ছোট্ট হিসাব/ রাশেদুল ইসলাম

রাশেদুল ইসলাম

অনেক দিন পর ঢাকার রাস্তা । কেমন অচেনা শহর যেন । গাছের পাতাগুলো গাড় সবুজ । বুনো বুনো ভাব । রাস্তার দুপাশে সুউচ্চ অনেকগুলো ভবন চুপচাপ দাঁড়িয়ে । এগুলো না থাকলে ষাটের দশকের ঢাকা বলা যেত । আমার অফিস  আগারগাঁও-এ । কিন্তু  আমি ঘুরে ঘুরে যাই । রাস্তার মুখোশ পরা মানুষ  আর বুনো গাছপালা  সবই কেমন  অপরিচিত মনে হয় আমার । এ যেন আমার চেনা ঢাকা শহর নয় ।  নিজের মুখের মুখোশে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার । 

অফিসের সামনে কঠোর নিরাপত্তা বলয় । অদৃশ্য এক ভাইরাসের ভয়ে তটস্থ সবাই । আমি নিয়ম মেনে  নিজের অফিস কক্ষে ঢুকি । ঝটপট  মুখোশটা খুলে ফেলি । অফিসের কাঁচের জানালা খুলতেই   এক ঝটকা বাতাস । একটা লম্বা দম  নিই আমি  । মুহূর্তেই সবুজের সমারোহ, আর  পাখির কিচিরমিচির শব্দে মনটা পাগল হয় আমার । নিজেকে বাংলার স্বাধীন নবাব মনে হয়  । মনে হয় কতদিন পরে  একটা নিঃশ্বাস নিলাম যেন !  আর, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার নামই তো  জীবন ! কিন্তু আমরা  এখন নিঃশ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছি  কেন ?  নিশ্বাসের সাথে করোনা ভাইরাস ঢুকে যাবে? যদি যায়,  তারপর?  হায় ! হায় !!  কি হবে আমার এই অমূল্য জীবনের?  সত্যিই এ এক  কঠিন প্রশ্ন । এমন কঠিন প্রশ্নের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে  মানুষ প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেবে কি করে ? 

এ কঠিন প্রশ্ন আমার মত লকডাউনে থাকা মানুষের । লকডাউনে থাকতে থাকতে আমার মনটাও লকডাউনে ঢুকে গেছে । খাঁচার পাখি যেমন আকাশে ওড়া পাখি দেখে ভয় পায়-ঠিক তেমনই যেন !  তার মনে হয়, ‘মেঘে কোথা বসিবার ঠাই’ ? খাঁচার পাখিরও  আকাশে উড়তে সাধ  হয় । কিন্তু, আকাশে তো গাছপালা  নেই  !  সে বসবে কোথায় ?  এই ভয়েই সে খাঁচার  বাইরে যেতে চায় না । লকডাউনে  থেকে আমার অবস্থাও কেমন যেন খাঁচার পাখির মত হয়ে গেছে ! 

 

তবে, এই করোনাকালে সবার জীবন কিন্তু এক রকম নয় । এই   করোনাযুদ্ধে অনেক মানুষই  করোনার  মুখোমুখি লড়ছেন । সম্মুখযুদ্ধে লড়ছেন ।  কেউ  ইচ্ছায়;  কেউ অনিচ্ছায় । যিনি   অনিচ্ছায় লড়ছেন,   তিনি  আমার আজকের লেখার বিষয় নয় । আবার যিনি  ইচ্ছায়, কিন্তু  বিভিন্ন ধান্দায় লড়ছেন – তিনিও  এ  লেখার বিষয় নয় । আমার এ লেখা মূলত, যিনি  শুধু নিজের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালন নয়;  করোনামহামারির এই কঠিন দুঃসময়ে  দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে উদ্বুদ্ধ হয়ে  জীবনবাজি রেখে কাজ করছেন –তাঁর জন্য । ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ দেশের সোনার ছেলেমেয়েরা যেমন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন; এই করোনাকালেও একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক করোনাযোদ্ধা একইভাবে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে  কাজ করছেন । মূলত  সেই  সকল করোনাযোদ্ধাদের   প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতেই  আমার আজকের এই  লেখা ।    

 লক্ষণীয় যে, যিনি এই করোনামহামারির কঠিন দুঃসময়ে মানুষের জন্য কাজ করছেন; তিনি সাধারণ  মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা পাচ্ছেন । দোয়া, ভালোবাসার বিষয়টি  অদৃশ্য অনুভবের বিষয় হোলেও তথ্যপ্রযুক্তির কারণে,  তিনি যে সত্যই মানুষের শ্রদ্ধা ও   ভালোবাসা পাচ্ছেন;   তা কিন্তু দৃশ্যমান ।  মৃতদেহ করোনা ভাইরাস ছড়ায় না  জানা সত্ত্বেও,  নিজের সন্তান ও  নিকটজনেরা যখন মৃতদেহের  ধারেকাছে যেতে চায়  না,  তখন নারায়ণগঞ্জের একজন মহান ব্যক্তি করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন এবং জানাজায় অংশ নেয়া শুরু করেন । খবরে প্রকাশ তিনি ৬৫ টি মৃতদেহ সৎকারে সরাসরি অংশ নিয়েছেন । তাঁর প্রতি দেশের মানুষের শ্রদ্ধা প্রকাশের বিষয়টি বিভিন্ন  মিডিয়া গুরুত্ব সহকারে  প্রচার করেছে । তিনি নিজে যখন সস্ত্রীক করোনায়  আক্রান্ত হন, দলমত নির্বিশেষে সকলেই তাঁর  সুচিকিৎসার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন । আল্লাহর অশেষ রহমতে তাঁরা রোগমুক্ত এখন । সম্প্রতি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ও একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের করোনা সনাক্ত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে । গোটা দেশের মানুষের প্রার্থনা তাঁরা যেন দ্রুত সুস্থ হন । এখানে পদমর্যাদা কোন বিষয় নয় ।  যে কোন ব্যক্তি,  যিনি ইতোমধ্যে  করোনাযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন – তাঁদের সকলেই  এখন  বিরল সম্মানের অধিকারী । কিন্তু আমার মত মানুষ,  যিনি শত সতর্কতার মধ্যে থেকেও  করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত নিজের আপনজনসহ অন্যদের একান্ত অবহেলায় নীরবে নিঃশব্দে বিদায় নিচ্ছেন- তাঁরা কিন্তু এ ধরণের সম্মান পাচ্ছেন না । তারমানে, একজন করোনাযোদ্ধা  বাঁচুন বা মারা যান বড় কথা নয় –তিনি  শুধু বর্তমানে  নয়;    অনাদিকালেও বেঁচে  থাকবেন ।  কিন্তু, আমার  মত মানুষ,  যিনি কেবল নিজেকে রক্ষা করতে  শত সতর্কতা সত্ত্বেও  করোনাআক্রান্ত হয়ে  বিদায় নেবেন, তিনি শুধু  বর্তমানেই  নয়, আগামী দিনের পৃথিবীও  তাঁকে  মনে রাখবে না ।

 এখন প্রশ্ন,  কেন ? 

এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ । এটা  ছোট্ট একটা হিসাব । যে পরের জন্য কিছু  করে না, কেউ তার কথা মনে রাখে না । মানব সভ্যতার ইতিহাসে  স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি টিকে থাকতে পারে না । স্মরণীয়- বরণীয় হতে পারে না ।  পৃথিবী যাঁদের স্মৃতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে,  তাঁদের প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে পরের জন্য কাজ করেছেন । সাধারণ মানুষের জন্যে কাজ করেছেন । এখানে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে । বঙ্গবন্ধু  আমৃত্যু বাংলার সাধারণ  মানুষের    জন্য কাজ করেছেন । তাঁর  উপযুক্ত উত্তরাধিকার আছেন বলেই এখন   এদেশের মানুষ তাঁকে  স্মরণ করছে,  তা নয় ।  তাঁর কোন উত্তরাধিকার না থাকলেও, পৃথিবীতে  যতদিন বাঙালি জাতিসত্তা টিকে থাকবে,  ততদিন এদেশের মানুষ তাঁকে গভীর  শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে । কারণ, উত্তরাধিকারের  কারণে কেউ স্মরণীয়- বরণীয় হতে পারেন না । আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর  উত্তরাধিকার কে ?   গৌতম বুদ্ধ, সক্রেতিস, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোস, নেলসন মেন্দেলা, মারটিন লুথার কিং, শেরে- বাংলা এ কে  ফজলুল হক – তাঁদের  উত্তরাধিকার কে ?  এত গেল অনেক বড় মানুষের কথা । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকির,  সমাজকর্মী পালন সরকার – এঁদের উত্তরাধিকার কে । পৃথিবী তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ  করে এই শুধু এই কারণে যে, তাঁরা পরের  জন্যে – দেশ তথা পৃথিবীর  মানুষের কল্যাণে  কাজ করেছেন ।

ধর্মীয় বিধানের আলোকেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে । পবিত্র কোরআনে মানুষকে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে । 

প্রশ্নঃ প্রতিনিধি কাকে বলে এবং  একজন প্রতিনিধির কাজ কি ? 

