ব্রেকিং নিউজ – সাহানা খানম শিমু

শাহরিয়ার খালেদ ভীষণ ব্যস্ত, প্রতিনিয়ত তাকে ছুটতে হয়। কখনও উপরওয়ালাদের কাছে কখনও অন্য কোথাও, অন্যরকম কাজে। তাছাড়া মিটিং সিটিং তো আছেই। সারাদিন খবরের পেছনে নিজে ছোটে এবং ছোটায় একদল তরুণ ছেলে মেয়েকে। কারণ একটা উঠতি চ্যানেলের বার্তা প্রধান সে। আজকাল  এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলে টিভি চ্যানেলগুলোতে। কে কাকে কিভাবে টপকে যাবে সেই চেষ্টা। আরেকজনকে টপকাতে হবে এটাই কথা, কাজটা কি অন্যায় হচ্ছে, অন্যজন কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এগুলো নিয়ে ভাববার বা চিন্তা করবার সময় নেই কারো। ইঁদুর দৌড়ে সবই ছুটছে।

কিছুদিন আগেও এতটা অস্থিরতায় ভুগতো না খালেদ। মাস কয়েক আগে গারমেন্টেসে আগুন লাগার ঘটনা অন্য একটা চ্যানেলে সবার আগে স্ক্রলে গিয়েছে। এরপর আগুনের পুরো ঘটনাটি তারা সরাসরি দেখিয়েছে। তারপর আরেকটি ঘটনা খালেদকে আরও অস্থির করে তোলে। আগুনের ঘটনার পরপরই গারমেন্টেস ভবনধ্বস। সাততলা পুরো বিল্ডিংটাই ছিল গারমেন্টেস আর কিছু অফিস। পুরো বিল্ডিংটা অল্প সময়ের মধ্যে ধ্বসে পড়ল, খবরটা অন্য একটা চ্যানেল প্রথমে কভার করেছে। পরে অন্য সব চ্যানেলের সাথে শাহরিয়ার খালেদও প্রচার করেছে, এরপর সরাসরিও দেখিয়েছে, তাতে কি! সবার আগে স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ দিতে পারাটাই আসল যোগ্যতা ভাবছে শাহরিয়ার। কয়েকটা ঘটনা পরপর ঘটে যাওয়াতে কেমন এক অস্থিরতা, চঞ্চলতা অনুভব করছে। চ্যানেলটাকে এগিয়ে নিতে হলে ব্রেকিং নিউজের ব্রেক দিতেই হবে। কিন্তু কি করলে একাজটা করা সম্ভব! ভীষণভাবে ভাবনা তাড়িত শাহরিয়ার খালেদ।

জরুরী সভা ডেকেছে বার্তা প্রধান শাহরিয়ার খালেদ, চ্যানেলের বার্তা বিষয়ক প্রত্যেক সদস্যকে। যারা খবরের যোগান দিচ্ছে, খবরগুলোর মান বিচার করছে, খবরগুলো সমন্বয় করছে এবং খবর পরিবেশন করছে। মোট কথা স্টুডিওর ভেতরে বাইরে খবর সংক্রান্ত কেউই বাদ যায়নি।

সময়ের আগেই সভাকক্ষ পরিপূর্ণ। সুইংডোর ঠেলে ঢুকলেন শাহরিয়ার খালেদ। দেরি না করে শুরু করলেন-

তোমাদের সবাইকে আমি জরুরীভাবে ডেকেছি কারণ বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা নিশ্চই খেয়াল করেছো মানুষ এখন আগের মতোন নাটক, সিনেমা, গান দেখে দিন পার করে না। তারা এগুলোর পাশাপাশি খবর দেখতে চায়। মানুষ আগের চাইতে অনেক সচেতন হয়েছে। আগেকার সময়ে ভালো গান গেয়ে, ভালো অভিনয় করে মানুষ স্টার হয়ে যেতো। আর এখন টক শো করে মানুষ স্টার হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সংবাদের গুরুত্ব কতখানি তা বুঝতে হবে, হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে হবে এবং সেই মতো কাজ করতে হবে। বাঘ-সিংহের পেটে যখন খাবার থাকে না, তখন ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য তারা যেমন হন্যে হয়ে খাদ্য খোঁজে ঠিক তেমনি করে খুঁজতে হবে খবরকে, ছুটতে হবে খবরের পেছনে। তোমরা আমার কথা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছ?

সবাই খালেদের কথা আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে। খালেদ আবার শুরু করল-

একটা বিষয় খেয়াল করেছ, উপরের দিককার চ্যানেলগুলো তো উপরের সারিতে আছেই। এখন নিত্য নতুন চমকপ্রদ খবর পরিবেশনের মধ্যমে পেছনের চ্যানেলগুলো উপরের দিকে উঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওরা নতুন নতুন খবরের খোঁজে পাগলের মতো ছুটাছুটি করছে। ওরা পারলে তোমরা কেন পারবে না? টাকা আমার কাছে কোন বিষয় না, যত টাকা লাগে নাও। ট্র্যান্সপোর্ট, ক্যামেরা লোকবল যা যা লাগে নিয়ে নাও, কিন্তু খবর চাই, তাজা খবর, গরম খবর, আগুন গরম খবর। আমাদের চ্যানেলটাকে প্রথম সারিতে না নেওয়া গেলেও, কয়েকটা স্টেপ তো আগাতেই হবে, তা সে যেভাবেই হোক না কেন, বুঝতে পেরেছ তোমরা?

পিনপতন নীরবতা, আবারও শাহরিয়ার খালেদ-

আরেকটা বিষয়ে তোমরা খেয়াল রাখবে ‘গ্রেডিং’।   সংবাদের গ্রেডিংটা পরিষ্কার বুঝতে হবে। কোন খবরটা “এ”গ্রেড নিউজ, আর কোনটা “বি” গ্রেড। কোন খবর মানুষ খাবে, শুধু খাবেই না গোগ্রাসে গিলবে সেটা জানতে হবে। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী খবরের গ্রেডিং করতে হবে। বড় খবর কিন্তু মানুষ খাবে না, সেটা কিন্ত  “এ” গ্রেড নিউজ নয়। মনে রাখবে নিউজ একটা পণ্য। পণ্য বাজারজাত করার জন্য যেমন পণ্যে ফ্লেভার যোগ করে আকর্ষণীয় করে তোলে, ঠিক তেমনি খবর পরিবেশনের আগে তাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে যে যে ফ্লেভার প্রয়োজন তাই যোগ করে উপস্থাপন করবে।

দীর্ঘ বক্তৃতা শেষে জানতে চাইলেন-

এবার বল তোমাদের আর কিছু জানার আছে বা বলার আছে?

একজন রিপোর্টার উঠে দাঁড়িয়ে বলল-

ভাইয়া, কোথায় কোন খবর ঘটবে, আগে থেকে বোঝার উপায় নেই। ঘটনা ঘটে যাবার পর, অন্যদের সাথে আমরাও জানতে পারি।

না, না, ভুল বললে সুমন, খবরের আগেও খবর থাকে। খবরের আগের খবর জানার চেষ্টা করো। সোর্স লাগাও, পাওয়ারফুল সোর্স লাগাও। প্রতিটা ক্ষেত্রে সোর্স ফিট করো, তারা জানাবে খবরের আগের খবর। টাকা পয়সা, ক্যামেরা, গাড়ি যখন যা লাগবে নিয়ে নাও, তবুও খবর চাই। সব কথা আমাকেই বলে দিতে হবে? তোমরা তোমাদের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করো। আজকের মতো সভা শেষ, যেভাবে বললাম, সবাই সেভাবে কাজে লেগে পড়।

সভার পর সংবাদকর্মীদের মধ্যে এক ধরণের উদ্বেগ, অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এটা ওরা বেশ বুঝতে পারছে এখানে কাজ করতে চাইলে নিত্য নতুন সংবাদের যোগান দিয়ে যেতে হবে। নতুন খবরের খোঁজে পুরো টিম খন্ডে খন্ডে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পরে দেশ জুড়ে। তারা একে অন্যকে লুকিয়ে অনান্য চ্যানেলের খোঁজ খবর রাখছে, চ্যানেলগুলো লোক নিয়োগ দেবে কীনা। কারণ তাজা খবর না দিতে পারলে খালেদ ভাইয়ের চাকরি আর করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। তিনি খবরের জন্য যেমন পাগল হয়ে উঠেছেন।

 

(২)

শাহরিয়ার খালেদ তার বিশাল অফিস রুমে এসে পৌঁছেছেন। ফাইল পত্র নাড়া চাডা করছেন। তিনি সাধারণত এতো সকালে অফিসে আসেন না। আসতে আসতে এগারোটা বারোটা বেজে যায়। গতরাতে বাসায় বৌ ছেলেমেয়ে না থাকাতে ঘুমটা ঠিকমতো হয়নি। তাই সকাল সকাল অফিসে চলে আসা।  ছেলেমেয়েদের হট্টগোলের জন্য নিশার সাথে রাগরাগিও করেছে। অথচ ভীষণ রকম নীরবতায় কাল রাতে যখন ঘুম আসছিলো না, তখন শুধু মনে হচ্ছিল বাচ্চাদের হট্টগোলই বুঝি ঘুমপাডানী গান।

ছেলে যায়েব আর মেয়ে সারাকে নিয়ে নিশা গতকাল দুপুরের পর মায়ের বাসায় বেড়াতে গেছে। বাচ্চাদের স্কুল দুদিন ছুটি। শাহরিয়ারেরও রাতে যাবার কথা ছিল শ্বশুরবাডি । কিন্তু গত রাতে বিভিন্ন চ্যানেলের বার্তা প্রধানদের সাথে সভা ছিল, সভা শেষ করে, অফিসের কিছু কাজ গুছাতে গুছাতে বেশ রাত হয়ে যায়। তাই আর উত্তরখান না যেয়ে গুলশানে নিজের বাসায় রাত পার করেছে।

নিশার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। উত্তরখানে তুলনামূলক কম টাকায় তিন কাঠা জমি কিনেছিলেন। চাকরী জীবনের শেষ দিকে পূর্ব পরিচিত একজনকে দিয়ে পাঁচ তলা ফাউন্ডেশনের একটা বাড়ি তোলেন। নাম দিয়েছেন “নিরিবিলি “। অবসর গ্রহণের পর মালিবাগের ভাড়া বাসা ছেড়ে উঠে যান নিজের বাড়িতে। যদিও বাড়ির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। বাড়িতে উঠে আস্তে ধীরে বাকি কাজগুলো করছেন। মা বাবা যখন মালিবাগে ছিল, ইচ্ছে হলেই নিশা চলে যেতে পারত। আর এখন এত দূর চলে গিয়েছেন যে, আগে থেকে প্রোগাম না করে মা বাবাকে দেখতে যেতে পারে না।

আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে পারলে, শাহরিয়ার নিজে যেয়ে ওদের নিয়ে আসবে। না হলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে।

 

এতভাবে বলার পরও সংবাদকর্মীরা নতুন কোন সংবাদ যোগাড় করতে পারছে না কেন? পুরো সেট বদলিয়ে ফেলবো কিনা…ভাবছে শাহরিয়ার খালেদ। অন্য চ্যানেলের অভিজ্ঞ লোকের জন্য বেশি টাকার টোপ ফেলবে কিনা…চিন্তা করছে খালেদ। বিরাট কাঁচের টেবিলের উপর তিনটা মোবাইল সেট, বিভিন্ন সময় বিদেশ থেকে কিনেছে। ল্যান্ডফোন দুটো পাশে আছে। মোবাইলের যুগে এগুলো তেমন খবর দেয় না।

হঠাই এক্সক্লুসিভ আই ফোনটা বেজে উঠল। এই নাম্বারটা বেশি মানুষের কাছে নাই। হাতে তুলে নিল খালেদ-

ভাইয়া দারুণ খবর, দারুণ। অন্য কোন চ্যানেল তো দূরের কথা, আশেপাশের মানুষ- জন বোঝার আগেই, আমার চোখের সামনে ঘটে গেলো ব্যাপারট।  উত্তেজনায় গলা কাঁপছে নোমানের। বস আমি পুরো দৃশ্যটা মোবাইলে নিয়ে নিয়েছি। একেবার টুইন-টাওয়ারের মতোন পুরো বিল্ডিংটা ধীরে ধীরে মাটির গহ্ববরে নিশব্দে ঢুকে গেলো। বস, তাড়াতাড়ি বড় করে ব্রেকিং নিউজে দিয়ে দ্যান। আমি ভিডিও আর ফটো এমএমএস করে এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

শাহরিয়ার খালেদের মুখে এক জটিল হাসি।

থ্যাংকুউ নোমান, থ্যাংকুউ ভেরি মাচ। জায়গার নাম, বিল্ডিংটা কয়তলা তাড়াতাড়ি বলো, আমি এক্ষুনি স্ক্রলে দিয়ে দিচ্ছি।

আমি ক্রাইম রিপোর্টের জন্য উত্তরখানে এসেছিলাম। হাঁটা পথে যাচ্ছিলাম,হঠাৎ আমার চোখের সামনে ঘটে গেলো বিষয়টা। কি অদ্ভুত যোগাযোগ খালেদ ভাই, ভাবেন একবার। বাসার ঠিকানা ৪২/১ উত্তরখান, বাড়ির নাম নিরিবিলি। পাঁচতলা বিল্ডিং। বাড়ির কাজ এখনও শেষ হয়নি, তবে বাড়িতে কিছু লোকজন বসবাস করছিল। ক্রাইম রিপোর্টের কাজে এ পথে আমাকে গত কয়েকদিন অনেকবারই হাঁটহাঁটি করতে হয়েছে।

শাহরিয়ার খালেদের হাত কাঁপছে, সমস্ত পৃথিবীটা ওর সামনে দুলে উঠছে। দম আটকে আসছে, খুব কষ্ট করে জানতে চাইল,

বাড়ির নাম নিরিবিলি? ৪২/১ উত্তরখান?…

জ্বি বস ঠিক বলছেন।

চুপ, নোমান চুপ।

উত্তেজনায় বসের সব কথা নোমান শুনতে পাচ্ছে না। দ্বিগুণ উৎসাহে বলছে।

বস আপনি স্ক্রলে এই ইনফরমেশনগুলো দিয়ে দ্যান। আমি খুব তাড়াতাড়ি ভিডিও পাঠাচ্ছি। বস আজ আমরা সব চ্যানেলকে টপকে যাব। এত নিঃশব্দে পুরো বাড়িটা মাটির অতলে চলে গেলো, এখনও পুরো এলাকা জানেনি তো অন্য চ্যানেল জানবে কীভাবে! বস ভাগ্য ভালো না হলে আমি এখানে আসব কেনো।

 

নোমানের কোন কথাই খালেদের কানে যাচ্ছে না। শুধু মাথার মধ্যে ধুম ধুম করে বাড়ি দিচ্ছে – তাজা খবর, গরম খবর, আগুন গরম খবর।