আমার সাত কাহন -১৩/ ছন্দা দাশ
ধারাবাহিক স্মৃতিগদ্য
আমার সাত কাহন -১৩/ ছন্দা দাশ
আমার সাতকাহনে সেজদির বেল কাহিনিন আমাকে লিখতেই হচ্ছে। জানি সেজদি আমাকে খুব বকাবকি করবে। কি আর করি। তবুও সাহস করে ভাবলাম লিখেই ফেলি।
আমরা তখন পৃথিবীর মুখ দেখেছি কিনা জানি না।মা এই গল্প যখন আমাদের শোনাতেন হেসেই কুটোপুটি হোতেন। আমার মা খুব হাসতে পারতেন। বড়দি,মেজদি আর সেজদি তখন খুব ছোট ছোট। সেজদি যাদের সাথে খেলতে যেতো তাদের মাথায় উঁকুন ছিল বলে সে উঁকুন সেজদির মাথায়ও এসে বাসা বাঁধে। এমনি সেজদির মেঘের মত চুল। তিন বোন একসাথে ঘুমায় বলে তিনজনের মাথায় উঁকুন হবে বলে মা সেজদির সব চুল কেটে বেল মাথা করে দেয়। এক দুপুরে ছুটির দিনে মা বলে, যাও চুপচাপ শুয়ে বই পড়ো নয় ঘুমাও। বড়দি মেজদি ঘুমালেও সেজদি কি আর ঘুমায় ? চুপি চুপি ছোট ছোট পায়ে গুড়গুড় করে সোজা বাইরে। সেদিন বাইরেও টিপ টিপ বৃষ্টি। সেজদি ভবি ভুলবার নয়। বৃষ্টি মাথায় করে সোজা অধ্যাপক আবাসের নিরিবিলিতে। কাউকে দেখতে না পেয়ে মেসোর রুমে উঁকি দিয়ে দেখে মেসো নেই। টেবিলের উপর দুটি বেল রাখা আছে। সেজদি আর দেরি না করে বেল দুটি নিয়ে সোজা বাসার পথ ধরে। কলেজের পুকুরের কাছে আসতেই চিৎপটাং। একেবারে কাদায় মাখামাখি। দুহাতে বেল দুটি নিয়ে বাসায় ঢুকতেই দেখে মা বেত হাতে দাঁড়িয়ে। মা সেজদিকে দেখে বকবে কি? হেসেই খুন। বাবাকে ডেকে বলে, দেখে যাও তোমার পূর্ণঠাকুর কি করেছে দেখ। বাবা এসে হেসে বলে, এতো তিন বেল এলো। সব্বোনাশ নির্মল বাবুর বেল নিয়ে এলো যে। উনার এমনিতে কোষ্টকাঠিন্য। মা বলে তুমি ভাবছো কোষ্টকাঠিন্য নিয়ে ।উনি কি ভাববেন তা নিয়ে ভাবো। সেজদির পিঠে সেদিন কিছু জুটেছিল কিনা জানি না। তবে তিন বেলের কথা মনে পড়লেই হাসি চেপে রাখা দায়।
এক ছুটির দিনে সকালবেলা জলখাবারের পর পরই পরাণ নাপিত চুল কাটতে তার ছোট বাক্স নিয়ে উঠোনে আমগাছের নিচটাতে তার সরঞ্জাম সাজিয়ে ডাক দেয়। কই গো দাদাবাবুরা আসো তোমরা। আমার আজ বড্ড তাড়া। পরাণ নাপিত মাসে একবার আসে চুল কাটার জন্য আমাদের বাসায়। সে সময় সব কাজ লোকেরাই এসে করে দিয়ে যেত। যেমন খুব ভোরে চৌবাচ্চার জল ভরে দিত গৌরাঙ্গ নামের এক লোক। তাকে সবাই হ্যাজা (সজারু) ডাকতো। কেন কে জানে? সে জিলিপিকে বলতো অমৃত। আমি ভাবতাম স্বর্গের খাবার। বড় হয়ে খাবো। তারপর আসতো শম্ভু। সে খবরের কাগজ দিয়ে যেত। সে আবার ল অক্ষর বলতে পারে না। মা প্রশ্ন করলে শম্ভু তোর মা কি রান্না করেছে আজ? সে বলে “ফই মাছ আর আউ “। আমি মনে মনে বলি, সে আবার কি? আর আসতো ধোপা অনন্ত, বাগানের ঘাস কাটতে রেবতী, মায়ের গয়না বানাতে তার নাম ভুলে গেছি। কারণ তাকে আমরা ডাকতাম কামরাঙ্গা। আরও অনেকজন হাঁড়ি বেটি, সিরজীর মা, এমন অনেক চরিত্র জড়িয়ে আছে।
জীবনের প্রবাহমাণতায়।ইতিমধ্যে শ্যামরায়ের হাটে নতুন সেলুন দিয়েছে একজন। উত্তম কাট নামে উত্তম কুমারের স্ট্যাইলে যে কাট এসেছে তা খুব জনপ্রিয়। সবাই সে কাট দিচ্ছে। তার পাশে এসেছে “সুচিত্রা “নামে লন্ড্রী। সেখানে লেখা আছে উত্তমরূপে কাপড় ধোলাই হয়। দাদা মায়ের কাছ থেকে চার আনা নিয়ে একদিন উত্তম কাট দিয়ে এলো। দাদা খুবই সুদর্শন বলে সবাই দাদাকে সুন্দর বলাতে দাদা খুশিতে ডগমগ। তাই দেখে ছোটভাই বাবুও আব্দার ধরে সেও উত্তম কাট দেবে দাদার মত। কিন্তু মা বলে, তোমার এখনও কাট দেবার বয়স হয়নি। তাই সেদিন পরাণ নাপিত এলে বাবু কোনমতেই চুল কাটতে যায় না। শেষে চারআনা,দুআনা,এক আনা নামে কি এক কাট দিয়ে তার চুল কাটা হলো। আমাদের পাশে আকাশ নামে যে ছেলেটি থাকে সে সবসময় দাদাকে অনুকরণ করে চলতো। দাদার দেখাদেখি সেও কোথাথেকে চার আনা দিয়ে উত্তম কাট দিয়ে গান গাইতে গাইতে আমাদের বাসার ভিতর দিয়ে তাদের বাসায় যাচ্ছিল। সেজদি দুপুরে তখন বিছানায় শুয়ে হয়তো ভাবছিলো কাকে জব্দ করা যায়। আকাশকে দেখামাত্র লাফ দিয়ে ডাক দেয়। এই তোর চুলের এমন অবস্থা কেন? সে খুব
খুশি হয়ে বলে চারআনা দিয়ে উত্তম কাট দিলাম। সেজদি বলে, বেশ করেছিস। কিন্তু চুলের বামপাশটা কম কাটা হয়েছে।আকাশ মুখ কালো করে বলে, কি করি রীনাদি।
সেজদি বলে চিন্তা করিস না। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। বলেই মায়ের সেলাই বাক্স থেকে কাঁচি এনে তার মাথার চুলগুলো খাবলা খাবলা করে কেটে বলে, যা এবার। আকাশ তার বাসায় ঢুকতেই তার মা তেড়ে আসে। তোর মাথার এমন অবস্থা কে করেছে? সে বলে রীনাদি। ওই অবস্থায় তার হাত ধরে আমাদের বাসায় এসে মাকে ডেকে বলে, ও খুড়ি মা, রীনার কানণ্ড দেখেন। আমার ছেলের চুলের কি অবস্থা করেছে? মা এসে তার মাথার দিকে তাকিয়ে হাসি আর চাপতে পারছে না। সেজদিকে ডাকতেই বলে, আগে ওকে জিজ্ঞেস করো চার আনা সে কোথায় পেল? শেষে মা তাকে চার আনা দিয়ে বেল মাথা করে আসতে বললেন। সেজদি দূরে গিয়ে বলে, আর কোনদিন আমার ভাইয়ের মত হতে চাইবি?
আমার বাবা ছিলেন বড়ো ভুলো মনের। কিছুই মনে থাকে না।চোখে চশমা এঁটে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াবেন আর বলবেন, এমন তো কোনদিন আর হয়নি! অথচ রোজই যে একই চিত্র সেটাও ভুলে যান। উল্টো পাঞ্জাবি গায়ে হয়তো ক্লাশ নিতে চলেছেন। সেজদি বলতো, এটা বাবার নুতন স্টাইল। ছোটবেলায় আমদের বাসায় সব কাঁসার বাসন ব্যবহার করা হতো। কাঁসার থালা, কাঁসার বাটি,কাঁসার গ্লাস। সেসব বাসন আমার মা এমন ঝকঝকে করে রাখতেন মনে হতো সোনার বাসনে ভাত খাচ্ছি। আর বাসনের পেছনে আবার সবার নাম লেখা আছে। কারণ অন্নপ্রাশনেরর সময় সেসব মামাবাড়ি থেকে পাওয়া। আমাদের পরের কয়েক বোনের নাম লেখা ছিল না। আমরা অনেক বোন কিনা! ঝকঝকে কাঁসার থালায় মা জুঁই ফুলের মত কালোজিরে চালের ভাত আর ছোট ছোট বাটিতে করে ডাল, সুক্তো,মাছের বাটি চারপাশে সাজিয়ে বাবাকে খেতে দিতেন। বাবা একটি তরকারি বা ডাল মেখে খেয়ে উঠে পড়তেন। মা বলতেন,
ও কি মাছ খেলে না? বাবা বলেন মাছ দিয়েছো? তাই
মা পাশে থেকে সব সময় দেখতেন সব খাওয়া হলো কিনা। মায়ের সব কাজ নিখুঁত হওয়া চাই। মা যখন আমাকে কাজ দিতেন ভয়ে আমার হাত থেকে সব জিনিস পড়ে যেত। মনে হত এই বুঝি ভুল হলো। আর তাই খুব বকাও খেতাম। আমার ভুলো মনের বাবা প্রায়ই কলেজে যাবার সময় রুমের চাবি খুঁজে পেতেন না। না পেলে বাবা বলতেন, যে পাবে তার জন্য উপহার আছে। আমরা উপহারের জন্য চাবি খুঁজে দিতাম হন্যে হয়ে। উপহার মানে গল্প বলা। একবার আমি ইচ্ছে করেই সে চাবি চালের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। রেখে নিজেই ভুলে যাই কোথায় রেখেছি। আর সে চাবির খোঁজে সবাই গলদঘর্ম। মা বলে, নিশ্চয় তুমি কলেজে রেখে এসেছো। বলেই মা বলেন, সব জায়গা দেখা হলো, চাল ছাড়া। বলেই চালে হাত দিতেই পেয়ে গেলেন। আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। সে যাত্রা রক্ষা করলেন ঈশ্বর আমাকে। (চলবে)
Facebook Comments Sync