বুনো ফুল/ তাহমিনা কোরাইশী

বুনো ফুল/ তাহমিনা কোরাইশী

বুনো ফুল/ তাহমিনা কোরাইশী

বুনো ফুল/ তাহমিনা কোরাইশী

 

জাহিদ আজ কি খালি হাতেই বাসায় ফিরবে? বাসা থেকে বের হওয়ার সময় চুমকি ফর্দটা হাতে ধরিয়ে বলেছিল—অফিস থেকেফেরার পথে এগুলো নিয়ে আসবে। কীভাবে যে চোখের পলকে এমন অঘটন ঘটে গেল ভেবে পায় না জাহিদ। ধানমণ্ডির মিরপুর রোডে বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ফর্দ অনুযায়ী সামগ্রী কিনছিল জাহিদ। সেই সময় একজন ভদ্রমহিলা ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এটা ওটার দামদর করছিল। আগবাড়িয়ে জাহিদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা ছিল তার। জাহিদও ঐ মেজাজেরই মানুষ। তালেতাল মিলে গেল। সেও হাসি মুখে মহিলার দৃষ্টি কাড়ে। মহিলাও একইভাবে দৃষ্টি কাড়ে। ফর্দ অনুযায়ী আটা, ময়দা, চিনি, দুধ, চানাচুর, বিস্কুট, টুথপেস্ট, চাপাতা, সসেজ, মেয়োনেস, চিজ ইত্যাদি নিচ্ছিল। মহিলাও কিছু নেওয়ার ভান করছিল। আর জাহিদের ফর্দ থেকে ঐ প্রডাক্টের ওটা ভালো ঐ কোম্পানির ওটা ভালো বলে জিনিসপত্র বাছাই করে দিচ্ছিল। ওদের আলাপচারিতায় দোকানিরা ভেবেই নিয়েছে স্বামী-স্ত্রী। গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে। গায়ের সাথে গা ঘেঁষে পুলক অনুভূতিতে বেশ ভালো মুডেই ছিল জাহিদ। স্ত্রী না ভাবলেও ভাবতে পারে বহুদিনের পরিচিত প্রেমিকা। মোটামুটি ভাবে সবগুলো প্যাকেট করা শেষ। জাহিদ বিল-পে করতে ক্যাশ কাউন্টারে ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিয়ে দাঁড়ায়। পে-স্লিপ সাইন করে। বিলের রিসিটটা জাহিদের হাতে দিতে দিতে দোকানেরই এক কর্মচারীকে বলে, স্যারের মালপত্র গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়।

ঐটুকু সময়ের মধ্যে মহিলা কেটে পড়েছে মালসমেত। দোকানের হেলপার ছেলেটা ভেবেছে উনার স্ত্রী। মহিলাও সুযোগের সন্ধানে ছিল। বলল, এই ছেলে মালপত্রগুলো ঐ কালো ট্যাক্সি ক্যাবে তুলে দাও। তড়িৎ গতিতে মহিলা ঐ গাড়িতে ওঠে। মালপত্র সমেত চলে যায়। হেলপার ছেলেটার সন্দেহ হয়। স্যার তো এখনও দোকানে মহিলা না বলে চলে গেল মালপত্র সমেত। সে নিজে থেকেই দোকানে ঢুকে স্যারকে বলল, সদাইপাতি ম্যাডামের গাড়িতে তুইল্যা দিলাম। ম্যাডাম গাড়ি নিয়ে চইল্যা গেছে স্যার।

 জাহিদ একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষণে চিৎকার করে বলল, এবসার্ট। করেছ কী? এই ছেলে তুমি আমাকে বলবে না! ঐ মহিলাকে আমি চিনি না। দোকানি দেখলো মহাবিপদ। নিজেদের সেইফ করতে দোকানি বলল, স্যার আমরাও তো ভেবেছিলাম উনি আপনার সাথেই এসেছেন। সব জিনিস উনিই পছন্দ করে দিচ্ছিলেন। আপনাদের একসাথে দেখে এ ছেলেটা ভেবেছে….বলে থেমে যায়।

