ধাওয়া (১৬)/ শাহানাজ শাহীন

ধাওয়া 17-19

ধাওয়া

ধারাবাহিক উপন্যাস 

ধাওয়া / শাহানাজ শাহীন

 

১৬//

আমার চিরচেনা কলেজ। মাঠের কোণায় বিশাল বকুল গাছ আকাশের অর্ধেক নিয়ে নিয়েছে।

পশ্চিম পাশে দোতলা চওড়া ভবন। টানা বারান্দা । লাল ইট বিছানো রাস্তা বারান্দা পর্যন্ত ঠেকেছে।

মাঠে সবুজ ঘাসের গালিচা। গ্রন্থাগারের সামনে লোহার পাইপের মাথায় লাল সবুজের পতাকা বাতাসে পত পত করে উড়ছে। সকালের মিষ্টি রোদে যেন হাসছে চারপাশ।

 

আজ আমার মন ভাল। সুহাসিনীর কড়া কথা উড়ে গেল মাথা থেকে। গতকাল সুহাসিনীর পরিবারের সাথে একসাথে বসে খাওয়ার মুহূর্তে মাথায় যে ঘন্টাধ্বনি বাজছিল তা এখন আর নেই।

নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের বরণ করার উৎসবের আয়োজন ছলছে। নবীনবরণ । এ উপলক্ষে কবিতা উৎসব। শুধু ছাত্ররা কবিতা রচনা করবে। মঞ্চে কবিতা পাঠ হবে । সামনে বসে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা সে কবিতা কিনতে পারবে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিলামে তুলবেন সেরা কবিতা। ছাত্রদের মধ্যে তুমুল আলোচনা। আমার তখন মনে হচ্ছিল নতুন জোড়াকৃত সমস্যা সামনে এসে হাজির হয়েছে।

তাদের হাতে লম্বা অনুষ্ঠানসূচি, তালিকা।

সেখানে আমার নাম আছে। আমিই জোর তুলেছিলাম মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

হবে স্বরচিত কবিতাপাঠ ।

কে জানত তখন সুহাসিনী সব গণ্ডগোল বাঁধাবে । পরিপূর্ণরূপে সমর্থন করা মানহানির মতোই এখন। এখন সবার সামনে নিজেকে নিলামে তোলার মতো করেই মঞ্চে উঠতে হবে। সুহাসিনীর চোখ তখন গিলে খাবে আমাকে। সর্বোচ্চ দরদাতা ক্রেতার মতো সুহাসিনী হাততালি দিবে কি দিবে না তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হবে। দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান চলবে। সবার বিশেষ প্রস্তুতি । যাইহোক নিজেকে ছোট্ট শিশু ভাববার কিছু নেই।

 

” কিরে , দোস্তা । “

” এক কথায় তুই এখন আমার কাছে অসাড়।

মৃত। ” মেঘ হস্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা মৃদুলকে বললো।

 

“না , দোস্ত, বিষয় গুরুতর। শুনলে তুই অবাক হবি।”

মৃদুল পিছন দিক থেকে কথাগুলো বলতে বলতে সামনে এসে দাঁড়ায় ।

“কি? বল শুনি। “

“তোকে নিয়ে দুই মুরগি যুদ্ধরত। “

 

” বলিস কি! “

 

” সারা আর মিলি । দুইজনেই তোর প্রেমে পড়েছে আমার বিশ্বাস। “

 

” কি করে বুঝলি?”

 

” ওরা বাজি ধরেছে তোকে নিয়ে। “

 

” তুই জেনেছিস কিভাবে? যাইহোক এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। “

 

” আসলেই নেই ? তাদের দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া তোকে নিয়ে। আর তুই বলছিস মাথাব্যথা নেই?

তুই আমার অতি পছন্দের। ভালো বন্ধুত্ব আছে বলেই জানালাম। “

 

মেঘ হাঁটছে মৃদুলের পাশাপাশি। সে মনে মনে চিন্তা করছে , আসলে পছন্দের মানুষ সে নয়। এটা মৃদুলের নিজের জন্য এক প্রকার সান্ত্বনা।

মৃদুল সুযোগ পেলেই সুহাসিনীর মন্দ বলে আনন্দ পায়। অথবা হতে পারে মৃদুল পড়ে আছে ঘাটে জল খেতে। আমি বোধহয় সেখানে কুমির।

জলে নামলেই গিলে খাব। তাই পথ পরিষ্কার করতে সারা ও মিলিকে টেনে এনেছে। আমার মাথায় ভয়ানক বিষয় কাজ করছে এখন ।

 

আমি চাইছি নবীনবরণ অনুষ্ঠান সূচি থেকে নিজের নাম বাদ দিতে । ইচ্ছা করছে এক দানবীয় প্রলয়ংকর ঘুর্ণঝড় এসে কলেজ উড়িয়ে নিয়ে যাক অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ আসার আগেই। তাহলে আমি বেঁচে যাই কবিতা পাঠ থেকে।

 

অডিটরিয়াম পরিপূর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করলেন।

তিনি আগতদের উদ্দেশ্য বললেন,

 

” এ বছরের নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের শুভ আগমনের শুভক্ষণ ঘোষনা করছি। আমরা সত্যিই নন্দিত তোমাদেরকে পেয়ে। “

কমলা রঙের শাড়িতে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে আজ অসাধারণ সুন্দর লাগছে । আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না । কমলা রঙে সাদা ফুল। যেনো প্রজাপতি। তিনি বললেন,

“অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি, আমাদের আজকের অনুষ্ঠান আয়োজন সফল হয়েছে মেঘের বাবা জনাব বাকের সাহেবের অনুদানের জন্য। ধন্যবাদ জানাই আপনাকে জনাব বাকের সাহেব।

মেঘের গর্বে শিনা টান টান হয়ে গেল বাবার জন্য। মৃদুল হন্তদন্ত হয়ে মেঘের দিকে আসতে থাকে।

মেঘ মৃদুলকে দেখে চমকে যায়। সে বলে গেছে কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় সে অনুষ্ঠানে থাকতে পারছে না।

 

” কিরে তুই কি করিস এখানে? “

 

” দোস্ত যাওয়ার সময় দেখলাম সুহাসিনী তৃতীয় সারিতে বসে আছে। তার হাতে কচকচে কয়েকটা নোট দেখলাম । সে কবিতা কিনবে । তোকে জানাতে এলাম। যাই দোস্ত।

“ভাগ এখান থেকে। সব ফালতু কথা । হাস্যকর। “

মৃদুল যেতে গিয়ে থেমে গেল,

“তুই বিশ্বাস করিসনি আমার কথা? “

” হুম। “

” আমি নিজের চোখে দেখে এলাম । “

 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাইকে বলছেন,

বন্ধুরা সবার কাছে জোর করতালি আশা করছি।

অডিটরিয়াম ফেটে পড়ল করধ্বনিতে।

মেঘ মৃদুলের কথা শুনতে পেল না। মঞ্চে শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। মেঘ শেষ মুহূর্তর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সে মঞ্চের পিছনে অপেক্ষা করছে।  চিন্তা করছে সুহাসিনীর কথা। মৃদুল বললো সুহাসিনী কবিতা কিনবে। যে মেয়ে মুরগি পুষে লেখাপড়া চালায়,সে কিনবে কবিতা! তাও নিলাম থেকে।

যেখানে নির্দিষ্ট মূল্য নেই। বিশ্বাস করতে পারছি না।

এটাও কি সম্ভব ! সে আমার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে?

 

ছাত্ররা মঞ্চে। তারা সবাই কবিতা হাতে নিয়ে অপেক্ষারত। প্রিন্সিপাল প্রথমেই জাহাঙ্গীরের নাম ঘোষণা করলেন। জাহাঙ্গীর তাঁর কবিতা পাঠ করলো। কবিতার নাম ” জলের প্রেম ” ।

তার কবিতা পাচঁ টাকা থেকে পনের টাকায় নিলামে মরিয়ম কিনে নিল।

মেঘের ধারণা যদি সুহাসিনীর সত্যিই টাকা থেকে থাকে তাহলে সে কার কবিতা কিনবে?

যদি সে তার কবিতা কেনে? কি হবে যদি সে সারা ও মিলির সাথে লিলাম যুদ্ধে নামে?

যদি সে তাদের সাথে দামে হেরে যায়?

নরেশের কবিতা এখন নিলামে উঠেছে ।

তার কবিতার নাম ” মাটির টানে ” । নরেশের কবিতার কোনো ক্রেতা নেই। নরেশ শেষ বর্ষের সেরা ছাত্র। কিন্ত অতি দরিদ্র। সে সব সময় চুপচাপ থাকে। অন্তর চোখে আমি স্থির দেখতে পাচ্ছিলাম

তিন কন্যার ভয়ানক যুদ্ধ আমার ক্রেতা হবার।

মৃদু কণ্ঠ কানে ভেসে এল,

“দশ টাকা। ” সুহাসিনী ।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আনন্দের সাথে বললেন,অসাধারণ। কেউ আছ পনের টাকার জন্য?

