বসন্তের একদিন/ রোকেয়া ইসলাম

বসন্তের একদিন

বসন্তের একদিন

ঈদের গল্প

বসন্তের একদিন/ রোকেয়া ইসলাম

 

কাজল যখন খালেক পেট্রোল পাম্পে পৌঁছালো তখন সকাল পৌনে নটা,  ততোক্ষণে  গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।  জায়গাটা খুঁজতে দশ মিনিট, আর দশ মিনিট মোড় নেবার জন্য ব্যয় হলো ।

কুড়ি মিনিট আর যানজটে পঁচিশ মিনিট,  মোট পয়তাল্লিশ মিনিটের ধাক্কা।

পয়তাল্লিশ মিনিটে গাড়ি খুব বেশি দূর যেতে পারেনি,  এই বাহনটা দ্রুত চালিয়ে আর যাত্রী ভর্তি গাড়িটা ধীর গতিতে চললে ধরাটা কঠিন নয়,  সমস্যা হলো কঠিন যানজটের কবলে পড়লে সামনের গাড়ির যাত্রীরা খুব বিরক্ত হবে,  এক জ্যামেই যদি পনর মিনিট কেটে যায়  তাহলেই তো খবর হয়ে যাবে! দুটো বড়সড় জ্যামে আঁটকে যাবার সম্ভাবনা আছে।

থাক ওরা চলে যাক।  

ফেসবুক গ্রুপ থেকে ওরা যাচ্ছে টাংগাইলে বসন্ত উৎসবে।

গ্রুপে ওকে জয়েন করায় শাহিদা, তবে গ্রুপের এডমিন ও নয়,। গ্রুপের নাম ” বসন্ত উৎসব “

টুং শব্দে গ্রুপে ঢুকে বুঝতে পারে  শুরু হয়ে গেছে বসন্ত উৎসব। কে কি শাড়ি পরবে তার সাথে অলংকার কি হবে সব আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ নয়,  শাড়ি গয়নার ছবিও পাঠাচ্ছে কেউ,  পুরুষরাও কম যায় না,  তারাও পাঞ্জাবি কি রঙের হবে সাথে কোটি কেমন কাটের কোন রঙের সব আলোচনা হচ্ছে । মাঝে মাঝে কেউ কাউকে মজার আক্রমণ করছে,  সবাই তাকে ঠেসে দিচ্ছে।  সবমিলিয়ে দারুণ! সারাদিন রাতদুপুরেও টুংটাং চলতেই থাকে।

মানুষ কত আনন্দ করতে পারে এই গ্রুপে জয়েন না করলে বুঝতে পারতো না!

রাজধানীর পল্লবহীন কুহুহীন বসন্ত থেকে পল্লবময় কুহুময় সজীব বসন্তের ছোঁয়া নিতেই ওর বুকের ভেতরেও নিটোল ঝর্ণা ধারার শব্দ শুনেছিল, শাহিদার আগ্রহটাও যোগ করে গুণফল গুণছিল কাজল।

এখন ভগ্নাংশ গুণতে থাকে কাজল,

গ্রুপ ট্রুপ বাদ। মাথা গরম, মেজাজ খারাপ! গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতেই সিদ্ধান্ত নেয় হাতে আজ কোন কাজ নেই সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাবে।

কল্যাণপুর থেকে গাড়িটা আগারগাঁর দিকে মোড় নিতেই একঝাক বাসন্তীর মুখামুখি হয়।

লাল পাড় হলুদ শাড়ি চুলে লাল ফুল গোঁজা,  কপালে টিপ, টুকটুকে লিপস্টিক,  দুহাত ভর্তি লাল চুড়ি দল বেঁধে চলছে মিরপুর রোড অভিমুখে,  পেছনে বসন্ত তরুণেরা । হলুদ পাঞ্জাবি সাদা পাজামা।

গাড়ি একটু এগুতেই  এগুতেই ঝাঁকে ঝাঁকে হলুদ আর লালের সমারোহে   বুঝতে পারে সারা শহর জুড়ে নেমে এসেছে বসন্ত।

রেডিও অফিস ছাড়াতে ছাড়াতেই কাজলের বুকের ভেতর ডেকে ওঠে কুহু,  একটু থেমে আবার কুহু ।

বসন্ত উৎসব গ্রুপের সাথে যোগ দিয়েছিল তো ওর বুকের ভেতরের এক অতৃপ্ত কুহুর জন্য।

যানজট সব ভেস্তে দিলো, মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিট ওকে পৌঁছাতে দিলো না। সব রাগ গিয়ে পড়ে শালার যানজটের উপর।

ঢাকায় তো শুনতে পায় না বাউরি বসন্তের কোকিলের ডাক। কতদিন শুনে না কোকিলে কুহু ডাক।

কত বসন্ত উৎসব হৈ হৈ করে পালন করেছে তবুও মাতাল বসন্তে হৃদয় তোলপাড় করে ডাক কুহুকেকা শোনা হয়নি।

এই যান্ত্রিক ইট লোহার ধাতব শহরে কি প্রাণময় কোকিল বাস করে,  ওরা কী এমন আকুল হয়ে ডাকে সঙ্গিনীকে! হৃদয় ছেঁড়া  সুগভীর প্রেম  দুরন্ত   আকুলতা প্রেয়সীকে কাছে পাবার।

এমনি দুর্দান্ত আকুলতা নিয়ে কাজলও তো একদিন ডেকেছিল পলিনকে।

পলিন ফেরাতে পারেনি সেই হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ করা ডাক, এসেছিল।

কি অথৈ সুখের সময় ওদের,  দিনরাত এক করে ধরা থাকতো সময়।

হাত ফসকে উড়ে গেল সুখ প্রজাপতি ভুল চিকিৎসায়।

পলিনের গর্ভে ছিল চারমাসের সন্তান।

একজোড়া বসন্তজন  রাস্তা পার হতে গিয়ে অসাবধানে থমকে দাঁড়ায় গাড়ির সামনে। ড্রাইভার হার্ড ব্রেক কষে, প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে যেন মরলে একসাথে মরবে।

ড্রাইভার খিস্তি খেউড় করতে থাকে।

মনটা খিঁচড়ে যায় কাজলের।

যাওয়া তো হলোই না এখন আবার মানুষ মরা দেখতে হতো।

গাড়ি রাওয়া ক্লাবের সামনে চলে আসে। পুরো রাস্তা জুড়ে নেমে এসেছে বসন্ত। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে কাজল,  সাথে সাথে ওর ফোন বেজে ওঠে। শাহিদা।

ওর মনটা খারাপ, কাজল দলে নেই,  শাহিদার কন্ঠে কিছুটা বিচলিত হয় কাজল। মেয়েটা ওর সাথে বসন্তের একটা দিন কাটাতে চাইছে এটা কি খুব বেশি চাওয়া।

শাহিদা তো ওর ভাল চায়। কিভাবে একটু স্বস্তি পাবে, পুরোনো ভুলে নতুন করে পথ চলতে বলে।

পুরোনো ভোলা কি এতো সহজ?  কাজল নিজেও তো অনেক চেষ্টা করছে,  পারছে কই!

গলফ ক্লাবের সামনে আসতেই আবার ফোন করে শাহিদা।

এখন বারবার ফোন করছো অথচ গাড়িটা একটু থামিয়ে রাখলে কি হতো?  ভেতরটা ফেঁপে ওঠে।

ওকে কড়া কথা শোনাবার জন্য ফোন তুলতে তুলতেই কেটে যায় কল।

কাজল কী শাহিদাকে কড়া কথা বলতে পারে? পারে কী যখন তখন বকাঝকা করতে?  কী অধিকার আছে, কে দিয়েছে ওকে এই অধিকার? 

প্রশ্নগুলো ফালাফালা করে কাজলকে।

প্রশ্নের উত্তরটা উঁকিঝুঁকি দিতেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে,  ও যাবে টাংগাইলের বসন্ত উৎসবে।

সিদ্ধান্ত পাক্কা করার সাথে সাথে শাহিদার ফোন । ওদের দল স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যাল ফ্যাক্টরিতে চা বিরতিতে।

খুব মন খারাপ করে আছে,  ওখান থেকে ফেরার বাস ধরে ফিরে আসবে চুপিচুপি।

শাহিদার কথা শুনে হো হো করে হেসে ফেলে।

ওকে কি বলবে নাহিদের সিদ্ধান্ত।

ওকে বসন্ত উৎসবে অংশ নিতে অনুরোধ করে।

উবারের ভাড়া মিটিয়ে গেট দিয়ে ঢুকে সোজা গ্যারেজে গিয়ে গাড়ি বের করে রাস্তায় আসতেই শাহিদার ফোন। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বুঝতে পারে সকলের চোখ এড়িয়ে কাঁদছে ও।

সোল পার্কের সামনে গাড়ি  পার্ক করে ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারে বসন্তের জমজমাট আয়োজন। হতেই হবে এটার আয়োজক কবি মাহমুদ কামাল।

শুনেছে তার কথা শাহিদার কাছে,  উনি নাকি বিশাল কবিতা উৎসবের আয়োজন করে! সেটার মত আয়োজন শাহিদা কখনও দেখেনি, শুনেওনি।

একটু দূরে গাছের তলে শাহিদা বসে আছে  ভাপা পিঠার প্লেট হাতে ধরে । খাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে আরো দূরে।  পানির বোতল নিয়ে  ওর পাশে দাঁড়িয়ে পানির বোতল এগিয়ে দিতেই বিস্ময়ে লাফিয়ে ওঠে,  সবার কান বাঁচিয়ে চিৎকারও দেয়।

কাজল হাত ধরতেই পিঠার প্লেট পড়ে যায়! 

