ভাষার লড়াই শেষ হয়নি – মাসুদ রানা
সকল ভাষা শহিদ ও ভাষাসৈনিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখে লেখাটি শুরু করছি। শহীদ দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারি যে অভিধায়ই ডাকি না কেন এর অর্থ একই। এ নিয়ে কাউকে লিখতে বলা হলে বা কেউ লেখা শুরু করলেই তিনি এর ইতিহাস তুলে আনেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে অবনত মস্তকে সালাম জানাই। কিন্তু এ লেখাটিকে আমি সেদিকে নিয়ে যেতে চাই না। ভাষা আন্দোলনের বয়স ৬৫ বছর হতে চললো। বাঙালির আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকারই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলো। ইতোমধ্যেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার তালিকায় বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অতি সম্প্রতি ইউনেস্কো বাংলাকে ‘বিশ্বের সুইটেস্ট ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আফ্রিকার একটি দেশ বাংলাকে তাদের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এগুলো নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার উন্নতি। কিন্তু তারপরও কথা থেকেই যায়। আজ ৬৫ বছরে পা দিয়েও আমরা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছি তা মোটেও শোভনীয় নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মিডিয়ার কর্মীদের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যেই যেসব বিভ্রাট পরিলক্ষিত হয় তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এখানেই লড়াইটা অসমাপ্ত রয়েছে বলে আমি মনে করি। ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছরে এসে একজন বাঙালিরও কোনোরূপ বানান বিভ্রাট এবং ব্যাকরণগত ত্রুটি না থাকলেই বরং মনে করা যেতো, আমরা সার্থক হয়েছি। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা অনেকের সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তাদের কাছে বাংলার ব্যবহারটা অসম্মানের, যা মোটেও কাম্য নয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী অনেকের সাথে কাজ করতে গিয়ে তাদের ব্যাকরণগত জ্ঞান এবং বানানের ব্যবহার দেখে আমি রীতিমত নিরাশ হয়েছি। অথচ একটু সচেতন হলে বা সামান্য চেষ্টা করলেই এসব ত্রুটি এড়ানো সম্ভব। পৃথিবীর সকল ভাষার ব্যাকরণই এক। সুতরাং ইংরেজি গ্রামার ভালো জানা থাকলে তার বাংলা ব্যাকরণেও দখল থাকবে; অনুরূপভাবে আরবি ব্যাকরণের কথাও বলা যেতে পারে। বাংলা ব্যাকরণটাই ভালো করে যদি আমার জানা থাকে তাহলে অন্য যে কোনো ভাষার ব্যাকরণ আমার কাছে সহজতর হবে এটা খুব স্বাভাবিক। আমি নিজে এটা প্রয়োগ করে দেখেছি। একটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করবো। মাত্র কয়েকদিন আগে একজন স্কুল শিক্ষক ফেইসবুকে আমার একটি বানান ভুল ধরলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম বানানটি আমি শুদ্ধই লিখেছি। তাই তাকে বললাম, আপনি কোন সূত্রের ভিত্তিতে আমার বানানটি ভুল বললেন। তিনি জানালেন মোবাইল অভিধান থেকে। আমি অবাক হলাম। তাই বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা অভিধানের পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করে তাকে তা দেখে নিজেকে সংশোধন করে নিতে বললাম। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তার পাণ্ডিত্বে কিছুটা আঘাত লাগলো বলে মনে হলো, তাই তিনি আবার আমার আরেকটি বানান ভুল ধরলেন। সে বানানটিরও একই অবস্থা । আমার শুদ্ধ বানানকে তিনি অশুদ্ধ বললেন। এরপরই আমি তার পরিচয় জানতে চাইলাম, জানতে চাইলাম তিনি কী করেন। যাক তার দোষ নেই; তিনি হয়তো বাংলা একাডেমির অভিধান ব্যবহার করার মতো সময় পান না। আর বর্তমান ব্যস্ত সময়ে, ডিজিটাল যুগে মানুষ কী করে বাংলা একাডেমির অতো বড় অভিধান সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে। কেউ হয়তো পাবলিক বাসে বসে স্মার্টফোনে লিখছে, তার জন্য মোবাইল ডিকশনারি ব্যবহারটাই সহজতর। কিন্তু সেই মোবাইল ডিকশনারির অবস্থা যদি ওরকম হয় তাহলে ব্যবহারকারি বিভ্রাটে পড়বে এটা খুব স্বাভাবিক। তাই আমি বলবো, যারা মোবাইল অ্যাপে অভিধান আপলোড করছেন তাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। সর্বোপরি বাংলা একাডেমির উচিত মোবাইল অ্যাপে বাংলা অভিধানকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা। আমার মতে বিষয়টি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মতোই আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। এ লড়াইটা জোরেশোরে চালাতে হবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্যতা এবং ব্যবহার আরো বেশি সম্প্রসারণ কীভাবে করা যায় সে লড়াইটাও আমাদের করতে হবে। তাই আমি মনে করি ভাষার লড়াই শেষ হয়নি বরং নতুন করে শুরু হয়েছে। আমাদের আরো অনেক দায়িত্ব বেড়েছে। সুতরাং ভাষাকে নির্ভুলভাবে ব্যবহার করবো এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধিতে প্রচষ্টা চালাবো এটাই হোক আমাদের এবারের মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার।
Facebook Comments Sync