জাহিদ একেবারে রেগেমেগে অস্থির হয়ে বলে, আমি কারো সাথে কথা বললেই সে আমার স্ত্রী হবে না কি? স্টুপিড, আপনারাও পারেন কথা প্যাঁচাতে। এই ছেলে তোমার কি উচিত ছিল না আমাকে জিজ্ঞাসা করা? এই তো সামনে আমার এলিয়েন গাড়িটা দাঁড়ানো।

ছেলেটা মাথা নিচু করে বলল, আমার কী দোষ স্যার? ঐ ম্যাডাম আমারে কইল, ঐ কালো গাড়িটায় মালপত্র তুলে দাও। তার কথামতো ট্যাক্সি ক্যাবে তুইল্যা দিলাম। মহিলা যে গাড়ি নিয়া চইল্যা যাইবো কে জানে? জাহিদ অগত্যা জানতে চাইল, মাঝে মাঝে কি এমন হয় আপনাদের দোকানে? দোকানের সেলসম্যান ছেলেটা বলল, না স্যার এই প্রথম। আমাদের রেপুটেশন আছে না? আমাদের স্টোরের ছেলেগুলো পুরনো। তবুও ওদের সাবধান করে দিয়ে বলে,  যে টাকা পেমেন্ট করে তার কাছে জিজ্ঞাসা না কইর‌্যা মাল তুলবি না। দেখছস কী সর্বনাশ হইল। বিনয়ের সাথে জাহিদকে জিজ্ঞাস করে, স্যার যা যাওয়ার তা চইল্যা গেছে। এটা কি আর পাইবেন? নতুন কইর‌্যা কিছু দিয়ে দিবো স্যার?

মাথা নিচু করে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় স্টোর থেকে জাহিদ। নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। পুরো দোষটা ওর নিজেরই। দোকানের ঐ ছেলেটাকে বকে কী লাভ? মহিলা পেলেই একবারে ফিদা হয়ে যায়। রসে ডুবে একেবারে রসগোল্লা হয়ে যায়। চরিত্রের দুর্বল দিকটা দোকানিরা বুঝে গেল। ভারি লজ্জা করছে জাহিদের। তার ওপর এতোগুলো টাকার সদাইপাতি গচ্ছা গেল। জাহিদ ভাবে স্ত্রী চুমকিকে এ নিয়ে কিছুই বলা যাবে না। চুমকি একেবারে মারমুখো আচরণ করবে। বলবে, আজতো তোমার মালপত্র নিয়েছে কোনোদিন তোমাকে নিয়ে যায় দেখ। দারুণ বাঁচা বেঁচেছো। মেয়ে দেখলেই এতোটা নেশায় ডুবে যাও? এতোটা অসতর্ক! মহিলা কি বেশি সুন্দরী ছিল? তোমাদের মতো পুরুষদের সুন্দর অসুন্দর লাগে নাকি? মহিলা হলেই হলো, মানে মেয়েমানুষ হলেই হলো। আর আজেবাজে শব্দ ব্যবহার করবে। না-না অসম্ভব, কিছুই বলবে না বাসায়। নিজের লজ্জা নিজেকেই লুকোতে হবে। ঘরে যতটা ঝামেলামুক্ত থাকা যায় ততই মঙ্গল। বলবে, মনে নেই জিনিসগুলো আনতে। কাল এনে দেবো। অফিসে অনেক কাজ ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি বলে রেহাই পাবে।

নিজেকে নিজেই বিবেকের বেত দিয়ে কষে নেয়। আর নয় হ্যাংলামোপানা। আসলে জাহিদের কপালটা খারাপ। যখনই কারও সঙ্গ চেয়েছে তখনই কোন না কোন নাজেহালে পড়তে হয়েছে। চেনা মেয়েগুলোর সাথে বাঁদরামি করা ওর ইথিক্সে পড়ে না। তাই অচেনা মুখের পেছনে ধাওয়া করে। এটা কী অন্যায়? চেনা মেয়েগুলো আগ বাড়িয়ে ভাইয়্য়া নতুবা আঙ্কেল পাতিয়ে ফেলে তাদের সাথে অন্যায় কাহন-কিচ্ছা করা সম্ভব নয়। তাই হাত বাড়ায় অজানায় অচেনায়। এই তো এর কয়েক মাস আগে রোজার ঈদের সময়। শপিংমলগুলো ছিল লোকে লোকারণ্য। মানুষের গা ঠেলে ঠেলে শপিং করতে হয়েছে। জাহিদ তার স্ত্রীকে খুশি করার জন্য ধানমণ্ডির এক শপিংমলে ঢুকে পড়ে শাড়ি কিনতে। তাকে না জানিয়ে দামী একটা শাড়ি উপহার দেওয়ার উদ্দেশ্যে। চুমকিকে যখনই শাড়ির কথা বলেছে তখনই ও বলেছে, কী দরকার দামী শাড়ির, ওগুলো শুধু তুলে রাখা হয়। একটু কমে দুটো শাড়ি নিলে দু’এক জায়গায় পরা যাবে ওটাই বেশি ভালো। কিন্তু জাহিদের পছন্দ বম্বের নায়িকাদের শাড়ি। সাধ আছে দীঘল শঙ্খচিলের ডানা সাধ্য চড়ুইডানা। ওতেই উড়া উচিত। মন বোঝে না। যাক সেদিন জাহিদ বড় একটা শাড়ি হাউজে মানে রঙধনু সাত রঙ ঐ স্টোরেই ঢুকে পরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বড় অসহায় বোধ করছে জাহিদ। মহিলাদের দাপটে ওর ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। বিশ হাজার ত্রিশ চলি­শ হাজারের শাড়ি মেলে বসে আছে সেলাইম্যানরা। জাহিদের বাজেট তিন বা চার হাজার করে দুটো শাড়ি নেবার ইচ্ছা। এ মুহূর্তে দেবদূতের মতো পাশে এসে দাঁড়ালো এক মহিলা। মোটামুটি সুন্দর গোছের হাল্কাপাতলা গায়ের গড়ন। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে, পছন্দ হচ্ছে না? না কি ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই আমাদের ঐ বিশাল শাড়ি তরীতে। ভাবির জন্য শাড়ি নেবেন বুঝি? পছন্দ করে দেবো? জাহিদ একেবারে অবাক মেঘ না চাইতেই জল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, সত্যি ম্যাডাম আমাকে এ যাত্রায় বাঁচিয়েছেন। খুশি হবো যদি দুটো শাড়ি পছন্দ করে দেন। জাহিদও অচেনা মহিলাকে এমন সাচ্ছন্দে বলেই বসলো। জাহিদ ভেবে নিলো এই মহিলা চুমকির বান্ধবী বা পরিচিত কি না। পরিচয়ে লিস্টে কোথাও খুঁজে পেলো না। মহিলার আচরণ একেবারেই পুরুষঘেঁষা। এমন পোজে দাঁড়িয়ে যা একেবারে স্বামী-স্ত্রীর মতো। গা ঘেঁষে। কখন হাত ছুঁয়ে কথা বলছে। জাহিদও পুলকিত। সুখ-সুখ অনুভূতিতে নড়েচড়ে বসে। আবছে আসা জিনিস মানে সাধা লক্ষী পায়ে ঠেলতে নারাজ জাহিদ। আরও কাছে আসে মহিলার। মহিলা গায়ে শাড়ি চড়িয়ে একটার পর একটা করে দেখছে লুকিং গ্লাসে আর জাহিদের চোখ আয়নার। মিটিমিটি করে হাসছে ওরা চোখের ভাষায়। অনেকগুলো শাড়ি দেখা হলো। জাহিদের আর ঐ মহিলার বেশি পছন্দ হলো যে দুটো শাড়ি। তারই দামদর শুরু হলো—একটি ৪ হাজার অন্যটি ৬ হাজার। জাহিদ ভাবল ২০ হাজার ৩০ হাজার থেকে এই শাড়িগুলো কম সুন্দর নয়। জাহিদ খুব খুশি হলো শাড়ি দুটো নিতে পেরে। মহিলা প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক আরও শাড়ি দেখার চেষ্টা করছে। জাহিদ ওর ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দেয় ক্যাশ কাউন্টারে ক্যাশিয়ার দশ হাজার টাকা রিসিট কেটে নেয়। ক্রেডিট কার্ড আর ক্যাশমেমো এগিয়ে দেয় জাহিদের দিকে। তৃপ্তির হাসি হেসে বিদায় নেওয়ার জন্য ঘাড় ফেরায় সেই মহিলার দিকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এবং সাথে এককাপ কফি খাওয়ার জন্য  প্রোপোজ করবে ভাবে মনে মনে। মতলবও আটার চেষ্টা করে মনে মনে।