উত্তরঃ  আভিধানিক অর্থে কারো পরিবর্তে কাজ করার জন্য নিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বলে । প্রতিনিধি হিসাবে একজন প্রতিনিধির নিজের কোন কাজ নেই । যিনি প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন  তিনি নিজে যা করেন, তাঁর নিযুক্ত প্রতিনিধি সেই কাজ করেন । যেমনঃ একটি রাষ্ট্র যখন   প্রতিনিধি বা  রাষ্ট্রদূত অন্য রাষ্ট্রে  পাঠান, তখন সেই রাষ্ট্রদূত নিয়োগকারি  রাষ্ট্রের  প্রধান বা  সরকার প্রধানের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন । ধর্মমন্ত্রণালয় যখন হজ্মিশনে কোন প্রতিনিধিদল পাঠান,  তখন সেই প্রতিনিধিদল হাজিদের  হজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের বিষয়টি দেখভাল করেন । তারমানে একজন প্রতিনিধির কাজের প্রকৃতি  জানতে হোলে, যিনি প্রতিনিধি  পাঠান,  তাঁর কাজ কী  তা  জানা দরকার  হয় । 

তাহলে প্রশ্নঃ  মহান আল্লাহর কাজ কি ? 

উত্তরঃ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্‌ নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, সকল জীবের  রিজিকদাতা ও পালনকর্তা হিসাবে উল্লেখ করেছেন ।  

প্রশ্নঃ তাহলে আল্লাহর প্রতিনিধির কাজ কি ? 

উত্তরঃ  পবিত্র কোরআনের বিধান অনুযায়ী মহান আল্লাহর সৃষ্টি, রিজিকদান ও প্রতিপালনে সহায়তা করাই একজন আল্লাহর প্রতিনিধির কাজ । তারমানে আল্লাহর যাবতীয়  সৃষ্টি ও মানুষের কল্যাণে কাজ করাই আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষের কাজ । 

এ কারণে যিনি দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন;  তিনি মূলত সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন  করেন । তাই,  পৃথিবী তাঁর  উল্লেখযোগ্য সকল  স্মৃতি অনাদিকাল গভীর  শ্রদ্ধাভরে সংরক্ষণ করে । 

 করোনাভাইরাস  থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায় সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ।   সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সচেতন থাকা নিজেকে সুরক্ষিত রাখার বড় উপায় । কিন্তু এ সব কিছুই তো একটা নিয়মে ফেলা সম্ভব । তাহলে আমি আমার  মনকে লকডাউনে রাখছি কেন ? নিজের  মনকে এত  ছোট করছি কেন ? একটি পরিবারের একজন করোনায় মারা গেছে বলে তাঁর পরিবারের সকলকে  তালাবদ্ধ করছি কেন ? শিশুসহ ঐ পরিবারের ৬ জন যে আটকা পড়ছে,   তাঁরা কি আমাদের মত মানুষ নয়  ? তাঁদের জীবন কি  আমাদের জীবনের মত মূল্যবান নয় ? আমার পরিবারে আমি নিজে যখন আক্রান্ত হব,  তখন কি হবে ? করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত রোগ নয় । একজন করোনারোগী থেকে  নিরাপদ দূরত্বে থেকেও তাঁর প্রতি  মানবিক আচরণ করা সম্ভব । আমরা তা করছিনে কেন ? একজন করোনা রোগী তো অন্য গ্রহ থেকে আসেন নি !  তিনি আপনার আমার মা-বাবা, ভাই- বোন বা কোন না কোনভাবে  আত্মীয় । আমার নিজের বিপদে আমি যেভাবে অন্যের সাহায্য প্রত্যাশা করি;  করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে অন্যকে সেই সাহায্য আমি নিজে কেন দিতে চাইনে  ? কেন তা দেওয়ার মত মন আমার থাকবে না ?  আমরা কি আমাদের লকডাউনে থাকা মনের জানালা খুলে দিতে পারিনে ? একটা ঝটকা বাতাসে কি আমরা আমাদের মনের গুমোট ভাবটা কাটাতে পারিনে ?

 আমরা কি আমাদের জীবনের ছোট্ট একটা হিসাব মিলাতে পারিনে ?