চন্দনের গন্ধ ৪/ আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

পর্ব ৪ 

 

তিসুর মা মারা যাওয়ার দুই বছর পরেই বিয়ে করেছে তিসুর বাবা। নতুন মা কখনও ওকে বকাবকি করেনি, কখনও আদরও করেনি। পছন্দ-অপছন্দ,আদর-অনাদর কোনটাই যেন তাঁর কাছে মূখ্য নয়। তিসু নামের একটা মেয়ে আছে সেটাও যেন সে জানে না। যখন ওর সাত বছর বয়স তখন এসেছে নতুন মা আর তাঁর সঙ্গে এসেছে ওরই বয়সী তাঁর নিজের মেয়ে রীনি। নিজের মেয়ে রীনিরও ঐ একই অবস্থা! এই মা যেন কাউকে ভালোবাসতেজানে না, পারে না! তাঁর মেয়ে হয়েও রীনি ওকে খুব ভালোবাসে। রীনি আর ও দুজনেই একই সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছে। ওদের জন্য একজন আয়া ছিল, সবকিছু সেই করেছে। বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত থেকেছে তাঁদের পার্টি, তাঁদের ব্যবসা নিয়ে। নতুন মা হৈচৈ খুব পছন্দ করেন। তিসুর হৈচৈ-হুল্লোড় একটুও ভালো লাগে না। যদিও রীনি আছে আর রীনির সঙ্গে সময় বোরিং হয়নি কখনও,  তবুও তিসু জানে ওখানে গেলে ওর ভালো লাগবে না, স্বস্তি পাবে না একটুও; তবুও যাবে। এই বাড়িতে দম বন্ধ আসছে ওর। একটুও ভালো লাগছে না। ঐ বাড়িতে কয়েকদিন থেকে আসতে চায়। কিন্তু এখানে তো অনেক কাজ; নয়নের বিয়ে তবুও যাবে। আশির্বাদ শেষে বিয়ের দিন তারিখ পাকা হয়ে গেলে তিমির মাকে বলল, ‘মা কয়েকদিনের জন্য বাবার ওখানে রেখে আসি তিসুকে।’ মা ছেলের কথা শুনে তাকাল তিমিরের দিকে। বলল, ‘এই সময়ে কেন যাবে বউ? বাসায় কত কাজ, কেনাকাটা আছে। বড়ো বউ তো কখনও তেমন কাজ করতে পারে না।’ তিমির সব কথা বুঝিয়ে বলল মাকে। সব শুনে রাজী হলেন মা।

 

বাবার বাড়ি গেল তিসু। কিন্তু তিমিরকে ছাড়া ওর ভালো লাগে না কখনও; লাগছে না আজও। রীনির সঙ্গে গল্পও অতো জমছে না। দুই দিন থাকার পরেই মন আর টিকতে চাইল না! বিয়ের এই কয়মাসে একবার এসেছিল, তারপর আর আসেনি এখানে। ভালো লাগছে না ওর; মন টিকছে না বুঝতে পেরেই চলে এসেছে এই বাড়িতে। ওকে দেখে শাশুড়ি অবাক! শাশুড়িকে ছালাম করে তিসু। নয়ন তাঁর এই ভাবীকে খুব পছন্দ করে, ভালোবাসে। নয়ন উচ্ছল হয়ে ওঠে। তিসুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাবী, তুমি এসেছ খুব ভালো লাগছে। কিন্তু মাত্র তো গেলে আর এলে।’ 

‘নারে, চলে এলাম; তোদের ছেড়ে ভালো লাগছিল না। তাছাড়া তোর বিয়ে। তুমি ভালো আছ তো ননদীনি?’

‘হ্যাঁ।’ 

‘আপনারা ভালো আছেন মা। বাবার হাঁপানির টানটা কি কমেছে মা? আর বিপুমনি, দিদি, দাদা ওরা সবাই কেমন?’

শাশুড়ি ওকে কাছে টেনে নেয়। বলে, ‘হ্যাঁ, মা সবাই ভালো। কিন্তু তোমাকে দেখে তো ভালো লাগছে না। এত রোগা লাগছে কেন মা।’ শাশুড়িকে বলতে চায় না ওর যে কিছুই ভালো লাগে না। তিসু বলে, ‘না, মা ভালো আছি।’ 

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শাশুড়ি বলে, ‘কিন্তু তোমাকে দেখে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না মা।’ 

‘না, মা ভালো আছি। আপনি আমাকে খুব স্নেহ করেন তো তাই রোগা দেখছেন ম্া। আমি ভালো আছি।’ 

‘বেয়াই, বেয়ান আর তোমার বোন রীনি ভালো আছে? তোমার বোনটাকে নিয়ে এলেই পারতে মা।’

‘না মা,  এল না। রীনি, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে হিন্দী কোর্সে ভর্তি হয়েছে সেটার পরীক্ষা শুরু হয়েছে তাই আসতে পারল না। পরীক্ষা শেষ হলে আসবে।’

 

তিমির অফিস থেকে ফেরেনি। তিসু ঘরে যেতেই একটা সুন্দর গন্ধ নাকে এসে লাগে; গন্ধটা যেন ধীরে ধীরে পেঁচিয়ে ফেলছে ওকে। ওর চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। কখন ঘুমিয়ে যায় বুঝতেই পারে না। আজানের সময় ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে একটা বাঁশির সুর শুনতে পেয়েছিল, ঘুম ভাঙার পরেও সেই সুর শুনতে পাচ্ছে! ঐ বাঁশির সুরে আনমনা হয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে আছে, উঠতে চাইছে কিন্তু পারছে না; শুয়েই থাকে। এমন সময় ‘চাচি, চাচি’ ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকেই লাফিয়ে বিছানায় তিসুর কোলের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ে বিপুল। বিপুলের ডাকে আনমনা ভাব কেটে যায় তিসুর। এখন আর বাঁশির সুর শুনতে পাচ্ছে না, পাচ্ছে না সেই সুগন্ধ। বিপুলকে জড়িয়ে আরও কাছে টেনে নেয় তিসু। ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছ বিপু সোনা।’ বিপুল এ কথার ধারে কাছে না গিয়ে চাচিকে একটা চুমু দিয়ে দারুণ উৎসাহে বলতে থাকে, ‘জানো চাচি, তুমি যখন ছিলে না তোমার ঐ আলমারির মাথার ওপর একটা মানুষ নাচছিল।’ বিপুলের থেমে থেমে উচ্চারণের পুরো বাক্যের কিছুই উদ্ধার করতে পারে না ও। তাই আবার জিজ্ঞেস করে, ‘কী বলছো বিপু সোনা।’

‘ঐখানে একটা মানুষ নাচছিল।’ আলমারির ওপরে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় বিপুল। তারপর কিভাবে নাচছিল তা অঙ্গভঙ্গি করে দেখায়।

‘কি হয়েছে তিসু’ বলতে বলতে বিপুলের মা, রায়না ঘরে ঢোকে। 

‘এস দিদি এস। বিপুল কী বলছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না দিদি।’ 

‘হ্যাঁ, তিসু; ও যে কী বলছে আমিও বুঝিনি। তুমি যেদিন তোমার বাবার ওখানে গেলে সেইদিন আমাকে আর ওর আব্বুকে এই কথা বলেছে। আমরা কিছুই বুঝিনি। আলমারির মাথায় মানুষ নাচবে কীভাবে? আর কেউ যদি নাচে তাহলে কি আলমারি আস্ত থাকে তুমিই বল। ওসব কথা থাক, তুমি কেমন ছিলে বল।’

‘ভালো ছিলাম দিদি।’ রায়নার ছোটোখাটো দোষগুলোবাদ দিলে ওকে ভালোই লাগে তিসুর। ওর চেয়ে বয়সে দুই তিন বছরের বড়ো হবে। আই.এ. পাশ করার পর বিয়ে হয়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ি রাজী থাকলেও আর পড়া চালিয়ে যায়নি রায়না। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর চলে যায় রায়না। বিপুলের বলা কথাগুলো চিন্তা করে তিসু। ওর বলা কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। তিসু জানে, বিপুল যা বলছে মিথ্যে নয়। মিথ্যে দেখেনি বিপুল! ও নিজেও দেখেছে মানুষের ছায়া ঘরের ভেতর হেঁটে চলে বেড়াতে। যে হেঁটে বেড়ায় তাঁর গা দিয়ে বের হয় চন্দনের গন্ধ। সেই ছায়ামূর্তি হাঁটে হাঁটে আর একটা হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে এগিয়ে আসে।  

 

এই বাড়িতে যে ছায়ামূর্তিকে হাঁটতে দেখেছে, যার গা থেকে বের হওয়া চন্দনের গন্ধ পেয়েছে, সেই ছায়ামূর্তিকে দেখেছে ওর বাবার বাড়িতে হাঁটা-চলা করতে। রাতে ঘুম আসছিল না। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল; মায়ের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছিল তিমিরের কথা, বিপুলের কথা; এ বাড়ির সকলের কথা মনে পড়ছিল ওর। কান্না পাচ্ছিল তিমিরের জন্য; ও বড়ো ছিঁচকাঁদুনে হয়েছে আজকাল। কথায় কথায় কান্না  ওর একটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই কান্নাস্বভাব ভালো নয় সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। কিন্তু আটকে রাখতে পারছে না। ও কাঁদছিল; হঠাৎ খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢোকে সঙ্গে আসে চন্দনের গন্ধ। ঘর ভরে যায় মিষ্টি চন্দনের গন্ধে। জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর। তিসু খোলা জানালাটা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনই দেখে ঘরের পূর্বকোণে যেখানে ওর মায়ের বিশাল এক সিন্দুক রাখা আছে সেখানে একটা লম্বা ছায়া; মানুষের ছায়া। কিন্তু মানুষ কোথায়? মানুষ নেই অথচ ছায়া আছে অদ্ভূত ব্যাপার! এই ঘরটা তিসুর মায়ের। মায়ের ঘর সাধারণত তালাবন্ধ থাকে। তিসু এসে এই ঘরে থাকতে চেয়েছে তাই এই ঘরে থাকা। রীনিও ওর ঘর ছেড়ে বোনের সঙ্গে ঘুমাবে বলে এই ঘরে ঘুমাতে এসেছে! রীনি ঘুমাচ্ছে। তিসু ওদিকে আর একবার তাকায়; তাকাতেই দেখতে পায় একটা বিশাল হাত ঈগল পাখির ডানার মতো ছায়া বিস্তার করে এগিয়ে আসছে। তিসু চিৎকার দিয়ে চেতনা হারিয়ে ফেলে। কতক্ষণ এমন ছিল তা মনে নেই তিসুর। চেতনা ফিললে দেখে মুখের ওপর ঝুঁকে আছে রীনি। তিসুর চিৎকারে জেগে ওঠে রীনি আর পাশে ওকে দেখতে না পেয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতেই দেখতে পায় মেঝেতে পড়ে আছে তিসু; তিসু চোখ খুলতেই রীনি বলে, ‘এই তিসু-পা, অমন চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালি কেন?’

‘আমি কেন যেন ভয় পেলাম। বুঝতে পারিনি।’ 

‘এখন চল তো, বিছানায় চল। তুই খাট থেকে নেমেছিলি কেন?’

‘কেন নেমেছিলাম কী জানি!’ মাথা নিচু করে বসে থাকে তিসু। 

‘চল তো, আর এখানে বসে থাকিস না।’ বোনের কথায় খাটে উঠে শুয়ে পড়ে। রীনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। 

‘আপু, বল তো কী হয়েছে তোর?’

‘কই কিছু নারে!’

‘তাহলে, অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন? তোর কী দুলাভাইয়ের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না।’

‘যাহ্!’ লজ্জা পায় তিসু।

‘নাহ্! তুই একা এলি! ও বাড়ি থেকে তোর সঙ্গে কেউ এল না তো তাই।’ উদ্বেগ উৎকন্ঠা মিশ্রিত রীনির কন্ঠ ভালো লাগে তিসুর। কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ‘থাক থাক আর পাকামো করতে হবে না। কি আমার বড়ো দিদি এসেছেন। ঘুমা।’ রীনি জড়িয়ে ধরে বোনকে। বলে, ‘নারে, ঘুম আসছে না, তুই এসেছিস ভালো লাগছে। তা না হলে সারাদিন একা একা বোরিং লাগে। পুরো বাড়িতে আমি আর জয়গুনের মা। মা-বাবা তো সারাদিন ওদের ব্যবসা-পার্টি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রাতেও দেখা হয়না ওদের সঙ্গে; ওরা যতক্ষণে আসে ততক্ষণে ঘুমিয়ে যাই আমি। ভাবছি লেখাপড়া ছেড়ে দিব।’ 

‘নারে দিদি, এই কাজই করিস না। জ্ঞান মানুষের প্রিয় সম্পদ; আর বই মানুষের একাকীত্ব দূর করে। গল্পের বই পড়বি, দেখবি কোথা দিয়ে সময় চলে গেছে বুঝতেই পারবি না। আর সবসময় মনে আনন্দ রাখবি, লেখাপড়া করবি, সেই সঙ্গে ভালো মানুষ হবি, তা নাহলে কেউ সম্মান দেয় নারে পাগল! সে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক।’  

 

একটু চুপ করে থাকে তিসু। বোনকে বুকের মধ্যে চেপে রাখে। বুকে চেপে রাখা দেখে মনে হয় বোনের সব দুঃখ-কষ্ট নিজের মধ্যে নিতে চাইছে তিসু। এই মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে তিসুর। বোনের মুখ তুলে বলে,‘কাল আমি ঐ বাড়িতে যাবো, যাবি আমার সাথে।’

‘নারে আপু, কাল পরীক্ষা।’ দুজনের আর কথা হয় না। ঘুমিয়ে যায় ওরা। সারারাত আর কোন অসুবিধা হয় না। 

( চলবে)

 

%d bloggers like this: