মাটির  খেলা থেকেই  পরবর্তীতে মাটির  নান্দনিক  শিল্পের  জন্ম।

বনভোজন

মিলি,শিরীন, পারুল,লাভলী, টুনু সবাই  মিলে বনভোজন  করতাম। এক বাড়ি  থেকে  চাল আর এক বাড়ি  থেকে  ডাল,নুন, পেয়াজ, ঝাল, রসুন,ডিম নিয়ে, পুকুর  পাড়ে ইটের  চুলা বানিয়ে  খিচুড়ি  রান্না  করা হতো। মা অবশ্য  সাহায্য  করতো। তারপর উঠানে মাদুর পেতে খেতাম।
আহারে! কি স্বাদরে!
হায়রে আমার দুরন্ত মেয়েবেলা।

চিঠি চালাচালি

লাঠি লজেন্সের লোভ দেখিয়ে পাড়ার বড় ভাই বোনেরা চিঠি আদান প্রদান করাতো। আমিও করতাম। আমি অত কিছু কি বুঝতাম। তবে এটুকু বুঝতাম, কেউ জানলে খারাপ হবে। অতি গোপনে এ ভাইয়ের  কাছে ও বোনের  চিঠি, ও বোনের কাছে ও ভাইয়ের  চিঠি। আবার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতাম, ওরা ভালবাসা করিছে। কিন্তু  ভালবাসা কি সেটাই বোধগম্য  ছিল না।
সে সব ভাই বোনেরা  কোথায়? অনেকে আছেন হয়তো, অনেকে নেই।
কে কার খবর রাখে!
তবে মনে পড়ে, খুব  মনে পড়ে।
মনে পড়ছে সেই ফ্যাসানেবল রনি আপা, মেধাবী  রোজী আপা,  খালিদ ভাই, লাভলী, তারিক, আঁখি, ডলার সবার কথা। কে কোথায় আছে? বড় বেশি  তোমাদের জন্য  মন পোড়ে। এ বয়সটাই বোধহয়  এমন সবার জন্য  মন কাঁদে।

প্রেমপত্র

সেই  ছোটববেলায়  প্রেমপত্রও পেয়েছি। দস্যু বনহুর বইয়ের মধ্যে  চিঠি দিতো। ।অজস্র  বানান ভুল।সেও তো অত বড় ছিল না। একবার একজন একটা খামের মধ্যে  চিঠি ও একটা লিপিষ্টিক পাঠিয়ে  লিখেছিলো,
তোমার জন্য  একটা লিপিষ্টিক পাঠাইলাম,অবহেলা করিও না,ইহা লন্ডনের  তৈয়ারি।
পরে শুনেছি সে তার বোনের  লিপিষ্টিক  চুরি করার জন্য  উত্তম  মধ্যম খেয়েছিলো।
আহারে!বেচারা।হায়রে  ভালবাসা।
ভালবাসা না মানে শাসন বারণ।

আবার একজন পরপর চিঠি দিয়েই  যেতো। তারতো প্রেম নয়, যেন সাগর। আর কি কাব্য!
যদি হয়,সুজন, তেঁতুল পাতায় নয়জন
তেঁতুল পাতা, তেঁতুল পাতা টক
তোমার সাথে প্রেম করা আমার বড় শখ।
পুকুরেতে পানি নেই, পাতা কেন ভাসে
যার সাথে কথা নেই, সে কেন হাসে?
ইটের পর ইট,তোমার কথা মনে হলে আমি হই ফিট
ওরে বাবারে!
জীবনের  প্রথম শাখে যে কোকিল  প্রথম ডাকে
হোক না সে কুৎসিত  কালো,তবু  সে প্রাণের আলো।
একথা লিখেছিল কেন? আমি কি কুৎসিত?
মোটেই  না।তাহলে!
হা!হা!হা!
সেই  আমলের  চিঠিগুলো  যেন কেমন ছিল। ইতি তোমার ৮০।
রাখি kমন।
আর এখন,আই মিস ইউ বেবি। যত ব্রেক আপ ততো স্মার্ট।
হায়রে!

ইনজেকশন 

ছোটবেলায়  আমি  ইনজেকশন  দিতে খুবই  ভয় পেতাম।  স্কুলে  ইনজেকশন  দিতে  এলে আমি স্কুলের  দেয়াল টপকিয়ে  বাসায় চলে আসতাম।  যিনি ইনজেকশন  দিতে  আসতেন  তার নাম রশিদ  কম্পাউন্ডার।  বরাশুলায় খা পাড়ায় বাড়ি।  একবার আমাদের  বাড়িতে  এলে আমি কাঁঠাল গাছের উপর উঠে বসেছিলাম।
অথচ নিয়তির  কি বিধান,  এখন আমার  আট নয়টা অপারেশন  হয়েছে। দুই, তিন বছর  অন্তর  অন্তর আমার একটা না একটা অপারেশন হবেই। এ বিষয়টা নিয়ে  আমার মা আপা খুব  কষ্ট  পেতেন। বলতেন, আমার হ্যাপোর জীবনটা এমন হলো।
আর কোথায় গেছে আমার ইনজেকশন  ভীতি!

পুকুরে  জাল ফেলা
আমাদের  বাড়িতে  একটা অনেক  বড় বাক্স ছিল।এক দুপুরে  আমি বাক্সের ভিতর ঢুকে ঘুমিয়ে  ছিলাম। এদিকে  আমাকে না পেয়ে,সারাটা বিকাল খুঁজে  বাসায় কান্নাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু  আমার কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙেনি।
পুকুরে  জাল ফেলা, লোক নামানো হয়েছিল। সন্ধার আমি চোখ ডলতে ডলতে বাক্স থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।

আনসার ক্যাম্প বোডিং

আমাদের  বাড়ির  কাছে আনসার ক্যাম্প ছিল। যেখানে এখন নড়াইলের শিল্পকলা একাডেমি  হয়েছে। সামনে একটামাঠ ছিল। যেখানে আমরা জোৎস্না রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতাম।
বোডিং-এ থেকে ছেলেরা লেখাপড়া করতো। ওখানে একটা লাইব্রেরি  করা হয়েছিলো।  তখন আমি বেশ ছোট। রোজ বিকালে বই পড়তে যেতাম। বই বাসায় আনা যেত না। ওখানেই  আমি প্রথম,ঠাকুর মার ঝুলি, পাতালপুরীর রাজকন্যা,  ডালিম কুমারের গল্প পড়ি। আহা্ ডালিমকুমারের জন্য  কি মায়া!

মাঝে মাঝে বায়স্কোপ  দেখান হতো।কখনো  কৃষি বিষয়ক, পরিবার পরিকল্পনা, স্যানিটারী ইত্যাদি  বিষয়ে।
এই বায়স্কোপ  দেখার জন্য  লোকের ঢল নেমে যেতো। লোকে লোকারণ্য। আসলে তখন তো বিনোদনের  তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের  ছেলে মেয়েরা কি এসব চিন্তা  করতে পারে! ফেসবুক, টুইটার, ম্যাসেঞ্জার,,হটসআপ,সিনেমা  কি নেই। আকাশ সংস্কৃতি  ঘরের মধ্যে। গোটা পৃথিবী  একটা পরিবার।

কালিদাস ট্যাঙ্ক

আমাদের  নড়াইলে কালিদাস ট্যাঙ্ক নামে একটা বড় দিঘীর মত ছিলো। আমি দেখেছি  অধিকাংশ  শহরে এরকম একটা দিঘী আছে। কালিদাস  ট্যাঙ্কে উপর  থেকে নিচে পর্যন্ত  সিঁড়ি  চলে গিয়েছে। ওখানে আমরা বিকালে মাঝে মাঝে খেলতে যেতাম। সড়সড়ি,দোলনা, স্লিপার ছিলো।
একবার আমি নাকি লাফালাফি  করতে গিয়ে  পড়ে ব্যাথা পেয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা আমাকে বাসায় নিয়ে  এসেছিল। আমার পড়ে যাওয়া  দেখে নাকি একটি ছেলে বড্ড কষ্ট  পেয়েছিল। মজার ব্যাপার সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট  ছিল। বড় হবার পর সে নিজে আমাকে গল্পটা করেছে। আর দুজনে হাসাহাসি করেছি
হায়রে! ছোট  বয়সের  ভাল লাগা!

চৈত্র সংক্রান্তি

বুনোপাড়ায়  চৈত্র  সংক্রান্তিতে পাটনিরা আসতো। যারা নাচ গান গেয়ে চাল,ডাল নিতো।  অধিকাংশ  ক্ষেত্রে  ছেলেরা মেয়ে সাজতো। আর গান কি।
নাকি সূরে
আমার গিন্নি  কবে হবে
আমার ভাবনা সেদিন  যাবে
বিয়ের কথা আগে বলো তোমার বাবাকে
আমি বাবাকেবলবো না
আমার জানতো রাখবেনা
আপনি আমার মাষ্টার  বাবা রাজী হবে না।
নিশ্চয়ই  বুঝেছেন, ছাএী,শিক্ষক প্রেম।  কী হাস্যকর!  পরবর্তীতে হুমায়ুন  আহম্মেদের ঘেটুপুত্র কমলায় এমন একটি চিত্র  দেখেছি। এটাই আমাদের  সংস্কৃতি।

মনে পড়ে নানীজানের কথা। কাঠি মামা, একলিম মামা, মিকু মামার মা।। নানীজান আমাদের  খুব  আদর করতেন। নানীজান খুব  পান খেতেন। ছোটবেলায় নানীজানের কাছে গিয়ে  পান খেতে চাইতাম। নানীজান মুখের  ভিতর থেকে একটু চিবানো পান দিতেন। আহা! কী স্বাদ!
কবে চলে গিয়েছেন নানীজান।
মনে পড়ে শান্তা খালাম্মা, জারিফা খালাম্মার কথা। তাকে আমার ভাগনে কল্লোলের বউ বলে খ্যাপানো হতো ।জারিফা খালাম্মা  কল্লোলের নানী হতো। তাই এই রসিকতা।
ডোরা আপা,ঝোরা আপা,লোরা আপা, রিকু মামা শাকিল শাপুর,হোমার,মৌসুম সবার কথা মনে পড়ে।   মফস্বল  শহরে মনে হতো সবাই  আমরা একটা পরিবার।
আগে কি সুন্দর  দিন কাটাইতাম।

হাজী নানীর বাগান

হাজীনানীর  বাগান ছিল  আর একটি আকর্ষণ । নাহার নামে নন্টু মামার একটা বোন ছিল। আমার বান্ধবী, আবার  ভাগ্নীও। ওকে সাথে করে হাজীনানীর  বাগানে যেতাম। নানীজানের একটা গোলাপজাম গাছ ছিল। আগডালে পেকে থাকতো। কি  কষ্ট  করে যে কোটা দিয়ে  পাড়তাম। তবে বাগানটা খুব  ভয়ের ছিল। দিনে দুপুরে  রাস্তা  দিয়ে  যেতেও ভয় করতো।আসলে কি কিছু  ছিল! অনেক  গল্প  ছিল  বাগানটা নিয়ে।
আচ্ছা  বাগানটা কি এখন ও আছে?
শুধু  তাই  নয়,নানীজানের বাড়ির পিছনে একটা তেঁতুলগাছ ছিল। সেটাও গা ছমছম করা। তেঁতুলগাছের কথা মনে করে রাতে ঘুমাতে পারতাম না।
নানীজান অসম্ভব  ভাল একজন মানুষ  ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়  রাতের  আঁধারে উনি আমাদের  খাবার দিয়ে গেছেন। সৈকতের  জন্য  দুধ দিয়ে গেছেন ।যখন কেউ আমাদের  সঙ্গে  ভয়ে কথা বলতো না।
মনে পড়ে বিউটি খালাম্মা, মঞ্জু  খালাম্মা,  মমো খালাম্মার কথা।
উনারা কেমন আছেন?!বড় দেখতে ইচ্ছে  করে!

মনে পড়ে ইসহাক চাচার কথা।

আব্বার সাথে নদীতে গোসল  করতে যেতাম। চাচা আব্বাকে দেখে বলতেন,  আফসার, তোর ঐ মেয়েটা না, যে ট্যা ট্যা করে নদীর  চরে শুয়ে শুয়ে কান্দিছিলো। পাশে এক মহিলা বসেছিলো। তুই  চাল দিয়ে, টাকা দিয়ে   কিনে নিয়ে ছিলি।সেই  কালো মেয়েটা না? আব্বা  রাগ হয়ে বলতেন, কি বলো চান্দেরতলায় আমার হ্যাপুর মতন চেহারা নেই।
আমি সত্যি  সত্যিই  মনে করতাম। আর বাসায় এসে কাঁদতাম।  মা আব্বাকে বলতেন, ভাইজান ইয়ার্কি করে, আর হ্যাপু কান্নাকাটি  করে। ওনাকে মানা করে দেবেন।
হায়রে আমার বিশ্বাস!

সজল
রেবা খালাম্মার ছেলে। সম্পর্কে  আমি নানী। খুব  সুন্দর  ছিল দেখতে। আমাদের গেটের কাছে এসে আমাকে ডাকতো সাফী আমার বউ। হ্যাপী বলতে পারতো না। আমি কোলে নিয়ে  ঘুরতাম।সবাই  রহিম  বাদশা রূপবান বলে খ্যাপাতো।
সজল আজ আর নেই।  ক্লাস  ফাইভে পড়ার সময় চলে গেছে চিরতরে। সজলের কথা আমার খুব  মনে পড়ে। কষ্ট  হয়!
আমার রহিম বাদশা।

আমার ভাগ্নে কল্লোল

কল্লোল যখন খুব  ছোট  তখন কোলে নিলেই কামড়াতো। আমিও তখন বেশ ছোট। আমি তবুও কখনও  ওকে কোল থেকে নামাতাম না। যদি ও ব্যাথা পায়।
একবার ওকে নিয়ে  ঈদের  দিন এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছি।
ওরা সেমাই  খেতে দিয়েছে, ও এক প্লেট খাওয়ার পর বলে, আরও খাবো। কান্না  জুড়ে দিয়েছে। এদিকে তারা আর দেয় না।
বাড়িতে  কিছু খায় না।খাবার মুখের মধ্যে  পোটলা করে বসে থাকে। অথচ সেই  কল্লোল! শিশুদের  স্বভাব বোধহয়  এমন হয়!
ওকে নিয়ে  মজার মজার গল্প  আছে। একবার ও ষোলটা রসগোল্লা  খেয়ে ফেলেছিল। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।মেজদা বলছে,  মাম আর খেও না। ও ততো চিৎকার  করে বলে,  আমি আলো খাবো।
সেই  কল্লোল এখন দু সন্তানের  পিতা। ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে।

ফেলে আসা দিনগুলো  কেন পিছু ডাকে।
স্মৃতিরা কেন রংয়ে  রংয়ে  ছবি আঁকে
মনে পড়ে শৈশবের  স্মৃতি। মনে পড়ে শামিম ভাই, লাভলু ভাই, ঝিন্টু ভাই, মিন্টু ভাই, তুষার ভাই খোকন ভাই, মুন্সেফ খোকন ভাই-এর কথা। সবার স্নেহের কথা। বাহার ভাই  কি বেঁচে  আছে? যে আমাকে আবোল তাবোল বলে খ্যাপাতো। দাহার ভাই? আজাদ ভাই,ইদরিস ভাই, মনা ভাই, সুবেন্দু দা? যাদের স্নেহধন্য  হয়েছি সেই  শৈশবে! ওনারা কি সবাই  আছেন?

আমার শিক্ষক

আদর্শ  লিপি শিখেছিলাম  দিদিমনির কাছে । যেন শুভ্র বসনা রজনীগন্ধা। নদীর ওপার থেকে দিদিমনি আসতেন।সাদা থান, চোখে চশমা, চটি পায়ে। দিদিমনি যখন অ,আ, শিখাতেন মনেহতো বাংলায় এতগুলো  (স) কেন!  দিদিমনির কাছ থেকে হাতের লেখা শিখেছি। দিদিমনি কুঁচ ( একরকম লাল ফল) দিয়ে গোনা শিখাতেন। সেই  যে শিখেছি তা দিয়েই আজও চলছি। কোথায় দিদিমনি! কবে কত যুগ আগে চলে গিয়েছেন। দিদিমনি বেঁচে থাকলে একটা থান দেবার বড় ইচ্ছে  ছিলো।
দিদিমনির কথা খুব  মনে পড়ে।
তিনি আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক।
মনে পড়ে নান্নু আপার কথা। আপার সাথে  গার্লস গাইড করতাম। শফিপুর, মৌচাকে আপার সাথে এসেছি। আপা আমাকে খুব  স্নেহ করতেন। নান্নু আপা চলে গেছেন সুদূরে।
মানা আপা ইংরেজি  পড়াতেন। বলতেন, তোর হাতের লেখা সুন্দর। যত্ন করিস। আপার কাছ থেকে আমি প্রথম ইংরেজিতে এ্যাপলিকেশন  লেখা শিখেছি।
মোশাররফ  স্যারও ইংরেজি  পড়াতেন। making a film,সোহরাব  রোস্তম পড়াতেন। একবার সোহরাব  রোস্তম পড়াতে গিয়ে বলেছেন,সোহরাবের বউয়ের প্রসব বেদনা উঠিয়াছে। আর সবাই  কি হাসি। স্যার ক্ষেপে গিয়ে  ক্লাসের  সবাইকে একঘন্টা  দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
কি ছেলেমানুষী!
আর একবার আমার এক খালাতো ভাই  বলেছিলেন, জানিস হ্যাপী থেকে হ্যাপেন্ড হয়। স্যার জিজ্ঞাসা করার পর আমি তাই  বলেছিলাম। আর যাব কোথায়! স্যার আমাকে একপায়ে দাঁড় করিয়ে  রেখেছিলেন।
ডলিআপা, রিজিয়াআপা, ডালিম আাপা (আমার আপার বান্ধবী  ছিলেন) ,ডলি আপার কথা মনে পড়ে। ডলি আপা  লাল সিঁদূরের টিপ পরতেন সেই  আমলে! ভাবা যায়।আপা আমাদের  বিজ্ঞান পড়াতেন। খুবই  ভাল শিক্ষক ছিলেন।
মনে পড়ে অঞ্জলি দিদিমনি,রেনুকা বকসী দিদিমনির শাড়ি পড়ার ঢং।  আজও চোখে ভাসে।
রাজ্জাক  স্যার, আমজাদ ফুফা, গফফর স্যারের কথা মনে পড়ে। বাসুদেব স্যার আমাদের  অংক করাতেন।কোনদিন  যদি অংক না পারতাম,সাথে সাথেই বলতেন,   তুই না দুলু, মোহনের বোন !
কি যন্ত্রণা! ভাই বোন বেশি  লেখাপড়ায় ভাল হলে যা হয়।
সারাটা জীবন একই কথা শুনে গেলাম।

আমাদের  একজন বিজ্ঞান স্যার ছিলেন। ক্লাসে  এসেই ঘুমাতেন। বাসায় কি সমস্যা ছিলো  কে জানে!
একবার পড়া দিয়ে ঘুমাতেন । তখন যার যা ইচ্ছা বলে যেত। একদিন পড়া দিয়ে  স্যার ঘুমাচ্ছেন, আমাদের  এক বান্ধবী  বলা শুরু  করলো, দেখ না,কি কান্ড হয়েছে, স্যার ঘুমাচ্ছেন।
আর একদিন পড়া দিয়েছে,  মরিচা কি, মরিচা কেন ধরে। নদীর ওপার থেকে আসতো একটা মেয়ে, নামটা মনে নেই।  পড়া খুব  ভালো  পারতো না। বলা শুরু  করলো,মরিচা গাছে ধরে,  শুরুতে  সবুজ  থাকে, পেকে গেলে লাল হয়।
স্যার আধোঘুমে বললেন, কেন ধরে  তাই  বল? সে বলা শুরু  করলো, রান্নায় ব্যবহার হয়। এতে স্বাদ হয়। বেশি হলে চোখ দিয়ে  পানি পড়ে।
আর সবার কি হাসি।সে আসলে মরিচকে মরিচা বানিয়ে ফেলেছে।
আর একবার স্যার গতানুগতিক ভাবেই ঘুমাচ্ছেন। আমাকে কয়েকজন বলল, ,তুই  গিয়ে উজ্জ্বলা কাপুড়িয়া  দিদিমনিকে ডেকে আন। উনি আমাদের  এসিস্ট্যান্ট  হেডমিসটেস ছিলেন। যে কথা সেই  কাজ। আমি দুই  ক্লাসের  হার্ডবোর্ডের ছেঁড়ার ফাঁকা দিয়ে  গিয়ে  দিদিমনিকে ডেকে আনলাম। দিদিমনি এসে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন। স্যার   ধড়ফড়িয়ে  ওঠেন।
পরের দিন  মূল ঘটনা জানাজানি হয় ।স্যার ক্লাসে এসে বলেন, কে ডেকেছে  দিদিমনিকে? সবাই  চুপ।একজনকে বলল,তুই  বল। সে ভয়ে আমার নামটা বলে দিল।
আর যাবা কোথায়। এক ঘন্টা  নীডাউন। বিরেন স্যার সমাজবিজ্ঞান  পড়াতেন। শুধু নাকে হাত দিতেন।
মনে হয় কি যেন শুকছেন।  একবার রাস্তা দিয়ে  যাচ্ছেন। আমরা তিন বন্ধু  ছাদ  থেকে  বললাম,শোকেন,শোকেন গোলাপ ফুল শোকেন।
পরের দিন  ক্লাসে  সপাং সপাং।পরবর্তীতে নীডাউন।
কি ছিলাম রে ভাই!

উজ্বলা কাপুড়িয়া
আমাদের দিদিমনি। যেন মা  দুগগা।সাদা দুধের  মতন গায়ের রং,, লম্বা, লম্বা  লম্বা কোঁকড়ানো  চুল।সেই  সাথে সেই  রকম ব্যক্তিত্ব! সারাটা স্কুল  ছড়ি হাতে ঘুরতেন। কখনও ওনার পায়ের ফুসরত ছিল না।  ঝিনুকের  মাঝে ইলিশ মাছের নকশা করা কানের দুল পরতেন। তখন ঝিনুকের মাঝে গোলাপফুল,নৌকা,ইলিশ  মাছ বসানো সোনার দুল বানানো হতো। মা,আপার এরকম দুল ছিলো।
এখনও শিক্ষকরা এমন দায়িত্ব  পালন করে। আমি নিজে ও শিক্ষক। 


ছোট  আপু
আমার ছোট আপু ছোটবেলা থেকে অনেক  মেধাবী।  সাহিত্যের  এমন কোন শাখা নেই যেখানে ওর পদচারণা  নেই। ছোটবেলা থেকে অসাধারণ  লিখতেো।
একবার স্কুলের  এক প্রতিযোগিতায় আমি কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম হয়েছিলাম। কিন্তু  পক্ষপাতিত্ব  করে আমাকে দ্বিতীয়  করা হয়েছিলো । আরযাবা কোথায়! ছোটআপু আমাকে টানতে টানতে নিয়ে আসছিল, আর বলছিল,   তোর পুরস্কার  নিতে হবে না।আর আমি চিৎকার  করে কাঁদ ছিলাম।,পুরস্কার  নেবোই নেবো।
ছোটবেলায়  আমি খুব  ভাল হাইজ্যাম্প দিতে পারতাম।পুরস্কার ও পেয়েছি  অনেক।
আমার ছোটআপু এখনো  নিরন্তর  লিখে  চলেছে। তবে প্রচারবিমুখ। ওর একশ দশটা বই রয়েছে। পুরস্কারও   পেয়েছে অনেক।

আমার ভাইয়া
আমাদের  বড় দুলাভাই।  উনাকে আমরা ভাইয়া বলে ডাকতাম।
আমার ভাইয়া  আমাদের  জন্য  কি সেটা লিখতে গেলে  একটা বই হয়ে যাবে। আমি জানি না পৃথিবীর  কোন দুলাভাই  তার শালা শালীকে এত ভালবেসেছে  কী না !বড়দা যখন শহীদ হন, উনি আমাদের  সন্তানের  মতন আগলে রেখেছেন।  একটা কথা খুব  মনে পড়ছে। আমি কখনও সাদা রংয়ের মিষ্টি খেতাম না। আমার ভাইয়া যতবার নড়াইলে আসতেন, আমার জন্য  লাল বা কাল রংয়ের মিষ্টি  নিয়ে  আসতেন।
দুনিয়ার  সবাই ভুলে গেলেও ভাইয়া আমার জন্মদিনটা কখনও ভুলতেন না। আসলে আমার আপার যখন বিয়ে হয়, তখন আমার এক বছর বয়স। বিয়ের  আসরে  ভাইয়ার কোলে আমাকে দেবার পর আমি নাকি ভাইয়ার শেরওয়ানী ভিজিয়ে দিয়েছিলাম। নতুন জামাই। কী ল্জ্জা! আমি আপা ভাইয়ার মাঝখানে ঘুমাতাম।

আমার আপা
মাকে হারিয়ে  কখনও বুঝতে পারিনি মাকে হারিয়েছি।  আমার আপা আমাদের  বুঝতে দেয়নি। পৃথিবীতে  এমন মমতাময়ী  বোন কারো আছে কিনা আমার জানা নেই। যে শুধু  দিয়েই গেছে, কিছু নেয়নি।
মানুষকে  ভালবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত। আমার আপা চলে গেছে সুদূরে। আপা আমার বড় কষ্টের জায়গা। আপাকে নিয়ে  আমি কিছু লিখতে পারি না।
আমার আপা আমাদের  দুবোনকে  একই রকম জামা বানিয়ে  দিতেন। উলেন সোয়েটার  বিভিন্ন  ডিজাইনে। সবাই  তাকিয়ে থাকতো। আপা সেলাই  ফোঁড়াই সব কিছুতেই  অত্যন্ত পারদর্শী  ছিলেন।
যা একবার দেখতেন সেটাই  বানিয়ে ফেলতেন।  কত যে সেলাই  ছিল  আপার! গম দিয়ে, দেশলাইয়ের  কাঠি, মাছের আঁশ দিয়ে  সেলাই করে বাঁধিয়ে রাখতেন।
তাজমহলের পাথর দেখেছো,দেখেছো কি তার প্রাণ
অন্তরে তার মমতাজ নারী বাহিরেতে শাহজাহান

