আমি ও আমার সহপাঠিবৃন্দ/ ফিরোজ শ্রাবন
আজকে ০৭ জুন,২০২০ সাল । আমাদের কোটালিপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন এর ১৯৯৫ ব্যাচের মোটামুটি সবাই ফেসবুক মেসেঞ্জারে যুক্ত হলাম। মনে পড়ে কত মধুর সেই স্মৃতিময় দিনগুলি। সিক্স থেকে দশম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া সুজিত পোদ্দারকে এখনও ছাত্র হিসেবে আমার আইডল মনে হয়। প্রত্যেকটা ক্লাসে তার পারদর্শিতা কখনও কখনও প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ছিল। সমস্যা ছিল সুজিত দ্রুত পড়া দিতে পারতো না। আস্তে আস্তে পড়তো। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো আহারে আমার যদি এমন মুখস্থ থাকতো তাহলে এক নিঃশ্বাসে পড়া দিতাম। আমাদের ফোরকান খুব দ্রুত পড়া দিত। স্যার মনে হয় ফোরকানকে তাই একটু বেশি প্রশ্ন করতো। আর ফারুকের কথা কি বলবো, পড়া দিতে গেলে ও চোখ বন্ধ করে যেভাবে বলতো মনে হতো অন্ধকার রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া কোন পথিক। জাহিদুলও খুব ভালো পড়া দিতে পারতো। তাছাড়া জাহিদুলকে আমার সবচেয়ে গোছানো মনে হতো। তার পড়ার টেবিল যে দেখেছে সে এটা মেনে নেবে। প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার খাতা জমা দিবো। কিন্তু আমার কিছুই রেডি নাই। আমি সাহস করে জাহিদুলদের বাড়িতে গেলাম । ও আমাকে জীবের পরিপাকতন্ত্র আর চিংড়ির গঠনতন্ত্র খুব সুন্দর করে এঁকে দিলো । আর আসার সময় একটা পাঁকা আম দিলো খেতে। আমের স্বাদের চাইতেও তার আন্তরিকতার স্বাদটা ছিল আমার কাছে বেশি মজার। আমাদের ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে সবাই মোটামুটি সুন্দরী ছিল। এখনও অনেক সুন্দরী আছে আমাদের চারেপাশে। কিন্তু তখনকার সময়ে আমাদের ব্যাচে আসলেই অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে ছিল। আর সুন্দরের স্ত্রীলিঙ্গ তো সুন্দরী। তাই তাদের সুন্দরী বললাম না হলে সুন্দরই বলতাম। মনে পড়ে ক্লাস সিক্সে স্যারেরা আগে ঢুকতো তার পরে মেয়েরা আসতো কমনরুম থেকে। তো আমাদের বিথী আপু হাইহিলের কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্লাসে ঢুকছিলো। মান্নান স্যার ব্যাপারটা খেয়াল করলো। বললো, কিরে তোর পায়ে কি কাঁটা ফুটছে নাকি, এভাবে হাঁটছিস কেনো? আমি আজও ভাবি যে বিথী সময়ের চাইতে কিভাবে তার পোশাক আচরণে অন্যদের চাইতে এগিয়ে ছিল। তার হেয়ারস্টাইল এখনকার মেয়েরা নকল করে । আর সে সেই ১৯৯৫ সালের কথা, ভাবা যায়! তো পরিচয় পর্বে স্যার একে একে সবার নাম জিজ্ঞাসা করতে করতে আমাদের নাসির ভাইর পালা এলো। সে বলে উঠল, নাম মো: নাসিন উদ্দিন। স্যার তাকে দিল এক ধমক। বলল মো: বলতে হয় না, বলতে হয় মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। তখন থেকে বুঝলাম যে আর যাই হোক, এই স্যার অনেক কড়া মানে রাগি। তাই সাবধান থাকতে হবে। আমাদের ক্লাসে আরও অনেক মেয়ে ছিল। পারভিন আক্তার তারপরে নাসরিন আক্তার। আমরা নাসরিন আক্তারকে নিয়ে ভীষণ রকমের আশাবাদি ছিলাম যে সে এস এস সি তে স্টার পাবে। কারণ সে ছিল মার্জিত, মেধাবী আর বুদ্ধিমতি। সে ভাল গাইতেও পারতো। ”মোরা ঝন্ঝার মত উদ্দাম মোরা ঝরনার মত চঞ্চল”। কিন্তু মুশকিল হলো কি, আমাদের স্কাউটস এর বঙ্কিম চন্দ্র বালা স্যার তার সাথে হারমোনিয়ামে তাল, লয় মেলাতে পারতো না। যদি মেলাতে পারতো তাহলে নাসরিন বা নাসরিনরা হয়তো এগিয়ে যেতো জেট বিমানের মত। আমাদের ক্লাসে কিছু অল্প মেধাবি ছাত্র ছিল। তার মধ্যে আমি শেষের দিক থেকে ৪/৫ নম্বর হবো। আমি আর প্রিয় লাল সাহা ছিলাম কাছাকাছি ছাত্র। আর গোলাম মওলা ছিল বলে ভাবতাম আমার পড়া না পারাতে যে লজ্জা তা আমার একার নয়। লিটুর কথা বলি, সে নিজে ভালো করে না বুঝলেও বোঝানোর ক্ষমতা ছিল তার দারুণ। প্রচন্ড রকমের বন্ধুসুলভ ছিল সে। কিন্তু আমার জন্য নয়, অন্য অনেকেরই হয়ত সে ছিল ত্রাণকর্তা। রশিদ ভাই খুব সুন্দর করে হাসতো আর একটা মেয়েকে ভালবাসে বলে, আমি আর শিপনের সমর্থন নেয়ার চেষ্টা করতো। আমি আর শিপনও খুব চাইতাম রশিদ ভাই ভাললোক, জয়ের মালা তারই হোক। কিন্তু মনে মনে বলতাম শালা, তোমার মনের আশা কোনদিন পূরণে হবে না। আমাদের ইব্রাহিম কারেন্টের ১০০০ ভোল্ট এর ছবি আঁকা জিন্স পরে আসতো আর যা বলতো তাতে মনে হতো পড়ালেখা ছাড়াও সুন্দর একটা ভবিষ্যত গড়া এটা কোনো ব্যাপারই না। কমেডিয়ান নাসিম সবাইকে হাসাতো কিন্ত কেই তাকে হাসানোর চেষ্টা করতো না। ভাবতো ওতো এমনিতেই সুখি ওর আর সুখের কি দরকার। একবার নাসিম আমাদের প্রাইমারী স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অতিথি হিসেবে গিয়ে গান গাইলো ”দরজা খুইলা দেখুম যারে করুম তারে বিয়া। বউ সাজাইয়া লইয়া জামু টোপর মাথায় দিয়া” আমি ভাবলাম স্বপন ভাইর সাথে চলে তো, তাই ওর এত দাপট। আমি অনেককেই বললাম, আমি আর নাসিম একই ক্লাসে পড়ি কিন্তু তাতে আমার দাম একটুও বাড়লো বলে মনে হলো না। তবে ক্লাসে ক্ষমতা দেখাত আমাদের আশরাফুল ভাই। সে তো রীতিমত আমাকে থ্রেট দিত, কেন দিত? তা শুধু আমি আর সে জানতাম, আর কেউ জানতো না। আমি সিনেমায় দেখতাম ভিলেন, নায়ক বা নায়িকাকে থ্রেট দেয়। কিন্তু আমি তো এরকম কেউ না, তবে সে পরে তার ভুল বুঝতে পেরেছিল। ততদিনে আমি স্কুল ছাড়ব বলে ভাবছি। আশরাফুল এর মাঝে চমৎকার একটা লিডারশিপ কাজ করতো। কেউ মানতো কেউবা এড়িয়ে যেত। যাই হোক, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। তাই এমন কিছু মহান লোকের সাথে আমার স্কুল জীবন কেটেছে। জালাল ভাইর সহযোগিতায় আমি ভালো একটা গ্রুপ পেয়ে যাই। আমাদের এস এস সি পরীক্ষার আগে এবস্ট্রাক্ট ফরমে ১০ জন করে সই করতে হতো। আর সেই অনুযায়ী এস এস সি পরীক্ষার হলে সিট পড়তো। আমি টেষ্টে অংকে ফেল করাতে আমি ভাল গ্রুপ পাচ্ছিলাম না। জালাল ভাই এগিয়ে এলো। বললো, আমি দায়িত্ব নিলাম, ফিরোজ পাশ করবে ইন-শা-আল্লাহ। এভাবে দায়িত্ব নেয়ার পরে কেউ যদি ফেল করে তার দয়ামায়া বলতে কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। আর একটা কথা, জালাল ভাই ছিল বড় হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু কেউ যদি সে হৃদয়ে