চার রমণীর কালীয় দমন/ দিলারা মেসবাহ 

চার রমণীর কালীয় দমন

চার রমণীর কালীয় দমন

চার রমণীর কালীয় দমন/ দিলারা মেসবাহ

ডিএনডি বাঁধে ফাটল। ভয়াবহ লিকেজ। শহরে ঢুকে পড়ছে উদ্দাম নর্তকী। বিষাক্ত তার ফণার ছোবল। ঐ শীতলক্ষ্যা উন্মাদিনী। রূপগঞ্জ বেড়ি বাঁধের লিকেজ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। শহর রক্ষা বাঁধও হুমকির মুখে। তিলোত্তমা ঢাকার চার নদী। শত সহস্র ফণা বিস্তার করে গ্রাস করতে আসছে রূপসী নগরীর যাবতীয় বৈভব। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ আর কালীগঙ্গা কেহ করে নাহি ছাড়ে সমানে সমান

 ঐ ডিনএডি বাঁধের লিকেজের সচিত্র প্রতিবেদনটি আকৃষ্ট করল চামেলির শ্যেনদৃষ্টি। মহাযজ্ঞ চলছে বুঝি। এলাকাবাসী, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা মিলে চলছে অবিরাম লিকেজ রোধের প্রাণান্ত চেষ্টা। বালির বস্তা সি সি ব্লক নিয়ে নাজেহাল অবস্থা।

 ‘ইউরেকা। পেয়েছি।

 মিসেস চামেলি চৌধুরীর ললিত অধরখানা উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে ওঠে।

সপ্তাহের ওপর হয়ে গেল। মনোটোনাস ঘরবন্দি দশা। এভাবে কি চলতে পারে? দেশের বন্যা পরিস্থিতি ফ্লাড সিচুয়েশন নাকি ডেঞ্জারাস।  সো হোয়াট? আমার লেজে যতক্ষণ টান না লাগছে ততক্ষণ আমি ফ্রি-নো হেডেক।  অতশত বাজে চিন্তা করলে পোষায়? শরীর ও মন দুই-ই যে বিট্রে করে বসবে। থ্রিলিং একটা কিছু ব্যাপারস্যাপার না থাকলে একে যে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়ে যাবার দশা। সে বড্ড ন্যাস্টি হোপলেস সিচুয়েশন।

কেবল চাপ চাপ লেখার্জি বয়ে বেড়ানো।নিজের কথাগুলো নিজেকেই শুনতে হয় মিসেস চামেলির।

 

আনন্দিত আন্দোলনে ত্রস্ত টানে মোবাইল সেটটি আয়ত করেন চামেলি। শূর্পনখার মতো সুতীক্ষ্ণ বেগুনি রঙে চর্চিত নখগুলো সূচালো আর দারুণ চৌকস।

হ্যাল্লো সামিরা। আজ একটা হেভি প্রোগ্রাম সেট করে ফেলেছি। নিউজ পেপারে পড়লাম, ডিএনডি বাঁধ রূপগঞ্জ না টুপগঞ্জ কী একটা এলাকায় লিকেজ। কলকলিয়ে ঢুকছে ফ্লাডের পানি। বেশ একটা হুলুস্থূল ব্যাপার। কী দারুণ ফ্যানটাসটিক।  ওখানে চল একটা আউটিং এ যাওয়া

 ওপাশ থেকে খলখলিয়ে হেসে ওঠে সামিরা।

শোন, শোন চামেলি। আমাদের মরিয়ম মীর্জার হাজব্যান্ডের কিন্তু সামান্য হেডেক হলেও হতে পারে। ঐ ডিনএডি বাঁধের দায় তার ওপরও বর্তায়, লিকেজ কেন হলো। ছাগল-জনতা আবার কৈফিয়ত তলব করে না বসে!

দূর ছাই। হেল ইয়োর কৈফিয়ত। ঐ যে কবি বলেছেন না, ‘যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?’ সেই দশা। সেনটেন্সটা গুছিয়ে বলতে পেরেছি তো, নাকি?’