কোথায় সে? কোথায় গেল সেই আগন্তুক মহিলা। জাহিদ ভাবল স্টোরের সামনে হয়তো-বা। দৌঁড়ে যায় দরজার সামনে এদিক ওদিক কোথায়ও নেই সে। এত তাড়াতাড়ি হাওয়া হয়ে গেল কিভাবে? আবার স্টোরের ভেতরে ঢোকে খোঁজে কিছুক্ষণের জন্য পাওয়া সেই মুখ। মহিলাদের ভেতরে ভেতরে তাকে খোঁজার চেষ্টা করে। অস্বস্তিকর ব্যাপার। তাও করতে হচ্ছে। অগত্যা দোকানি এবং ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় গেল বলেন তো সেই মহিলাটি। দেখছি না কোথাও।

ক্যাশিয়ার দোকানিরা সবাই অবাক, কী বলেন স্যার? আমরা ভেবেছি আপনার সাথেই এসেছেন। আর তাঁর জন্য দুটো শাড়ি কিনেছেন। আরেক সেলসম্যান লোকটি বলল, শাড়ির প্যাকেট উনি নিয়ে গেল আমার হাত থেকে। স্যার আমরা ভেবেছি আপনার স্ত্রী। জাহিদের মাথায় হাত! ওদের সাথে কথা বাড়ানো মানে আরো বোকামি। তবুও আস্তে আস্তে নিচু গলায় বলেন, আপনারা কি চেনেন ওনাকে?

—না স্যার, আমাদের চেনার প্রশ্নই ওঠে না। এমন মহিলারা তো ঈদের চাঁদে আসে। ঈদের এই মাসে যারা কোথাও বের হয়নি এমন মানুষও আসে। এরা হলো মৌসুমের অতিথি পাখি। আর যারা রেগুলার কেনাকাটা করে সে রকম কাস্টমারদের সাথে আমাদের পরিচয় থাকে। তাদের ফোন নম্বরও ঠিকানাও থাকে। স্যার আমাদের দোকানের রেপুটেশন আছে না। আমরাই বা এমন মানুষকে প্রশ্রয় দেবো কেনো?

এর মধ্যে ক্যাশিয়ার ডেকে সবাইকে সর্তক করে দেন বুঝে শুনে কাজ করতে। প্যাকেট দেওয়ার সময় সাবধান থাকতে। যার মাল তাকে বুঝিয়ে দিতে। বুঝেছ? রাগত স্বরে সেলসম্যানগুলোকে  বলে।

আমও গেল ছালাও গেল। চুমকিকে সারপ্রাইজ দেবে। নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হবে। একটু ভুলের খেসারত এমনভাবেই দিতে হচ্ছে জাহিদকে। একটু স্পর্শ তাকে অচেতন নেশাবুঁদ করেছিল। সম্মোহিত করেছিল। সেজন্য মহিলার পালিয়ে যাওয়া টের পায়নি। এমন কথা জাহিদ স্ত্রী চুমকিকেও বলতে পারবে না। সে শুনিয়ে দেবে। ওহ্ আমি কি সুন্দরী নই। এর জন্য আমাকে নিয়ে শাড়ির দোকানে যেতে তোমার লজ্জা। অন্য মহিলাকে নিয়ে মৌজ করে শাড়ি কিনতে গিয়েছিলে। নিশ্চয় তোমার কুমতলব ছিল মহিলা টের পেয়ে রাস্তা গুটিয়েছে। এই ঈদের সময় দশ হাজার টাকা খুইয়ে এসেছ। ওহ্ চালাকি না। কোন প্রেমিকাকে শাড়ি কিনে দিয়ে এসেছে আর এই আবোল-তাবোল গল্প ফেঁদে বসেছো না? তোমার নাড়ী-নক্ষত্র চিনি। একদিন হয়তো একটা জলজ্যান্ত বাচ্চা এনে আমার কাছে বলবে ভুল করে একটা বিয়ে করে ফেলেছিলাম। বাচ্চার মা বাচ্চাকে ফেলে পালিয়ে গেছে। এই বাচ্চাটা ধর এটাই তোমার সারপ্রাইজ। তাই না?

জাহিদ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকবে অপরাধীর মতো। কত অনুনয় বিনয়  করে মাফ চাইবে। যদিও মাফ একদিন হয়ে যাবে তবুও চুমকির মনে ক্ষত-চিহ্ন ভরবে না। সন্দেহের বীজ মহীরূহ হবে দিনে দিনে।

নাহ্ আর নয় এমন কাজ, জাহিদ তওবা করেছে। ঘরের বউটি যদিও ডাল বরাবর তবুও নিত্যদিন ডালের স্বাদই নেবে। কখনও ভুনা, কখনও ভর্তা, কখনও ঢলঢলে ঝোল করে খাবে। আর তাকাবে না বাইরে বিশেষ খাবারের দিকে।

কথায় আছে না কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। জাহিদের চরিত্রের এই দোষটি হাজার কলস জলে ধুয়েও হয়নি সাফ। অবশ্য আগের থেকে সর্তক অবস্থানে জাহিদ এখন। সে ভাবে নারীসঙ্গপ্রিয় মানুষটির উপযুক্ত শিক্ষা হলো। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দেয়। পরিচিত মুখের মেয়েদের সঙ্গ ভালো লাগে কিন্তু তাদের আবোল তাবোল প্রস্তাব দিতে নিজেরই বিবেকে বাঁধে। তা বটে, বিবেক বলে একটা পদার্থ এখনও জীবিত আছে জাহিদের। দারুণ শিক্ষা হলো। প্রতিবার ভাবে কিন্তু আবার ভাঙা শামুকে পা কাটে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় আঙুর ফল টক বলেই।

ধানমণ্ডি থানায় জিডি করেছে। থানার কর্মকর্তার সাথে সখ্য হয়েছে। কিছু কথা বললেন তিনি তাই। এমনই কিছু কেস এসেছে উনাদের হাতে। শপিংমল এবং প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে ঘটছে এমন ঘটনা। রোগির পাশে বসে বসে খোশ গল্প করতে করতে কিছু ময়লা ছিটিয়ে  দেয়। নিজেরাই ঝেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এভাবে গলার চেন, হাতের ঘড়ি, কানের দুল, টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। একবারে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা হয়তো মল জাতীয় কিছু গায়ে ছিটিয়ে। তাকেই আবার সাথে নিয়ে ওয়াশিংরুমে গিয়ে পরিষ্কার করার নামে এগুলো ছিনতাই করে এমন ঘটনা কয়েকবার ঘটলো এই হোমফোর্ড হাসপাতালে। স্টাফদের সর্তক অবস্থানে ঘুঘু ফাঁদে পা দিয়েছে। পুলিশকে খবর দেওয়ার পর হাতে নাতে ধরা পরলো দু’জন। পুলিশ অফিসার আহমেদ আলীর সেল নম্বরটা জাহিদ সেইভ করে রেখে দেয়। কখন আবার কোন বিপদে পড়ে। যদিও ইচ্ছে নেই জালে আটকানোর। ওদেরকেই আটকানোর চেষ্টা করবে জাহিদ। জাহিদ আজকাল ভেবে চিন্তেই পা ফেলছে। জাহিদ তাকে তাকে থাকে ওদের কারো সুযোগ বুঝে ধরা যায় কিনা? পহেলা বৈশাখের একটা পাঞ্জাবি কিনতে শতবর্ষী মেনসওয়ারে ঢোকে। নিজের পাঞ্জাবি নিজেই কিনবে আজ আর কোনো মহিলার আশ্রয় নেবে না। না চাইলেও যেন ওর কাছে এসেই বর্ষার জল গড়িয়ে পরে। অবশ্য এবার ওকে টার্গেট নয়, ওর পাশে ওরই মতো এক ভদ্রলোককে পেয়ে যায়। দুজন হাল ফ্যাশনের মহিলা। ছিমছাম পাতলা গড়ন। সেদিনের ঐ মেয়েগুলোর মতোই কিছুটা ছাট আছে। দেখতে তেমন আহামরি না। কিন্তু বেশ মেকআপ করা ছিল। ওর পাশে একজন গোব্যাচারা কিনা কে জানে। সেই ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওরা একজন একজনকে বলছে। ওল্ড ফ্যাশন। একটি পাঞ্জাবির ডিজাইন আমাদের বুটিক হাউজের ডিজাইনকে ছুঁতে পারবে না। তাই না? কী বলিস?

