বাঙলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

বাঙলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস

বাঙলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস

বাঙলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই দিনটি কোন আড়ম্বর ছাড়াই আমাদের জীবনে আসত, আবার চলেও যেত। আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন এই দিনটিতে কোন ছুটি থাকত না। ছিল না আজকের মত কোনো উৎসবের আবহ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এই দিনে আমরা ছুটি পেয়েছি। সে সময় খুব ভোরে হল থেকে দল বেধে আমরা রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। পরে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এবং আরো পরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় এরসাথে যুক্ত হয় চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা যা কোনভাবেই বাঙলা নববর্ষের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত নয়। এটা স্পষ্টত অষ্টমীর একটা অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস যদি জানতে চাই, তার আগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বা সভ্যতার বর্ষপঞ্জির ইতিহাসের দিকে একটু আলোকপাত করা দরকার। মিশরীয়রা সর্বপ্রথম সৌর বা সূর্য বৎসর গণনা করা শুরু করে খৃস্টপূর্ব ৪০০০ বৎসরেরও আগে। এরপর আসে গ্রীকরা। তারাও সৌর বৎসরের ক্যালেন্ডার গণনা করতো। তাদের কাছ থেকে রোমানরা এর ব্যবহার শিখেছিল। তখন তাদের মাস ছিল ১০টা আর দিন ছিল ৩০৪ টা। বছর শুরু হতো মার্চ থেকে। জুলিয়াস সিজার এর সংস্কার করে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস যোগ করে সাড়ে ৩৬৫ দিনে বছর গণনা শুরু করেন। অন্যদিকে পারস্যের জরথুস্ট্রীয়রা যে নববর্ষ পালন করে তার নাম নওরোজ। তাও ৩০০০ বছরের বেশি পুরানো। তারা সূর্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে যেদিন রাত ও দিন সমান হয়, সেদিন তাদের নওরোজ হয়। চীনারা বসন্তের প্রথম দিনে তাদের নববর্ষ উদযাপন করে। বাঙলা নববর্ষের ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদেরকে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রের দিকে তাকাতে হবে। প্রাচীনকালে ক্যালেন্ডার এর জায়গায় বিভিন্ন পঞ্জিকা চালু ছিল। আর তার নাম তখন ছিল পঞ্চাঙ্গ। পাঁচটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এই পঞ্চাঙ্গ তৈরি করা হতো, যথা- বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই গণনা পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছিল আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। 

 

ইতিহাস পাঠে এও জানা যায় যে, যীশুখৃস্টের জন্মের অনেক পরে এক্সিগুয়াস নামে এক খৃস্টান পাদরি ৫৩২ সালে খৃস্টাব্দ গণনা করা শুরু করেন। যীশুর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর ধরে এই সন গণনা শুরু হয়।  সৌরজগতে নিজ কক্ষপথে পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে যে ৩৬৫ দিন সময় লাগে, তার উপর ভিত্তি করে এই বর্ষপঞ্জি তৈরী করা হয়। এরপর ৫৭০ খৃস্টাব্দে মক্কায় নবী মোহাম্মদ (দঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ৫৩ বৎসর বয়সে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। তাঁর হিজরতের দিনটিকে ভিত্তি হিসাবে ধরে পরে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। তবে প্রচলিত সৌর মাসের উপর নির্ভর না করে হিজরি সন গণনায় চন্দ্র মাসের উপর নির্ভর করা হয়।

চন্দ্র তার আপন কক্ষপথে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আগের জায়গায় আসতে সময় নেয় ২৮ দিন। তাই প্রত্যেক চন্দ্র মাস হয় ২৯/৩০ দিন। যার ফলে ৩৫৪ অথবা ৩৫৫ দিনে এক বছর হয়। এজন্য হিজরি সন খৃস্ট সনের তুলনায় বৎসরে ১০/১১ দিন করে কম হয়। যদিও এভাবেই চলে এসেছে কয়েকশ বছর। এই উপমহাদেশ কৃষ নির্ভর অর্থ ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও সুলতানী আমল পার হয়েছে। কিন্তু মুঘল শাসনামলে সম্রাট আকবর লক্ষ্য করলেন, উৎপন্ন ফসলের উপর ভিত্তি করে যে খাজনা আদায় হয়, তাতে সমস্যা হচ্ছে। এক বছর সঠিক সময়ে খাজনা আদায় হয় তো, তিন বৎসর পরে ঐ সময়ে মাঠে ফসল থাকে। এই সমস্যা কাটানোর জন্য তিনি তাঁর সভাসদকে আদেশ করলেন। মূলত তিনি রাজস্ব প্রশাসনের সংকট দূর করতে এই উদ্যোগ নেন। 

আকবরের সিংহাসন আরোহন করেন ১৫৫৬ সালে। দেশ শাসনের ২৯তম বছরে তিনি পঞ্জিকা সংস্কারের এই আদেশ দেন। তাঁর অত্যন্ত আস্থাভাজন আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী অনেক ভেবেচিন্তে এর একটা সমাধান বের করেন। তিনি হিজরি সালের শুরুর দিনটা ঠিক রাখেন কিন্তু চন্দ্রের পরিবর্তে তদস্থলে ৩৬৫ দিনের সৌর বর্ষপঞ্জি চালু করেন। পিছনের দিক থেকে হিসাব করে এসে, একে হিজরি সনের সাথে হিসাবের সমন্বয়ও করেন। যাকে আমরা আজ বাংলা বর্ষপঞ্জি বলি। সৌর বৎসর মূলত ঋতুর সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু চন্দ্র বৎসর এর সাথে সম্পর্কহীন। আকবরের সিংহাসনে আরোহনের দিন থেকে এটা কার্যকর হয়। সেই হিসাবে ১৫৫৬ সালের ১০ মার্চ তথা ৯৯২ হিজরিতে বাঙলা সন গণনা শুরু হয়।  আবুল ফজলের লেখা আইন-ই-আকবরীতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমে এর নাম ছিল ফসলী সন, পরে এটা বঙ্গাব্দ বা বাঙলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়। সম্রাট আকবরের রাজত্বে তিনি সর্বত্র এর প্রচলন করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় এর পৃথক নামও আছে। এখন বাংলায় ১৪৩০ সন শুরু হলো, কিন্তু চন্দ্র বছরে ১০-১১ দিন কম হওয়ার কারণে হিজরি এখন ১৪৪৪ সন। 

এবার আসা যাক বাঙলা বার অর্থাৎ সাত দিনের নাম কিভাবে আসল সেই প্রশ্নে। মূলত মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ- নক্ষত্রের নাম থেকে এগুলো এসেছে। যেমন sun থেকে এসেছে রবিবার, moon থেকে এসেছে সোমবার, mars থেকে এসেছে মঙ্গলবার, mercury থেকে এসেছে বুধবার, jupiter থেকে এসেছে বৃহস্পতিবার, venus থেকে এসেছে শুক্রবার আর saturn থেকে এসেছে শনিবার। যদিও হিজরি সনে আরবী ভাষায় এর পৃথক নাম রয়েছে, তথাপি বাঙলা বর্ষপঞ্জি তৈরীর সময় গ্রীক রোমানদের এই নাম রেখে দেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে তা গ্রহন করা হয়েছিল।

বাঙলা বারো মাসের নাম এসেছে কোথা থেকে এটাও জেনে নেওয়া যাক। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে বিভিন্ন নক্ষত্রকে যে সব নামে অভিহিত করা হতো, মূলত সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে এই নামগুলো-

বিশাখা থেকে এসেছে বৈশাখ,

জেষ্ঠা থেকে এসেছে জৈষ্ঠ্য,

অষধা থেকে এসেছে আষাঢ়,

শ্রবণা থেকে এসেছে শ্রাবণ

ভদ্রা থেকে এসেছে ভাদ্র,

অশ্বিনী থেকে এসেছে আশ্বিন,

কৃত্তিকা থেকে এসেছে কার্তিক,

মৃগশিরা থেকে এসেছে অগ্রাহায়ণ,

পুষ্যা থেকে এসেছে পৌষ,

মঘা থেকে এসেছে মাঘ,

ফাল্গুনী থেকে এসেছে ফাল্গুন,

চিত্রা থেকে এসেছে চৈত্র।

১৫৮২ সনে ১৩ তম পোপ গ্রেগরী জ্যোতিবিদদের পরামর্শে বহু বছর ধরে চলে আসা খৃস্ট ক্যালেন্ডারের বিভিন্ন ভুলত্রুটি সংশোধন করেন এবং সেই সাথে লিপ ইয়ার চালু করেন যা আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। সারা বিশ্বে এটা অনুসরণ করা হয়। তাই এখন একে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার বলা হয়ে থাকে।

গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সঙ্গতি রেখে আমাদের দেশের বাংলা একাডেমি বাঙলা বর্ষপঞ্জিকা সংশোধন করে। এর ফলে প্রতি বৎসর ১৪ এপ্রিল আমাদের এখানে বাঙলা নববর্ষ পালিত হয়। কিন্তু এই ধরনের কোনো সংস্কার ভারতে না হওয়ার ফলে এক দিন পরে অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল সারা ভারতে নববর্ষ উদযাপিত হয়।

কাজী মুজাহিদুর রহমান
কাজী মুজাহিদুর রহমান