 দুই রমণী রিসিভার ভাসিয়ে জলতরঙ্গ হাসিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়েন। এত প্রাণপ্রাচুর্য। উপচে-উপচে কেবলই গড়িয়ে পড়ে।

 চামেলি চৌধুরী, সামিরা শোয়েব, মরিয়ম মীর্জা আর মঞ্জুরী বেগম-চার রমণী-চার সখী পাজেরো জিপে ছুটলেন প্লাবন দর্শনে। ঐ ঢেউ খেলানো রণরঙিনী বানভাসির অপরূপ নৃত্যপরা-রূপ দর্শনে অতঃপর….. মরিয়ম মীর্জা দায়িত্ববতী মহিলা বৈকি। আউটিঙের মজাই হলো টক- ঝাল-মিষ্টির স্বাদ নেয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতি দর্শন। তার সঙ্গে সর্বদাই অন্নপূর্ণার ভান্ডারের ছোট সংস্করণটি মজুদ থাকে। আউটিতে যেতে হলে জাঁকালো রসালো যাত্রাই করতে হয়। এ তথ্যে অন্য তিন রমণী ওয়াকিবহাল। তারপর রাতেই ফোনে ফোনে জেনে নিয়েছেন এই বর্ষায় কার কী অভিরুচি। রসনারও তো রং বদলায়। চিকেন স্যান্ডউইচ, টেস্টি পাকৌড়া, পাটিসাপটা, কাঁচাগোল্লা। হটপটে কফি পর্যন্ত। এনজয় করবে তো বাপু প্রাণ ভরে কর। চেপেচুপে মাত্রা গণনা করে কী পোষায়? হাড়কিপটে রুক্ষ ছক-মেলানো মানুষগুলো যে কী মজা পায় জীবনে। অথচ এই তো একমুঠো জীবন। একেবারেই একমুঠো।

 

ড্রাইভার কুতুবউদ্দিন বয়সে প্রৌঢ়। সর্বদা চিমসে মুখ জুড়ে জমাট মেঘের দল। আজ দৃঢ়ভাবে বসে যাওয়া অসময়ের বলিরেখাগুলো যেন থিরথির করে কাঁপছে।

 ক্যাসেটে বাজছে আমি চঞ্চল হে/আমি সুদূরের পিয়াসি।চার আকাশপরী এখন যেন এ তুচ্ছ পৃথিবীর কেউ নয়। বানে ভিজে জবুথবু এ স্বদেশভূমির তো নয়ই। তারা শুধু সুদূরের পিয়াসি আকাশকন্যা।

 ঈষৎ পৃথুলা মরিয়ম মীর্জা পরেছেন পারপল কালারের মিহি শিপন। কানে মুক্তোঘেরা এমিথিষ্ট। চুলগুলো বিশেষ যত্নে ফ্রেঞ্চ রোল করেছেন। তাতে মহার্ঘ হেয়ার পিন। রিস্টওয়াচটি পেলব রিসেট দারুণ অ্যাট্রাকটিভ লাগছে। মুক্তোগুলোও বড্ড লাভলি।

 চামেলী চৌধুরী কস্টলি সালোয়ার কামিজ পরেছেন। ললিত বাহুতে ঝুরি ঝুরি এক ডজন বাইশ ক্যারেট গোল্ডের চুড়ি। একটু নাড়া পেলেই ঠিকরে পড়ে স্বর্ণরেণু।

 অঙ্গুরীয় বিলাসিনী বলে খ্যাতি আছে সামিরার। ওর দেরাজে বিবিধ বর্ণের ডিজাইনের শত শত রিং। ওর এনগেজমেন্ট রিঙের ডায়মণ্ড নাকি লাখটাকা ছাড়িয়ে যাবে। ওর ইয়ার রিং-এর রক্তলাল চুনি আর রিয়েল পার্ল থেকে আভিজাত্য আর সৌন্দর্য যেন অপূর্ব মায়া বিস্তার করেছে।

 মঞ্জুরী বেগের নিটোল ফিগারের মাহাত্ম্য অনেক রমণীর প্রাণেই ঈর্ষার অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে দেয়। কী লালিত্য! কী দীপ্তি এই দেহলতায়। মাঝে মধ্যে সুতানলি সাপের মতো হিসহিসে হয়ে উঠতে পারে বুঝি। ডিএনডি বেড়ি বাঁধ জুড়ে চলছে যেন মহাযজ্ঞ। অগুনতি মাথা, বিজবিজে কাদার মধ্যে গাঁথা অসংখ্য কুচকুচে শরীর-এরাই সংখ্যায় গরিষ্ঠ। ছোট্ট কিন্তু পাওয়ারফুল বাইনাকুলারে চোখ রেখেছে চামেলি চৌধুরী। বাকি তিনজনের হাতে কস্টলি ক্যামেরা।

 অপূর্ব জলের কেলি। কী বিস্তার। কী বিস্তার। লাভলি ঢেউগুলো কী সুন্দর কিউট। মিসেস চামেলি গত সাতদিনের গৃহবন্দি দশায় থেকে একেবারে বোর হয়ে গিয়েছিলে। টিভি স্ক্রিনে আর কতক্ষণ চোখ রাখা যায়-সেই তো মনীষা, মাধুরী, সেই শাহরুখ আর জনম সমঝা কারো‘…… একেবারে বস্তাপচা বিকেলের কনে দেখা রোদে ভাসতে ভাসতে ঐ অকূল ঢেউয়ের অপরূপ বিস্তারে মনটা একেবারে সাম্বা ড্যান্স করে উঠল।

 ‘ও-য়া-ওা বি-উ-টি-ফুলা লাভলি। লাভলি।

 চামেলি যেন সিম্ফনি বাজান কোকিল কণ্ঠের ঈষৎ বিস্তারে। ওরা তিন রমণীও ঝলমল করে জ্বলে ওঠে। তিন কিন্নরী যেন আকাশমহল থেকে  আনন্দবিহারে পা রেখেছে মর্তে-এ বিরল প্রাকৃতিক শোভা দর্শনে। ওরাও সমস্বরে গায় আনন্দ সঙ্গীতের বিশেষ রাগিণী, ‘-ও-য়া-ওা-ও-  য়া-ও! চামেলি ইউ আর গ্রেট। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি ম্যাচ। থ্যাঙ্ক ইউ।

 মনে হচ্ছে কোনো আর্ট ফিল্মের মহড়া হচ্ছে যা কিনা অস্কার জিতে নেবে। ঝটিতি মাদার ইন্ডিয়ার কথা মনে এল মঞ্জুরীর। এক সময় নার্গিসকে ভালোই লাগত তার। বালির বস্তা একটার পর একটা পাহাড় হয়ে যাচ্ছে প্রায়। এদিকে নাগিণীরা ফুঁসছে। শোঁ-শোঁ হচ্ছে ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাসের। এতক্ষণে জলশোভা দর্শন শেষে মঞ্জুরী বেগ বলে ওঠে,

চল এবার নিরিবিলি কোথাও। ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই। এমন উত্তাল নদীর হাওয়া।”

 ওরা তিনজন হেসে গড়িয়ে পড়ে। মুহুর্মুহু স্ন্যাপ নিচ্ছে প্রত্যেকে। এমন অসাধারণ দৃশ্যপট। তার মধ্যে ঐ সব রূপচ্ছটা দেহবল্লরী।

পাজেরো দাপিয়ে নিরিবিলি একটা এলাকা চয়েজ করে ওরা। মরিয়ম বাস্কেট বের করে। সামিরা এনেছেন হরেক কিসিমের ফ্রুটস। মঞ্জুরী মোটা বর্ণিল শতরঞ্জিটা পেতে দেয়। টেপ রেকর্ডার, দেবব্রত বিশ্বাসের বর্ষার গান অবিরাম বেজে চলে,…. ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে‘…..

