আমারে ভুলিয়া যেও মনে রেখো মোর গান –  লিয়াকত হোসেন খোকন 

আমারে ভুলিয়া যেও মনে রেখো মোর গান -  লিয়াকত হোসেন খোকন 

যখন রবো না আমি দিন হলে অবসান

আমারে ভুলিয়া যেয়ো মনে রেখো মোর গান

আমার মালার ফুলে ধূলা যদি লাগে ভুলে

গানের কুসুমগুলি হবে না তো কভু ম্লান

আমারে ভুলিয়া যেও মনে রেখো মোর গান।

মোর জীবনের যত ভুল তুমি ভুলে যেও সেই দিন

নিভে যাক নিশি ভোরে যেদিন হলো মলিন

গানে গানে পরিচয় সুন্দরতম হয়

সেই স্মৃতি হবে মোর বিদায় বেলার গান

আমারে ভুলিয়া যেও, মনে রেখো মোর গান……..

 

৭৮ বছরেরও আগে এ গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন কুন্দনলাল সায়গল। মাত্র ১৭টি বছর তিনি সংগীতভুবনে থেকে ১৭৬টি ফিল্মি ও ননফিল্মি গান করে গেছেন। তাঁর গাওয়া প্রতিটি গানই আজ পর্যন্ত পপুলার হয়ে থাকল তাঁর দরাজ কণ্ঠ, কথা ও সুরের কারণে।

তাঁর গাওয়া –  ‘প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার’; ‘সাগর থেকে ঝিনুক এনে ’ বার বার শুনেও যে তৃষ্ণা মেটে না।

 

এখনো আমাদেরকে কী যেন এক মায়াজালে আবিষ্ট করে রাখে কুন্দনলাল সায়গলের গান। তাঁর মতো জনপ্রিয় হয়ে আছেন আরও অনেকে। ১৯৪৬ সালে জগন্ময় মিত্রের হিট ‘ ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে তোমারে করেছে রাণী ‘ আজও মন কাড়ে। জগন্ময় মিত্রের এ গান কোনোদিন পুরোনো হওয়ার নয়। আজও কোথাও কোনো রেস্টুরেন্টে এ গান বেজে উঠলে পথ চলতে গিয়ে অনেকে থমকে দাঁড়ান। গানটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কান পেতে এই গান শোনেন এ প্রজন্মের অনেক সংগীতপ্রেমিক। যার বয়স এখন ষোলো তারও ভালো লাগে এই গান।

 

গানের কথায় এক জায়গায় আছে –

নয়নের জলে যে কথা জানাই

সে ব্যথা, আমার কেহ বোঝে নাই…

মেঘের মরমে যে মিনতি কাঁদে

চাঁদ বুঝিবে না জানি।।

মাধবীলতা গো মাধবীলতা আজ তুমি

আছ ফুলের স্বপন সুখে.

একদিন যবে ফুল ঝরে যাবে

লুটাবে ধুলির বুকে।

খেয়ালি প্রেমের খেলা বোঝা দায় –

কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়,

মূক হয়ে যায় কারো মুখরতা

কারো মুখে জাগে বাণী ..।

এ তো প্রেমিকের মনের কথা। এই গান ভালো লাগবেই না কেন! আজও ভালো লাগে ৬৫ কি ৬৭ বছর আগে জগন্ময় মিত্রের গাওয়া সেই –  ‘ তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন আমারে আধো রাতে সেথা উঠেছে কি চাঁদ আঁধারে ’, ‘ভুলি নাই, ভুলি নাই ভুলি নাই ভুলি নাই নয়নে তোমারে হারায়েছি স্বপনে তোমারে পাই  ’ – এরকম বহু গান! এখনো অনেক লোক আছেন যারা প্রায় প্রতিদিনই জগন্ময় মিত্রের গান না শুনলে তাদের কিছুই ভালো লাগে না। জগন্ময় মিত্রের চিঠির গান

‘ তুমি আজ কত দূরে ’ আজও কি বাঙালি ভুলতে পেরেছে! পারেনি। পারবেই বা কেন! এ গান তো হৃদয় আকুল করা।

 

