আমার সাতকাহন- ৪ / ছন্দা দাশ

ধারাবাহিক  লেখা

আমার সাতকাহন- ৪ / ছন্দা দাশ

 

মেলা থেকে ফিরতি পথেও আমাদের ক্লান্তি নেই।সারাক্ষণই হাত পায়ের সাথে মুখেরও কাজ চলছে। অনেকখানি পথ। কখনো সোজা সরল, কখনো ধান ক্ষেতের আল বেয়ে,মটরশুঁটির পাশ দিয়ে, কখনো গ্রামের

ভিতর দিয়ে। তখন গ্রামে বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস ছিল।

তাই ঘর বাড়ি তকতকে, ঝকঝকে।দেখলেই মনে হত

দাওয়ায় বসে যাই। উঠোনের কোণে চাঁপাগাছের ডালে

নীলকণ্ঠ পাখীর ডাক, ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে কর্পূর মেশানো জল, মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা সব যেন

বাংলার আকাশ, বাতাসের সাথে মেশানো।

 

শীতের সকালের রোদ কিছুতেই অন্য ঋতুর সকালের মত মিষ্টি আর উজ্জল না।এই রোদের সাথে কমলা, লাল,হলুদ

রঙের এক অপূর্ব অনুসঙ্গ। কোন বাড়ির উঠোনে এই

রঙের শুকোতে দেওয়া কাপড় দেখলেই মনে অন্য এক অনুভূতির সুর তোলে। বাবা আমাদের অক্ষরজ্ঞানের পরই

শুকতারা, আবোল তাবোল, সন্দেশ, ছোটদের রামায়ণ, মহাভারত এসব বই কিনে দিতেন। আমার প্রথম শেখা

কবিতাটি ছিল, “তিনটি শালিক ঝগড়া করে রান্নাঘরের

চালে, শীতের বেলায় দুই প্রহরে দূরে কাদের ছাদের পরে

ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয় বেগুনি রঙের শাড় ‘।কবিতাটি

মনে চিরকালের জন্য আসন নিয়েছে। এছাড়াও বাবা

প্রায়ই ডেকে কাছে বসিয়ে সঞ্চয়িতা থেকে আবৃত্তি করে

শুনাতেন,দেবতার গ্রাস,বন্দী বীর,মদন ভস্ম,অভিসার,সোনার তরী, দুই বিঘা জমি,গান্ধারীর আবেদন। এসব কবিতা আর আমাদের পড়তে হয়নি। কখনও বাবা বলতেন, তুমি পড়ো। আমরা তিনজন

পরবর্তিতে বাচিক শিল্পী হিসেবে বেশ নাম কিনেছিলাম।

 

আমার ছোড়দি কৃষ্ণা চৌধুরীর কথা এখনো বলা হয়নি। পৃথিবীর সব চাইতে শান্ত, সবচাইতে পবিত্র, সবচাইতে

ভালো মেয়েটিই আমার ছোড়দি। বাসায় সে আছে কি নেই

বোঝাই যেত না। আমরা সব ভাইবোন তাকে ভীষণ ভালোবাসি। কখনো উচ্চস্বরে কথা বলেনি। দাদা আর ছোড়দি পিঠাপিঠি ছিল।একসাথেই পড়তে বসলে দাদা উঠে যেত,ছোড়দি ওর বই তুলে গুছিয়ে রাখা, তার মশারী টাঙানো,ঘুমুলে মাথায় বালিশ দেয়া সব করতো। কখনও এনিয়ে তার অভিযোগ নেই। বরং দাদা কিছু নিয়ে ঝগড়া করে যদি বলে, আমি মায়ের কাছে নালিশ দেব। ছোড়দি ব্যাকুল হয়ে বলতো, ভাই বলিস না। হাত পেতে দিয়ে বলতো, তোর ইচ্ছেমত আমায় মার, তবুও মাকে বিরক্ত

করিস না।এই বিরল দিদিকে আমরা জন্ম জন্মান্তরে কামনা করি।

 

বাসার কাছাকাছি এসে যেখানে থামি দুটো রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে। যদিও দুটো রাস্তা দিয়েই বাসায় যাওয়া যায়।

তবুও যেখানটিতে দেখি পাড়ার ছেলগুলো খালের মত

জলাশয়ের জল সেচে মাছ ধরছে সে রাস্তা দিয়ে ছুটে

যাই। রোজ যাদের খেলার মাঠে দেখি সেই ছেলেমেয়ের দল একটা খোলের মত বেতের তৈরি দু’ধারে লম্বা দড়ি

বাঁধা সেচক দিয়ে জল অন্যধারে ফেলছে। পানি কমে আসতেই ছোট ছোট কত রকম মাছ লাফাচ্ছে। ওদের সরিয়ে আমরা রশি নিয়ে পানি সেচতে গিয়ে একবার সাগর কাদায় গড়াগড়ি। আমাদের মধ্যে সাগর ছিল সবচেয়ে দুষ্টু। একবার আমাদের মধ্যে একজন কি কথায় বলেছিল “কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে

পায় তাই বলে কি কুকুরে কামড় মানুষের শোভা পায় ”

সে লাফিয়ে সাথে সাথে বলে, কেন পাবে না? বলেই পাশে কুকুর দেখে তার গায়ে দিল কামড় বসিয়ে। আমরা ভয়ে ভৌঁ দৌড়। এমন কত যে তার দুষ্টুমির স্মৃতি, মনে পড়লে আজো হাসি পায়। রাস্তার পাশদিয়ে বিশাল ধানের ক্ষেত।

