ক্যাম্পাসের প্রেমগুলো কখনো মরে না – মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
সেদিন বিকালটা খুব বেশি ভাল কাটছিলো না। মৃদু বৃষ্টি, শীতল আবহাওয়া সব মিলিয়ে বড় একা মনে হচ্ছে নিজেকে। আর স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা যেহেতু চলছে, এ নিয়ে আরো একটি দুশ্চিন্তা। কারণ ভর্তি পরীক্ষার নির্দিষ্ট কোনো পাঠ্যসূচী নেই। কিন্তু আমার অধ্যয়নও কেবল কম নয়। তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। সুতরাং একদিকে অধ্যয়নের বিরক্তি, আর অন্যদিকে নিজেকে খুবই জ্ঞানশূন্য মনে হচ্ছে।
হঠাৎ মনে হল আর একদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। তাই পরীক্ষার আসন ও কেন্দ্র সম্পর্কে জেনে নেয়া আবশ্যক। পরে প্রবেশপত্রে দেয়া নীতিমালা অনুযায়ী ম্যাসেজ প্রেরণ করলাম। ফিরতি ম্যাসেজে পরীক্ষার কেন্দ্র, কক্ষ ও তার বিস্তারিত ঠিকানা প্রেরিত হয়। ঠিকানাটি হল- আনোয়ারা বেগম মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ নাজিমুদ্দিন রোড, ঢাকা। ঠিকানাতে শুধু অনুরূপ কথাটিই লেখা ছিল। তাই সে নাজিমুদ্দিন রোডটি খুজঁতে আমি ব্যাকুল হয়ে পড়ি। ফোন করতে শুরু করি ঢাকায় অবস্থানরত বন্ধু ও পরিচিত লোকদের। কিন্তু কেউই এ ঠিকানার কোনো হদিস দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার পূর্বের দিন বৃহস্পতিবার বিকাল বেলায় ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ রোডের বাসা থেকে বের হয়ে এ কে খানের দিকে রওয়ানা করলাম। পরে সেখানে এসে আরো একজন পরীক্ষার্থীসহ আমরা দু’জন হই। এরপর বাসে করে আমরা ফেনী আসি। ফেনীর এস এস কে রোডের বাস টার্মিনাল থেকে আরো একজন পরীক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে যোগ হয়। তারপর তিনজন মিলে আমরা বাসে করে ঢাকার পথ ধরি। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে যখন নামি, তখন রাত দশটা। তখন সেখানেও আমাদের সাথে আরও এক বন্ধু একত্রিত হয়। পরে আমাদের চার জনের একজন জানালেন ঢাকা পলিটেকনিকে তার এক বন্ধু রয়েছে। তখন চারজন মিনি সিটিবাসে করে ফার্মগেটের পথ ধরি। এরপর দুটো রিকশা নিয়ে আমরা পলিটেকনিকের ছাত্রাবাসে উঠি। সেখানে রাত্র্রিযাপন শেষে আমরা পরীক্ষা কেন্দ্রের সন্ধানে চিন্তিত হয়ে পড়ি। সকাল যখন সাতটা তখন আমরা ছাত্রাবাস হতে মূল সড়কে বের হয়ে এসেছি। সবাই যখন স্ব স্ব কেন্দ্রের সন্ধানে ব্যস্ত, আমিও তখন নিজের চিন্তা করতে থাকি। পরে সেখানকার কোনো একজনের কথামত গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। গুলিস্তান এসে একটি রিকসায় উঠে নাজিমুদ্দিন রোড় খুঁজতে লাগলাম। ততক্ষণে চারজন স্ব স্ব পথ ধরেছে। পরে আমি নাজিমুদ্দিন রোড় খুঁজে পাওয়ার আরও কিছু সময় পর আনোয়ারা বেগম মুসলিম স্কুলটি খুঁজে পেলাম। তখনো পরীক্ষার আরো দু ঘণ্টা বাকি।
একঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট গেটের দরজায় অপেক্ষা করতে করতে পা দুটো প্রচণ্ড ব্যথা করছে। আমার সঙ্গে তখন আরো বহু পরীক্ষার্থী অপেক্ষা করছিলো। তাদের কেউ কেউ আমার মত বিরক্তি বোধও করছিলো। কিন্তু সবার সঙ্গে তাদের কোনো একজন অভিভাবক রয়েছে। অভিভাবকেরা কেউ তাদের ঘাম মুছে দিচ্ছে, আবার কোনো অভিভাবকের হাতে জলের পাত্র ও পরীক্ষার্থীর ব্যাগ বহন করছে। আবার কোনো অভিভাবক তাদের পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য পরিবেশনে ব্যস্ত।
পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রায় ১৩ মিনিট পূর্বে দারোয়ান দরজা খুলে দিলো, তার সঙ্গে দু’চারজন পুলিশ সদস্যও দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর আমার ব্যাগটি কাঁধে নিতেই পুলিশ সদস্যরা আমার গতিরোধ করল। একজন বললো, ব্যাগ নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে না। এরপর আমি ব্যাগটি নিয়ে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। অন্য পরীক্ষার্থীর ব্যাগটি তাদের অভিবাবক সংরক্ষণ করছে। এর আগে আমি স্বাভাবিক থাকলেও সে মূহুর্তে অবিভাবকের শূন্যতা আমাদের হৃদয়ে হাহা করে উঠলো। খুব অসহায় মনে হল নিজেকে। যাইহোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মবেদনার গ্লানি হৃদয়ের গহীনে ডুবিয়ে দিয়ে বাস্তবতায় ফিরে এসেছি। ব্যাগটি রাখার স্থান খুজঁতে খুঁজতে কেন্দ্রের একটু দূরে একটি লেপ তোষকের দোকানে রেখেছি। দোকানিও রাখতে একটু অনিহাবোধ করেছিলো।
পরীক্ষা কক্ষে আমার জন্য নির্ধারিত আসনে বসেছি। চারদিকের আসনগুলো খুব খালি, কারণ পরীক্ষার্থীরা এখনো পুরোপুরি আসন গ্রহণ করেনি। পুরো হলে আমিসহ মাত্র কয়েকজন। আমার ডান পাশে এক ছেলে তার পেছনের একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। ছেলেটি মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো এখানে সবাই বিজ্ঞান বিভাগের? অন্য কোনো বিভাগের কেউ নেই?
এরপর মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো তুমি কোন বিভাগের?
আমি উত্তর দিয়েছি মানবিক।
এরপর মেয়েটি আমার বাড়ি কোন জেলায়? পড়াশুনা কোথায় করেছি? এ সবসহ আমার সম্পর্কে আরো নানা বিষয় জেনে নিল। তার সম্পর্কে প্রশ্ন করেও আমি অনেক কিছু জেনে নিলাম। তার কথাগুলো এমন আবেগময়ী ভাষায় উপস্থাপন করছিলো, যেন ঠোঁট দুটোর মধ্য থেকে মুক্তা ঝরছে। আমার অজান্তে দখল করে বসেছে আমার হৃদয়। মধুমাখা কন্ঠস্বর, সীমাহীন মায়াবী ও অপূর্ব বদনখানি। কিন্তু হঠাৎ আমার এতটুকু বোধ হল, তার নামটিই তো এখনো জানা হল না। এরপরই আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, তোমার নাম কী?
সে উত্তর দিল শ্রাবণী।
তারপর সে আমার নাম জানতে চাইলে তাকে আমার নামটি বললাম এবং সে মন্তব্য করল খুব সুন্দর নাম। সেদিন আমার সাথে জীবনে প্রথম কোনো একটি মেয়ে হৃদয়স্পর্শী আচরণ করেছে। কিছুক্ষণ পরই যথা নিয়মে পরীক্ষা শুরু হলো। এক ঘণ্টা পর পরীক্ষা শেষে তাকে বললাম, পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সে বললো তেমন ভাল নয়। এরপর আমরা দুইজন একসঙ্গে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পড়লাম। তখন তাকে কী বলবো এমন কোনো কথার প্রসঙ্গও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এরপরই অসংখ্য পরীক্ষার্থীদের ভিড়ে আমি তাকে আল্লাহ হাফেজ বলে বিদায় জানিয়েছি। পরে সে এবং আমি স্ব স্ব গন্তব্যে চলছি। এরপর সামনের দিকে পথ চলছি আর অন্তরের ভেতর ঢেউ খেলছে শ্রাবণীর কথা বলার কলাকৌশল ও অপূর্ব চেহারাটির মুগ্ধতা দেখে। নিজেকে নিজে অপরাধী সাব্যস্ত করছি আর ভাবছি, শ্রাবণীর ফোন নম্বর অথবা তার সাথে যোগাযোগের কোনো ঠিকানা চেয়ে নিলাম না কেন? তার সাথে জীবনে আর কোনোদিন সাক্ষাৎ কি হবে? হলেও কোথায় হবে? কীভাবে হবে?
Facebook Comments Sync