আমার  সাতকাহন – ২ / ছন্দা দাশ

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা

আমার  সাতকাহন/ ছন্দা দাশ

পর্ব  -২

এক একটি ঋতু, একটি দিন, এক একটি মুহূর্ত আসে মনের আঙিনায় এক এক রকম অনুভূতি নিয়ে। সকাল

বেলার মন কি দুপুরে মেলে? কিংবা সন্ধ্যায় বা রাতে তা কি আর অনুভূত হয়? ঠিক সেইভাবে পৌষের সকালটি

চিরকাল আমার মনে যে ছাপ রেখে যায় তা আনন্দের। তাই পৌষের সকালে আমরা অনেকখানি স্বাধীনতা নিয়ে

চা জলখাবরের পর বেরিয়ে আসি মাঠে, যেখানে সমবয়সী বন্ধুরা জড়ো হয়ে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, হকি,দাঁড়িয়াবান্ধা,মার্বেল,ডাংগুলি এসব খেলতাম, কখনো বা ঘুড়ি উড়াতাম। আমার কিশোরী বয়সে সেই  সময় কোন অধ্যাপকের মেয়ে ছিল না।তাই আমি আমার ছোটভাই বাবুয়া, আমার দাদা কাজল সবাই সাথে  খেলেছি। মেয়েদের সাথে পুতুল না খেলে ছেলেদের খেলাগুলোই খেলেছি। একটু বড় হলে আবার দুজন অধ্যাপকের মেয়ে আসে  আমারই বয়সী । ওরা এখনো আমার প্রিয় বন্ধু।

এই ফাঁকে আমার সেজদি রিনা দাশের সাথে পরিচয়টা করিয়ে দিই। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সব ‘চে ডানপিটে ছিল সেজদি।তার মুখে হাসিটা চিরকাল ছাপমারা আছে। তেমনি সে কাউকে মুখ কালো করে থাকতেও দিত না।কখনো এক জায়গায় দু’মিনিটের বেশি থাকবে না।সারাক্ষণ সবার পেছনে লেগেই আছে। আমাদের কাজের লোক কেষ্টদাকে দেখামাত্র চেঁচিয়ে বলবে,

 “ভূতের মতন চেহারা যেমন

নির্বোধ অতি ঘোর,

যা কিছু হারায় গিন্নী বলেন

 কেষ্টা বেটাই চোর।

বেচারা মায়ের কাছে নালিশ জানাতে জানাতে অস্থির।পাশের কোয়ার্টারের ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক সোলায়মান কাকাবাবু রোজ সকালে আসেন বাবার সাথে গল্প করতে। উনি আসলেই

বই নিয়ে সেজদি উচ্চস্বরে পড়তে থাকবে সোলেমান ব্রান্ডে ওয়াজ বন অন মানডে। কাকাবাবু রোজ একই

পড়া শুনে ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরে একদিন বাবাকে

বলেই ফেল্লেন, অংশুমান বাবু আপনার সব ছেলেমেয়েরা

বড় শান্ত। শুধু এই মেয়েটা বোধহয় একটু টকেটিভ। আরেকদিন আরেক টেকো কাকুকে দেখে বলে, কাকু

আসার সময় কি তুফান হয়েছিল? সে কাকু অবাক হয়ে বলে, না তো! সেজদি গম্ভীর মুখে বলে না, আপনার মাথার

চুলগুলো সব উড়ে গেল কিনা! 

এজন্য সে মায়ের অনেক বকাঝকা, মারও খেয়েছে। একটা ব্যাপার কিন্তু খুব বিস্ময় সেজদিকে কেউ বর্ণ পরিচয় করায়নি।সে নিজে নিজেই পড়তে লিখতে শিখেছে।

 

বাসা থেকে বেরুলেই মাঠ, যে মাঠে ছিলো

আমাদের সকাল বিকাল খেলা। মাঠের চারপাশেই খালের

মত। যার জলে কচুরিপানা সারাবছর হাসে। তারপরেই

কলেজের বিশাল ভবনগুলি মাথা উঁচিয়ে আছে আমাদের নতুন পৃথিবী দেখা চোখের সামনে। রোজ বিকেলে লেখাপড়ার মত খেলাও ছিল আমাদের অত্যাবশকীয়  একটি কাজ। মা,দিদি বা কাজের লোকেরা

আমাদের হাত পা মুছিয়ে, ক্রিম মাখিয়ে দিয়ে ফর্সা কাপড়

পড়িয়ে দিত। এই পৌষে অবশ্যই কি সুন্দর সুন্দর মায়ের

হাতে বোনা সোয়েটার পরতাম। সব বাচ্চারা যখন জড়ো

হত রঙিন প্রজাপতির মতই লাগত! মা চাচীরা বারান্দায়

বসে গল্প করতো কখনো। আমাদের দরজার সামনেই

বেশি জমায়েত হত। কারণ দরজা খুললেই দু’দিকে

দুটো গাছ। একটি মাধবীলতা, অন্যটি বাগানবিলাস।

দুদিক থেকে এসে মিলিত হয়ে অপূর্ব স্বর্গ রচনা করে

ছিল! খেলতে খেলতে কখনোও কলেজ ভবনে চলে যেতাম। সেখানেও খেলা।পাঁচকোণা খেলা বলে আমাদের নিজেদের উদ্ভাবিত একটি খেলা ছিল। কলেজ ভবনের

দেওয়ালে খেলতে খেলতে আমরা চক দিয়ে যা পড়েছি

এ,বি,সি,ডি,। অ,আ বা ক,খ সেসব লিখতাম। শব্দগঠন করে লিখতাম। সেজদি তাই দেখে দেখে বর্ণ পরিচয়, শব্দগঠন শিখে ফেলেছে। আমার অবশ্য জানার কথা নয়। মায়ের মুখ থেকে শোনা। সে খুব তাড়াতাড়ি শিখতে পারতো কিন্তু কখনো কোথাও বেশিক্ষণ স্থির  থাকবে না।

 

এই পৌষে আমাদের সবচে বেশি আনন্দ। নাটক নিয়ে পাগল হওয়ার ঋতু ছিলো  আমাদের।

এ সময়টা।বড়দের দেখাদেখি আমরা ছোটরাও নাটক

নিয়ে মেতে থাকতাম। স্টেজ বাঁধার জন্য মা চাচীদের

শাড়ীর দফারফা। আমাদের উৎসাহ দেবার মানুষ তো

ছিলই। কলেজের ব্যচেলর অধ্যাপকেরা যাঁরা ‘নিরিবিলি ‘

নামে শিক্ষক আবাসে থাকতেন উনারা আমাদের নাটক ঠিক করে দেওয়া থেকে রোজ রিহার্সালও করাতেন।

যেদিন নাটক মঞ্চস্থ হতো সেদিন আবার দলবেঁধে দর্শকও

ছিলেন উনারাই।

 

স্মৃতির পথে হাঁটতে হাঁটতে অসংখ্য স্মৃতির এলোমেলো হাওয়া আমার লেখার ধারাবাহিকতাকে ক্ষুণ্ন করছে।কখনো সুখে, কখনো দুঃখে। বেদনার মত সুখের অনুভূতিগুলোও গলায় কষ্টের কুণ্ডলী পাকায়। নাটক আমার শিরায় রক্তের সাথে প্রবহমান। কলেজে এত নাটক হতো মনে হতো এও যেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের বাসা ছিল শিল্পের চারণক্ষেত্র। তার মধ্যমণি তো আমার বাবা। আর বাবাকে কেন্দ্র করে আমার কাকু, মামারা তো আছেই। আমার ছোটকাকু অভিজিৎ হোর এসবে খুব উৎসাহী। উনি আমাদের বাসায় থেকে পড়তেন, দীপু কাকু (ডাঃ দীপেশ রঞ্জন হোর), ছায়া পিসী সবাই মাতিয়ে রাখতেন সারাদিনই।আর মামাবাড়ি কাছে বলে মামারা তো নিত্যসংগী। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিবার বলতেই প্রথম যে নাম সে আমার মামাবাড়ি।মামা ওস্তাদ মিহির লালা মেডিকেল শেষ বর্ষে এসে শুধু গানের জন্য পড়া ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।যেদিন নাটক হতো সারারাত আমরা নাটক দেখতে দেখতে কখনো দৌড়ে বাসায় আসতাম জল খেতে বা অন্য প্রয়োজনে। দরজা খোলাই থাকতো। কখনো মনে এতটুকু ভয়ের ছায়া পড়েনি। একবার ঐতিহাসিক এক নাটকে আমার এক মামা (মায়ের কাকাতো ভাই)  শত্রুর গুলিতে আহত হয়ে পড়ে যাবার দৃশ্যে পা স্টেজের ফাঁকে আঁটকে যায়।কোন মতেই আর উনি নড়তে চড়তে পারেন না।বার বার ভেতর থেকে প্রম্পট করার পর উনি বলে উঠলেন, তোরগুলিও আমি হজম করে নিলাম।

(চলবে)

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ
%d bloggers like this: