চন্দনের গন্ধ / আফরোজা অদিতি

চন্দনের গন্ধ 14,15

চন্দনের গন্ধ / আফরোজা অদিতি

পর্ব ১১

 

সেদিন রবিবার। স্নান সেরে নাস্তা করে প্রতিদিনকার মতো কাপড় পরার আগে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে তিমির। ধোঁয়ার রিং ছড়িয়ে দেয় বারান্দার বাতাসে। তিসু চা এনে রাখে টেবিলে।

‘আজ কী অফিসে না গেলেই নয়!’ কথা বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তিসু।

‘কেন?’

‘না, আজ তোমার অফিসে গোলমাল হবে। তোমার বিপদ হবে!’ নির্বিকার কন্ঠে বলে তিসু।

‘তুমি জানলে কী করে! হাত গুনতে জান নাকি?’ তিমিরের কন্ঠের তির্যকভঙ্গী লক্ষ্য করলেও গায়ে মাখে না তিসু।

‘আমি স্বপ্নে দেখেছি। তোমাদের ব্যাংকে ডাকাতি হচ্ছে।’

‘পাগল তুমি। স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না।’

 চা আর সিগারেট শেষ করে কাপড় পরে তিমির।

‘তুমি সত্যি যাচ্ছ তাহলে?’

‘যাব না! দেখব না, তোমার স্বপ্ন কতোটা সত্য!’

‘ঠাট্টা নয়। তোমার সঙ্গে আমার ঠাট্টার সম্পর্ক নয়। তুমি যাচ্ছ ভালো কথা, কিন্তু নিচে নামবে না! তিসুর বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যা তিমিরকে কথাটা মনে রাখতে সাহায্য করলো। এরপর তিসু ‘ বিপদ তো একটা হবেই…’ বলে আনমনে আরো কী যে বিড়বিড় করছিল তা

বুঝতে পারলো না তিমির। অফিসে বের হয়ে গেল।

বেলা প্রায় এগারোটা। তিমিরের চেম্বারে অনেকদিনের পুরানো বন্ধু সুজিত এসেছে। প্রায় ছয় বছর পর দেখা। বিদেশ থেকে দেশে এসে পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষ্যাৎ করছে! দুই বন্ধু মিলে গল্প করছিল। গুলির আওয়াজ এল নিচ থেকে। সুজিত প্রথম কথা বলে।

‘নিচে কিছু হলো নাকি?’ তিমির জানালায় উঠে গিয়ে দেখে কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না।

পিয়নকে বন্ধুর জন্য চা-আর কিছু খাবার আনতে নিচে পাঠিয়েছিল। চা এবং কিছু মিষ্টি, লুচিসহ আরো কিছু খাবার ট্রেতে নিয়ে রূমে ঢোকে সে। ওকে জিজ্ঞেস করে তিমির।

‘কী হয়েছে? তুমি কাঁপছো কেন? আর নিচে কিসের শব্দ হলো? বন্দুকের গুলির মতো মনে হলো!’

‘হ্যাঁ, স্যার! চারজন লোক বন্দুকের ফাঁকা শব্দ কইরে কাউন্টার থেকে টাকা লইয়ে গেছে। দারোয়ান আর ক্যাশিয়ার সাহেবের মাথা ফইট্টা গেছে। বন্দুকের বাঁট দিয়া ওনাগো মাথায় মারছে তো।’ ‘কী!’ চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় তিমির।

সুজিতকে বলে, ‘তুই চা খেতে থাক আমি আসছি।’ বলে বুঝতে পারলো ওর হাত-পা কাঁপছে! দাঁড়াতে না পেরে আবার চেয়ারে বসে পড়ে । তিমিরের মনে পড়ে গেল তিসুর সকালের কথাগুলো। ওর পিপাসা পেল খুব। ঢকঢক করে জল খেল। সব কথা হারিয়ে গেছে মুখ থেকে; সুস্থির হতে পারছে না কিছুতেই, কাজের কথা মাথায় আসছে না! খুব অসহায় লাগছে নিজেকে! কিছুক্ষণ পর মন শক্ত করে নিচে নামার জন্য তৈরি হয়; সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে পিয়নকে বলে, ‘কী বলছ তুমি! আর সব

কোথায়?’ ‘সবাই টেবিলের নিচে লুকাইছিল। আমি চা নিয়া আইতেছি যখন সিঁড়িতে উঠতে নিছি সেই সময় অরা আমার দিকে বন্দুক তাক কইরে রাখছিল।’ একটানা কথাগুলো বলে গেল পিয়ন রবি। অনেক কষ্ট করে এই পিয়নটাকে কথা শিখিয়েছে! তারপরেও এইভাবে কথা বলে

রবি।

তিমির নিচে এল। তিসু না করেছিল কিন্তু নিচে না এলে তো চলবে না। এখানকার ম্যানেজার, সব দায়-দায়িত্ব তো ওর! জবাবদিহী করতে হবে ওকেই। খাতাপত্র মিলিয়ে দেখল প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতরা। সব গুছিয়ে পুলিশি-ঝামেলা মিটিয়ে চেম্বারে এল। তিসু কেমন করে জানলো যে ডাকাতি হবে ব্যাংকে! তাহলে কি ডাকাত দলের সদস্য তিসু! ডাকাত দলের হয়ে কাজ করে তিসু? ওর নিজের ভাবনাতে নিজেরই হাসি পেল। তিসু তো বাড়ি থেকেই বের হয় না!

তাছাড়া ও তো ওর লাইব্রেরি আর মেয়ে নিয়েই থাকে। মোবাইল আছে না! মনের মধ্যে একটা কিন্তু একটা খচখচানি নিয়েই বাসায় ফিরলো; বাসায় ফিরতে ফিরতে আজ একটু দেরি হলো।

তিমিরকে কোন কথাই বলল না তিসু। তিমিরও এই প্রসঙ্গ তুললো না।

নিত্যদিনের মতো চা খেল তিমির। অফিস থেকে যখনই বাসায় ফেরে তখনই এক কাপ চা চাই তাঁর। চায়ের সঙ্গে সিগারেট হবে তারপর অন্য কিছু। চা খেতে খেতে টুকটাক সাংসারিক কথা বলল তিসুর সঙ্গে; মেয়ের সঙ্গে সময় কাটালো! কিন্তু মনের আড়ষ্টভাব কিছুতেই কাটাতে

পারলো না তিমির। তিসুকে কিছুতেই বলতে পারলো না, তিসু তোমার কথাই ঠিক। তুমি কীভাবে জানলে আজ ব্যাংক ডাকাতি হবে! আমি তো কিছুতেই এই কথা কাউকে বলতে পারছি না। আমাকে সব কথা বলতে পারো না কেন? তোমার এত দ্বিধা কেন? আমি তোমার স্বামী, তুমি আমার মেয়ের মা। তাহলে কেন এত দ্বিধা রাখ তোমার মনে। আমি তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি… অনেক…অনেক ভালোবাসি। তিমির এত কথা মনে মনে বললেও মুখে একটা কথাও বলতে পারলো না তিসুকে!

তিমিরের চা শেষ হলে কাপ-পিরিচ নিয়ে রান্নাঘরে ধুয়ে রাখতে গেল। ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তিমির। ওর মনে হলো খুব রোগা দেখাচ্ছে তিসুকে। ওর শরীর খারাপ? কই কিছুই তো বলেনি! তিসুকে জিজ্ঞেস করতে হবে কী হয়েছে? কেন এত রোগা দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু তিসু কাপ-পিরিচ নিয়ে সেই যে গেল প্রায় একঘন্টা হয়ে গেল আসছে না। তিসুকে না ডেকে নিজেই রান্নাঘরে গেল তিমির। দরোজার কাছে থেকে শুনতে পেল তিসুর কান্নাভেজা ভারী কন্ঠ।

কথা বলছে কার সঙ্গে? দরোজার পাল্লা ভেজানো! কান পেতে দাঁড়ালো তিমির। অন্য কোন কন্ঠ শুনতে পেল না তিমির। শুধু তিসুর কন্ঠই শুনতে পাচ্ছে।

‘আমি চলে যাব! কী বলছো এসব?তিমিরকে ফেলে, উর্মিকে ফেলে আমি চলে যাব। না, না তা হয় না! ওরা তো কোনো অন্যায় করেনি। উর্মি, ও আমার মেয়ে ওর কী দোষ বল! ওকে ফেলে রেখে আমি চলে যাব! না, না আমি পারবো না।’ তিমিরের কৌতূহল বেড়ে যায়। এগিয়ে গিয়ে

পাল্লা একটু ফাঁক করে দেখে কেউ নেই শুধু তিসু হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পাল্লা ফাঁক করাতে ভেতরের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কেউ নেই! শুধু তিসু একা! কিন্তু কথা বলছে কার সঙ্গে সেটা বুঝতে পারলো না তিমির। বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধৈর্য রাখতে না পেরে দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে তিসুর চিৎকারে দাঁড়িয়ে গেল। তিসু হাত দিয়ে মার

ঠেকানোর চেষ্টা করছে আর চিৎকার করে বলছে.  মেরো না, আমাকে মেরো না।…

এই ঘটনার পরে স্থির থাকতে পারে না তিমির। ডেকে ওঠে, ‘তিসু এই তিসু।’

তিসু চোখ তুলে তাকালো কিন্তু অদ্ভূত সে দৃষ্টি, পাগলাটে ভাব যেন খেলা করছে চোখে-মুখে। তিসুকে ধরতে যাবে কিন্তু ওর গালে একটা চড় এসে সপাটে পড়লো। ওর গালটা জ্বলে যাচ্ছে আগুনের মতো! কে মারলো? বুঝতে পারলো না। ওখান থেকে তিসুকে প্রায় কোলে নিয়ে

ঘরে এল তিমির। ঐদিন আর কোন কথা হলো না। তিসুকে শুইয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল তিসু। তিমির কিছু খেল না। উর্মি তো ওর দিদার কাছে শোয়। ওখানেই খেয়েছে মনে হয়।

মেয়ের খবর নিয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখে মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ওর মা-বাবা শোয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মেয়েকে একটু আদর করে ঘরে এল।

পরদিন রাত্রে। তিসু চুল বাঁধছে আয়নার সামনে, তিমির বই পড়ছে। তিসুর চুল বাঁধা শেষ হলে চিরুনি থেকে চুলগুলো ছাড়িয়ে একটু থুতু ছিটিয়ে কাগজের বাক্সে রেখে দিলো। কাগজের বাক্সটা চুলে ভরে গেলে মাটিতে পুঁতে রাখবে। বাগানের একজায়গায় একটা গর্ত করে রেখেছে

যেখানে বাক্সটা চুলে ভরে গেলে ঐ চুল বের করে পুঁতে রাখে। চুল তো পচে না, মাটিতে মিশে যায় না।

তিসুর চুল বাঁধা শেষ হলে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসে। তিমিরি বই একপাশে রেখে ওকে বলে, ‘ তুমি দিন দিন এত রোগা হয়ে যাচ্ছ কেন তিসু? তোমার কী কোন অসুখ করেছে? ’

‘না, কোথায় রোগা হয়েছি। আমি ঠিক আছি।’ স্বামীর কথার উত্তর দেয় তিসু।

‘অসুখ করেনি তাহলে খাওয়া-দাওয়া করছো না ঠিকঠাক। ভিটামিন এনে দিয়েছিলাম, সেই বোতল তো খোলাই হয়নি দেখলাম। আমি অফিস করে এসে তোমাকে আর কত দেখবো বল তো সোনা!’

‘আমি সব ঠিকঠাক খাচ্ছি। ভিটামিন খেতে ভালো লাগে না।’

‘ওষুধ কি কেউ ভালো লাগে বলে খায়! ওষুধ খায় মানুষ অসুখ সারিয়ে শরীর ভালো রাখার জন্য।’ এরপর দুজনের আর কথা হয় না।

তিসু শুয়ে পড়ে। তিমির খেয়াল করে তিসুর গলার তাবিজটা নেই। তাবিজের কথা জিজ্ঞেস করে ।

‘তোমার তাবিজ কোথায় তিসু?’

‘হারিয়ে গেছে।’ সোজা উত্তর দেয় তিসু।

‘হারিয়ে গেছে! আমাকে বলনি কেন?’

‘এমনি।’

এবারে রাগ হয়ে যায় তিমিরের। বলে, ‘এটা কোন উত্তর হলো। এমনি। তুমি কী চাও বল তো বউ, আমাদের সংসারটা নষ্ট হয়ে যাক। একটা মেয়ে আছে আমাদের। ও দিন দিন বড়ো হচ্ছে। এখন যদি

চাও সংসার নষ্ট হোক তাহলে কী করে চলবে তিসু।’

‘তা চাইব কেন?’ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে তিসু।

‘তবে সব ঠিকঠাক করছো না কেন?’

‘সবই তো ঠিক করছি।’

‘না কিছুই ঠিক করছো না।

তিমিরের এই কথা শোনার পর তিসুর রাগ হয়ে যায়। রেগে আগুন তিসু বলে, ‘যা করছি, বেশ করছি, ঢের করছি। এর বেশি আর পারবো না।’ ওর রাগ দেখে একটু নরম হয় তিমির। ওকে কাছে টানে। আদর করে। নরম স্বরে কথা বলে।

‘তোমার কি আমার আর উর্মির কথা মনে পড়ে না! আমাদের কথা একটু ভাববে না তুমি।’

‘ভাবার কোন দরকার নাই।’ তিসুর এই রকম সোজাসাপটা কথাতে আহত হয় তিমির। কষ্ট বাজে বুকের গভীরে। আর কোন কথা হয় না, কথা থাকে না আর! তিমিরের দিকে পিঠ দিয়ে পাশ ফিরে

শোয় তিসু। স্বামীর দিকে তাকালে দেখতে পেতো দুঃখভারাক্রান্ত একটি হৃদয় আর দুটি চোখে উত্তাল সাগর! তিমির ঘুমাতে চেষ্টা করে। তিসুকে কোনরকম জ্বালাতন করে না তিমির।

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি