বিড়ম্বনা / তাহমিনা কোরাইশী
সূর্যবানু আলেয়ার চুলে হাত রাখে। এই চুলে কাঁচি চালাতে দারুণ বিড়ম্বনা। বলে,
– ওলো মাগী ইমন নাগিনীর লাহান চুলের ফণা কাটতাম কেমনে? তোর চুল আমার ব্যবসা তবুও আমার হাত কাঁপতাছে।
আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা নয়নতারা, খুরশেদা,ফুলির মা,জানু সবাই হাপিত্যােস করে মরছে। ফুলির মা কয়
– তোর সোয়ামী টের পাইলে তোরে আস্তা রাখবো? এখনও সময় আছে, ভাইব্যা চিন্তা কাম করোন ভালা।
আলেয়ার দুচোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরছে তো ঝরছে। বলে,
– কি করবাম? ঘরে এই দুই দিন ধইরা কিচ্ছু নাই। দুলালের দোকান থনে বাকি আনতাম । হেঅ বাকি দেয় না। তার কি দোষ? তার তো চলন লাগবো! পোলার বাহের কাজ কাম নাই কয়দিন। দেশেত কি যে অসুখ আইলো করোনা। মানুষ বাঁচতো ক্যাম্বায় ! অসুখে কি মারবো ? না খাইয়্যা মরবো। ও সূর্যবানু বুজি তুমি তোমার কাম করো দেহি। জলদি করো। আমার আবার বাজার করন লাগবো। তুমি যে টাহা দিবা হেইল্যা দিয়া চাইল ডাইল ডিম আলু আনব্যাম। বেলায় বেলায় খাওন তো দেওন লাগে । পোলা মাইয়্যা হেগরে কেমতে না খাওইয়্যা রাখি কও দেহি।
অগত্যা সূর্যবান তার হাতের কাঁচিটার সদগতি করলো। ঘচঘচ করে চুলগুলো কাটলো পরম যত্নে আবশ্যই। এই তার রুটি রুজির বস্তু, এর সাথে বুজরুকি ? না তা হবো না । ঝেড়ে টেনে বেছে লম্বা চুলের গোছাটা লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে নেয়। মনে মনে ভাবে, নেক কাল বাদে এমন একখান চুলের গোছা ওর হাতে আইছে। আলেয়াকে টাকা দিতে কার্পণ্য করে না সূর্যবানু। মনটা ফুরফুরে। মুক্তা মণি পার্লারের সাবিনা ম্যাডাম এই চুল পাইয়া দারুণ খুশি হইবো । ভালো দামে কিনে নিবে। সূর্যবানুর কাজই হলো চুলের ব্যবসা। চুল যোগাড় করে পার্লারে সাপ্লাই দেয়। তারা কি করে তা দিয়ে ওর কি কাজ! ওর লেনদেন ঠিকমতো চললেই হলো।
চোখের জল মুছতে মুছতে ছুটলো অন্য দোকানে দুলালের দোকান পার হয়ে। যদি দুলাল বাকির টাকা নিয়ে নেয়, ওকে ওর মালসামান ঠিক মত না দেয় ! প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে ছুটতে ছুটতে ঘরে যায়। রান্না শেষ করে আলেয়া ভাত । ডিমের তরকারি, আলু দিয়ে একটু ডালও রান্না করে । আজ আর ওর মাথা থেকে কাপড় নড়ে না। স্বামী এমন কি পোলা মাইয়্যাও যেন বুঝতে না পারে।
ডাক পড়ে মোমেন আলীর । চিৎকার করেই কথাগুলো বলে,
– কই চাইড্যা ভাত দে। বাইরে যামু একখান কাজের যোগাড় হইছে। আল্লায় মুখ তুইলে চাইছে।
আলেয়ার দুচোখে জল আসে স্বামীর কথা শুনে। আজ কাল কেবলই চোখ পোড়ে, জল আসে। নানান কথার ঝাঁপি খুলে যায় । আলেয়া অন্যমনস্ক ভাবেই বলে
-আনতাছি। পোলা মাইয়্যারে লইয়্যা বহ।
স্বামীর সামনে আপাতত যাতে যেতে না হয় তাই সেও জোরে জোরে ডাকে,
– ওই তুলি, ওই আবুল পাটিখান বিছা। বাজানের লগে তোরা খাইয়্যা লও। গরম গরম ভাত। রাইতে প্যাট ভইরা খাইতো পারস নাই। লা ধর বাডিগুলান লইয়্যা যা।
তুলি আবুল আজ একেবারে ব্যধ্য সন্তানের মত দৌড়ে আসে মায়ের ডাকে। হাতে হাতে পাটি বিছিয়ে খাওন সাজিয়ে নিজেরাও বসে পড়ে।গামলাডা ভর্তি সাদা সাদা ফুলের মতন ভাত আর বড় বড় ডিমের তরকারি লোভনীয় লাল মিষ্টির লাহান চাইয়্যা রইছে। ওদের আর তর সইছে না কখন এর ওপরে হামলে পড়বে এই অপেক্ষায়। মোমেন সন্তানদের নিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নেয়। আলেয়াকে ডাকে। সে দূর থেকেই উত্তর করে।
– তুমি খাইয়্যা তাড়াতড়ি যাও দেহি। আমি হাতের কাজ শেষ কইরা খামুনে।
কোন রকমে এ যাত্রায় বেঁচে যায় আলেয়া। সারাদিনও ভালো থাকে। মোমেন কাজে বেরিয়ে যায়। আর দুশ্চিন্তায় থাকতে চায় না। কাজ শেষ করে নিজেও পরিতৃপ্তিসহকারে খেয়ে নিয়। কিন্তু তবুও ওর মনের অস্থিরতা কাটে না। কষ্ট হয় স্বামীর পছন্দের ভালোবাসার বিষয় আসয় এভাবে তছনছ করে ফেললো! কি করার ছিল ওর । তুলি আর আবুলের অনাহারি দৃষ্টি আলেয়াকে পীড়িত করেছে। স্বামীর অসহায়ত্ব! সে তো ইচ্ছে করে কর্মহীন ঘরে বসে থাকতে চায় নাই। সময় বাধ্য করেছে। আলেয়াকে এতোটাই মান দিয়ে রেখেছে যে অভাবের সংসারেও পরের বাড়ির কাজের বুয়ার কাজ করাতে দিতে রাজী না মোমেন ।
আলেয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । আজ আর কাজ নেই। হাত গুটিয়ে বসে থাকার দিন। স্মৃতি আজ ডেকে নিয়ে যায় পদ্মা পাড়ের ফুলকি গ্রামে। গ্রামটা ভরা মানুষ, ঘর বাড়ি স্কুল কলেজ মসজিদ মন্দির মাদ্রাসা। গৃহপালিত গরু ছাগল মুরগী । হালচাষের ষাঁড় লাঙ্গল । মাছ ধরার জেলে পরিবার। যদিও ভিটে বাড়ি ছাড়া আর তেমন জায়গা জিরাত ওদের ছিল না। তাদের শরিকদের ছিল জমি জমা। মোমেন বর্গাচাষীর কাজ করতো। সময় পেলে আলেয়াও মোল্লাবাড়ির ধানভানা ঝাড়াবাছার কাজ করে আসতো। বসত ভিটায় আশেপাশে বেশ একটু জায়গা ছিল যাতে আলেয়ার সবজিমাচা ও সবজি বাগান ছিল। নিত্য দিনের চাহিদা মিটে যেতো। অভাব বলে কিছু কখনও টের পায়নি।
আলেয়ার চোখের সামনে ভেসে আসে সেই বীভৎস দিনগুলো! বর্ষা বন্যায় নাকাল অবস্থা । সারা রাইতদিন ঝরতাছে ঝরতাছে যেন আসমান ফুটা হইয়্যা গেছে। নদী ফাইস্যা উঠে পাগলের লাহাইন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য । হায়! শুরু হইলো পাড় ভাঙ্গন। একের পর এক পাড় ভাঙ্গে আর আমাগো বুকের পাঁজর ভাঙ্গে। কূল কিনারা নাই, রাক্ষুসী পদ্মার চেহারা পাল্টাইয়া গেছে। যেনো বেদিশা হইয়া গেছে। গাছ পালা ধনীজমি ক্ষেত খামার, এক এক কইরা স্কুল মসজিদ , মন্দির,স্কুল ঘর দোতাল দালান,বসত ভিটা,গাছ গাছালি,ফসলি জমিন রাক্ষুসী পদ্মার পেডে । ওর পেডে ডোকছে। আজদাহা খাইলো পুরা গ্রামডা । চাইয়্যা চাইয়্যা দেখন ছাড়া কি আছে আর? যে যার মতন কইরা গরু বাছুর ঘরের টিন সামানপাতি লইয়্যা পাড়াপাড়ি করলো। কতটুকু কে বাঁচাইতে পারলো! গ্রাম শুদ্ধাই মানুষ এক কাতারে । যাগো ঘর বাড়ি জমিজমা আছিল তাগো লাগে এক লাইনে আমাগো লাহাইন অভাগিরাও দাঁড়াই। চক্ষুর সামনে একখান গ্রাম পানির তলে ভাবা যায়!
দেশে থাইক্যা আর কি করমু মোমেন আলী কয় আলেয়ারে
– লও আমরা ঢাকা শহরে যাই। মুনির ভাই ,মোফাজ্জল হেরা তো ভালোই আছে কইলো।
আলেয়া বলো
– ঢাকা গিয়া কি করবা ঠিক করছো? ঢাকার কাজ আর গ্রামের কাজ কাম কি এক হইবো ? এইখানে মাইনষের জমিন বর্গা খাটছো। ঢাকা শহরে গিয়া কি করবা?
মোমেন
-তাই! হেরা যা করে তাই করুম।
আলেয়ার মন সায় দেয় না। অজানা অচেনা ঐ শহরে কি এক আতংকে দিন কাটবে আলেয়ার!
মোমেন জেনেছে কেউ রিক্সা চালায়, কেউ কামলার কাজ করে ,কেউ ইট ভাঙ্গে, কেউ ঘর বানানোর মিস্ত্রীর জোগাইলার কাজ করে। মাইয়্যা মানুষ করে বাসা বাড়ি আর গর্মেনসের কাজ । কাজ তো কিছু শিখা লাগবো। না পারলে গতর খাটার কাজই করন লাগবো।
অবশেষে আসতেই হলো । চাল নেই চুলো নেই । কেবল বন্ধু মুনির আর মোজ্জামেলের ভরসা। তারা পরিবার নিয়ে থাকে । রায়েরবাজার জাকিরের বস্তিতে। বহু বছর আগে অবস্থান নেয়াতে শহরের হালচাল যাপিত জীবনের আচরণ জানা হয়ে গেছে। শিখেছে রিক্সা চালানো , মিস্ত্রীর সাথে জোগাইলার কাজ, ইট ভাঙ্গার কাজ। প্রথম প্রথম কত জাতের কাজই করতে হয়েছে।তাদের পরিবার করেছে বাসায় বাসায় ঝিগিরি আর যারা একটু সেলাই ফোড়াই জানে তারা গার্মেন্টসের কাজ জুটিয়ে নিয়েছে।
আলেয়া আর মোমেনের দুই সন্তান তুলি – আবুলকেও শিখতে হয় ঢাকা শহরের নিচুতলার মানুষের বস্তিবাসি সংসারধর্মের কথা। সেই গ্রামের অবাধ খোলার মাঠের দুরন্ত শৈশব কৈশোর এক গৃহবন্দী জীবনের গল্পে হয়েছে রূপান্তর। এক রূমের ঘরে আশা হতাশার টানাপোড়েন এই জীবন। নদীর মুখের গ্রাস তো কেড়ে নেয়া যায় না। যখন সে উগলে দেবে অন্যদিকের নতুন চরে ওঠা আগামীর পথে ঠাঁই খুঁজে পাবে অনেকেই । সে স্বপ্ন নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই ভূমিহীন কৃষকের। সে তো কেবল জানে ভাড়া খাটা বর্গাচাষী জীবন। মোমেন আর আলেয়া দুঃখ নিয়ে ভাবতে চায় না সময়ে খাল বিল নদী নালার কথা । বুকের ভেতরে ক্ষতচিহ্ন বুকে ভরে থাকে । পুরোটাই বাংলাদেশ। হোক গ্রাম হোক শহর যেখানে তার অবস্থান রুটি রুজির তখন থেকে এটাই তার দেশ। ভালোবাসা জন্মায় তাকে ঘিরে। অল্পবিদ্যায় যা বোঝে মনকেও তাই বুঝ দেয়।
নতুন যখন এসেছিল এই বস্তিতে তখন প্রথমটাতে নয়নতারা বুজির সাথে ছুটা কাজে এক বাসায় কাজও করছিল কয়দিন স্বামী মোমেনকে না জানিয়ে। বেগম সাহেব খুব ভালো ছিল। আলেয়াকেও বাচ্চাদের জন্য প্রায়ই বাসি তরকারি মাছ মাংস দিয়ে দিত। কখনো মুরগীর গিলা কলিজা ঠ্যাঙগুলো । অনেকগুলো মুরগী আনলে আলেয়া সব কুটেবেছে দিত বিনিময়ে ঐ জিনিসগুলো ওর কপালে জুটতো। বাসায় গিয়ে বেশ মজা করে তেল মশল্লা ঢেলে রান্না করতো আলেয়া । নিজের এবং বাচ্চাদের খাওয়া হতো আর বাদবাকী স্বামীর পাতে। সেই দিনই কাল হলো ওর জীবনে । স্বামীর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। এতো আদরের বউ তার কথার মান রাখলো না? সেই দিন ভীষণ ভাবে কথার চাবুকে জর্জরিত করেছে আলেয়াকে । এর পর থেকে ঐ পথে আর পা রাখেনি আলেয়া। যদি অভাবে না খেয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েও যায় তবুও নয়।
ভুলেও মোমেনের কথার অবাধ্য সে আর কখনো হয়নি । এই দুবছর শহরের জীবন ভালোই কাটছিল। কখনো রিক্সা চালিয়ে কখনো যোগালির কাজ করে, কখনো মোজাম্মেলের টঙঘর দোকানে বসে পান বিড়ি সিগারেট চা বিস্কুট বিক্রি করে। এমন সময় এই আজব অসুখে সব কেমন তছনছ কইরা দিতাছে। কি খাইবো ! মানুষ কেমতে চলবো । কাজ নাই কাম নাই ঘরে বইসা থাকলে খাওন জুটতো কেমতে ?