পনের টাকা।

সারা ভয়াবহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুহাসিনীর দিকে।

সুহাসিনী সারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

মেঘ বজ্রের মতো চমকে উঠল । অবশেষে সুহাসিনী নরেশকে কিনে নিল কবিতার ছলে?

বেশ দশ টাকায় বিক্রি হয়ে গেল নরেশের কবিতা।

সুহাসিনী কিনে নিল। সুহাসিনীর জন্য করতালি হোক। মেঘ ভাবছে কি করে সুহাসিনী এমন করতে পারল? সে কি করে আমাকে ছাড়া অন্যের কবিতা কিনে নিল?

গম্ভীর মুখ করে নরেশ দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চে।

উদাস তার দৃষ্টি কালো ফ্রেমের চশমার ফাঁকে দূরে হারিয়ে গেল। নরেশ মঞ্চ থেকে নেমে গেল।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এবার ঘোষণা করলেন কবিতা নাম্বার নয়। মোশাররফ মেঘ। মেঘ তখন মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে মঞ্চের মেঝের দিকে।

তার চোখ ভ্রু কুঁচকানো। রাগে তার মাথা খারাপ। ইচ্ছা করছে সুহাসিনীকে কষে চড় মারতে।

তার মঞ্চ থেকে পালিয়ে যেতে মন চাইছিল তখন ।

কিন্তু উপায় নেই। সে আটকা পড়েছে ।

 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মেঘের দিকে তাকালেন। বললেন ” মেঘ সামনে আস। এতো লজ্জিত হবার কি আছে। মেঘ অতি কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করে কিছুটা সামনে এসে দাঁড়াল। তাঁর পরনে সাদা ফুল হাতা শার্টের সাথে ছাই রঙের সোট টাই  অত্যন্ত সুদর্শনীয় ।

তার কবিতার নাম “উড়ে যায় প্রেম”।  সে তাঁর কবিতা পাঠ করল। এখনো তার কবিতার দর ওঠেনি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, শেষ ভালোই আসল ভাল।

মিলি ধুম করে বলে বসল ,” পাঁচ টাকা। “

এক মুহূর্ত দেরি না করে সারা বললো,”বার টাকা “

এইতো জমে উঠেছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম টেবিলে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে বললেন,

মিলি দর বাড়িয়ে বললো, ” পনের টাকা ” ।

 সারা, “বিশ টাকা। “

মিলি, “পচিঁশ টাকা “।

 সারা, “ত্রিশ টাকা ” ।

মিলি, “পয়ত্রিশ “

সারা, “চল্লিশ “।

মিলি, “পঞ্চাশ টাকা।

সারা চুপ হয়ে গেল। তার আর বলার নেই। মেঘের আনন্দ হলো না। তার মুখ মলিন। গম্ভীর।

আহা খুব ভাল। মাশাআল্লহ। পঞ্চাশ টাকা।

পঞ্চান্ন টাকা, আছে কেউ? শে বারের মত বলছি,আছ কেউ। বেশ, বিক্রি হয়ে গেল পঞ্চাশ টাকায়। মিলি কিনে নিল। দারুণ। মিলি সব সময়ই এগিয়ে।

আমাদের আজকের এই অর্থ যাচ্ছে ছাত্র সংসদে।

এটা আসলেই অদ্ভুত। কলেজে মিলির রূপের কাছে বাকিরা মৃত। মিলি সেরা ছাত্র না হলেও। সেরা রূপবতী। ক্রেতা বিক্রেতাগণ এক সাথে ক্যান্টিনে।

মেঘ মিলির সাথে কোণার দিকে একটি টেবিলে বসল। সে চায় না সুহাসিনী তার সামনে পড়ুক।

মিলি আহ্লাদের সাথে বললো ,যাওয়ার পথে আমাদের খামার বাড়িতে যেতে চাও মেঘ ?

আমার আব্বু আম্মু সেখানেই আছেন আজকে । প্রতি ছুটির দিন উনারা যান । ছোট করে পিকনিকের আয়োজন ।

মেঘের থেকে দুই টেবিল সামনে সুহাসিনী নরেশের সাথে বসে কথা বলছে। মেঘের সুহাসিনী ।

সে হাসছে। কি নিয়ে এতো হাসি? কি করে সে নরেশের সাথে বসে হাসতে পারছে। কি ভয়াবহ সুন্দর লাগছে তাকে ! মেঘের মনের মধ্যে চলছে নানান কথা । মিলি দেখতে পেল মেঘের কোনো মনোযোগ নেই তার প্রতি। সে মেঘকে বললো, কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো মেঘ?

