বাসনা কুন্তল/ বেগম জাহান আরা
মইনের বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে মোবাইলে সময় দেখে শুভ। প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরি হয়েছে। নিশ্চয় শুরু হয়ে গেছে পার্টি। মইনের ষাটতমো জন্মদিনের পার্টি। মনটা খারাপ হয়ে যায় শুভর। তিন ঘন্টা আগে বাসা থেকে বের হয়েও আসা গেলো না যথাসময়ে! মরার জ্যামেই খেলো জীবনটা! একা একা গজ গজ করতে করতে দরজায় এসে বেল বাজালো।
মইনই দরজা খুললো। জড়িয়ে ধরে দুজন দুজনকে। জানে জিগার দোস্ত দুজন। থাকে একই নগরে। একজন বসুন্ধরা, একজন ধানমন্ডি। দূরত্বটা বেশি নয়। কিন্তু জ্যামের কারণে বহুদুর। দুই থেকে তিন ঘন্টা সময়ের ব্যবধান। সেই কারণে আসা যাওয়া হয় কম। কিন্তু ফোনে যোগাযোগ থাকেই। তাই সয়ে যায় দুরত্ব।
-খুব দুঃখিত মইন।
-না না, ঠিক আছে। ভেতরে আয়।
অবাক হয় শুভ। শুধু তারা তারাই! এতো ছোটো পার্টি! বলে, কোহেন আসেনি?
-আসতে চেয়েছিলো। পরে জানালো, শরীরটা ভালো নেই।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুভ বলে, হুম, শরীরটা তো নিয়ে গেছে লাউরা।
-কিছু বলার নেই রে। এই বয়সে বৌ চলে গেলে, শরীরে মনে বিষয়টা মেনে নেয়াই মুশকিল, মইন বলে।
-বিয়েও করলো না, ছেলে মেয়েও নিলো না। বিয়ে করলে নাকি প্রেম নষ্ট হয়ে যায়। কি সব থিওরি! লিভটুগেদারেই কাটিয়ে দিলো জীবন। বলতো মইন?
-সত্যি, একটা সন্তান থাকলে হয়তো এতোটা নিঃসঙ্গ হয়ে যেতো না।
-সেই বিয়ে তো করলো, লাউরার ইচ্ছায়, লাউরার মৃত্যুশয্যায়।
-থাক শুভ, এখানে বস। চা না কফি?।
-সত্যি থাকবে বাংলাদেশে কোহেন? প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে যায় শুভ।
-কি যে বলিস! বাবা নেই, মা নেই, বোনের বাসায় থাকবে? হয় নাকি? একদিন এসেছিলো দেখা করতে। প্রথমে চিনতেই পারিনি। হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেছে। মাথায় লম্বা লম্বা চুল।
-মানে? অবাক হয় শুভ। বলে, চিরকাল তো আর্মি ছাঁটে চুল কাটতো।
-সে অনেক কথা শুভ। আস্তে আস্তে বলবো।
অনিতা, মইনের বৌ এলো খাবারের ট্রে হাতে।
লজ্জিত হয় শুভ। বলে, ছি ছি, একি কান্ড! আমি টেবিলে বসেই খাবো অনিতা। শীলা আসুক না।
-পথে আছে। এসে পড়বে। ফোন করেছিলো। গুলশানের কাছেই জ্যামে বসে আছে। আমি বলে দিয়েছি, আপনি এসে গেছেন।
– এই এক জ্বালা। পিচ্চি নাতনিটার জন্য রোজ তাকে যেতে হয় উত্তরা। নানির ডিউটি করে। আমি এখন দুই নম্বর। হাসে শুভ।
-তাওতো আমাদের কপাল ভালো, নাতি নাতনিরা ঢাকাতেই আছে রে, মইন বলে।
–সত্যি। মায়ার বন্ধন। আসলে পরম্পরা ছাড়া জীবনের মূল্য কি? বল?
শীলা এসে পড়েছে। সবাই তাকে স্বাগত জানায়। মইনের বৌ আর শুভর বৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট। যখন দেখা হয়, তখন সে কি বাঁধ ভাঙা গল্প!
শুভর মন পড়ে আছে কোহেনের কথা শোনার জন্য। তারা একসাথে ব্যাংকে চাকরি করতো। ঝকমকে ছেলে ছিলো কোহেন। একমাথা কালো কুচ কুচে চুলে আর্মি ছাঁট। বাম হাতে দুটো বড়ো পাথরের আংটি। ডানহাতে দামি ঘড়ি। চলাফেরায় আভিজাত্য। কথাবার্তায় কেতাদুরস্ত। বিশ পঁচিশজনের ভিড়ে ওকে চোখে পড়বেই। বিদেশে চাকরি করার সখ প্রথম থেকেই। ষাটের দশকে বিদেশ যাওয়া এতো সড়সড়ে ছিলো না। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বিদেশ ছিলো স্বপ্নের সোনার হরিণ
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই অফিসের টুরে আমেরিকা গিয়ে গাড়ি একসিডেন্টে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো কোহেন। পরে ওর চাচা, আমারিকাবাসী কাজেম সাহেবের চেষ্টায় সে থেকে যায় ওখানে। আর দেশে আসার নাম নেই। ক্রমে শেকড় গজালো বিদেশের মাটিতে। লাউরা এলো জীবনে। অভিবাসী হয়ে গেলো কোহেন। হারিয়ে গেলো তাদের বন্ধু বন্ধুত্ব দুটোই।
বেশ জমিয়ে গল্প চলছিলো। হঠাৎ দরজায় বেল বাজে। অবাক হয় মইন। এখন তো কারো আসার কথা নয়! মইন উঠে গিয়ে দরজা খোলে। উল্লাসে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কোহেন এসেছিস?
সবাই তাকায় দরজার দিকে। খুশির ফোয়ারা বয়ে গেলো ঘরে। অবাক হয়ে শুভ দেখে কোহেনকে। মাঝ পিঠ বরাবর আধাপাকা চুল ছড়ানো। চিরুনির সাথে সংস্রব নেই মনে হয়। সেই ঘন কালো চুলের অর্ধেকও নেই মাথায়। বামকানে একটা ইয়ারিং ঝুলছে। চকচকে প্রাণবন্ত চেহারাটা বেশ মলিন। পাজামা পাঞ্জাবি পরলে কি ভালো দেখাতো আগে! বিষন্নতায় ছাওয়া মুখমন্ডল। এ যেনো অন্য কেউ। সেই কোহেন নয়।
চেয়ারে বসতে বসতে পকেট থেকে রাবারব্যান্ড বের করে ঝুটনি বাঁধলো খুব যত্ন করে। কয়েকটা চুল ছিঁড়ে গেলে ‘আহা আহা’ করে। বলে, বেচারা লাউরার চুল ছিঁড়ে গেলে খারাপ লাগে।
–মানেটা কি কোহেন ভাই? অনিতা এবং শীলা এক সাথেই প্রায় প্রশ্ন করে। উৎসুক চোখে তাকায় শুভ আর মইনও। মানে, তাদেরও প্রশ্ন এটা।
–ও হো, সব কথা তোরা জানিস না বন্ধু। আসলে জীবনের সত্য ঘটনা গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ। জানি, বুঝি, আমার কষ্ট হবে মনে করেই তোরা লাউরার কথা কিছু জানতে চাস না। এক বছর হয়ে গেলো আজ ৬ই মার্চ। বেঁচে আছি। প্রথমে বলেছিলাম, পার্টিতে আসতে পারবো না। ভেবেছিলাম, ঘরেই থাকবো। পিকু আপু বাইরে গেলেন। কেমন খালি খালি লাগতে লাগলো। কেমন একটা একাকীত্ব! এই তারিখেই ঘটেছিলো ঘটনাটা। কাউকে কিছু বলতে পারি না। মনে জোর এনে তৈরি হলাম। আজই ভালো দিন। লাউরার কথাগুলো তোদের শেয়ার করার। ওকেও স্মরণ করা হবে। শেষের বাক্য উচ্চারণের সময় গলাটা ভার হয়ে এলো কোহেনের।
বিষন্নতায় থম থম করে উঠলো ঘর। কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না।
নাতনির গল্প থামিয়ে শীলা তাকালো অনিতার মুখের দিকে। মইন আর শুভ
সরাসরি তাকালো কোহেনের দিকে। লাউরার কথা শুনতে চায় তারাও। কিন্তু সর্বনাশা ব্যথার গনগনে অঙ্গারে হাত দিতে পারেনি কেউ। ফোনেও জানতে চায়নি মইন বা শুভ। আসলে গাঢ় কষ্টের কথা বলার হয়তো একটা ক্ষণ লাগে। ভাষার যোগান লাগে। শুরু করার শক্তি লাগে। তখন ফেটে পড়ে আগুনের উদ্গীরণ। যেমন মাটি ফেটে সহ্যের শেষ মহূর্তে বের হয় লাভা। আজ হয়তো কোহেনের সেই ক্ষণ।
–শেষ কয়টা মাস লাউরাকে নিয়ে হসপিসে ছিলাম। ওটা হলো মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকার জায়গা। যাদের ভালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই, তাদেরকে এখানে রাখা হয়। নগেন দাসদের তুলসি তলা আর কি। কোহেন থামে।
অন্যেরা থেমেই আছে। বোবা হয়ে গেছে সবাই।
–শেষের কেমোগুলো দেয়ার পর লাউরার নজরকাড়া ঢেউখেলানো সোনালী চুল কয়েকদিনের মধ্যে সব পড়ে গেলো। আরও ফ্যাকাসে দেখাতে লাগলো লাউরাকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করতো কখনও আমার। আহা, কেশ বিন্যাশে ফ্যাসন বিলাসী লাউরা, বেল মাথা হয়ে গেছে।
মৃত্যুর স্তব্ধতা ঘরে। কোহেনের কথা শোনার জন্য চারজনের পুরো শরীরই কান হয়ে উঠেছে। টান টান হয়ে আছে স্নায়ু।
–সময়গুলো খুব কষ্টের ছিলো রে। শেষ দিকে ও খুব আমার সঙ্গ চাইতো। ছূটি নিয়েছিলাম। বিছানার পাশে চেয়ার নিয়ে লাউরার হাত ধরে বসে থাকতাম। কখনও বিছানায় বসলে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে অস্ফুটে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়তো। ভয়ে ভয়ে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। মস্ত বড়ো অপারেশন হয়েছিল মাথায়। বেচারা! এতো যে নিয়ম কানুন মেনে চলতো, ইয়োগা করতো, তার আবার ক্যান্সার হবে, এটা ভাবিনি আমি কখনও। আসলে মানুষ কতোটুকু ভবিষ্যত ভাবতে পারে!
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। হারিয়ে গেছে সবার কথা।
–চুল উঠেছিলো পরে? শীলা জানতে চায় সাহস করে।
–দু চারটে। হাত দিয়ে দেখতো লাউরা। আয়নায় মুখ দেখতো না। আমাকে একদিন বললো, আমি চাই তুমি আমাকে বিয়ে করো। আর কোনো হোম থেকে একটা নবজাতক এনে আমার কোলে দিও। কেমন বৌ বৌ এবং মা মা লাগে দেখতে, তার ছবি তুলে রেখো।
চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে মইনের। যে মেয়ে বাচ্চা নেয়নি, বিয়ে করেনি, সে এখন বিয়ে করতে চাইলো। বাচ্চা কোলে নিতে চাইলো। সখটা তাহলে ছিলো!
অনিতা দেখে, মুখ ঘুরিয়ে শীলা চোখ মুছছে। দুঃখের দহে পৌঁছুলে কান্না সংক্রামক হয়ে ওঠে। অনিতার অশ্রুও বাধা মানে না।
ধ্যানমগ্নের মতো কোহেন কথা বলে যাচ্ছে আপন মনে। ব্যথার উদ্গীরণ হলে বোধহয় ওর কষ্টটা কিছু কমবে। সব্বাই শুনছে কোহেনের কথা। একদিন চার্চের পাদ্রি ডেকে বিয়ে করলাম। অনেক কষ্টে লাউরা উঠে বসলো। ফুল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম বাসরশয্যা। লাউরার বোন ফুল দিয়ে সাজালো ওকে। কে বলবে মাথায় চুল নেই? সেই অসামান্য চিকুর রাশি অদৃশ্য! ফুলের মুকুটে লাউরাকে সেই আগের মতিই সুন্দর লাগছিলো। পাদ্রির সাথে সমস্ত শপথ উচ্চারণ করলাম আমরা। বললাম, সারাজীবন দুজন দুজনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও জানি, সারাজীবন মানে আর কয়েক সপ্তাহ। তাতে কি! বিয়ে তো বিয়েই। দশ পাউন্ডের একটা ওয়েডিং কেক কাটা হলো। দুজন দুজনকে খাওয়ালাম। কি মিষ্টি করে হাসলো লাউরা।
একটু থামে কোহেন। কয়েকটা নিশ্বাস টানে এবং ছাড়ে। শীলা এবং অনিতার টিসু পেপার ভিজে গেছে।
–লাউরার কিছু সম্পত্তি ছিলো। সেগুলো যেনো নিরংকুশভাবে আমি পাই, সেজন্যেই বিয়ে করেছিলো লাউরা। ওদেশের আইনে, বিবাহিত দম্পতির মর্যাদা উচ্চে। একজন মারা গেলে অন্যজন তার সব কিছুর মালিক। লিভ টুগেদার করলে কেউ কারো সম্পত্তি পাবে না। যদি না উইল করে রাখে। বিয়ের দুই সপ্তাহ পরে পরিচিতের মধ্যেই নবজাতক পাওয়া গেলো। কিন্তু কোলে নেয়ার শক্তি ছিলো না লাউরার। তবু পাশে শুইয়ে ছবি তুলে দিলাম মোবাইলে।
ছবিগুলো বার বার দেখতো আর হাসতো। দিন ফুরিয়ে আসছে বুঝতে পেরেছিলো লাউরা। একদিন বললো, আমার তো চুল নেই। তুমি আর চুল কেটো না। মনে করো, আমার চুল তোমার মাথায় গিয়ে বড়ো হচ্ছে। আহা, কি দারুণ স্বপ্নবাজ মেয়ে ছিলো, না? সেই থেকে চুল কাটিনি। সত্যি বিশ্বাস করি, লাউরার চুল আমার মাথায় বড়ো হচ্ছে। তবে ওর মতো মসৃণ চিকুর রাশি হয়ে নয়, নিতান্তই আমার কর্কশ চুল হয়ে। আবার চুপ সে।
–কি হলো? খেতে দিবি না কিছু? গল্প তো খতম। স্বপ্নের ঘোর থেকে কোহেন ফিরে আসে বাস্তবে।
সচকিত হয় অনিতা। তাইতো, কারো প্লেটেই কিছু নেই। তাড়াতাড়ি সকলের প্লেটে খাবার তুলে দেয়। ঘরে বানানো চিকেন প্যাটিস, মিট বল, পরাটা, নানরুটি, খেজুর গুড়ের পায়েস, পুডিং, সব অপেক্ষায় আছে।
শুভর মনে হলো, কাউকে সদ্য কবর দিয়ে এসে ব্যথা ভারাতুর মনেই বসে গেছে ভুরি ভোজে। এইতো মানুষের জীবন! গল্প তো নয়, যেনো শর্টফিল্ম দেখছিলো। এমন দিল–তোড় ভালোবাসাকে নিজের হাতে মাটির নিচে রেখে এসেও মানুষ বাঁচে! কাটাবে কি করে বাকি জীবন কোহেন? মনের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে ওঠে শুভর।
কোহেন বারবার হাতঘড়ি দেখছে। মইন প্রশ্ন করে, কোথাও যেতে হবে?
–না। সেই আসবে। কোহেন বলে।
–কে, কে আসবে? বলিস নিতো? মইন প্রশ্ন করে।
–প্রমীলা। আমার বাকদত্তা। কুহু আপার ননদ। আমার লম্বা চুলের গল্পটা সে জানে। এক দিনেই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। আমার শূন্য ঘরে আসতে চেয়েছে। ও নিজেই আসবে তোদের দাওয়াত দিতে। মনে আছে তো প্রমীলাকে?
–আমাদের ব্যাচমেট ছিলো একজন প্রমীলা, মইন বলে।
–সেই, সেই প্রমীলা। কোহেন বলে, আমার এই অযত্নচর্চিত চুল অনেকদিন পর প্রমীলা শ্যাম্পু দিয়ে পরিষ্কার করে দিলো। কি আরাম লাগলো! ভারি মিষ্টি মেয়ে রে!
–সেই প্রমীলা? ওকে মেয়ে বলছিস? শুভ অবাক হয়।
কোহেন বোঝে, ওরা প্রমীলার বয়সের কথা মিন করছে। তা বয়স তো হয়েছেই। তারা সমবয়সী সবাই।
–বয়স কিছু নয় রে, প্রাণটাই আসল। হাসে কোহেন। বলে, কাম অন, টোস্ট করি। জীবন থেকে আনন্দ বাদ দিতে নেই ফ্রেন্ডস। কাম অন। চিয়ার্স!
Facebook Comments Sync