শাহিদা পরিচয় করিয়ে দেয় কবি মাহমুদ কামালের সাথে। সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক  পরেছে মিষ্টি কমলা রঙের পাঞ্জাবি। টকটকে ফর্সা রঙের মানুষটির স্মিত হাসি  বয়সটা লুকিয়ে ফেলে অনেকখানি।

তিনি আজ খুবই ব্যস্ত,  চারদিকে ঘুরছে দৃষ্টি আর তিনি ছুটছেন আটদিকে।

মঞ্চে কখনও কবিতা কখনও গান কখনো বসন্ত আলাপন।

টাংগাইলের বসন্ত বরণে রাজধানী থেকে এক বাস বসন্ত যোগ হয়েছে, তারা কখনো মঞ্চে কবিতায় ঢেলে দিচ্ছে নিজেকে, কখনো সুরে নিবেদন করছে প্রাণ,  কখনো ধুম আড্ডায় ভুলে যায় চারপাশ।

হাসি আর কলস্বরের সাথে পাল্লা দিয়ে মোবাইলে ক্লিক ক্লিক। কাজল পুকুরপাড়ের বাঁধানো ঘাটলায় বসে।

হঠাৎ ওর বুকের ভেতর ডেকে ওঠে” কুহু “

বসন্তের বিরহী কোকিল এমন নিবিড় করে সুর তোলে । কাজল পুকুরপাড় ধরে হাঁটতে থাকে বন পথে।

আজ বসন্তের প্রথমদিন কোকিল তো ডাকবেই, ডালপালায় প্রাচুর্যে ঘুঘুস্বর শুনতে শুনতে হাঁটে কাজল।

কত অচেনা পাখির অজানা সুর ওকে ডেকে যায়, নামহারা ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে, আকুল করা সবুজ হাতছানি দেয়। কান উঁচিয়ে হাঁটতে থাকে কোকিলের কুহু ধ্বনির জন্য।

খা খা দুপুরে ঘুঘুস্বরও ওর কান স্পর্শ করে না, শুধু শুকনো পাতা বাতাসে ওড়ে মৃদুস্বরে, কাছের কয়েকটি ন্যাড়া গাছ সবুজ পাতা বের ঈঙ্গিত দিচ্ছে

কোকিলের ডাক না শুনলে কিসের বসন্ত  আজ?

শাহিদা সামনে এসে দাঁড়ায়,  ওকে খুঁজে খুঁজে হয়রান,  অচেনা জায়গায় কই গেল কাজল।

গাড়িতে ফিরছিল।

গাজিপুর পার হতেই চায়ের তেষ্টা চাগিয়ে ওঠে। বড় রাস্তা ছাড়িয়ে

ভীড় এড়িয়ে  দূরের টংঘরে গিয়ে চায়ের কথা বলে সামনের বেঞ্চে বসে থাকে।

শাহিদা পাশের দোকান থেকে গরমাগরম পেয়াজু নিয়ে আসে।

দীর্ঘকাল খোলা দোকানের খাবার খায় না কাজল,  তাকিয়ে বুঝতে পারে স্বাস্থ্যসম্মতভাবেই তৈরি হচ্ছে খাবারগুলো।

দোকানির হাত থেকে চায়ের কাপ হাতে নিতেই কাজলে বুকের ভেতর কোকিল ডেকে ওঠে, সাথে সাথে কানে আসে গানের সুর।

দোকানিকে  জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে এক কিশোর মনের আনন্দে গাইছে পাশের দু’দোকান পরে।

কাজলের আগ্রহে ডেকে আনে গাতককে।

স্ট্রিটলাইটের আলোর আভা পড়ছে ওর মুখে,  কি মায়াময় লাগছে গাতককে!

ছেলেটির মা-বাবা নেই,  ও সারাদিন মুটের কাজ করে, রাতে নানীর কাছে থাকে। সন্ধ্যা থেকে দোকানের পেছনের গাছের তলে বসে গান গায় যতক্ষণ ওর মন ভাল না হয়। ও বাঁশিও বাজায়।

গাইছে প্রাণখুলে, মনের সকল ঐশ্বর্য মিশে যায় ওর সুরে। 

গান থামিয়ে বাঁশি ঠোঁটে ছোঁয়ায়।

মাটির ভেতর থেকে মায়াবী কলস্বর , সামনের ধান ক্ষেতে অবাধ বাতাসে, দোল খেতে খেতে পল্লবিত বৃক্ষ ছুঁয়ে বাঁশিতে আশ্রয় খোঁজে।

সারাদিন কাজলের মনের আনাচে কানাচে যে কোকিল বাউরি বসন্তের সুর তুলেছে কিশোরটির বাঁশি প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে  সেই অধরা সুর।

 

শাহিদার হাতটা ধরে কাজল, বাঁশির সুর ওঠানামা করছে….

রোকেয়া ইসলাম
রোকেয়া ইসলাম