কোথায় যে এর শেষ। তখন ধান কাটা শেষ। ছেলের দল নাড়া পুড়িয়ে রস জ্বাল দেয়,পায়েস রান্না করে, বনভোজন করে। কখনও বিলে ইঁদুরের গর্ত খুড়ে এত ধান বের করে, দেখে আমাদের চোখ চরক গাছ। ওদের সাথে সাথে আমরাও ঘুরি। এই বিল দেখলেই আমার খালি মনে হয় এরই নাম বুঝি ‘ভূবনডাঙার মাঠ’। আর মাঠ দিয়েই খোকা মাকে নিয়ে বিদেশে যায়।বাবার সাথে যখন গল্প করি  তখন বলি, বাবা তুমি ভূবন ডাঙার মাঠে গেছ? বাবা তখন কত গল্প আমাদের শোনাত। মায়ের সাথে

সারাদিন কত কথা হয়। কিন্তু প্রাণের কথাগুলো বাবার সাথে চিরকাল। গেল বছর ভূবন ডাঙার মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সবার কথা মনে পড়ছিল। এ সময় আমরাও সবাই মিলে পিকনিক করতাম। সবার বাসা

থেকে চাল,ডাল, ডিম নিয়ে বাসার কাছাকাছি। এ সময় হর গৌরী সেজে চাল তুলতে দল আসতো। তাদের দেখে পিছু পিছু ছুটি।কখনো পালকী কাঁধে বেহারা নতুন বউ নিয়ে যাচ্ছে রাস্তা বেয়ে। দেখে দৌড়ে পালকীর সামনে দাঁড়াতেই বেহারা থামে, নতুন বউ- এর মুখ দেখায়। আমার

গলার কাছে ব্যথার স্পর্শ। মাকে ছেড়ে যাচ্ছে খুকী!

 

আজ লেখার সার্থকতা বিশাল এক আনন্দে ধরা দিয়েছে আমার হৃদয়ে। সকালে ফেসবুক খুলতেই দেখি সাবিনা নিরু আমাদের আদরের নিহার, পাশের কোয়ার্টারের অর্থনীতির তুখোড় অধ্যাপক নুরুল আলম তালুকদারের কন্যা আমায় মেসেজ পাঠিয়েছে। সে আমার এই স্মৃতি

জড়িত লেখায় স্মৃতিকাতর। সুদূর কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সে অধ্যাপনা করছে। ভাবতেই আমার গায়ে শিহরণ দিচ্ছে। কত ছোট ছিল সে। তার মাকে আমি আপা ডাকতাম। তিনি আমায় কী যে স্নেহ, মায়া দিয়ে ছায়া দিয়েছিলেন আজকের সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন মানুষেরা কী তা কখনো অনুধাবন করতে পারবে?

পৌষে তখন গ্রামে যাত্রাপালার আয়োজন জমজমাট। শহর থেকে যাত্রাপালার দল এসে মাঠে বিশাল তাঁব টানিয়ে  প্রায় একমাসের জন্য আসর বসাতো।পুরো গ্রামের মানুষের যাত্রা নিয়ে চনমনে ভাব। সন্ধ্যে হলেই খেয়েদেয়ে যাত্রার আসরে।সে কী কৌতুহল তাদের। অবশ্য বাবা এর ঘোর বিরোধী। কড়া নির্দেশ কেউ যেন এর আশপাশে না যায়।খেলতে খেলতে আমরা কখনো তাঁবুর ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতাম। রঙ চঙ মাখা মেয়েরা, রাজা রাণী সাজা মানুষগুলো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমার কিশোরী চোখ আমায় নিয়ে যেত অন্য কোন জগতে।

একদিন দাদা, আমি, বাবু কেষ্টদার সাথে যাত্রাপালা দেখতে যাবার বায়না ধরলাম বাবার কাছে। বাবা দিদিদের বেলায় কখনো সম্মত হোতেন না। কি ভেবে মত দিলেন। হয়তো এত ছোট ছিলাম বাবা ভেবেছেন ঘুমুয়েই পড়বো আমরা।কেষ্টদাকে বলে দিলেন ঘুমালে নিয়ে আসতে।

কিন্তু সারারাত আমি ঘুমাইনি। সাধক তুকারাম নামে

যাত্রাপালা হয়েছিল। তারপর সার্কাস দেখে তো বিস্ময়ে

হাতের লোম খাঁড়া। সেই প্রথম সেই শেষ।

আমরা প্রায় সকালে পড়াশেষে হাতে পেয়ারা নিয়ে বাসার চারধারের দেওয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে বসি। কারণ ওধারে রোদে পিঠ ঠেকিয়ে পান্তাভাতের থালা নিয়ে খেতে বসেছে আমারই বয়সী ছেলে মেয়ের দল।

ওরা যখন লাল চালের ভাতের সাথে লাল পুঁইবীচির তরকারী দিয়ে খেত আমার এত সুন্দর ছবি আজও মনে হয়না পাঁচতারা হোটেলে খেতে বসেও। মা দেখতে পেয়ে কখনো বলেন, বারান্দায় তেল দেয়া আছে। মেখে স্নান করে নাও। কখনো বাবা উঠোনে রেডিও ছেড়ে খেলার ধারা বর্ণনা শুনছেন।আমাদের দেখে ডাক দিতেন। বসে যেতাম বারান্দায়। বাবা খেলার সাথে সাথে বুঝিয়ে দিতেন কিভাবে খেলার মাঠ সাজানো হয়েছে, কোনটাকে কি বলে।এ ভাবেই আমাদের ক্রিকেট খেলা ভালোভাবেই শেখা হয়ে যায়। আমরাই বুঝি সে সময় একমাত্র মেয়ে

যারা ক্রিকেট খেলা শুনি রেডিওতে

 (চলবে)

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