 ‘মনে করতে পারো কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত। বিকেলের সোনারোদে ভরে রয়েছে। ভাগ্যিস! আজ বৃষ্টি হয় নি এ বেলা। আমরা লাকি, সো লাকি।

মঞ্জুরী বেগ তন্দ্রালু মায়াবী চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে খুলতে মুগ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে।

 

সন্ধ্যা এখুনি তার ধূসর রঙের আঙরাখায় ভরে দেবে পড়ন্ত সূর্যের পরিশ্রান্ত অবয়ব।

 ‘এখনও হাতে আধ ঘন্টার বেশি সময় আছে। চল আমরা এবার নৌকায় চড়ব। দারুণ এক্সাইটিং। বছরভর গল্প করা যাবে ক্লাবে, পার্টিতে। চল চল, কুইক।

 মঞ্জুরী বেগ তাড়া দেন।

 ‘কুতুবমিয়া একটা শক্তপোক্ত নৌকা ভাড়া করো জলদি। ভাড়া মিটিয়ে

 নেবে, কেমন?’

 চামেলি খুশি ছড়িয়ে বলে।

ওরাও সমস্বরে বলে ওঠে,

 ‘কুইক কুতুবমিয়া। শক্তপোক্ত নতুন নৌকা।

 দূরে দুটো নৌকা-তাতে আহাজারিতে আকীর্ণ কয়েকটি মুখ। বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের কলসি। ঐ সব দূরের গ্রামবাসী। টিউবয়েল ডুবে গেছে। খাবার পানির সন্ধানে বেরিয়েছে ওরা। আর রিলিফ চায় ওরা। দুচোখে এক টুকরো খড়কুটো খোঁজে ওরা। কুতুবউদ্দিন তীক্ষ্ণ চিৎকারে ওদের সঙ্গে কথা বলে। কটা টাকার আশায় ওরা ডিনএডি বাঁধে নেমে পড়ে নৌকা খালি করে দেয়। নতুন চেরাইকাঠের গন্ধ নৌকায়। বি কেয়ারফুল।

 চৌদ্দ পনেরো বছরের উদোম গা মাঝির দুই চোখ ডুবে যেতে চায় কৌতুকে। কালো মুখে এক ঝাঁক সাদা দাঁত ঝিকিয়ে উঠেই মিলিয়ে যায়। ডরাইয়েন না। ডরের কিচ্ছু নাই। আপনেরা যুৎ কইরা বসেন। আমি আলগোছে নাও টান দেই।

 বেপরোয়া সাহসী অর্বাচীন বালকের অভয়বাণী ওদের শান্ত করে অতঃপর। বালক-মাঝির মাথায় হাজারো চিন্তার জট। এদের হাবেলি তো আর বানে ভাসে নাই। এই ফুলপরীরা এসেছে জলপরীদের সাথে ভাব জমাতে। এই ভ্রমণের মরতবা কী ভাবতে পারে না অর্বাচীন মাঝি। বানে ভেসে গেছে ওদের ভিটেবাড়ি। সুখী মানুষের এমন কাণ্ড বোঝে তার কী সাধ্য। শিক্ষিত মানুষের লীলার শেষ নেই। মঞ্জুরী বেগ ও সামিরা নৌকার পাটাতন গলুই আঁকড়ে স্থির হয়ে বসে থাকে। ওদের মস্তকঘূর্ণি ব্যারাম বোধ হচ্ছে। ওদিকে চামেলি মহানন্দে উথলে ওঠে,

 ‘অপূর্ব! অ-সাধারণ বি-উ-টি-ফুল।

 প্রচণ্ড স্রোত ওদিকটায়। মাঝি নৌকার মুখ ঘুরিয়ে ফেলে এস্ত ক্ষিপ্রতায়।

 মরিয়ম মীর্জার সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারা। তাদের এক পারিবারিক বন্ধু বলেছে, ঐ সব দুর্গত এলাকায় তড়পানো মাছ পাওয়া যায় সস্তা দামে। তাজা মাছ কোথায় মিলবে বলতে পারো?”

বালক খুব সাবধানে লগি বয়। সহসা কথা বলে না। খানিক দম নিয়ে লুঙ্গির মালকোচা খুলে ফেলে সে। গায়ের পানি কেচে বলে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে,

 ‘এই… ওই দিকে।

অপার থইথই পাখার সেদিকে তর্জনী নির্দেশ করে কালো কিশোর।

 ঝলমল করে ওঠে আকাশপরীরা।

দারুণ। লাফানো মাছ-ফিশফ্রাই-উফ।

অথৈ জলের দিকে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। পাশ কাটিয়ে যায় অ্যালুমিনিয়ামের কলসিভরা মাছওয়ালা। মাঝি হাঁকাহাঁকি করে একরাশ তড়পানো বারোমিশালি মাছ কিনে দেয় অ্যালুমিনিয়ামের কলসিসহ।

 এবার ফেরার পালা। ওদের মানতেই হয় এই নৌকা ভ্রমণ দারুণ রিস্কি। তবে প্রচুর স্ন্যাপ নেয়া হয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে থইথই সমুদ্র তার ওপর জলপরীরা ভাসছে।

 পাজেরো সোনাঝুরির গাছটার নিচে পার্ক করে কুতুবউদ্দিন গম্ভীর মুখে দেখছিল বানের পানির বেলাজ নৃত্য। খাঁজকাটা কপালের নিচে গর্তে বসানো দুটো চকচকে মার্বেলের মতো চোখ। বেগম সাহেবাদের নৌকা বরাবর অনিচ্ছুক পাহারায় ঘুরে যাচ্ছিল বারবার। বড়ই কঠিন দায়।

 

এবার পাততাড়ি গোটানোর পালা। অষ্টআশির বন্যায় চামেলি ছাড়া  

আর তিন রমণীই ছিল আমেরিকায়।

হারি আপ এভরি ওয়ান। মনে হয়, আমরা দারুণ এনজয় করেছি। এবার চল গুলশানে। ওখানে সামিরার ডাইনিং টেবিলে লবস্টার লম্বা লম্বা উড় নাচিয়ে শোকগীতি গাইছে।

ওরা চার উল্লাসিনী বন্ধুর রসিকতায় হুলুস্থূল করে হেসে ওঠে।

কুতুবউদ্দিন একমনে আস্তে আস্তে গাড়ি ড্রাইভ করছিল। চারপাশে থই থই জনতা। কাদা পানিতে সয়লাব।

 ‘হোয়াট হ্যাপেনড? এমন পিঁপড়ের মতো গাড়ি চালাচ্ছো কেনো?

কুতুবউদ্দিন।চামেলি খরখরে গলায় বলে ওঠে।

 ‘মানুষগুলো কেমুন দৌড়াদৌড়ি করতাছে। গাড়িচাপা পড়বে তো

 ম্যাডাম।”

 ‘ওহ হোপলেস। হর্ন দাও।

ভিতরের ঠান্ডায় কাচে কেমন কুয়াশার আস্তরণ পড়েছে এক বৃদ্ধের গায়ে গাড়ি প্রায় উঠে যাচ্ছিল। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় এক কর্দমাক্ত যুবক। হোঁচট খেয়ে রাতকানা বৃদ্ধ পড়ে যায় সড়কে। মুহূর্তে কী হয়ে যায়।…

কালো কাঁটায় গা-ভরা কৈয়ের ঝাঁকের মতো অসংখ্য মানুষ ধেয়ে আসে। মাছ তো কিনেছে ওরা নানা পদ-শুধু কৈয়ের প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। এখন নাকি হাজার লক্ষ অযুত নিযুত কৈয়ের ঝাঁক। কাঁটা ভরা গা কী ভয়াবহ!…

উফ!