আশ্রয় না নেয় তাহলে তাকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। আমাদের হাসান ছিল সবচাইতে লাজুক। মজার ব্যাপার হলো সে এখন দুই ছেলের বাপ কিন্তু তার লজ্জা এখনও কাটে নাই। ক্লাসের আর এক মেধাবী মুখ মানিক চন্দ্র হীরা তার বগলে সবসময় বই আর স্কেল থাকতো। সে সবার সাথে মিশতো না শুধুমাত্র ভাল ছাত্র ছাড়া। আবার ভাল ছাত্ররা হয়ত ভাবতো হেডস্যারের ছেলে নিশ্চয়ই ভালো রেজাল্ট করবে। আমি ভাবতাম, সে যদি আমাদের বন্ধু হতো কত না ভাল হতো । কারণ স্কুলের মাসিক বেতন এবং পরীক্ষার ফিস সময় মত না দিতে পারলে সেই ছাত্রকে পরীক্ষা দিতে বেশ সমস্যায় পড়তে হতো। আমাদের নুরু স্যার প্রবেশপত্রের পেছনে কোন ছাত্রের কত বকেয়া তা পরীক্ষার আগেই লিখে দিত। তাই পরীক্ষার হলে চাইলেই কেউ ঢুকতে পারতো না। পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় প্রত্যেককে চেক করে ঢুকানো হতো। আমার ভাল লাগতো না। কারণ বেতন না দেয়ার জন্য তো আমি দায়ি না। আমি তো বাসায় বলি যে বেতন দিতে হবে। কিন্তু পরীক্ষার যে রেজাল্ট তাতে তাদেরকে বড় গলায় বলাটাও মুশকিল ছিল। যাই হোক একটা উপায় ছিল। পরীক্ষার হলে ঢুকতে না দিলে সে ছাত্র কোন শিক্ষকের সুপারিশ নিয়ে আসলে ঢুকতে দিতো। আমি বরাবরা মান্নান স্যার থেকে সুপারিশ নিয়ে আসতাম। কারণ প্রথম সাময়িক পরীক্ষার সময় আব্বা বলতো, আমি মান্নান স্যারকে অনুরোধ করেছি, দ্বিতীয় সাময়িক এর সময় যেয়ে পুরো বছরের বেতন পরিশোধ করে দিয়ে আসবো। মান্নান স্যার ছিলেন আব্বার বন্ধু। আর আব্বা তাই করতো। দ্বিতীয় সাময়িক এর সময় পুরো বছরের বেতন দিয়ে আসতো। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় তাই মান্নান স্যারই ছিল সুপারিশ পাওয়ার একমাত্র ভরসা। আর তাই প্রথম সাময়িক পরীক্ষাটা আমার জন্য ছিল ডাবল আতঙ্কের। আমার বাবার থেকে এই জিনিসটা আমি এখনও করি। যেমন ইউটিলিটি বিল আমি ৩ মাস বা আরও বেশি অগ্রিম দেয়ার চেষ্টা করি। তো সেবার মান্নান স্যার সুপাারিশ করতে দেরি করছিলো। ততক্ষণে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমার এত লজ্জা লাগছিলো যে পরীক্ষার হলে ঢুকে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। লিখতে পারছিলাম না। কারণ একে ত মন খারাপ তার পরে আবার উঁচু বেঞ্চ । যারা ভাল ছাত্র তারা নিচু বেঞ্চ আগেই দখল করে বসে থাকতো। নিচু বেঞ্চগুলো সামনের দিকে থাকতো। আমরা তো সামনে বসতাম না। সামনের বেঞ্চে বসে যদি কলম কামড়াতাম তাহলে স্যাররা এসে বলতো কিরে? লিখছিস না কেনো? তাই এই রিক্স নিতাম না। আর একটা কথা, বেতন না দেওয়ায় ছাত্র নয়, অভিভাবকদেরকে শোকজ করা উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ অন্য অনেক ছাত্র আমার চাইতে আরও বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতো সুপারিশের আশায়। আপনারা তো দেখেন কোন হাসপাতাল কি রোগিকে বিলের কপি দেয়? দেয় না। বিল দেয় তাদের আত্মীয়দের বা সাথে থাকা লোকদের। তাহলে বেতনের জন্য কেন ছাত্রকে আটকে রাখবে? অবশ্য কিছু কিছু হাসপাতাল এখন রোগিকে আটকে রাখে। আমার মনে হয় তখনকার সময়ে অভিভাবকদের চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। তবে তখন নগদ টাকা সবার সব সময় হাতে থাকতো না। এত কথা কেন বললাম, আমাদের মানিক ছিল গোপাল চন্দ্র হীরার ছেলে। নামটা না বলে আমি প্রধানশিক্ষক এর ছেলেও বলতে পারতাম। কিন্তু নামটা এই জন্যই বললাম, এই নামের সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো স্মৃতি। শুধু তারাই জানবে যারা এই স্কুলের ছাত্র ছিল। স্যারের চশমার উপর দিয়ে তাকানোর স্টাইল এখনও ভুলতে পারি না। তার চশমার উপর দিয়ে তাকানো মানে খবর আছে। আমার সাথে এমন কোন ঘটনা ঘটে নাই। তবে যার সাথে ঘটেছে সেই জানে তার মর্ম। স্কুলের পরীক্ষার ফিস বা মাসিক বেতন দেয়া বা সুপারিশ নিয়ে অনেকেরই হয়ত অনেক গল্প আছে। যা এখন তার সফলতার গল্পের কাছে হার মেনেছে। নীলকমল ছিল বাচ্চদের মত। ও হাঁটতে পারতো না। একজন লোক সম্ভবত হাউজ টিচার কোলে করে নীলকমলকে স্কুলে নিয়ে আসতো। টিফিন পিরিয়ড়ে সবাই যখন খেলাধুলা বা আড্ডায় মশগুল তখন নীল কমল কি করে সময় কাটাতো তা আজও জানা হল না । কিভাবে জানবো, আমরা তো ভীষণ ব্যস্ত তখন। দিনেশ চন্দ্র সাহা, নিরেট ভদ্রলোক। ক্লাসের পড়াও নিয়মিত পারতো । আর আল মামুনকে আমার খুবই ক্যালকুলেটিভ মনে হত এমনকি এখনও। অনেক রিজার্ভ ছিল । আমরা ভাবতাম ও যদি আমাদের বন্ধু হয় তাহলে ইংরেজি নিয়ে ভাবতে হবে না। কারণ ওর আপন চাচা রাজ্জাক স্যার ছিলেন আমাদের ইংরেজি শিক্ষক। ক্লাসে হইচই স্যার একদম বরদাস্ত করতেন না। এমনকি পাশের ক্লাসে হইচই হলে মাঝের দেয়ালের উপর দিয়ে ডাস্টার ছুড়ে মারতেন। কিন্তু মামুন যেন এক অন্য জগতের মানুষ। বন্ধু বানানোর চাইতে ভালো নোট বানানো তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই ভেবেই নিলাম পড়াশোনায় যারা খারাপ তাদেরকে হয়তো কেউ দলে ভিড়াতে চায় না। তাতে নৌকা কুলে না ভিড়ে ডুবে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। মামুনের এই হিসেবি জীবন এখনও ওকে বাচিঁয়ে রেখেছে। কারণ আমরা জানি, পূরুষ মানুষ দু-প্রকার ১) জীবিত ২) বিবাহিত। আর মামুন এখনও প্রথমটা । মামুন এখনও বিয়েই করলোনা। আর ওই দিকে আমাদের রহমতউল্লাহ তার নাতির ছবি ফেসবুকে পেষ্ট দেয়। কি বিচিত্র আমাদের জীবন! এই রহমতউল্লাহকে আমি চিনি একজন যোদ্ধা হিসেবে। কারণ আমরা যখন শুধু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত তখনও সে তার নিজের এমনকি তার পরিবার নিয়েও তাকে ভাবতে হত। আমাদের স্কুলে রাজনীতি ছিল না। তবুও কি মনে করে আমাদের কামাল সব সুনাম ক্ষুন্ন করে মারামারি করলো। তাতে লাভের কিছুই হলো না। শুনেছি কলেজে মারামারি করলে তার দাম বাড়ে । কিন্তু স্কুলে মারামারি করে কামাল এমন ভাবে দাম কমালো যে আমাদের কামাল কলেজে গিয়েও আর দাম বাড়াতে পারলো না। কামরুজ্জামানের কি হলো বুঝলাম না। হঠাৎ করে সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ভাল রেজাল্ট করলো। সব স্যারেরা ক্লাসে বিগত পরীক্ষার খাতা নিয়ে আসতো এবং কে কত পেয়েছে তা বলে দিত। দেখলাম কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল প্রত্যেক বিষয়ে ভাল নম্বর পেয়েছে । আমরা খাতা পেতাম সবার শেষের দিকে। ততক্ষণে কত পেয়েছি তা বলার ধৈর্য্য হয়ত স্যারের আর থাকতো না। আর আমরাও ভিড়ের মাঝে মিশে যেতাম। পরীক্ষায় কত পেলাম তার চাইতে পাশ করেছি িএটা কম আনন্দের ছিল না। আমাদের আবু সালেহ মুছা ওরফে সেলিমও ছিল পড়ালেখায় দুর্দান্ত খারাপ। ওর বাবা আর্মিতে ছিল। বাড়িতে আসলে স্কুলে চলে আসতো। আর সবার সামনে সেলিমকে বোঝাতো যে তোমাকে পড়ালেখায় আরও ভাল করতে হবে । সেলিমও মাথা নিচু করে এমন ভাবে শুনতো মনে হত এবার বোধহয় কিছু একটা হবে । এবার বোধহয় সে আমাদের ছেড়ে ভাল ছাত্রের দলে ভিড়বে। কিন্তু পরীক্ষা শেষে দেখতাম সে তার আগের অবস্থান থেকে একচুলও নড়ে নাই। আসলে সে বন্ধুদের ছেড়ে যেতে চায় না, নাকি পড়াশোনা আসলেই কঠিন? তবে আমার কাছে পড়াশোনা কিন্তু কখনই কঠিন মনে হয়নি। কঠিন মনে হত চাঁদনিরাতে সবাই যখন মুগ্ধ হয়ে চাঁদ মামাকে দেখছে উঠোনে খেলছে, তখন নিজেকে পড়ার টেবিলে রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। আমি সান্ত্বন্ পেতাম এই ভেবে, কত ডাক্তার, ইনজিনিয়ার পাশ করার পরে মাত্র ডাক্তারি শুরু করবে কিন্তু পড়াশোনার চাপে পাগল হয়ে গেছে বা মারা গেছে । তারা হয়ত এই চাঁদনি রাতটা অসংখ্যবার মিস করে গেছে। কিন্তু কি লাভ হলো চাঁদনি রাতটাও দেখলোনা আবার পাগলও হয়ে গেলো! আমার সৌভাগ্য যে পড়ার চাপে আমি কখনই পাগল হইনি। আমি পাগল ছিলাম আমার র্নিবুদ্ধিতাকে কাটিয়ে কত তাড়াতাড়ি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠা যায় সেই চিন্তায়। আফসোস এখনও বুদ্ধিমান হতে পারলাম না, সত্যি বলছি। শিপনের কথা যদি বলি তাহলে তা আর শেষ হবে না। শিপন ছিল ক্লাসের মধ্যমণি। সবাই তাকে পছন্দ করতো আর শিপন করতো আমাকে। কারণ আমি যতটুকু পারতাম ওকে শেয়ার করতাম। আমি ছিলাম খুবই ভীতু টাইপের। ও সবসময় আমাকে সাহস ধার দিত । হয়তো অনেককেই সাহসী করে তুলেছিল। তবে আমি ভাবতাম আমিই বেষ্ট । আলিউজ্জামান শিপনের আপন চাচাত ভাই হওয়া সত্ত্বেও সে ছিল শিপনের বিপরীত। পড়াশুনাই যেন তার একমাত্র সম্বল। আমি এখনও আনারকলি মার্কেটে গেলে শিপন আমাকে বলে তুই বেডা কিল্লাইগায়ে ভয় পাশ, বুঝিনা? তাই আনারকলি মার্কেটের আশে পাশে গেলে আমি এখনও কিছু সময় দাড়িয়ে থেকে সাহস সঞ্চয় করে আসি। আমি যখন তিতুমীর কলেজে পড়ি ততদিনে শিপন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী । তো তখন প্রায়ই আনারকলিতে যেতাম আড্ডা দিতে । শিপন বলতো, কিছু লাগলে বলিস। আমি বলতাম, বলবো সময় হোক। আমি মনে মনে বলতাম, বন্ধুদের কাছে ঋণ করতে নেই। কারণ তা সারা জীবনেও শোধ হয় না। অথবা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি শিপনের কোন প্রলোভনেই সাড়া দিতাম না। আমি জানতাম, অভ্যাস খারাপ হয়ে গেলে তা আর ভালে হয় না। আমি বলতাম, নিশ্চয়ই সামনে ভাল সময় আসবে। কিন্তু শিপন বলতো, তোকে দিয়ে কিছু হবে বলে মনে হয় না।
Facebook Comments Sync