আমার সাতকাহন-১২ / ছন্দা দাশ

আমার সাতকাহন 11

আমার সাতকাহন

ধারবাহিক স্মৃতিগদ্য

আমার সাতকাহন-১২ / ছন্দা দাশ

 

ছোটবেলায় সবাই হয়তো চুরি করে কিছু না কিছু। আমরাও সে অভ্যাস থেকে দূরে থাকিনি। বড়দির কথা আমার মনে নেই। মেজদিতো ভালো খাবার খুব ছোটবেলায় খেয়ে নিতো তা আগেই বলেছি। সেজদির কথাও মনে নেই। তবে সেজদি খুব কম খায়। মানুষের পেছনে লাগাই ছিল তার প্রধান কাজ। ছোড়দি লুকিয়ে হরলিক্স আর দুধ পাউডার খেতো শুধু। একবার হরলিক্স চুরি করে

মুখে পুরেছে। তখুনি বড়দি এসে বলে, কি করিস? ছোড়দি চুপ। বড়দিও ছাড়ে না। কথা বলাবেই। আমি, দাদা, বাবুও এসে জুটেছি। ছোড়দি বেচারা যেই মুখ খুলেছে বাতাসে সব হরলিক্স ধোঁয়ার মত বেরিয়ে এলো। আর পায় কে! বড়দির বকা সেদিন ছোড়দির কপালে। দাদা তো কন্ডেস্টমিল্ক এর কৌটো দেখলেই একটানে খেয়ে নিতো। ছোটবেলায় দাদা বলতো, আমি বড়ো হয়ে যখন চাকরী করবো সব টাকা দিয়ে কন্ডেস্টমিল্কের কৌটো কিনে সাজিয়ে রাখবো আর খেয়ে খালি কৌটো ছোড়দির গায়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারবো। এখন দাদা আর ছোড়দির দূরত্ব সাত সমুদ্দুর।

 

আমার মেজ জামাইবাবু খুব ভালোবাসতেন আমাদের নিজের ভাইবোনের মত। ছাতক থেকে আমাদের জন্য বিশাল বিশাল টুকরি ভরা কমলা, আম পাঠিয়ে দিতেন। সেবারে পাঠালেন ফজলী আম। দাদা আবার সেদিন কোথায় যেন বেড়াতে যাবে। তাই টুকরি থেকে বিশাল একটা আম নিয়ে মাল ঘরের পেছনে বসে ছুরি দিয়ে বসে বসে  খাচ্ছে। আমি ছোটবেলা থেকে দাদার ভক্ত। তাই বাসায় এসে কাউকে বলিনি। সন্ধ্যায় মা আম কাটতে বসে নিজে আর খান না। চোখ মুছে বলেন,  আমার ছেলেটিকে আম দিতে ভুলেই গেলাম। আমার মা এমনই। স্কুলে যেতে হতো  দশটার মধ্যে । আমাদের তরকারি দিতে না পারলে মাও আর তা খেতেন না। আমি ফস্ করে বলি, দাদা চুরি করে খেয়েছে আমি দেখেছি। আমার মায়ের মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠেছিলো সেদিন চুরির কথা শুনেও। আমি একবারই চুরি করেছিলাম। বিস্কিট চুরি করে বিছানায় শুয়ে একটা খেতে খেতেই ঘুমের অতলে। আর কিছুক্ষণ পরেই আমায় অসংখ্য লাল লাল ডেঁয়ো পিঁপড়ে ছেঁকে ধরে। কামড়ের চোটে ঘুম ভেঙে দেখি বিস্কুটের গুঁড়ো সারা বিছানায়। সেজদি হাসতে হাসতে বলে, আর করবি চুরি? আর একবারও চুরি করতে গিয়ে একই বিপত্তি। বড়দির আদেশ সন্ধ্যে হলেই পড়ার টেবিলে রাত দশটা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে।পড় বা না পড় উঠতে পারবে না। আমাকে দিয়েছে সেদিন translation করতে। আমি বই উল্টাতে গিয়ে দেখি আরে এতো করাই আছে। কিন্তু সেই ঘুম। অর্ধেক টুকে ঘুমের কোলে।বড়দি কখন পেছন থেকে এসে চুল ধরে টান। এবারে দ্বিগুন করতে দিলো।

 

বাবা কখনও  আমাকে বকেছেন এমন স্মৃতি  দুঃস্বপ্নের মতই আমার কাছে। তবুও সময় বিশেষে কেন যে বাবাকে এত ভয় পেতাম কে জানে? কিছু চাইতে গেলে বাবার দরজা থেকে পাঁচবার ফিরে শেষে মরীয়া হয়ে বলতেই বাবা তার ডাবল দিতেন আমাকে। দশটাকা চাইলে বিশ টাকা দিতেন। আমার সব ভাই বোনেরাও তাই। ব্যতিক্রম শুধু সেজদি। সেজদি তার চাহিদামত জিনিস লুকিয়ে কখন যে বাবাকে বলে আদায় করে নেয়, আনবার পর আমরা দেখতে পাই। মায়ের কাছে অনুযোগ করলে মা বলে, তোরা কেন বলিস না। অবশ্য মা সেজদিকে পূর্ণ ঠাকুর বলে বকা দিতেন। আমাদের বাড়িতে পূর্ণ ঠাকুর নামে এক ব্রাহ্মণ যে মুহূর্তে  মারা যায় সেজদির জন্ম নাকি সেই মুহূর্তে  হয়েছিল। আর তার স্বভাবও নাকি সেজদির মত। তাই মা সেজদিকে বকা দিলে পূর্ণ ঠাকুর বলবেই।

 

এক বিকেলে আমি মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে মামুনের সাথে দেখা। হাতে মনসুর। আমাকে দেখে বললো,

কোথায় যাইতেছো? মনসুর খাইবে? আমার মামা কল্য শহর থেকে আনিয়াছে। তুমি কি শহরে গিয়াছো? 

 মামুন সদ্য গ্রাম থেকে এসেছে। তাই শুদ্ধ বাংলা তখনও বলতে পারে না।সে (অর্থনীতির আর এক জাঁদরেল অধ্যাপক ফজল সাহেবের ছেলে) এখন প্রায় কত দেশে যায়, কত

ভাষায় কথা বলে। তার কথা শুনে পরদিন আমি বাবাকে বলি, বাবা কাল তুমি যখন শহরে যাবে আমায় নেবে? বাবা সাথে সাথেই আমাকে নিয়ে যায়।ট্রেন থেকে নেমেই ষ্টেশন রোডে আমাদের বিশাল ঘড়ির দোকান। এখন যেটা ঘড়ি মার্কেট। আমার কাকুরা ওখানেই থাকতেন। বাবা আমাকে ওখানে রেখে ডি,সি সাহেবের সাথে মিটিং এ বসবেন। দোকানের পাশেই ছিল উজলা সিনেমা হল। আমি দুচোখে বিস্ময় নিয়ে কখন বাবার হাত ছেড়ে চলে গেছি এক বামন বুড়োর পিছে পিছে জানি না।কিছুদূর গিয়ে দেখি বাবা নেই। ভয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকি বাবাকে। বাবা নেই। কিন্তু রাস্তায়  অনেক ছাত্রর সাথে দেখা হয়ে যায়। ওরা আমায় দেখে বলে,  তুমি কার সাথে এসেছো? আমি যে হারিয়ে গেছি একথা বলতে আমার লজ্জা পাচ্ছিল। তাই বলি, বাবার সাথে। বাবা আছে আমাদের মার্কেটে। ওরা সে কথা শুনে চলে যায়। শেষে আমাদের বাজারে যে স্বর্ণকার মায়েদের গয়না বানাতে

বাসায় আসে সে আমার হাত চেপে বলে,  চল স্যারের কাছে। এবারে আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে বলি, আমি তো হারিয়ে গেছি।

 

এক একদিন  সকালবেলা ঘুরতে ঘুরতে অধ্যাপক আবাসে চলে যাই। আমাদের দেখলেই অধ্যাপকেরা ডাক দিয়ে গল্প করতেন আমাদের বয়সি বন্ধুর মত। আমি ছোটবেলা থেকেই সবাইকে নকল করে অভিনয় করতাম বলে উনারা আমাকে খুব আদর করে বলতেন, একটু শোনাও বাংলার দিদিমনি কাল কিভাবে পড়ালেন, কিংবা ঐ কাকু যেন কিভাবে কথা বলে? আমিও মহাউৎসাহে শুরু করে দিই নকল করে অভিনয়। অধ্যাপক সুকুমার দে আমাকে দেখলে ডাক দিবেনই। বাবাও মাঝে মাঝে আমার অভিনয় দেখে হেসে বলতেন, অবিকল হোচ্ছে রে! ঐ আবাসে আমার মেসো অধ্যাপক নির্মল সেন ও থাকেন একপাশের রুমে (যিনি মাস্টারদার অন্যতম সহযোগী। তাঁর সমস্ত লেখাপড়া জেলে এমনকি পরীক্ষাও জেল থেকেই)। মেসো আর মাসী সারা জীবন আলাদা থেকেছেন। কেন আমার জানা নেই। কখনো মনেও আসেনি কেন?। কিন্তু মেসো আমাদের কি যে স্নেহ করতেন তার তুলনা নেই! আমার মাসী দোলনচাঁপা অপূর্ব সুন্দরী! তখনই কোলকাতায় সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। মেসো থাকেন এখানে। উনি বাণিজ্যের অধ্যাপক হয়েও ইংরেজিতে  দক্ষ ছিলেন।  দলে দলে ছাত্র তার কাছে পড়তে আসতো।

আমার মায়েরা তিন বোন। বাবা সাহিত্য, বড় মেসো বাণিজ্য আর ছোট মেসো বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ছোট মেসো তপন চৌধুরী (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বপন চৌধুরীও দিলীপ চৌধুরীর ভাই)  অসামান্য একজন মানুষ ।উনি প্রথমে চুয়েটে পরে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ শেষে চট্টগ্রাম বোর্ডের  চেয়ারম্যান হন। সেই বড়ো মেসো খুব কম কথা বলতেন আর দেখতেও খুব সুপুরুষ ছিলেন। আমায় দেখলেই ডাক দিয়ে বেল খেতে দিতেন । নিজেও রোজ এত এত বেল খেতেন । আমার খেতে ভালো না লাগলেও চুপচাপ খেয়ে বলতাম, যাই? একটু হেসে বলতেন যাবে? যাও। তখন বুঝতাম না। উনার

একমাত্র সন্তান টিটো (অপরূপ সুন্দর) থাকে অনেক দূরে মায়ের কাছে। হয়তো মনে পড়তো। অবশ্য মাসী মাঝে মাঝে আসলে টিটো তখন বাবার কাছে আসতো। আজ মাসীও নেই, মেসোও নেই। দুজন একা দু’প্রান্তে কাটিয়ে গেছেন বড়ো পবিত্রতায় কোন অমৃতালোকে? ভাবলে

বিস্ময় লাগে।

(চলবে)

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