আরেকজন বলছে, সত্য তো আমরা কিছুতেই কম্প্রোমাইজ করিনি। পাঞ্জাবিগুলো এক্সক্লুসিভ করেছি। ভালো এবং আনকমন হতে বাধ্য। 

পাশের লোকটি ওদের কথা লুফে নিল। বলল, ম্যাডাম কোথায় আপনাদের বুটিক হাউজ? দুইজন দুই দিক থেকে পাকড়াও করে সেই ভদ্রলোককে। এই তো সামনেই। এখন থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তার শেষ মাথায়। পাশে মুখ ফিরিয়ে জাহিদ খেয়াল করছিল ব্যাপারটি। ওর সন্দেহ ঠিক মনে হচ্ছে। জাহিদকে যেন চিনতে না পারে। জাহিদ কান খাড়া করে শুনছে অন্যদিকে ফিরে। সত্যি মহিলা দুজন ঐ ভদ্রলোককে একবারে লাড্ডু বানিয়ে ফেলেছে। দুজন গল্প করতে করতে লোকটিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অগত্যা জাহিদও পিছু নিল। এই সুযোগে জাহিদ পুলিশ অফিসার আহমেদ আলীকে ফোন করে ঘটনা বলে এবং সাহায্য প্রার্থনা করল। কিছুক্ষণের মধ্যে আহমেদ আলী নির্দিষ্ট স্থানে এসে উপস্থিত। আর জাহিদ ওদের ফলো করতে করতে কখন যেন অন্যমনস্ক হয়ে ওদের হারিয়ে ফেলল। আজ ওদের দুজনের বয়কাট চুলে চেহারায় পুরুষের আদল বোঝা গেল। 

জাহিদের মনের ভুলও হতে পারে। চুল ছোট করলে মেয়েদের বেশ স্মার্ট লাগে। হয়তো ঐজন্যই। এর আগে বাঙালি ললনাদের মতো শাড়ি কপালে লাল টিপ দিয়ে দেখা হয়েছে। ওরা দুজনেই দু’বার ওকে চিট করেছে জাহিদের তাই মনে হচ্ছে। একেবারে নিশ্চিত নয় জাহিদ। ঐ ভদ্রলোকটি বলছিল দূরে হলে যাবে না। মেয়ে দুটো বলছিল, না ভাই এইতো ওয়াকিং ডিস্টেন্স। আপনার মন ভরে যাবে দেখে আসবেন। না কিনতে চাইলে না কিনবেন। আরেক জন বলল, এনডি কটন, এনডি সিল্ক, সুতি, সিল্ক, হাতের কাজ, মেশিনের কাজ সবই পাবেন এর মধ্যে। রঙ খুবই সুন্দর। গাঢ় বা হালকা দুটোই পাবেন। গলির মুখে স্থির দাঁড়িয়ে রইল ওরা। দৃষ্টি পুরো গলি পথটার দিকে। গেল কোথায়? তিন তিনটি মানুষ একেবারে উড়াল। আহমেদ আলী বলে, আমি যখন এসে পড়েছি ওরা যাবে কোথায়? আমার নাকের ডগা দিয়ে একটা মশাও যেতে পারে না। ওরা জলজ্যান্ত তিনটে মানুষ। সান গ্লাসটা নাকের ডগার ঠিক করে বসাতে বসাতে বলল, দেখুন তো ঐযে দূরে একজন লোক খুড়িয়ে হাঁটছে। ঐ লোকটি না তো? অবশ্য মহিলা দুটো তার সাথে নেই। জাহিদ দৃষ্টি প্রসারিত করল। লোকটি এদিকেই আসছে। জাহিদ বলল, জি মনে হচ্ছে ঐ লোকটি। চলুন  কাছে যাওয়া যাক। সে অবশ্য এদিকেই আসছে।

জাহিদ বলল, আহা কী হাল হয়েছে লোকটির! প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতেই ওরা কাছে এসে দাঁড়ায়। লোকটি ভীষণ অসহায়ের মতো নিজেকে প্রকাশ করে। দেখুন ভাই ঐ দু’জন মেয়েমানুষ আমার কি হাল করেছে। 

জাহিদ জানতে চাইল ওরা দুজন পালালো কোথায়? অসহায়ের মত লোকটি বলল, কিছু বোঝার আগেই তো আমার যথাসর্বস্ব নিয়ে 

গেল। আহমেদ আলী বলল, চলেন আমার সাথে। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর আহমেদ আলী। আপনার ভয় নেই। দেখি কতটুকু আপনাকে সাহায্য করতে পারি। এদের দুজনকে পেয়ে স্বস্তির শ্বাস নেয় ভদ্রলোক।

জাহিদ বলল, আরে ভাই আপনাকে বাঁচাতেই আমি উনাকে মানে পুলিশ ইন্সপেক্টর আহমেদ আলীকে খবর দিলাম। আপনাকে ফলো করছিলাম হঠাৎ কোথায় যে হারিয়ে গেলেন। একটুর জন্য ধরতে পারলাম না। ভদ্রলোকটি বলতে লাগল, ওরা দুজনে তাকে কিছুদূর আনার পর চোখে কিছু যেন লাগিয়ে দিল তারপর আর কিছু দেখতে পাইনি। কোথায় যেন একতলায়ই হবে। হয়তো কোনো গ্যারেজ বা দারোয়ান বা ড্রাইভারের রুম। ওদের সাথে আরো দুজন লোকও ছিল আমাকে জোর করে ধাক্কিয়ে কোথায় ঢুকালো। কিলঘুষি চড় কিছুই বাদ নেই। মুখে কসটিক টেপ হাতও বেঁধে দিল। চিৎকার করতে পারছি না। ওরা প্রায় চার জন আমার পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ যা ছিল সব নিয়ে গেছে। প্রায় পনের হাজার টাকা ছিল, বিদেশি কারেন্সি মানে একশ ডলারের দুটো নোট ছিল। সবই নিয়ে গেছে। আরও বলছিল, দেখতে এত বড়লোক টাকা-পয়সা কম কেন? এই বলে কত যে গালগাল করল।

জাহিদ একটু দুষ্টুমি করে বলল, যাক বাঁচা গেছে ওরা আপনার সতীত্ব হরণ করে নি তো?

হো হো করে হেসে ওঠে লোকটির সাথে আহমেদ আলীও। আপনি পারেন ভাইয়া।

জাহিদ ভদ্রলোকটিকে আহমেদ আলীর কেয়ারে দিয়ে চলে আসে বাসায়। সেদিন আর জাহিদের পাঞ্জাবি কেনা হয়নি। অন্যের ঘটনা বেশ রসিয়ে চুমকিকে বলেছে। পুরুষ মানুষের চরিত্র নিয়ে চুমকিও কিছু কথা শুনিয়েছে। তাকেও ছাড়েনি। বলেছে, তুমি এমনটিই করতে। তোমার চরিত্র একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা! তোমাকে আমি খুব ভালোমতই চিনি, বুঝেছ? তোমার সাথে ঘটেছে কি না কে জানে? 

ওর কথা শেষ হতে না হতেই আহমেদ আলীর ফোন। ওপাশ 

থেকে জাহিদকে বলছে, জাহিদ সাহেব, বলেছিলাম না এগুলোকে ধরবোই।

জাহিদ খুব খুশি মুডে বলে, কংগ্রেচুলেশন ভাইয়া। অবশেষে হাতকড়া পরানো হলো গণশালীদের।

আহমেদ আলী হাসতে হাসতে বলল, ওরা দুজন আপনার শালীও না শালাও না। জাহিদ অবাক হয়ে বলে, তবে কী?

, ওরা দু’জন হিজড়া। 

-তাই নাকি?

—দেখা হলে বলব, সত্যি ভারী কষ্টের জীবন! ওদের জন্য মায়া হয়। কত বিচিত্র মানুষের জীবন। আহমেদ আলী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আহমেদ আলীর হাস্যরস একেবারে উবে গেছে। তার গলার আওয়াজ বেশ ভার ভার মনে হচ্ছিল। সেলফোন বন্ধ করার পূর্বে আহমেদ আলী বলল, দেখা হলে বলব। আজ রাখি। জাহিদের হাসি মিলিয়ে গেল মুখেই।

চুমকির কৌতূহল, কী হয়েছে? বল কী হয়েছে?

জাহিদের মুখে কথা নেই।

তাহমিনা কোরাইশী
তাহমিনা কোরাইশী
%d bloggers like this: