বড়দা সাঈফ  মীজানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি / শারমিনা পারভিন

বড়দা সাঈফ  মীজানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি / শারমিনা পারভিন

 

আমায় গেঁথে  দাও না মাগো

একটা পলাশ ফুলের  মালা

আমি জনম জনম রাখবো ধরে 

ভাই  হারানোর  জ্বালা।

 

আজ ৫ মে। দিনটি অন্যান্য  যেকোনো দিনের মতোই একটি সাধারণ দিন। কিন্তু  আমাদের  জীবনে ভাই হারানো  ভাই বোনদের, কাছে, সন্তান  হারানো মা বাবার কাছে,বড়ই বেদনা বিধুর, বড্ড কষ্টের, সীমাহীন  যন্ত্রণার দিন! 

এই দিনে আমাদের  বড়দা, আমাদের  পরিবারের  সবচেয়ে বড় ভাই,,পিরোজপুরে ম্যাজিষ্টেট থাকা অবস্থায় নির্মমভাবে শহিদ  হন।

 

বড়দা কখনো  আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট,  কখনো অস্পষ্ট ,  ধোঁয়াটে। আবার কখনো  অতি উজ্বল।

কারণ  যখন বড়দাকে বাধ্য করা হয়েছিলো, আমাদের  থেকে অনেক দূরে  চলে যেতে, তখন আমি নিতান্তই ছোট। 

আমার কাছে আমার বড়দা মধ্য  আকাশের  ধ্রুবতারা।

 

তবে মাঝে মাঝেই  কিছু  স্মৃতি  তাড়িয়ে  নিয়ে  বেড়ায়, কষ্ট  দেয়। বড়দার জন্য  কষ্ট  হয়, চিৎকার  করে কাঁদতে  ইচ্ছে  হয়!  কেন আমার ভাইটা শহিদ হল? খুব   কি দরকার ছিল?
আবার মাঝে মাঝে  মনে হয়, এই দেশ, এই পতাকায় আমার ভাইয়ের  রক্ত মিশে আছে। তাইতো আজ আমরা স্বাধীন ভাবে শ্বাস  নিতে পারছি।
এই পতাকা আমার ভাইয়ের মতো  লক্ষ শহীদের রক্তে  রঞ্জিত হয়ে হয়েছে এতটা বর্ণীল।

যতদূর  মনে পড়ে,দাদা ছিলেন যুগের চেয়ে আধুনিক।  দাদা ছিলেন স্মার্ট,  সুদর্শন, লম্বা ছিপছিপে।
যে পোশাকই পরতেন,  দাদাকে মানিয়ে যেতো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দাদা পোশাক পরতেন।
দাদার ঠোঁটের  পাশে ছিল  একটা আঁচিল। যা দাদার মুখায়বকে করেছিলো  দৃষ্টিনন্দন।
সাটের হাতায় কাবলিন,পাঞ্জাবি, চোস্ত পাজামা,পাঞ্জাবিতেবাড়ব সোনার বোতামপড়তেন।
সব ধরনের  ফ্যাসানেবল কাপড় দাদার প্রিয় ছিলো। যেটা সেই  আমলে নড়াইলের মতো জায়গায়  বিরল ছিলো।
বড়দা খুব  ভালো  লনটেনিস  খেলতেন। ছুটি ছাটায় যখন নড়াইল  আসতেন এখানকার এসডিও সাহেব, ম্যাজিষ্ট্রেটদের সাথে ডা বাংলায় লনটেনিস  খেলতেন।
ঈদের  দিন  আমরা দুবোন, তিন  ভাই, আব্বাসহ নদীতে  গোসল করতে যেতাম।
বড়দা গা ঘঁষে ঘঁষে  গোসল  করিয়ে দিতেন।
ছোটবেলায় বড়দা যখন বাড়িতে  আসতেন, আমাদের  দু ‘বোনকে নিয়ে  পাখী শিকারে যেতেন। আমরা দু বোন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা  করতাম  কখন পাখিটা পড়বে!
আমি যখন জন্মাই বড়দা তখন পাকিস্তানে। বাড়িতে  আসার পর সবাই  যখন বলেছিল, দেখ,দুলু তোর একটা কালিচরণ বোন হয়েছে,  তখন দাদা  নাকি রেগে গিয়ে  বলেছিলেন, ও আমার ফুটফুটে  বোন। আর আমার ঘন ঘন ছবি তুলতেন।
বড়দা আমার নাম রেখেছিলেন  কুড়ি। কবে কবে পপীর সাথে মিলিয়ে হ্যাপি হয়ে গিয়েছি।