 ছোট একটা আর্তধ্বনি বেরিয়ে যায় চামেলির স্ফুরিত অধরে…।

 

ঝাঁকে ঝাঁকে কালো-কালো মাথার মিছিল। কাদামাখা পা জোড়া-জোড়া মালকোচা উদোম গা।…

মুহূর্তে জ্বলে উঠেছে হাজার-হাজার অগ্নিমুখ বিসুভিয়াস। কালো-কালো উদ্ধত পা শীতলক্ষ্যার বানের তোড়ের চেয়ে তীব্র হয়ে আছড়ে পড়তে চাইল পাজেরোর স্বচ্ছ সফেদ যান্ত্রিক পারিপাট্যের ওপর।

 ‘নাইমা আয় ব্যাটা। মানুষ বইলা মালুম হয় না। নাইমা আয়। নাইলে হ্যাঁচড়াইয়া নামাইমু।‘… কুতুব প্রবল আন্দোলনে দুই কম্পিত রগভাসা হাত জোড়া করে ক্ষমা প্রার্থনা করে যত ততই জনতার আক্রোশ ফেটে পড়ে।  কোথা থেকে অসংখ্য বাঁশের দণ্ড উদ্যত হয়ে আসন্ন সন্ধ্যার আকাশ ঢেকে দিতে থাকে। এক দুই চার… অগণিত অসংখ্য কালো হাত ভয়াবহ বাঁশের দণ্ড… কালো কাঁটা ভরা কৈ।… এক্ষুণি গুঁড়িয়ে দেবে সব… তারপর?

 আচানক! ত্বরিৎ ভঙ্গিতে খাপখোলা তরবারির তীক্ষ্ণতা নিয়ে নেমে পড়লেন মঞ্জুরী বেগ।

হাওয়া খাইতে আইছিলেন নি, হাওয়া?’

 এক উদভ্রান্ত কোটরাগত চক্ষু প্রৌঢ়ের ঘৃণার উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হয় চরাচরে,

হাওয়া খাইতে আইছিলেন না আপনেরা? হাওয়া?

 সেসব কথা ভ্রূক্ষেপ করে না মঞ্জুরী বেগ। অকম্পিত কণ্ঠে ভিতরের আন্দোলন ফুটতে দেয় না সে।

 ‘ভাইসব। ড্রাইভারের পক্ষ থেকে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।

 ততক্ষণে বৃদ্ধকে টেনে তুলেছে গ্রামবাসী। ছোট একটা জটলা তাকে ঘিরে।

 ‘ভাইসব। আমরা হাওয়া খেতে আসি নি, আমরা এসেছি আপনাদের ত্রাণের ব্যবস্থা করতে। আজ সরেজমিনে আপনাদের দুর্দশা দেখে গেলাম। ফিরে গিয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা… আমরা এসেছি গুলশান সাউথ নারী কল্যাণ কেন্দ্রথেকে।

 

তীক্ষ্ণ উচ্চারণে মঞ্জুরী বেগ শত শত ফেটে পড়া জনতার ক্রোধের

 অনলকুণ্ডে পানি ঢালতে থাকেন পরম নিষ্ঠায়।

এবার হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়েন চামৌর, মরিয়াম, সামিরা। চামেলি পারপল কালারের মসৃণ শিফনের ঘোমটা টেনে নেন যত্নে বাঁধা খোঁপায়।

 মরিয়ম, সামিরাও ততক্ষণে অনভ্যস্ত হাতে টেনে নিয়েছেন অবগুণ্ঠন।

 বিয়ের পর এই প্রথম বোধহয় এমন ঘোমটা রচনা!….

 চামেলি শূর্পণখা অঙ্গুলিগুলো বিভিন্ন মুদ্রায় প্রস্ফুটিত করে ভেঙে পড়ে অনুনয়ে,

 ‘আমরা এসেছি এলাকার মা-বোনদের আব্রু আর আহার জোটাতে। আমরা ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট মানে সাংবাদিক। আমরা আপনাদের সকলের দুর্দশার ভাগদার হতে চাই। ক্যামেরা ভরে আপনাদের দুর্ভোগের ছবি নিয়েছি। সবকিছু রেকর্ড হয়ে গেছে।

 মরিয়ম মীর্জা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। তবু স্পষ্ট উচ্চারণ দীপ্ত ভঙ্গিতে বলে যায়,

আমি একজন ফটো-সাংবাদিক। ভাইসব, কেবলমাত্র সরকারি ত্রাণ দিয়ে এ বিপদ উদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা যে যেভাবে পারি এগিয়ে দেবো বন্ধুর হাত। এদেশ আমাদের। দুর্যোগ আসে প্রতি বছর। এর মোকাবিলা আমাদের সকলের করতে হবে সাহসের সঙ্গে। বাঁধ রক্ষায় আপনাদের প্রচেষ্টা আমাদের আশাবাদী করেছে। আগামী রবিবার আমরা আসব ইনশাল্লাহ শুকনো খাবার, বস্ত্র ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে।

 ‘কত রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা স্বাধীন এ মাটি-এ দেশ রক্ষা করতে হবে। বিপদে আমরা যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি তো এ স্বদেশভূমি যে পাথর হয়ে যাবে, মরুভূমি হয়ে যাবে।

 সামিরা এতক্ষণ হাজার ভোল্টের শক খাওয়া মানুষের মতো বোধশূন্য ছিল। এবার অকম্প কণ্ঠে সে ভাষণ দিতে থাকে,

 

ভাইসব। অতি সামান্য কিছু টাকা এনেছিলাম। কেন্দ্রের মহিলাদের চাঁদা। তা-ই দিয়ে যেতে চাই।

চার বিপদগ্রস্ত রমণী পায়ের তলায় সামান্য মাটি যেন খুঁজে পান। টাকা যখন নিয়েছে তখন আর বিট্রে করবে না নিশ্চয়ই। রমণীরা এখন তপস্বিনী।মঞ্চ-নাটকের কুশলী নায়িকা। কোনো অব্যর্থ তন্ত্রমন্ত্র আওড়াচ্ছে ক্রমাগত প্রাণের গভীরে। কয়েকটি নিথর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হয়। জনতার ভয়াবহ ক্ষোভ যেন কমে আসছে।…

 সামিরার ভাষণ শেষ হয় নাই। সে মাথার ঘোমটা সাবধানে টেনে ধরে বলে চলে,

ঐ কালুরাক্ষুসী শীতলক্ষ্যা যেভাবে রঙিনী হয়ে উঠছে তাতে ভয় হয়। সে কী চায়? আমরা সবাই মিলে ওর গভীরে যে ক্রোধ, যে বিষ হিসহিস করছে তার বিনাশ করব, করতেই হবে। কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করা যাবে না ভাইসব।

 ততক্ষণে গুটিগুটি পায়ে বৃদ্ধ এগিয়ে এসেছেন। দ্রুত সামিরা আপন ললিত কাঁধে লতিয়ে দেয় বৃদ্ধের জীর্ণ বাহু।

 চামেলি টিস্যু পেপার চেপে ঘাম মোছে।

 বিস্ফোরক ক্রোধে বিস্তৃত অজস্র ফণা যেন দুলছে… কেবল দুলছে। উন্মত্ত জনতা মৃদুমন্দ দুলছে। ফণাগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কাঁটাগুলো সংবরণ করেছে ওরা।

 জনতা মৃদুমন্দ দুলছে যেমন বাঁশির তরঙ্গে মোহিত সর্প নিস্তেজ ফণা

 দুলিয়ে দোল খায়।

দিলারা মেসবাহ
দিলারা মেসবাহ