মানুষ  চলে যায় রেখে যায় কথা
ফুল ঝরে যায়  রেখে যায় বোঁটা।
আপা কই মাছের দাঁত জমাতেন সেলাই  করবেন বলে। আপা চলে যাবার পর একটা কৌটায় কইমাছের অনেক দাঁত পাওয়া গিয়েছে। কোথায়! আমার মা সম আপা!
অতি আপন মানুষগুলো কীভাবে চলে গেলো।আর কোনদিন দেখতে পাবো না।

আমাদের  গার্লস স্কুলে ঈদে মিলাদুন নবী হতো খুব  বড় করে। স্কুলে  সাজ সাজ রব  তো। রচনা প্রতিযোগিতা হতো। এমন কোন বার নেই,যেবার পুরস্কার  পেতাম না। খাওয়া দাওয়া হতো। সালাউদ্দিন  স্যার মিলাদ পরিচালনা  করতেন।।কি সুমধুর   কন্ঠ। যেমন সুরেলা, তেমন সুদর্শন স্যার । নুরানি  চেহারা।
আজও যেন স্যারের মোনাজাত কানে বাজে।

তখন আমার সবই  ছিল
বন্ধু  বান্ধব  যা পেয়েছি
সবই খাঁটি ছিল
কতজন এলো গেলো
কতজনআসবে যাবে
দিনশেষে  ওরাইতো রয়ে গেল
রাগ অভিমান ছিল,
কষ্ট  ছিল না
এখন রাগ নেই, কষ্টটা রয়ে গেল।

মনে পড়ে পিয়ারীর কথা। সেই  পড়ুয়া মেধাবী  পিয়ারী। আমরা যখন খেলায় মত্ত, ও তখন পড়েই চলেছে।
ফল ও পেয়েছে, প্রতিষ্ঠিত,নামকরা ডাক্তার। ডলি  আমাদের  ক্লাসে ফার্স্ট হতো । সে কোথায় হারিয়ে গেল।
রমনা খুব  ভাল নাচতো।
তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।
মানুর সেই  দূূরদিপবাসিনী গানের সূর আজও কানে বাজে।
মিলি,রপগঞ্জের  মিলি, কবিতা,রোজী, রমা সবাই  স্বমহিমায় ভাস্বর।
ভাল আছে তনু  জাহিদ,শাকিল নান্নু,নাহার রোজ সবাই।
ভাবতে ভাল লাগে বন্ধুরা যে খানে আছেসবাই  প্রতিষ্ঠিত।

দাও ফিরিয়ে  সে মেয়েবেলা
চাঁদের  কনা চাঁদবুড়ি
পাঠশালাতে নামতা
বাদল রাতে গা ঝমঝম
ভূতের  গল্পে ভয়ে মরি
দাও ফিরিয়ে  মেয়েবেলা
ঘুমপাড়ানি গানের সুর

আমার কলেজ  জীবন

আগেই বলেছি সেই  ছেলেটির দাঁড়িয়ে  থাকার কথা। ভ্যান, রিক্সা  দিয়ে  কে কার আগে যেতে পারে। ছেলেটির সাইকেল দিয়ে  ঘোরা,আর শিস দিয়ে  গাওয়া।
দাদা পায়ে পড়ি রে মেলা থেকে বউ এনে দে
একদিকে দাদাদের শাসন, মুরব্বিদের  ভ্রুকুটি পার না হতেই দুবছর শেষ। ভাললাগা কথাটা মনেই থেকে গেল।
এর মধ্যে  পাখি উড়গিয়া।
আমাদের  সময় এমনই ছিল ।  ভালবাসাতো দূরের কথা, ভাললাগা বলতেই দুবছরের বেশী সময় লেগে যেতো। আর ততদিনে মেয়েটা পগার পার। আর এখন!, ভালবাসা নয়,মুরগী পোষা।

সত্য স্যার
আমাদের  বাংলা পড়াতেন।চোখ মুদে আবেগে আপ্লূত  হয়ে রক্তাক্ত প্রান্তর পড়াতেন।
তোমার আমার মাঝে  শুয়ে আছে আমার পিতার লাশ, আমিতোমার দিকে এগুবো কি করে?
তোমার হাতে হাত রাখবো কি করে?  অথবা,পোড়া শরীর মনের নানা মানে না!
মনে হতো স্যার বেদনায়কাতর। সেই  সাথে আমরাও।
আজও জোহরা বেগম, ইব্রাহিম কার্দির জন্য  কান্না  পায়।
অথবা
হৈমন্তি, অন্নদাদিদি! যে শুধু  দিয়েই গেল
অন্নদাদিদি যেন ভস্মাচ্ছিত বহ্নি।
শ্রীকান্তের নতুনদা। নতুনদা তুমি কোথায়? দূর হইতে কুকুরের  ডাক শোনা যাইতেছে।

আসে নব বসন্ত
ডাকে কোকিল
শাখায় শাখায় দোল দিয়ে যায় দখিন হাওয়া
তখন তোমার মনে লাগে রং
চোখে লাগে রঙিন  স্বপ্ন
আজও যেন ঘুম ঘোরে শুনতে পাই।

আচ্ছা  সত্য স্যার কেমন আছেন? আমারঅতি প্রিয় শিক্ষক।

মনে পড়ে নব স্যারের কথা।
স্যার বলতেন পেপার নয়,ফেইফার, জেরুজালেম নয়,জেরিঝালেম।
কি অসাধারণ  পঠনশৈলী,উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি! 
মনে পড়ে হাফিজ স্যার, মোস্তফা  স্যার, গফুর স্যার,রেজাউল স্যারের কথা।

কত না স্মৃতি! সেই  নিশিনাথতলা, জমিদার বাড়ি, রূপগন্জ বাজার,  মুচির পোলে চা খাওয়া, আমার শিক্ষাঙ্গন ভিক্টোরিয়া  কলেজ।
ভিক্টোরিয়া কলেজের  সামনে একটা ক্যামেলিয়া গাছ ছিল।  এখন ও কি আছে গাছটি! এখনও কি নৌকা বাইচ হয়! হিন্দু পাড়ায় চৈত্রসংক্রান্তিতে পাটনিদের নাচ হয়!

কত শত স্মৃতিরা ভিড় করছে। কোনটা রেখে কোনটার স্মৃতিচারণ করব!
আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি  কিনে এনেছি
বাঁশি  কই আগের মতন বাজে না
মন আমার তেমন করে সাজে না
তবে কি ছেলে বেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি?
আর কত!এখন বোধহয়  মহাপ্রস্থানের সময় জানান দিচ্ছে
একটু বেশি  তাড়াতাড়ি  হয়ে যাচ্ছে  না? ঈশ্বরই ভাল জানেন।

চারিদিক  অবরুদ্ধ, গৃহবন্দী।
তার মধ্যে  এ স্মৃতি  কাতরতা।
ভাইরাসের  ভয়,মৃত্যুর মিছিল,হাহাকার,  আতংকের পরিবেশ, সব মিলিয়ে এক ঘোর অমানিশা, এক অস্বস্তিকর  অনুভূতি। আপাতত  এই নিয়ে  বেঁচে  আছি।
বেঁচে  থাকতে হবে এই অনুভূতি  নিয়েই বেঁচে  আছে গৃহবন্দী  ভয়াতুর  মানুষ।
এ মুহূর্তে   ভাবনা, জল্পনা, কল্পনা, পরিকল্পনা,  চিন্তা , দুঃশ্চিন্তা, স্বপ্ন, আশা,নিরাশা আর ভালবাসাই সম্বল।
যা চিরন্তন, যার মৃত্যু নেই।

যেথা রামধনু ওঠে হেসে
যেথা আর ফুল ফোটে  ভালবেসে
সেই দেশকে ভালবেসে সেই  মাতৃভূমিকে ভালবেসে
এই অমানিশায় আমরা উচ্চস্বরে  বলি
মুক্ত করো ভয়
আপনা মাঝে শক্তি  ধরো
নিজেকে করো জয়।


আমার কথাটি ফুরালো নটে গাছটি মুড়ালো।