বড়দা যখন পাকিস্তানে টেনিং করছিলেন, তখন আমাদের  দু ‘বোনের জন্য  জামার কাপড় নিয়ে আসতেন। যেগুলো তখন খুবই  মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য  ছিল।
যেমন, মখমল,সাটিন, ভেলভেট।
একবার দাদা  পাকিস্তান  থেকে এক ঝুড়ি আম নিয়ে  এসেছিলেন। আম খাবার পর দাদা পা দিয়ে  আমের আঁটি পুঁতে দিয়েছিলেন। সেই  লেংড়া আমগাছটা আমাদের  পুকুর পাড়ে আজ ও  দাঁড়িয়ে  আছে,  প্রচুর আম দিচ্ছে।
শুধু নেই  আমার বড়দা!
বড়দা শহিদ  হবার পর মা আমগাছটায় পরম আদরে হাত দিয়ে  কাঁদতেন আর বলতেন, আমার দুলুর লাগানো গাছ। আমার দুলু পা দিয়ে  পুঁতেছিল। কতবার যে মা বলেছেন, হয়তো হাজারবার,কোটিবার।

বড়দার সাথে একবার সুন্দরবন গিয়েছিলাম স্পীডবোটে। শিবশা নদী পার হবার সময় মার বেশ ঠান্ডা  লাগছিল। দাদা বার বারই বলছিলেন, মার শীতের কাপড় আনা হয় নি কেন? অথচ তখন ছিলো গরমকাল।
পরিবার,আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু – বান্ধবের উপরে দাদার ছিল  অপরিসীম মায়া।সবার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াতেন। তাই  বেোধহয় সবাইকে  ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি  চলে গেলেন।

মেজদা  রাজনীতি করতেন। আমাদের  বাড়িটাই ছিল  রাজনৈতিক  পরিমন্ডলে  পরিবেষ্টিত। মেজদা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে  রাত করে বাড়ি ফিরতেন। বাসার সবাই  চিন্তা  করতো। একবার  বড়দা রাগ করে দরজা বন্ধ  করে দিয়ে  বলেছিলেন, খোকন তোর বাড়ি আসতে হবে না।বাইরে থাক।
মেজদা  কালিদাস ট্যাংকের পাড়ে গিয়ে  বসেছিলেন।
অনেক রাত, বড়দার ঘুম আসে না,পরে  খুঁজতে খুঁজতে  মেজদাকে  ওখানে পেয়ে যান। বড়দা বলেন, খোকন  বাড়ি চল। দুই ভাই গলাগলি ধরে  বাড়ি চলে আসেন। বড়দার শাসনের মধ্যে  ছিল  এক অপত্য স্নেহ।

বড়দা যখন খুলনায় ম্যাজিষ্টেট তখন দাদার বাসায় গিয়ে, দাদাকে বলেছিলাম, দাদা সিনেমা  দেখব।
সেই  সিনেমা দেখার  আজন্ম  নেশা। দাদা পিয়নকে সাথে দিয়ে  সিনেমা দেখতে পাঠান। গিয়ে দেখি, উর্দূ ছবি, বহুরানী চলছে। আমিতো উর্দু কিছুই  বুঝি না।কান্নাকাটি।  বাধ্য হয়ে পরের শোতে আবার আমাকে নিয়ে  যায়। ছবির নাম অবাঞ্ছিত। সুজাতা আজিম।
সুজাতা নদীর চরে পড়ে আছে, আজিম ডাকছে,রোকেয়া, রোকেয়া। আকাশ বাতাস কাঁদছে। সেই  সাথে আমিও।
এদিকে দুপুর  দুইটায় গিয়ে যখন রাত নয়টায়  বাসায় না ফিরি তখন খোঁজ  খোঁজ পড়ে যায়। ঠিক  সেই  সময়ে ঘরে ফিরি। মনে আছে দাদা পিয়নটাকে খুব  বকাবকি করেছিলেন।

বড়দা যখন সি,এস,এস পরীক্ষা  দিয়ে  ম্যাজিষ্টেট হলেন, তখন মানুষ  বড়দাকে দেখতে আমাদের বাড়ি আসতো।আফসার সাহেবের ছেলে ডেপুটি হয়েছে।
আর একবার দাদা যখন পিরোজপুরেে ম্যাজিষ্ট্রেট আমি আর মা বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি তখন বেশ ছোট। রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। সকালে দাদা বিছানা ভিজা দেখে বলেছিলেন, কিভাবে বিছানা ভিজলো?মা হেসে বলেছিলেন,পানি পড়েছে। বড়দা,মা দুজনেই  হেসেছিলেন। আমি মার মুখ চেপে ধরেছিলাম।
আমরা যখন চলে আসি, দাদা লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে  ছিলেন। আমাদের  যতদূর দেখা যায় হাত নাড়াছিলেন।
আজও আমার চোখে ভাসে।

বড়দা সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। অসম্ভব  মেধাবী, অনলবর্ষী  বক্তা। কবিতা লিখতেন, আবৃত্তি  করতেন, নাটক লিখতেন, নাটক মঞ্চস্থ  করতেন। দাদা যখন পাকিস্তানি বাহিনীর  হাতে ধরা পড়েন তখনও দাদা লিখছিলেনবঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ক্রান্তিকালের আকাশ।
এজন্যই  বোধহয়  বড়দার প্রতি অত্যাচার আরও নারকীয়  হয়েছিল।
ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের  আসর বসতো।

একবার আমি ঢাকা বারে এডভোকেটশিপ পরীক্ষা  দিতে  গিয়েছি। ওখানে এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ। আমার বাড়ি নড়াইল  শুনে বললেন, আমি নড়াইলের এক সাঈফ মীজানকে চিনতাম। যিনি পিরোজপুরে ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন, একাওর সালে শহিদ হন।
উনি গল্প করছিলেন, একবার উনি লঞ্চে করে পিরোজপুর  যাচ্ছেন। তখন ১৯৭০সাল। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করেছে। তখনকার সময়ে উনি দেখেন একজন সুদশন,স্মার্ট  তরুণ ডেকে দাড়িয়ে  বলছে, ‘দেশ হয়তো একদিন  স্বাধীন  হবে, সেদিন  হয়তো আমরা থাকবো না।’ আর মানুষ  মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে।
পরে উনি জানতে পারেন, বড়দা পিরোজপুরের  ডেপুটি ম্যাজিষ্টেট।
এত বছর পর ও উনি দাদাকে ভোলেননি।
এই কথাটি বড়দা বার বারই  বলতেন। বড়দার বন্ধু  সাহিতিক,শাহেদ আলী ভাই প্রায়ই বলতেন, মীজান বলতো দেখ শাহেদ,দেশ একদিন  স্বাধীন  হবে,কিন্তু  সেদিন  আমরা থাকবো না।
তাই  হলো।  দাদা চলে গেলেন। জীবন  দিলেন। , দেশ স্বাধীন  আর দাদার দেখা হলো না। দাদার কথাই সত্যি  হলো।
কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  কনভোকেশনে মোনায়েম খান এসেছিলেন। বড়দা মোনায়েম খানের গাড়িতে  ঢিল ছুঁড়েছিলেন। তদানীন্তন  সমস্ত পত্র- পএিকায় দাদার ঢিল ছোঁড়ার ছবিটা বেরিয়েছিল।
ফলে দাদাকে সি,এস,এস পরীক্ষায়  পুলিশ  ভেরিফিকেশনে আটকে দেয়া হয়েছিল। দাদাকে জয়েন করতে দেয়া হয়নি। পরের  বছর দাদা জয়েন করেন ইপিসিএসএ।
দাদা যখন ব্যংকের চাকরিতে  জয়েন করেছিলেন,তখন শুধু বাংলায়  স্বাক্ষর করতে না দেয়ায় বড়দা ঘৃণাভরে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন।

ছোটবেলা থেকে বড়দা ছিলেন তুখোড় বক্তা। চৌকস।একবার বঙ্গবন্ধু  নড়াইলের নারায়নপুরে একটি সভা করেছিলেন  আব্বার  সভাপতিত্বে। বড়দা তখন ক্লাস  নাইনের ছাত্র।
বড়দা ওই সভায় বক্তৃতা  করেছিলেন। অতটুকু কিশোরের বক্তৃতা  শুনে বঙ্গবন্ধু  মুগ্ধ  হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আব্বাকে বলেছিলেন, আফসার ভাই  দেখবেন, আপনার এই ছেলে একদিন  অনেক  বড় হবে।ওইবার বঙ্গবন্ধু  আমাদের  বাড়িতে  রাত্রিযাপন করেছিলেন।
বড়দা আমৃত্যু  বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারন করেছিলেন।
ছাত্র রাজনীতির  সাথে ছিলেন একান্ত ঘনিষ্ঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুর  এ জি এস, ফজলুল  হক হলের সাহিত্য  সম্পাদক, পত্রিকা সম্পাদক  ছিলেন।
আমৃত্যু  আওয়ামী  রাজনীতিকে ধ্যান জ্ঞান করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর  কথাই ঠিক  হয়েছে। বড়দা অনেক বড় হয়েছেন, শহিদ হয়েছেন। দেশকে দিয়ে  গেছেন অনেক কিছু। যার সুফল ভোগ করছি আমরা সবাই। কিন্তু  আমরা কি পেয়েছি!
বড়দার বন্ধুরা স্ব স্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।
আজ বড়দা বেঁচে  থাকলে হয়তো মন্ত্রী  হতেন, কুটনীতিক হতেন, উপদেষ্টা  হতেন, সেটাই হয়তো ভাল ছিলো। পরিবারের জন্য  ভালো হতো, দেশের জন্য  ভালো হতো, এলাকার মানুষের  জন্য  ভালো হতো, সুনাম হতো। সবাই মনে রাখতো।
শহিদকে কেউ কি মনে রাখে?
আজ শুনতে হয় শহিদ,টহিদ,মুক্তিযুদ্ধ, টুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা,টাধীনতা,গন্ডগোলের বছর।
হায়রে,বাঙালি!
এজন্যই  কি বড়দা জীবন দিয়েছিলেন!
তিরিশ লাখ শহিদের  কি অপরাধ!
বড়দা জীবনে বহুবার কারাবরণ করেছেন।
অত্যন্ত ষ্স্পট কথা বলতেন। অসীম সাহসী,অকুতোভয়।
দেশের জন্য এমন কিছু  নাই, যা উনি করতে পারতেন না।
দেশকে মা মনে করতেন।
তাইতো উনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, উনি দেশ মাতৃকার  শ্রেষ্ঠ সন্তান।

১৯৭১সালের ২২ মার্চ।
বড়দা নড়াইল  এসেছিলেন। মনে আছে খোলা ছাদে আব্বা,দাদাদের বন্ধুরা সবাই  মিলে রাজনীতির আলোচনা চলছে।
সবাই  উত্তেজিত।
ইয়াহিয়া  খান  কি গড়ি ছাড়বেন?
ভুট্টো  সাহেব কি আলোচনায় বসবেন?
সবার মনে একই ভয়। এবার কি হবে? রেডিও ঘিরে  সবাই  বসে আছে।
আমি তখন খুব  ছোট। তবে যেহেতু ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক  পরিবারে মানুষ  হয়েছি,  একারণে এসব কথায় অভ্যস্ত ছিলাম।
শেখ সাহেব কি ছাড় দেবেন?
নাকি আলোচনায় বসবেন?
সেই  ছোটবেলায় পরিবার থেকে বঙ্গবন্ধু  নামক মহামানবের গল্প শুনে বড় হয়েছি।
পরের দিন  বড়দা আমাকে যশোরে আপার বাসায় রেখে,পিরোজপুর চলে যান।
২৫ মার্চ। ভয়াল রাত। বঙ্গবন্ধু  স্বাধীনতার ডাক দিলেন। শুরু হলো নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু  হলো। আমরা বাড়ি ছাড়লাম। এক কাপড়ে,সহায় সম্বলহীন। আমার ভাগ্নে সৈকত তখন আপার পেটে। আরেক ভাগ্নে কল্লোল খুব  ছোট। আমি ও ছোট।এক ঘন্টার মধ্যে  রাজা থেকে ফকির। রাস্তায়  নেমে গেলাম আমরা।
খাবার নেই, সবার পেটে খিদে। দুধের জন্য  কল্লোল সারাদিন ট্যা ট্যা করে কাঁদতো। দাদারা মুক্তিযুদ্ধে।আব্বার  খোঁজ নেই। বড়দার খোঁজ নেই।
ছোট আপু মামাবাড়িতে। আমাদের বাড়ি পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে  দেয়া হয়েছে। পুড়ছে পুড়ছে আফসার সাহেবের বাড়ি, পুড়ছে।
পালালাম হবখালী নামক  গ্রামে। সাথে ছিলমার আর আপার কিছু  গহনা। যাদের আশয়ে ছিলাম,রক্ষক ভক্ষক হয়ে গেল। মাটির  নিচে পোঁতা গহনা আর পাওয়া গেল না।
কচু শাক, ছেচি শাক খেয়ে  বেঁচে  থাকা। অথচ আমরা কত স্বচ্ছল পরিবারে মানুষ  হয়েছি।
একটু পরিস্থিতি  নরম্যাল হলে মা আমাকে সাথে করে নিয়ে  নড়াইল  চলে আসেন।
ততদিনে রাজাকাররা আমাদের বাড়ি দখল করে নিয়েছে। মা অনুরোধ করে  কোন রকমে একটা ঘর চেয়ে নেন।নিজ ভূমে পরবাস। হায়রে জীবন!
পোড়াবাড়ি। চারিদিকে  কাচ আর কাচ। দরজা জানালা নাই। খা খা করছে।খাবার নেই। কোন রকমে চটা দিয়ে  ঘিরে  তার মধ্যে  আমাদের সৈকত হলো। সারা রাত পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকাররা কান পেতে ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের  বড় কষ্টের জায়গা। ছোটবেলার থেকে অনেক কষ্টের অভিজ্ঞতা  রয়েছে আমার। বার বারই লেখার চেষ্টা  করেছি। পারিনি। হয়তো একদিন  পারবো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন  বড়দার কোন খোঁজ  ছিল না। অনেকে বলতেন, দুলুর কোন খোঁজ জানো?
তারা হয়তো উদ্দেশ্যমূলকভাবে জিজ্ঞাসা করতেন।হয়তো খবরটা জানতেন।
মা বলতেন, কারো খবরই জানি না,মোহন খোকন দুলু  ওদের আব্বার কোন খবর জানি না।
কি অসহনীয়  সেই  দিনগুলো।
তারপর এলো সেই  মাহেন্দ্রক্ষণ।
দেশ স্বাধীন  হলো,সবাই  একে একে ফিরে  আসছে। ছোড়দা,মেজদা,আব্বা, ভাইয়া,পরিচিত অপরিচিত সবাই  ফিরে  এলো। নড়াইলে যারা যুদ্ধে  গেল, তারাও ফিরে  এলো।
ফিরে  এলেন না শুধু  আমার বড়দা।
আমার মায়ের খোলা ছাদের উপর  দাঁড়িয়ে  শুধু  অপেক্ষা  আর অপেক্ষা।
সেই৷ রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে
এক মধ্যবয়সী নারী এখনও রয়েছে হাত বাড়িয়ে
খোকা ফিরবে? নাকি ফিরবে না?
দুলু ফিরবে।আমার মা নিশ্চিত।
তাকাতে তাকাতে চোখ হয়েছে ধূসর।

দিনটা ছিল  ১৯৭১ সালের ৫মে। বড়দা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছিলেন আগে থেকেই। গোপনে গোপনে মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করে যাচ্ছিলেন।রাজনৈতিক  যোগাযোগ  রাখছিলেন। যেটা এদেশীয় চররা পাকিস্তানিদের কাছে ঠিকমতো  পৌঁছে  দিচ্ছিল।
টেজারীর দায়িত্বে  ছিলেন বড়দা।সমস্ত  অস্ত্র, গোলা বারুদ  মুক্তিযেদ্ধাদের  হাতে তুলে  দেন।
দাদা পালিয়ে  যেতে পারতেন।যাননি। রয়ে গেলেন।
ধরা পড়লেন। ভয় কি দাদা জানতেন না। দাদা কখনও কাপুরষ  ছিলেন না।
দাদাকে পেয়ে পাকিস্তানিরা নারকীয়  উল্লাসে  মেতে উঠলো। পৈশাচিকতার চরমে উঠলো তাদের তান্ডব। গাড়ির  চাকার সাথে দাদার দেহটাকে বেধেে প্রদক্ষিণ  করা হলো সারা শহর।
তবুও হায়েনাদের হিংস্রতা কমেনি।
নিয়ে যাওয়া হলো বলেশ্বর নদীর পাড়ে।
দেখো মুক্তি  দেশ স্বাধীন  চায়।
মৃতপ্রায় দাদাকে ক্ষত বিক্ষত করা হলো বেয়নেট  দিয়ে। ওরা ব্ল্ল,বল,পাকিস্তান  জিন্দাবাদ। দাদা বললেন,জয় বাংলা। বলেশ্বর নদীতে ফেলে দেওয়া হলো দাদার  লাশ।
স্রোতে ভেসে গেলেন দাদা।নাকি কুমিরের  পেটে গেলেন দাদা! 

বড়দা নিখোঁজ। বাংলাদের কোথাও দাদার কবর হোল না।হায়রে! এজন্য কি বড়দা দেশকে  ভালবেসেছিলেন? যবনিকাপাত হলো দেশের এক সূর্য  সন্তানের।

আমার মা স্বাধীনতার পর চৌএিশ বছর বেঁচে  ছিলেন।
উনি বিশ্বাস  করতেন, তার দুলু বেঁচে  আছে। মাথায় গুলি খেয়ে কিছু  মনে করতে পারছে না।
ভারত  বাংলাদেশ  কোথাও মা দাদাকে খুঁজতে বাদ দেননি।
কোন পীর,ফকির যে যা বলেছে তাই  করেছেন।
পাবনায় একজন পাগল মুক্তিযোদ্ধ্ ঘুরছে।
সে কি তার দুলু?
মৃত্যুর  আগে মা বলে গিয়েছেন, যদি দুলু ফিরে  আসে তোমরা তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত কোর না।
হায়রে মার অন্ধ বিশ্বাস!
বাড়িতে ভাত রাঁধা হয়নি।মা কোথায়? ফুরফুরার পীর সাহেবের  কাছে।

বড়দা চলে গেছেন, রেখে গেছেন,অজস্র কান্না। একটা পরিবারের  সবচেয়ে বড় সন্তান  যদি এভাবে চলে যায় কান্না ছাড়া তাহলে আর কি থাকে।
আমরা সবাই  ছোট। সেই  দুঃসময়ে ভাইয়া আমাদের  জন্য  হাত প্রসারিত করেছিলেন। আজ আমরা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে  সবাই  বড় হয়েছি।
তুমি চাইতে আমরা মানুষ  হই, হয়েছি তো দাদা।
তুমি কি দেখতে পাচ্ছেো বড়দা?
বড়দা তুমি হারিয়ে গেছো, দিয়ে  গেছো একটা দেশ, পতাকা, মানচিত্রে  আমাদের  স্থান। যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন  তুমি দেখতে।
তুমিতো বলতে,দেশ হয়তো একদিন  স্বাধীন  হবে,সেদিন  হয়তো আমি থাকবো না।
হয়তো না বড়দা।সত্যিই তুমি নাই।
আমরা আছি তোমাকে বুকে ধারণ করে।

এখনও হায়েনারা ওত পেতে থাকে। বুলি পালটিয়ে,ভোল পালটিয়ে, পোশাক পালটিয়ে, রং পালটিয়ে।
আমরা কি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছি!
তিরিশ  লাখ  শহিদের  রক্তের বিনিময়  এমন স্বাধীনতা চেয়েছিলো!
জানি তুমি ভালো  আছো বড়দা।তুমি ভালো না থেকে পারো না।
কারণ তুমি যে দেশ মাতৃকার  সূর্য সন্তান।

তোমাদের মৃত্যু  নেই। তোমরা অবিনশ্বর।

উদয়ের  পথে শুনি কার বাণী ,ভয় নাই, ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ,যে করিবে দান
ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।
ঘুমাও বড়দা, শান্তিতে  ঘুমাও। কেউ তোমাকে জাগাবে না।

মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা -  শারমিনা পারভিন হ্যাপি