চিঠির গানটা ১৯৪৮ সালে রেকর্ড করা জগন্ময় মিত্রের। আমার বাবা এ গান শুনতেন, তারপর আমাদের কালেও এই গান ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বাল্য ও শৈশব কেটেছে রেডিও রেকর্ডে এই গান শুনে শুনে। আজ আমার ছেলেরাও ইউটিউবে শুনছে  চিঠির গান মন ভরে শুনছে। শুনবেই না কেন! গানের কথায়, সুরে লুকিয়ে যে আছে এক মোহমায়া। আমাদের পূর্বের প্রজন্ম থেকে এ গানটা কাজ করেছে এক কালজয়ী চিঠির-ই মতো। এখনো কিন্তু তাই। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এই গানের রেকর্ড বিক্রি দাঁড়িয়েছিল ক্যাসেট যুগের আগে পর্যন্ত ২২ লাখ কপি। শোনা যায়, ক্যাসেটেও এই গান নাকি ১ কোটির ঊর্ধ্বে বিক্রি হয়েছে। সিডি আর ইউটিউবের যুগে এ প্রজন্মও জগন্ময় মিত্রের এ গান শুনতে ভুল করে না।

 

একবার ঢাকার নীলক্ষেতের এক রেস্টুরেন্টে বসে চা পান করছি, ঠিক তখনই বেজে উঠল সত্য চৌধুরির গাওয়া –

পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায় –

খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর।

প্রণয় তোমার মিছে নয় মিছে নয়,

ভালোবাসি তাই মনে জাগে এত ভয় –

চাঁদ ডুবে যাবে ফুল ঝরে যাবে মধুরাতি হবে ভোর।

সবার মনের দীপালি জ্বালাতে যে দীপ আপনি জ্বলে,

কেন আর তারে ঢেকে রাখো বলো তোমার আঁচলতলে?

শোনো না কি ওই দিকে দিকে হায়

কত বধূ কাঁদে, কাঁদে কত অসহায় –

পথ ছেড়ে দাও নয় সাথে চলো, মুছে নাও আঁখিলোর …….’ গানখানি।

দেখলাম, পুরো গানটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট থেকে কেউ বেরোল না। সবাই কান পেতে শুনছিল এই গানখানি।

কেনই বা লোকে ভুলবে রবীন্দ্রনাথের লেখা পংকজ কুমার মল্লিকের গাওয়া ‘আমি কান পেতে রই আপন হৃদয় গহন দ্বারে বারে বারে।’ আজও এই গান শুনে আমরা থমকে যাই। যত কাজ, যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন এই গান পুরোটা যে শোনা চাই।

 

এমনই আরও অনেক বাংলা গান আছে যা ৬৫ কী ৭০ বছর আগের , অথচ আজও পুরোনো হয়নি। কোনোদিন পুরোনো হবেও না তেমনি ধ্রুপদি গানের মধ্যে কয়েকটি হলো –

রবীন মজুমদারের –  ‘বিরহ দিয়ে গেলে এই কি গো শেষ গান’, ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাইবা জ্বলে’, কানন দেবীর –  ‘ওগো সুন্দর মনের গহনে’, ‘মেঘনগরের অন্ধকার’, ‘যদি ভালো না লাগে তো দিয়ো না মন’ – এরকম বহু গান কালজয়ী হয়ে থাকল। সহজে যে ভোলা যায় না।

ক্ষণে ক্ষণে আজও মনে পড়ে কানন দেবীর গাওয়া –

তুফান মেল! তুফান মেল যায়!

তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে ময়নামতীর ঘাট এড়িয়ে

কাশের বনে ঢেউ খেলিয়ে বংশীবটের ছায়, যায় যায় ।

কার ফুলে যে হারায় মধু কার ঘরে যে এল বধূ –

কান্না হাসির ইন্দ্রধনুর রং লাগাতে চায়, যায় যায় যায়।

অজগরের সেই তো মাসি চমক দিয়ে বাজায় বাঁশি,

সবুজ সোনা রঙের বুকে ঝলকানি লাগায়,

যায় যায় যায় তুফান মেল যায় যায় যায়……….  ” গানের এই কথাগুলি – তখন চোখের পাতায় ভেসে ওঠে

শুধু শুধুই ” কানন দেবী ” !!

 

বাঙালি কোনোদিনও ভুলতে পারবে না লতা মুঙ্গেশকরের –  ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের –  ‘এই রাত তোমার আমার’, মানবেন্দ্রের – ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’, মান্না দে-র –  ‘ কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই ’, ‘সুবীর সেনের – ‘এত সুর আর এত গান’, গীতা দত্তের –  ‘তুমি যে আমার ওগো’, ‘ঐ সুর ভরা দূর নীলিমায়’ – এসব গান এক অদ্ভুত লাবণ্য ও অমরত্ব অর্জন করেছে। আহা ভোলা যায় না সুধীরলাল চক্রবর্তীর –  ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায়’ কিংবা ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’; সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের – ‘ওগো মোর গীতিময়’, ‘হয়ত কিছুই নাহি পাব’; সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’, শ্যামল মিত্রের –  ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’, তালাত মাহমুদের – ‘যেথা রামধনু ওঠে হেসে’, ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’ – এরকম বহু গান আছে যা প্রতিনিয়ত এখনো আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনি। শচীন দেব বর্মনের – ‘তাকদুম তাকদুম বাজে ’ এ গানও ভোলা যায়নি। এ প্রজন্মের শিল্পীরা এ গান স্টেজে, চ্যানেলে গেয়ে কৃতিত্ব নিতে চায়।

 

আব্বাসউদ্দিন আহমেদের ‘মাঝি বাইয়া যাওরে’ এখন পর্যন্ত বাঙালি প্রতিদিনই গাইছে –  এ গান থেমে নেই। সবার মুখে মুখে – ‘মাঝি বাইয়া যাওরে’ । কীভাবে বাঙালি ভুলবে পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেই –  ‘মা আমার সাধ না মিটিল’। এই গান শুনে এখনো মা-বোনেরা চোখের জল মোছেন। অথচ এ গানের বয়স ৭০ কি ৭৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এরকম বহু গান আছে যা সময়কে নিজের মধ্যে বেঁধে ফেলেছে।

 

একদা রেকর্ডে আঙুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, যূথিকা রায়, আব্বাসউদ্দিন, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, উৎপলা, প্রতিমা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখের গান শুনবার জন্য গ্রামোফোন-এর চারপাশে লোকজন গোল হয়ে বসত। সবকিছু ভুলে গিয়ে গান শুনে তারা মন ভরে নিত।

কি করে ভুলি অখিল বন্ধু ঘোষের গাওয়া – আজি চাঁদনী রাতি গো, মালাখানি গাঁথি গো, ফিরে যেও না ; অন্তরা চৌধুরীর গাওয়া – বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে আয় না ;

অপরেশ লাহিড়ীর গাওয়া – এই দুনিয়া চিড়িয়াখানা রং-বেরঙের মানুষ নানা ;

অমল মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – পদ্মদিঘির ধারে ধারে ডাহুক -ডাকা মাঠের পারে কানামাছি খেলার কথা যায় কি ভোলা ;

আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – আমি মিস ক্যালকাটা চাই না দিতে টিপস ;

আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া – আমি আলপনা এঁকে যাই আলোয় ছায়ায় ভোরের আলোর মাঝে মায়া ভরা এই সাঁঝে ;

আশা ভোসলের গাওয়া – আমায় তুমি যে ভালোবেসেছ জীবনে যে তাই দোলা লাগানো ;

ইলা বসুর গাওয়া – কত রাজপথ জনপথ ঘুরেছি মরুভূমি সাগরের সীমানায় ;

উৎপলা সেনের গাওয়া – ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায় রামধনু জ্বলে তার গায় ;

কিশোর কুমারের গাওয়া – কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে ;

কৃষ্ণচন্দ্র দের গাওয়া -মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান ; কুন্দনলাল সায়গলের গাওয়া – নাই বা ঘুমালে প্রিয় রজনী এখনো বাকি ;

গায়ত্রী বসুর গাওয়া – তুমি আমার নিত্যকালের নিত্যদিনের সাথী ; গীতা দত্তের গাওয়া – ওগো সুন্দর জানো না কি তুমি কে আমি কার ;

গৌরীকেদার ভট্টাচার্যের গাওয়া – এনেছি আমার শত জনমের প্রেম আঁখিজলে গাঁথা মালা ;

চন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – সেই শান্তছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি যদি থাকত ;

জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – এ কোন সকাল – রাতের চেয়েও অন্ধকার – ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা ;

জপমালা ঘোষ গাওয়া – ছোট্ট খোকন লেখে চিঠি আধো কথায় মিঠি মিঠি ; জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গাওয়া – আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায় ;

তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া – ওগো কন্যা ঘুমাও কত আর – পদ্মকলি নয়নদুটি মেলো একবার ; তারাপদ চক্রবর্তীর গাওয়া – পূজারিণী খোলো খোলো মন্দিরদ্বার, দেবতা ডাকে বার বার ;

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছ, পরেছ শঙ্খদ্বীপের শাঁখা ;

দীপক মৈত্রের গাওয়া – কত কথা হল বলা, কত কথা তবু বাকি ;

ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া – বাসরের দীপ আর আকাশের তারাগুলি নিবিড় নিশীথে যবে জ্বলবে ; ধীরেন্দ্রনাথ দাসের গাওয়া – আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে ; নির্মলা মিশ্রের গাওয়া – আমার এ বেদনা মাঝে তুমি অশ্রু হয়ে এলে ;

পঙ্কজ কুমার মল্লিকের গাওয়া – চৈত্র দিনের ঝরা পাতার পথে দিনগুলি মোর কোথায় গেল ; পিন্টু ভট্টাচার্যের গাওয়া – এক তাজমহল গড়ো হৃদয়ে তোমার, আমি হারিয়ে গেলে ;

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া – আমার সোনা, চাঁদের কণা, ভুবনে তুলনা নাই রে ; বনশ্রী সেনগুপ্তের গাওয়া – আজ শুধু খেলা এ রংঝরা বেলা আর এই মধুমেলা যে মন ভরাল ;

বাণী ঘোষালের গাওয়া – রিনিক ঝিনি ঝিনি  চিনি তারে চিনি সুর ঝরানো মন ভরানো তার কঙ্কন কিঙ্কিণী ; বাসবী নন্দীর গাওয়া – ফুল জাগবে বলে বনে লাগলো দোলা দোলা লাগলো মনে ; বিশ্বজিতের গাওয়া – তোমার চোখের কাজলে আমার ভালোবাসার কথা লেখা থাকবে ; বেগম আখতারের গাওয়া – এ মৌসুমে পরদেশে যেতে তোমায় দেব না ;

বেচু দত্তের গাওয়া – কত আশা কত ভালোবাসা জাগে মধুর এ জীবনে ; ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া – তব লাগি ব্যথা ওঠে গো কুসুমি সে কি জানো না তুমি ; ভূপেন হাজারিকার গাওয়া – গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা ;

মোহাম্মদ রফির গাওয়া – কথা ছিল দেখা হলে বিজনে তোমার মনের কথা বলবে ;

মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া -ওই যে সবুজ বনবীথিকা – দূর দিগন্তের সীমানায় ছোট্ট নদীটির ওই বাঁকে ; মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – ঘুমালে রাতের চাঁদ মেঘের শয়নে ওই, তুমিও ঘুমাও শুধু আমি একা জেগে রই ; মান্না দের গাওয়া – আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নিশুতি রাত গুমরে কাঁদে ; মিন্টু দাশগুপ্তের গাওয়া – আজি এ সন্ধ্যায় এসেছে কুটুমেরা ; মৃণাল চক্রবর্তীর গাওয়া – কথা দাও ভুলবে না গো ; যূথিকা রায়ের গাওয়া – সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে এসেছি ভুলে মাটির প্রদীপ হয়ে তুলসীমূলে এসেছি ভুলে ;

রঞ্জিত রায়ের গাওয়া – আমি শান্তিপ্রিয় লোক অশান্তি মোর সয় না ধাতে আর যা কিছুই হোক ; রাণু মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না চাই তার লাল ফিতে ; রাহুল দেববর্মণের গাওয়া – মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে ; রুমা গুহঠাকুরতার গাওয়া – একখানা মেঘ ভেসে এল আকাশে ;

লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া – প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে আমারই এ দুয়ার প্রান্তে, সে তো হায় মৃদু পায় এসেছিল পারিনি তো জানতে ; শচীন গুপ্তের গাওয়া – তুমি নেই শুধু এই আর কিছু নয়, তবু মনে হয় ফুল যেন আর ফোটা চায় না ;

শচীন দেব বর্মণের গাওয়া – ও জানি ভোমরা কেন কথা কয় না, মহুয়া কেন মাতাল হয় না ; শিপ্রা বসুর গাওয়া – ঘুম আসে না দুচোখে আমার ; শৈল দেবীর গাওয়া – বনের চামেলি ফিরে আয়, বিরহী চাঁদের নয়নের নীড় ঝরিয়া যায় ; শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – তুমি কাঁকন কখন বাজিয়ে গেলে কলস নিয়ে কাঁখে ;

শ্যামল মিত্রের গাওয়া – ও শিমুল বন, দাও রাঙিয়ে মন – কৃষ্ণচূড়া দোপাটি আর পলাশ দিল ডাক ; সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – বনের পাখি গায় বোলো না বোলো না ;

সত্য চৌধুরীর গাওয়া – সেই চম্পা বকুলতলে তোমারে দেখেছি বনপথে চলিতে চলিতে ; সন্তোষ সেনগুপ্তের গাওয়া – জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল ; সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া ছল ছল আঁখি মোর জলভরা মেঘে যেন ছাওয়া ;

সনৎ সিংহের গাওয়া – সরস্বতী বিদ্যেবতী তোমায় দিলাম খোলা চিঠি ;

সবিতা চৌধুরীর গাওয়া – এনে দে এনে দে ঝুমকা ; সুকৃতি সেনের গাওয়া – পদ্মা নদীর তীরে সন্ধ্যা নামিল ধীরে বলেছিলে প্রিয়, দেখা হবে নির্জন নদী তীরে ; সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া – হয়তো তাকে দেখোনি কেউ কিম্বা দেখেছিলে ;

সুজাতা চক্রবর্ত্তীর গাওয়া – ভুল সবই ভুল এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা – সে ভুল ; সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া – তুমি ডাকবে কি ডাকবে না ভাবছ যখন ;

সুধীরলাল চক্রবর্তীর গাওয়া – তুমি কতদূরে কোন গহন আঁধারে ওগো চিরতরে গেছ হারায়ে ; সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া – আমার এ গান ওই সাত রঙে রঙে সাজাল আকাশের আঙিনা ;

সুবীর সেনের গাওয়া – স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে আকাশ যে ওই রাঙল রে ; সুমন কল্যানপুরের গাওয়া – দূরাশার বালুচরে একা একা আজও গান গাই ;

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া – অলির কথা শুনে বকুল হাসে, কই তাহার মতো তুমি আমার কথা শুনে হাসো না তো ;

মুকেশের গাওয়া – মন মাতাল সাঁঝ সকাল কেন শুধুই কাঁদে ; কানন দেবীর গাওয়া – প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম তোমার চরণ স্মরণ করি – ইত্যাদি কত সব গান।।

 

গান আজও আছে! গানের সেই সুদিন নেই বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেন। ভালো গান সৃষ্টি হচ্ছে না এখন আর। গান নাকি হয়ে গেছে ওয়ান টাইম বলপেনের মতো। শুনেছি, এখন যারা গান করেন তাদের কেউ কেউ কণ্ঠের চাইতে শরীর দোলানোকে বেশি বেশি পছন্দ করেন। সে-জন্যই কি এখনকার গানের আবেদন দীর্ঘস্থায়ী হয় না? ৬২ বছর আগে ফেরদৌসী বেগম গেয়েছিলেন ‘ও রঙিলা মনে যে লাগে এত রং’। তারও আগে শচীন দেব বর্মন গেয়েছিলেন –  ‘রঙিলা রঙিলা রঙিলারে’। কিংবা লতা মুঙ্গেশকরের – ‘রঙিলা বাঁশিতে’। এরকম গান এখনো বাজলে বাঙালির মনে রং লাগে।

 

গান তো অনেক হয়েছে, হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। যিনি সদ্য তরুণ তার কাছে বড়ো প্রিয় মনে হবে এ সময়ের গান। তবে এটা সাময়িক মাত্র। দু-দিন পরে তার ভালোলাগা গানগুলো আর ভালো লাগছে না তার কাছেই।

তবে একথা ধ্রুব সত্য যে, মানুষের মনে এখনো দোল দিয়ে যায় –  লতা, সন্ধ্যা, গীতা, হেমন্ত, সায়গল, মানবেন্দ্র, শ্যামল, ভূপেন, শচীন দেব, জগন্ময় মিত্র, ফেরদৌসী রহমান, আবদুল জব্বার, বশির আহমেদ, মাহমুদুন্নবি, আঞ্জুমান আরা বেগম, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতউল্লাহ এবং আরও অনেক শিল্পীর গান। প্রায় ৭৮ বছর আগে

কানন দেবী গেয়েছিলেন –  ‘লাগুক দোলা লাগুক দোলা আমার গানেই তোমার মনে লাগুক দোলা…’। এখন পর্যন্ত ঐ গান বাঙালির মন দোলায়িত করে যায়। সে-সব গানের সুর ও বাণী এখনো ব্যাকুল করে ভাবায়। এ যেন অন্তহীন সুরের নদী, যেন বয়ে চলেছে নিরবধি কাল হতে কালান্তরে।

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , কাজী নজরুল ইসলাম , দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মুকুন্দ দাশের দেশাত্মবোধক গানগুলো পুনঃ নতুন প্রাণ খুঁজে পেল। ‘ চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল ’ – এর সঙ্গে নতুন নতুন গান যোগ হলো – ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, সহ আরও অনেক। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা… আমরা তোমাদের ভুলব না ’ এই গান শুনলে যে-কেউ ফিরে যায় ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলোতে। তখন তো আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম পশ্চিম বাংলার মাটিতে। সেই স্মৃতি বা ভুলি কেমনে!!!

তাই অবশেষে গানের ভাষায় বলে যাই ঃ

 

ভুলি নাই , ভুলি নাই , ভুলি নাই ভারতের অবদান।

আশ্রয় -প্রশ্রয়ে পেয়েছি – খাদ্য বাসস্থান ,

দিয়েছিল তারা মুক্তিযুদ্ধ করিবার অস্ত্র

ভারতের উৎসাহে বলিয়ান হয়েছিলাম।

পাকিস্তানী হানাদারদের যুদ্ধে পরাস্ত করে

নিয়েছিলাম বন্দর থানা দখলে।

জয় বাংলা স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত।

কত সহযোদ্ধা প্রাণ হারালো যুদ্ধের প্রান্তরে –

এক সাগর রক্ত দিয়ে – অবশেষে পেলাম বাংলাদেশ ।

কি করে ভুলি ভারতের ঋণ ?

১৯৭১ সালে আশ্রয় নিয়েছিলাম কলকাতায়, এক অনুষ্ঠান থেকে উৎপলা সেন বের হতেই তাঁকে দেখে বলতে শুরু করলাম ঃ

ভুলেছি তোমারে অনেক বেদনা সহি

আজ কেন মোরে ডাকো নাম ধরে

অকারণে রহি রহি।

তোমায় সেদিন ফেলিয়া এসেছি পিছে

আজ কেন মনে রাখো প্রিয় মিছে

ভুলে যত কথা মিছে কেন যাও দহি।

হারানো দিনের সেই প্রিয় মধুগান

কন্ঠবীণায় হয়ে আছে আজও মান

তোমারে  ঘিরিয়া যত মুখচ্ছবি

মনে হয় প্রিয় রাতের স্বপন সবি

তুমি যারে মন দিয়েছিলে প্রিয়

সে তো আমি নহি নহি…………….

উঁনি আমার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসছিলেন……

বললাম, আমি জয় বাংলা থেকে এসেছি, হাতটা বাড়িয়ে দিতে উনি  বললেন, ” আমি কিন্তু ঢাকার মেয়ে…. “। কী করে ভুলি সেই দিন, সেই ক্ষণ – আর তো ফিরিবে না!!

%d bloggers like this: