ভালোবাসার এই দিনে অন্তর্গত ভাবনা/ সুলতানা রিজিয়া

ভালোবাসার এই দিনে অন্তর্গত ভাবনা/

ভালোবাসার এই দিনে অন্তর্গত ভাবনা/

ভালোবাসার এই দিনে অন্তর্গত ভাবনা/ সুলতানা রিজিয়া

 

আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।

কে কবে কেনো এই দিনটির প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন  তার সঠিক ইতিকথা আমাদের কাছে আজও রহস্যাবৃত্ত। রহস্যের প্রতি আজন্মকাল এক অলঙ্ঘনীয় টান কম বেশি সকল মানুষের মনে চিরজাগরূক থাকে। এমন রহস্যের ঘোর পরবর্তীকালে রোমাঞ্চকর আচার অনুষ্ঠান হিসাবে ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট তারিখে লটকে যায়। একসময় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই দিনটি হৃদয়ের গন্ডি ছাড়িয়ে সমাজ, সংসারে পরিচিতি লাভ করে।

বিশ্বজুড়ে সকল দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্বে, বিজয়ের গৌরবে, কৃষিকাজে, ঋতুর আবহে স্মরণীয় দিনসমূহ ঐতিহাসিক ভাবে পালিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগলিক এবং সংস্কারের দাবীতে প্রণিধানযোগ্য কিছু নির্বাচিত দিন বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃতি লাভ করেছে। যেমন মে দিবস, নারী দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস, কন্যা দিবস, প্রবীণ দিবস। ইদানীংকার জনপ্রিয় দিন হিসাবে ভালোবাসা দিন বা ভ্যালেন্টাইন ডে সফলভাবে বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। প্রতি বছর এই দিনটিকে ঘিরে আবর্তিত হয় সামাজিক, পারিবারিক জীবনে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি এবং ভালোবাসার শিল্পসত্তায়। দিনটি মূলতঃ তারুণ্যে ভরপুর প্রজন্মের কাছে স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বর্তমানে এই উৎসবকে ঘিরে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মেলবন্ধনে অর্থনৈতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। কৃষিজাত পণ্যের পাশে ফুল চাষের চাহিদা বেড়েছে। ভালোবাসা দিসবকে কেন্দ্র করে ফুল এবং রং-এর প্রসার ঘটেছে। একই সাথে সাজ পোশাকে সংযুক্ত হয়েছে বসন্ত ঋতুর উজ্জ্বলতর প্রভাব।

“ফুল ফুটুক আর না ফুটুক –

আজ বসন্ত “।

এই বসন্ত ঋতু নিয়ে শুধু বাংলার বাঙালি নয়, বিশ্বের সর্বত্রই  নবজাগরণের বর্ণচ্ছটা সাড়া পড়ে। প্রকৃতির বুকে জেগে উঠে বৃক্ষ তরুলতার ঘরবসতি। শীত ঋতুর করাল থাবায় ম্রিয়মান ধরিত্রীমাতা বসন্তের আগমনে তার বুকের সকল প্রাণকে নিয়ে সাড়ম্বরে জেগে উঠে। আপন বৈভবের ডানা মেলার জন্য উদগ্রীব থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, ঋতুর মহিমা। স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর এই পৃথিবীকে ঋতুর উত্তরীয় দিয়ে সাজিয়ে রাখেন। এক এক ঋতুতে তাঁর পৃথিবী এক এক রূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাইতে বসন্তের আগমনে জেগে ওঠে হেলা অবহেলার লতাগুল্ম। প্রাণসঞ্চারি সবুজে উঁকি দেয় বংশ প্রদীপ! ছোট, বড় কলিতে ভরে যায় তাদের মায়াবী সবুজাভ শরীর। ফোটে নানা রঙের, আকার প্রকারের পুষ্প। চৌদিকে আমোদিত হয় তাদের মিশ্র সুবাস। আ হা-!

“ফুলে গন্ধ নেই, সে তো ভাবতেই পারিনা”!

তারা বাতাসের দোলায় অক্লান্ত,

প্রজাপতি, ভ্রমরের সোহাগ স্পর্শে শিহরিত,

বীজের গৌরবে গরবিনী।

আমি মনে মনে বিস্মিত হই, আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যে! মানুষের জীবনচক্রের সাদৃশ্য খুঁজে পাই প্রতিটি প্রাণী, বৃক্ষ তরুলতার মাঝে। আদি থেকে অন্তে প্রাণের অস্তিত্ব তো একই নিয়মে বাঁধা!

মাঝে মাঝেই উন্মুক্ত আকাশে দিকে তাকাই। কী বিশাল এর ব্যাপ্তি! স্মরণে জেগে ওঠে “সুরা মুলক”  এর আয়াত-

মর্মার্থ:

তিনি ( আল্লাহ্ ) সুবিন্যস্তভাবে স্তরে স্তরে সপ্ত আসমান তৈরী করেছেন!

তাঁর সৃষ্টিতে কোন ব্যতিক্রম খুঁজে পাবে না!

চোখ তুলে দেখো, তাঁর সৃষ্টিতে কোন ত্রুটি দেখো কি!

পুনরায় দৃষ্টিগোচর কর, তোমার চক্ষুদৃষ্টি দোষ না দেখে ব্যর্থভাবে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।

 

আমিও দেখি, খুঁজি, অতঃপর ব্যর্থতার অসহায়ত্বে মনের জমিনে সেজদায় মিশে যাই। আমার সামনের দৃশ্যমান জগত তিরতির করে কেঁপে ওঠে রোদন সুখে। আমি ফিরে আসি আমার ঘোরলাগা বয়সী যাপনে, দূরাগত ঠিকানার খোঁজে।

আল্লাহ্ রাব্বুল আল-আমিন এই মহাবিশ্বের সকল মখলুকাতের মহান সৃষ্টিকর্তা। তিনি তাঁর মনের মাধুরি দিয়ে সৃজন করেছে বিশ্বপ্রকৃতি এবং অসীম আকাশের ( সপ্তাকাশ )  বিস্ময়কর কক্ষপথের রূপরেখা। তাঁর সকল সৃষ্টির মূলেই রয়েছে তাঁর প্রিয় সৃষ্টি আশরাফুল মখলুকাত স্বরূপ মানুষ। মানুষের সকল সুখ, শান্তি,স্বস্তি,আনন্দের প্রতি তাঁর দয়ার্দ্র অনুভব চিরবিরাজমান। তাঁর এই অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ দেখি আমাদের চারপাশেই।

ঊর্ধ্বে চন্দ্র সূর্য  তারকারাজি,

মৃত্তিকায় মখমল সদৃশ্য তৃণভূমি

সবুজের আলোছায়া

রঙের বাহারী আলোকলতা।

 

আমরা জন্মের পরপরই পরিচিত হই আলোর সাথে, সুবাসের সাথে,

রঙের মুগ্ধতার সাথে।

সৃষ্টির সৃজনশীলতা বিকাশে ফুলের প্রাধান্য স্বয়ং দয়াময় আল্লাহ্ ই হেফাজত করে আসছেন।

ফুলে গন্ধ নেই, ভাবতেই পারিনা।

ফুলে রং নেই চিন্তারও অধিক।

ফুলে প্রেম নেই প্রেমিক মানতে পারেনা।

আল্লাহর রহমতের দান এই ফুল মূলতঃ সুবাস, রং, মানবিকতা, সেফার ও বিশুদ্ধার প্রতীক।

 

ফুলের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান বিশ্বজনীন।

সুখে ফুল,

দুঃখে ফুল,

বিরহে ফুল,

বিচ্ছেদে বা মরণে ফুল,

প্রেমে ফুল,

লজ্জায় ( বাসরে ) ফুল,

লেখকের কলমের কালিতেও ফুল অপরিহার্য।

আমরা ফুলের ঘ্রাণ ও রং নিয়ে মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হই, হতবাক হই, উৎফুল্ল হই।

চিত্তবিনোদনে ফুল আমাদের প্রিয় অনুষঙ্গ-

রঙের উৎসব আমাদের প্রেরণার মঞ্চ,

দৃষ্টির শীতলতা,

আবেগের ঝাড়বাতি।

ফুল ভালোবাসেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে সত্যিই বিরল।

 

ফুল আল্লাহ্ তায়া’লার সৃষ্টির ধারাবাহিকতার ধারক। ফুলের বীজে নতুন প্রাণের উন্মেষ ঘটে। এমন শস্য নেই, এমন তৃণলতা তরু- বৃক্ষ নেই যার ফুল হয় না! ফুলের বীজ হয় না! ফুলের রেণু, পরাগেও রয়েছে সৃষ্টির মাহাত্ম্য ! মধুর আদি ও অকৃত্রিম উৎস ফুল। মধু মানবদেহের জন্য উপকারী পথ্য। মধু অনেক প্রজাতি পাখির, কীট পতঙ্গের প্রিয় আহার্য। মধুর শেফা ( আরোগ্য ) পবিত্র কুরআন শরীফে উল্লিখিত আছে।

 

ফুল নিয়ে কতশত সঙ্গীতের বাণী ও সুরের মূর্চ্ছনা আমাদের মনে প্রশান্তির পরশ বুলায়। ফুলের জনপ্রিয়তা বর্তমানে ঘরে ঘরে আসন কেড়েছে। এক চিলতে বারান্দা, জানালার কার্ণিশে, গেটের কোনে কিংবা বাড়ির ছাদে ফুলের উল্লাস বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জমে উঠেছে ফুলের চাষ, ফুল এখন পেশার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। আন্তর্জাতিক আয়ের উৎসে রূপ নিয়েছে। মানুষের জীবন, সমাজ সংসারে ফুল এখন আর নিছক চিত্ত বিনোদনের তটে থেমে নেই, ফুলের রোজগারে জীবনের চাকা সচলও হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়েছে। ফলে মানুষ গ্রামীণ বা মফস্বলি জীবনকে বেছে নিচ্ছে। শহর কেন্দ্রীক ঘনবসতির নাগপাশ থেকে মুক্ত হচ্ছে। আধুনিক কৃষিকাজ কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় খামার সম্প্রসারণে আগ্রহী হয়ে উঠছে। একই সাথে ফুল চাষের পরিধিও বাড়ছে। দেশি- বিদেশি মনকাড়া সুগন্ধিযুক্ত ফুলের চাষ করার ক্ষেত্র হিসাবে এখন এই বাংলার পলিমাটি তার উর্বরতা উজাড় করে ঢেলে  দিচ্ছে। আসুন আমরা আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি ফুলকে ভালোবাসি, ফুলের কদর করি, টবে কিংবা জমিনে ফুলের চাষ করি। এতেই মানুষ ও ফুলের সখ্য নতুন মাত্রা পাবে। বৈদেশিক বাণিজ্যের দ্বারও উন্মোচিত হবে।

সুলতানা রিজিয়া
সুলতানা রিজিয়া