আমার সাতকাহন-১১/ ছন্দা দাশ

আমার সাতকাহন 11

আমার সাতকাহন

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা

আমার সাতকাহন-১১/ ছন্দা দাশ

মেজ মামা রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের  পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি পদার্থবিদ্যার একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন ছাত্রমহলে। ছোটমামা সরিৎ লালা ছিলেন বইয়ের পোকা।কিন্তু সে পড়ার বই না। গল্পের বইয়ের সাথে তাঁর যত সখ্য। মামা সকালবেলা পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বের হয়েই গল্পের বই হাতে পড়তে পড়তে বাসায় ফিরতেন। বিকেলে কিন্তু আবার পরীক্ষা হবে। অথচ সমস্ত পরীক্ষায় তাঁর কী চমৎকার রেজাল্ট! পেশাগতভাবে উনি এখন একজন প্রতিষ্ঠত প্রকৌশলী। তাঁর স্ত্রী জনপ্রিয় টেলিভিশন শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ। আমাদের ছোটমামী। ছোটমামা, বড়দি,মেজদি, ছোটকা, মনা মামা, ঝুনু মামা রাতে সবাই মিলে কী আনন্দ করে লুডু, ক্যারাম খেলতো। এসব মনে পড়লে আবার সে সব দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। আমার আরও অনেক মামা ছিলেন । (মায়ের কাকাত, জ্যাঠাত ভাই) সবাই দিনগুলোকে স্বর্ণালী করে রেখেছে মনের ঘরে। ঝুনুমামা তাদের মধ্যে সবচে দুষ্টু। কার বাগানে কোন ফল ধরেছে,কার ঘরে মুরগিগ, ছাগল আছে এসবের ধান্ধায় থাকেন। সুযোগ বুঝে একদিন সাবাড়।  অরবিন্দ দেওয়ানজি  নামে পদার্থ বিজ্ঞানের ডেমনস্ট্রেটর খুব ভালো পড়াতেন। তবে উনি কড়া ছিলেন বলে ছাত্রেরা তাঁকে খরবিন্দুবাবু নাম দিয়েছিলেন। বড়দি, ঝুনুমামা,বাবলুদা  (প্রিন্সিপালের ছেলে) আরও অনেকে উনার কাছে পড়তেন। সকালবেলা উনি পড়াতে পড়াতে রুটিতে মাখন লাগিয়ে খেতেন। ঝুনুমামার হয়তো  লোভ হয়েছিলো। তাই একদিন অরবিন্দবাবুর মাখনের কৌটো চুরি করে ঝুনুমামা সবাইকে খাইয়ে বলেছিলেন কিনে এনেছেন। পরদিন যখন বড়দিরা পড়তে যান তিনি রেগে মেগে বলেন,

: আমি আর কাউকে পড়াবো না।আগে চোর কে বলো?

হঠাৎ দেখেন বাবলুদা নেই। ব্যাস আর যায় কোথায়! সোজা হুকুম দিলেন বাবলুর কান ধরে নিয়ে আয়।

বেচারা বাবলুদা কাঁদো কাঁদো হয়ে বড়দিকে বলেন,

 মীরা আমি তো এর কিছু জানিনা। বড়দির তো শ্যাম রাখি না কূল রাখির মত অবস্থা। অরবিন্দ বাবু

একদিন পড়াতে পড়াতে একজনকে বলেন, ‘দরজাটা খুলে দাও পওর (আলো) আসুক’। সেজদি আবার প্রচার করে দিয়েছে উনি সেজদিকে নাকি বলেছেন, ‘দেখ দেখ কি সুন্দর বিড়াল, লেজ উয়া (উঁচু) করে পালাচ্ছে। হয়তো মাখন এই চুরি করেছ ‘।

সবার সে কী হাসির ফোয়ারা বয়ে যেত! 

 রোববারের দুপুর আসে অন্য রঙে রাঙিয়ে। আমাদের স্কুল নেই,পড়ার চাপ নেই,মায়ের বকুনী নেই, বাবার কলেজ নেই। সকালে জলখাবারের পরই মাঠে। আমাদের সময় সবার বাড়ির দরজা সবার জন্য খোলা। অনায়াসে আমরা নিজের বাড়ির মত প্রতিবেশির বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে যাই।বারান্দায় বসে গল্প করি। আজকাল আত্মীয়ের বাসায় যেতেও ফোন করে জেনে নিই সে থাকবে কিনা,ফ্রি আছে কিনা। রোববারে দুপুরে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে বাবা নিজের রুমে দিবানিদ্রা দিতেন। তখন আমরা ভাইবোন বাবার মাথার কাছে গোল হয়ে বসে পাকা চুল বেছে দেবার ছলে গল্প শুনতাম। তিনটে চুল বাছলে একটি গল্প। আর এই গল্প শুনতে শুনতেই কত দেশ বিদেশের গল্প, লেখকের সাথে আমাদের বাবা পরিচয় করিয়ে দিতেন। বাবার রুমে সবসময় কত রকম বই। আমার খুব লোভ সেই বইয়ের প্রতি। বড়দির কড়া হুকুম ‘ওসব পড়ার বয়স তোর হয়নি এখনো’। তাই আমি বাবার যে গোলটেবিলখানা ছিল আর তার উপর মায়ের হাতে  ক্রুশ কাঁটায় বোনা লম্বা ঢাকা টেবিলক্লথের নিচে লুকিয়ে পড়তাম।নৌকাডুবি আমি সেভাবেই পড়েছিলাম। আমি তখন স্কুলে পড়ি না। মেজদির এক বান্ধবী পরীক্ষা দিতে যাওয়ার মুহূর্তে মেজদিকে বলে, ইরা নৌকাডুবি কার লেখা? আমি ফস,করে বলে উঠি, রবীন্দ্রনাথের। উনি বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আরেকবার স্কুলে সবে ভর্তি হয়েছি পঞ্চম শ্রেণিতে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমার পাশে বসেছে দশম শ্রেণির ছাত্রী। পরীক্ষা বাংলা দ্বিতীয়  পত্রের। সে ছাত্রী আরেকজনকে লুকিয়ে প্রশ্ন করছে,

 : পটলতোলা কি হবেরে? 

সেও  পারে না।আমিই তাড়াতাড়ি বলি উঠি,  “মরে যাওয়া “। অটলবাবু পটল তুলে চলে গেছেন

স্বর্গে। তারপরেই ওই ক্লাশের সব মেয়েরা একের পর এক আমায় বাগধারা, রচনা, চিঠি এসব বলতে বলায় আমি মহানন্দে বানিয়ে বানিয়ে নিজের খাতা গুটিয়ে ওদের বলতে থাকলে, কিছুক্ষণ পর দেখি প্রধান শিক্ষক এসে আমায় অন্যরুমে নিয়ে গেলেন। সেদিন খুব ভয়ে ভয়ে বাড়ি এসেছিলাম। আর কখনো বলিনি সেকথা। এতদিন পরে আজ প্রথম জানিয়ে দিলাম। অনেক পরে অনুধাবন করেছি, বাবা আমাদের কী দিয়ে গেছেন। বিনিময়ে  কিছুই হয়তো সেভাবে করতে পারিনি। এইরকম এক রোবাবারের কথা।পরিমল সেন নামে অন্তরখোলা একজন অধ্যাপক ছিলেন। ব্যাচেলর আবাস ‘নিরিবিলিতে’ থাকতেন। উনি যখন হাসতেন তার শব্দ অনেকদূর পর্যন্ত প্রকম্পিত হতো। রোজ বিকেলে উনি আমাদের সাথে খেলতেন লুকোচুরির,দাঁড়িয়াবান্ধা। আরো একজন ছিলেন ছয়ফুটেরও বেশি লম্বা নিখিলেশ দত্ত।  উনি  এটর্ণি জেনারেল হয়েছিলেন। উনার সাথে কথা বলতে গেলে আমাদের গলা উঁচিয়ে কথা বলতে হতো। তাই উনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে কথা বলতেন।

 

আজ সকাল থেকেই মন  অন্য সুরে গাইছে। কিছু কিছু চলতি সময়ের ঘটনা আমায় সেই গল্পটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে যা ছোড়দির মুখ থেকে আমার শোনা।

আমরা ভাই বোনেরা কমতে কমতে একসময় মাত্র তিনজনে এসে ঠেকেছি। তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে। মাঝে মাঝে আসে। আমি, ছোড়দি (কৃষ্ণা) আর বাবু।বাবু থাকে মহানন্দে তার নাটক নিয়ে।আমি আর ছোড়দি নিজেদের মতো বোন আর বন্ধুত্বের ভালোবাবাসায় বাস করি। কলেজ থেকে ফিরেই কলেজের গল্প, নিজের গল্প  সাত রাজ্যের গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসি। রাতে দুজনে এক বিছানায় শুয়ে শুয়েও ফিসফিস করে কথা বলে যাই। এক একদিন মা ওঘর থেকে ডাক দেন। এখনো ঘুমোস নি। আমি একটু দেরি করে উঠলেও ছোড়দি সাতসকালে উঠেই সবার জন্য চা,জলখাবার নিজের হাতে বানাতো। রান্নাও ছোড়দি করে মায়ের কষ্ট অনেকখানি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলো। এমন কি আমার পড়ার টেবিলে চায়ের কাপ এনে দিত সে। এ নিয়ে ছোড়দি কখনো অনুযোগ বা মন খারাপও করেনি। এমন বোন পাওয়া আমাদের ভাগ্য বলতে পারি। ছোড়দি মাঝে মাঝেই ভিঞ্চি, পিকাসো, শেক্সপিয়ার এমন আরও মহান ব্যক্তিদের কোন ঘটনার উল্লেখ করে তুলনা দিতেন কাজের। একদিন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। ছোড়দি গান প্র্যাকটিস করছে বসে। আমরা দুজন তখন ওস্তাদের কাছে ক্ল্যাসিকেল গানের তালিম নিচ্ছিলাম।গান বন্ধ করে ছোড়দি হঠাৎ প্রশ্ন করে,

 আয়না কোথা হতে এলো জানিস? আমি মাথা নেড়ে জানাই, না। ছোড়দি শুরু করে,

“একদিন এক চাষি জমিতে চাষ করতে গিয়ে জমিতে চকচকে একটি জিনিস দেখে হাতে তুলে নেয়। দেখে তার ভেতর একজন কৃষকের ছবি। সে অবাক হয়ে তা একজন সাধুর কাছে নিয়ে যায় কি তা জানার অভিপ্রায়ে। সাধু তা হাতে নিয়ে দেখে তার ভেতর একজন সাধুর ছবি। সাধু বলে, এতো সাধু পুরুষ।পাশে ছিল একজন কসাই। সে বলে, দেখি দেখি। হাতে নিয়ে দেখে একজন কসাইয়ের ছবি। সে বলে, আরে এতো কসাইয়ের ছবি।শেষে একজন শিক্ষক বল্লেন, এ হচ্ছে আয়না। আমরা যা তার ছবি এখানে পড়ছে।” 

ছোড়দি হেসে বলেন কি বুঝলি? আসলে আমাদের যার চরিত্র যেমন আমরা অন্যকেও সেরম ভাবি। এটা ছোড়দি কোন ঘটনা বুঝাতে গিয়ে বলেছিলো। এখন আমি তা বেশি রকম অনুভব করছি যেন!

(চলবে)

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