আমার সাতকাহন-১০ / ছন্দা দাশ

আমার সাতকাহন 11

আমার সাতকাহন

আমার সাতকাহন-১০ / ছন্দা দাশ

 

বিকেল হলেই মাঠে খেলতে যাওয়াও আমাদের নিত্য কর্মের মধ্যেই পড়ে। কিছু কিছু খেলা ছিল আমাদের নিজেদের উদ্ভাবিত। শিক্ষক নিবাসের একজন শিক্ষক ছিলেন খুব ধর্মভীরু। সারাক্ষণ তিনি ইস্টনাম জপ করেই  চলেছেন। কিন্তু যেই মাত্র ওনার বাগানে ছাগল ঢুকেছে কি, উনি গীতা মন্ত্র জপতে জপতেই ছাগলের গলা টিপে দফারফা শেষ। মাঝে মাঝে আমরা আমের মৌসুমে ওনার বাগানে হানা দিতাম। উনি যখন ইট, পাটকেল নিয়ে আমাদের তাড়া করতেন আমাদের তখন মহউল্লাস। সেই অধ্যাপকের নামানুসারে আমরা খেলাটির নামকরণ করি। আর সেটি খুব প্রিয় খেলা ছিল আমাদের। সে অধ্যাপক ইংরেজিজ সাহিত্যে গোল্ডমেডেল পাওয়া ছাত্র কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনেক পরে যখন ওনার মেয়ে আসে দেশ থেকে এবং আমার প্রিয় বান্ধবী হয় আমরা সে খেলাটা খেলতে গেলে সে বলে,  বাবার নামে খেলাও আছে? আমরা মুখ লুকিয়ে হাসতে থাকি। মার্তন্ড প্রতাপ বড়ুয়া বলে যে অধ্যাপক ছিলেন তার ভাই দোর্দন্ড প্রতাপ বড়ুয়া যাকে আমরা শংকুদা ডাকতাম তিনি ছিলেন আরেক চরিত্র। নিজে হাসতেন না কিন্তু সারাক্ষণ মানুষকে হাসাতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওনার কৌতুক পরিবেশন ছিল সবার প্রধান আকর্ষণ। শংকুদা একবার কলেজে ছাত্র পরিষদে জি,এস পদে দাঁড়ায়। চারিদিকে তাকে নিয়ে সে কি মাতামাতি! দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টারে ছেয়ে গেছে।”‘মাইকে গান বাজতে “শংকু মোদের যেমনি রসিক তেমনি অমায়িক,তাহার চেয়ে বড়ো এ্যাক্টর, তেমন সাহিত্যিক।” আমরাও বিকেল হলে শংকুদা সেজে সবাই লাইন বেঁধে গানটি গাইতে গাইতে মাঠ প্রদক্ষিণ করতাম। কিন্তু অবধারিত জয়ী হবে বলা শংকুদা মেজদির জন্য গো হারা হেরে গেল। শংকুদা মেজদির ক্লাসমেট ছিল কিনা মনে নেই। তবে তিনি মেজদিকে একবারও বলেননি

ভোট দিতে। আর মেজদি যখন তার প্রতিপক্ষকে ভোট দেয়, কলেজ শুদ্ধু সব মেয়ে মেজদিকে অনুসরণ করে। তাদের অভিভাবকদের নির্দেশ, অংশুমান হোরের মেয়েরা যাকে ভোট দেবে তাকেই ভোট দিবি।এমনই ছিল আমার বাবার জনপ্রিয়তা!

আমাদের সংসারে আমাদের মা-ই ছিলেন সর্বময়ী ক্ষমতার অধিকারী।  মায়ের কথাই শেষ কথা। বাবা থেকে ছোটভাই বাবু পর্যন্ত তা মেনে চলতো। বাবার মত কোন পুরুষকে আমি আজ পর্যন্ত তার স্ত্রীকে এত সম্মান করতে আর দেখিনি। আমার মাও বাবার সমস্ত প্রয়োজনের দিকে যেমন সজাগ দৃষ্টি রাখতেন আবার তেমনি নিজে আর আমাদের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা,ভক্তি আর ভালোবাসা বোধ জাগাতে কোন মাকে দেখিনি।আমাদের অপরাধে মা যখন বকতেন অনিবার্যভাবে তা বাবার উপর দিয়ে গড়াবেই। একবার মা কোন কারণে ছোড়দিকে বকা দিতে গিয়ে বাবাকেও ছাড়লেন না। তারপরেই মা সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আধা ঘণ্টা পরে ছোড়দিকে দেখতে না পেয়ে মা ব্যাকুল। এমনিতে ছোড়দি শান্ত ছিলো বলে মায়ের দূর্বলতা বেশি ছোড়দির জন্য। যে মেয়ে কোনদিন ঘরের বাইরে একপাও দেয় না, সে এতক্ষণ ঘরে নেই। কোথাও না পেয়ে মা বাথরুমের দরজায় গিয়ে দেখেন বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পর দরজা খুলতেই দেখেন সে অঝোর ধারায় কেঁদেই যাচ্ছে। মায়ের তো বিস্ময় কী হয়েছে তার!

শেষে সে মাকে বলে, তুমি কেন আমার দোষের জন্য বাবাকে বকলে?’ মা তো হেসেই আকুল।ছোড়দিকে বলে, আয় দেখ তোর বাবার কিছু মনে আছে কিনা।সত্যিই আমার মহাদেব বাবা তখন সেতারের তারে মগ্ন।আমার বাবা সব ধরনের বাদ্যযন্ত্রে সিদ্ধহস্ত। কতদিন দেখেছি বাবা কলেজে যাবার মুহূর্তে মাকে বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে। এমনিতে আমার মা বিলাসী ছিলেন না কখনো। কোথাও বেড়াতে যাবার সময় একটু সাজলেই লক্ষ্মী প্রতিমার মত মনে হতো। আমার মনে হতো আমার মা পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। সাজলেই মা  বাবার সামনে দাঁড়াবেন প্রথমে। বাবা তাকিয়ে মাথা নাড়ালেই মা তারপর বেরুতেন। মা বাবার এ সুন্দর মুহূর্ত আমায় স্বর্গীয় আনন্দ দিয়ে যেত। বাবা নারী অসম্মানকারীদের ভীষণ অপছন্দ করতেন। শুধু নিজের বৌ-এর গায়ে হাত তুলেছিল বলে আমাদের বহু বছরের পুরোনো কাজের লোক কেষ্টদাকে বিদায় করেছিল।সে বাবার পায়ের উপর পড়ে  কাঁদলেও বাবাকে টলাতে পারেনি। আমাদের বিয়ে দিতে গিয়েও বাবা কখনও পাত্রপক্ষকে মেয়ে দেখাননি। বাবা বলতেন, দেখলে বিয়ে করতেই হবে। সে যত কুরূপাই হোক। মেয়ের নারীত্বের অসম্মান আমি করতে দেব না। এ বাজার নয়, তুমি দেখে পছন্দ করে নিবে। দেখতে চাইলে অন্য উপায়ে দেখ।সে সময়ে পাঁচ মেয়ের বাবার মুখে এ সাহসী উচ্চারণ কিন্তু এত সহজ ব্যাপার ছিল না।

রোববার স্কুল নেই। সকালের মিঠে রোদে নেমে গেছি বাসার সামনের মাঠে সবাই। চলছে বল খেলা।এ খেলায় আমি গোল কিপার ছাড়া আর কিছুই খেলতাম না। তাও আবার এক একদিন স্কুলের বিজ্ঞান স্যার অরুপ চ্যাটার্জী একটু দেরী করে যখন ক্লাসে ঢুকতে যাই দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করেন, আজ গোল খেলি না দিলি? ক্লাসের ছেলেরা মুখ লুকিয়ে হাসে। আমার কোন বোধই ছিল না এ নিয়ে। আমি ভাবতাম,  এটাই স্বাভাবিক। সেদিন খেলতে গিয়ে কে যেন বললো,  ঐ দেখ বোয়ালখালীর রাজপুত্র আসছে। কার বাসায় কে জানে?  আমি পেছন ফিরে দেখি আরে ও তো আমার মেজমামা অসিত  লালা। মামা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র। আমার সব মামারাই খুব মেধাবি। একমাত্র জীতেন বা জীতু মামার কথা আমার ভালো মনে নেই। জীতু মামা সারাক্ষণ মুখে হাত দিয়ে ব্রন টিপে টিপে কথা বলতেন।সেটা মামার বদ অভ্যাস।

কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলে বলতেন,  ভয়ংকর সুন্দরী। সুন্দর আবার ভয়ংকর কি করে হয় আমি তাই ভাবতাম। অনেক সময় দুষ্টুমী করে বলি,  সে মেয়েটা তোমার কথা জিজ্ঞাস করেছে। আর পায় কে? আমাদের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির মত অবস্থা। মেজমামা সত্যিই সুপুরুষ। যেমনি লম্বা,তেমনি গাঁয়ের রঙ,তেমনি চুল। মামা সাদা ফিনফিনে ধুতি পাজ্ঞাবি পরে রাস্তা আলো করে যেন হাঁটতেন। আর উনি খুব দিলখোলা মানুষ।মা আর মেজমামার খুব মিল ছিল। মা যেমন ভাই অন্তপ্রাণ, মামাও দিদি বলতে অজ্ঞান। গেইটের বাইরে থেকে হাঁক দিতেন টুনটুনি——-+-।টুনটুনি অর্থাৎ সেজদি যেখানেই থাকুক দৌঁড়ে চলে আসবে দরজা খুলে দিতে। এভাবে আসতে গিয়ে একবার সেজদির পায়ে আস্ত একখানা খন্তা পেরেক কাঠসহ ঢুকে যায়। সেজদির তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। ঐ মস্ত কাঠসহ পেরেক পায়ে একপায়ে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসে। সমস্ত পথ রক্তে ধুয়ে যাচ্ছে। বাবা

তাই দেখে ব্যাকুল। সে পা সারতে পুরো একমাস লেগেছিলো।

(চলবে)

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