গ্রামডা যেমন পদ্মার পেডে, আজদাহা আছিল ক্ষুধার জ্বালায় পুরা গ্রামারে খাইছে নদী। এই দেশে আবার কিসের আজদাহা রাক্ষুসে দানব আইলো যে মানুষ খাইয়্যা পেড ভরবো! গ্রাম ছাইড়া শহরে আইলো চাইরডা ভাতের আশায়। এই শহরেও এই জ্বালা। গ্রামেও কি শান্তি আছে! কি অসুখ আইলো মানুষের লগে মানুষ মিলাইতে পরতো না। দূরে দূরে থাকবো কেমতে এই বস্তির মানুষ । খাওনের পয়সা নাই পরিষ্কার থাকুনের মালসামান পাবো কই । আলেয়া আজ চিন্তামণির ঘরবসতিতে কোনভাবেই এ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না । ঝাকে ঝাকে উড়ে আসছে সুখ দুঃখের কত যে স্মৃতি! আজ তার আর কোন কাজ নেই । স্বামী গেছে কাজে । দুটো সন্তানের খাওয়া দাওয়া সারা । অখন্ড অবসর। হাত পা ছড়িয়ে স্মৃতির মাঝে বসতভিটা গড়তেই পারে। তবু আতঙ্ক কাটে না আলেয়ার । মাথার চুলে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। আহারে সেই চুল আমার কি করবাম! যা পছন্দ ছিল মোমেনের পিঠভারা এই কেশই দেইখ্যা পাগল হইয়্যা ওরে বিয়া করছে মোমেন । আলেয়া ভালো কইরাই জানে সুগন্ধি তেল ,সাবান , দুইটাকার পাতা শ্যাম্পু সবই যোগান দেয় মোমেন ভালোবেসে। বিরিশিরি নদীর পাড়ে কলমাকান্দার মাইয়্যা আলেয়া। আর গোপালগঞ্জের পদ্মার পাড়ের পোলা মোমেন ঘর বাধলো ভালোবাসার টানে । কাজের খোঁজে অনেকের সাথে মোমেনও অস্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিল আলেয়াদের গ্রামে।সেই ভালোবাসা বিয়া জীবনের পথে পথে এক সাথে হাঁটা।
এ ভাবেই দিনটি পার করে দেয় আলেয়া । সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে মোমেন দুহাতে ঝোলা ভরা সদাইপাতি নিয়ে। বাচ্চা দুটোর চিৎকার
– বাজানে আইছে বাজানে আইছে।
মাথায় আঁচল টেনে চেপে ধরে সামনে এসে বাজার নেয়।
-নে ধর পাঙ্গাস মাছ আর চাইল তেল, তরকারি আছে। মাছ দিয়া ভাত খাইবো আইজ আমার পোলা মাইয়্যা, বলে হাসতে হাসতে গোসলে যায় কলপাড়ে । আজ আর মোমেনের ভ্রুক্ষেপ নেই কারো দিকে । বীরদর্পে তার চলন বলন। মোমেনের মেজাজ আজ বেশ চাঙ্গা।পুরুষমানুষ হাতে পয়সা না থাকলে একেবারে বিলাই হয়ে থাকে আর টাকা পয়সা হাতে এলেই পুরুষত্ব তুঙ্গে ওঠে। আলেয়া বাজার গুছিয়ে রান্না শেষ করে।
মোমেন আর তার সন্তানদের এক সাথে বসে খেতে বলে। আল্লাহতায়ালার নাম নিতে নিতে হাতের কাজ শেষ করে কিছুটা সময় নেয়। যতক্ষণ না তারা ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। অবশেষে আলেয়াকে তো আসতেই হবে যেমন উট পাহাড়ের কাছে আসে ।আলেয়া ভাবে, এই ভাবে কয় দিন চলবাম মাবুদ জানে। ভয়ে ভয়ে বিছানায় ওঠে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায়ে রেখে শুয়ে পড়ে। ঐ সামন্য শব্দে মোমেনের আজ ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজ সারাদিনের খাটুনিতে ক্লান্ত শরীর তবু কি আনন্দে একেবারে ফুরফুরা। অনেক দিন পর যেমন পেটের শান্তি হয়েছে তেমনি মনের শান্তির দরকার। মোমেনের ভাত ঘুম ভেঙ্গে যায়। আলেয়াকে কাছে টানে বলে,
– এতোক্ষণে তোর সময় হইলো আওনের।
আলেয়া নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সরে যেতে চায় কিন্তু পারে কই! মোমেনের হাত ওর শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দীঘল চুলে হাত ছোঁয়ায়। আচমকা হাত টেনে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত আলেয়াকে স্পষ্ট করে দেখতে চায় । চিৎকার চেঁচামেচিতে কেউ একজন ঘরের বাতি জ্বালায়। ভাতঘুম ভেঙ্গে যায় তুলি আবুলেরও । মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে ওরাও কাঁদতে থাকে । আলেয়া ভয়ে নিজেকে সরিয়ে ছেলে মেয়ের কাছে যেতে যায়। পথ রোধ করে মোমেন দৌড়ে এসে আলেয়ার পিঠে দুমদুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে জানতে চায়
– কি করলি তুই? এই কাজ তোরে দিয়া কে করাইছে? এখনই কবি নইলে আইজ তোরে মাইরাই ফালামু। আবার আরম্ভ করে মোমেন – শহরে আইসা শহরের বাতাস লাগছে ? চুল কাটছিস কিসের লাইগ্যা?
ওদের চেঁচামেচিতে রাতের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বস্তির যত মহিলা হুমড়ি খেয়ে ভিড় করে ওর দরজায়। জোরে জোরে আওয়াজ তুলে ডাকে ফুলির মা ,ওর সাথে নয়নতারা ,সূর্যবানু,ফুলবানু, খুরশেদা।ফুলির মা ওদের মুরব্বির মত । সবাই তাকে মানে, সমীহ করে চলে। তার কথার দাম দেয়।
ফুলির মা বলে,
– ওরে মোমেন আগে আমাগো কথা শোন তারপর বিচার করিস। মাইয়াডারে এমনি কইরা মারিস না।
মোমেন দরজা খোলার সাথে সাথে হুড়মুড় করে সবই ঘরের ভিতরে ঢোকে। সূর্যবানু আর ফুলির মাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে আবার কান্না জুড়ে দেয় আলেয়া। ফুলির মা কয়,
– কান্দন থামা, কথা কইতে দে আলেয়া।
আলেয়ার হয়ে তার পক্ষে সেদিনের সেই ঘটনা বর্ণনা করতে কম বেশী সবই আরম্ভ করলো । হৈচৈ ডামাডোলে সবার কথাই বোঝার চেষ্টা করলো মোমেন।
-তোমার বউ তোমার মুখের দিকে, পোলা মাইয়্যার মুখের দিকে তাকাইয়া এমনই একখান কাম করছে । তুমি তো সারা বছর কাম করতাছো, এখন তো ইচ্ছা কইরা বইয়া বইয়া থাকো নাই। কামকাইজ নাই। পয়সাপাতি নাই । হ্যায় কি করবো হাতপা গুটাইয়া বইয়া থকবো কেমতে? তাই ওর নিজের চুল বেইচ্চা হেই টাকায় বাজার কইরা তোমাগো খাওয়াইছে। হ্যায় ,সে অন্যায় করছে কি করবা ? যেই অন্যায় করলে মানুষ বাঁচে হেইডা আর অন্যায় থাকে না।
মোমেনের মুখে ভাষা নেই। চোখ দুটো ছলছল! অক্ষমতার আঁচে শরীর মন জ্বলছে। মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো মোমেন।
Facebook Comments Sync