মেঘ আনমনা হয়ে ঘোরের মধ্যে বললো,” কি বলতেছিলা? “

” তুমি কার পিছনে ঘুরঘুর করছো? “মিলির দ্বিতীয় প্রশ্ন।

মেঘ মাথা নাড়ল। বললো, কারো পিছনে নেই। ক্যান্টিনের খাবার মজা হয়েছে আজ, তাই না?

মেঘ কোনো উত্তর দিল না।

মিলি বিরক্ত হল। সে বললো, মেঘ তুমি কি আমার কথা শুনছো? সত্যিই খাবার মজা হয়েছে।

মেঘ হাবার মতো তাকিয়ে রইল। মিলির কথা তার কানে গেল না। তার চোখ সামনে, সুহাসিনীর টেবিলে।

আমরা কি অন্য কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি খাবার আর পিকনিক ছাড়া?

মিলি নড়েচড়ে বসে।

” অবশ্যই পারি। কি বিষয়ে কথা বলতে চাও? “

” জানি না। ” অনন্তকাল ধরে মানুষ যে সব কথা বলে আসছে? সেরকম কোনো কথা জানা আছে তোমার?

অনন্তকাল ধরে মানুষ কি কথা বলে আসছে মিলি জানে না। সে কৌতূহল নিয়ে বলে,

” অনন্তকাল কি? কোন কথা?”

মেঘ আর কথা বাড়াল না। সে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। সে বুঝতে পারছে না ভিতরে কি হতে চলেছে।

মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে আছে । অথবা এমন কিছু একটা। সে সোজা সুহাসিনীর টেবিলের দিকে হেঁটে গিয়ে বললো,”সুহাসিনী একটু কথা বলতে চাই। “

” কি কথা?”

সুহাসিনী ধমকের সুরে বললো।

সুহাসিনী টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মেঘের ভাবসাব কেমন যেন মনে হচ্ছিল। সে মেঘকে বললো, “কি হয়েছে তোমার?”

মেঘ তার কথার উত্তর না দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইল।

সুহাসিনী পিছনে সরে গিয়ে বললো, “কি করছ এসব । “

মেঘ একই কাজ আবারও করার চেষ্টা করল।

” মেঘ এসব কি হচ্ছে। থাম বলছি। সামনে আসবে না। আর এক পা এগুলে আমি তোমার গালে কষে চড় মারব। সুহাসিনী ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়।

মেঘ তার পিছন পিছন আসতে থাকে। পিছন দিক থেকে তার নাম ধরে ডাকতে থাকে

সুহাসিনী দাঁড়াও। তোমার সাথে কথা আছে।

সুহাসিনী দ্রুত হেঁটে রাস্তায় আসে। সে রিকশায় ওঠে।

মৃদুল ঝড়ের বেগে হাজির সেখানে। সে মেঘের সামনে এসে দাঁড়াল।

” কিরে কি সমস্যা তোর? সুহাসিনী দ্রুত চলে গেল কেনো? “

” কথা বলবি না আমার সাথে। যা এখান থেকে। “

কয়জনকে তোর একসাথে ভাল লাগে? মিলি , সারা এখন সুহাসিনী ।

মেঘের মাথায় রক্ত গরম এখন। কাউকে সে এখন চেনে না। না মৃদুল, না মিলি, সারা। সে মৃদুলকে ধাক্কা মারে। মৃদুল পড়ে যেতে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

তারপর বলে, এই শালা তুই উল্টে গেছিস? কি হয়েছে তোর?

তুই এমন আচরণ করলে তো তোর সাথে  চলাই মুসকিল হবে।

মেঘ হাঁটা থামিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলে, “যা না তোর মতো চল। আমার সাথে চলার দরকার নেই। যা আজকের পর থেকে আমরা কেউ কাউকে চিনি না। এবার খুশি হয়েছিস? “

 

আমার কবিতার শব্দ, লাইন ভিতরে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে আমাকে । আমি দগ্ধ মনের সাথে বাড়ির পথে হাঁটছি । এসব কিছুর পিছনে শুধু একটি নাম সুহাসিনী । মৃদুলের সাথে একটা বিষয়ে আমি একমত। তার ধারণা আমি বদলে গেছি। আমার ঠিক তাই মনে হচ্ছে। আমি বদলে গেছি। সুহাসিনী আমাকে বদলে দিয়েছে।

 

মেঘ সুহাসিনীদের বাড়ির দরজার সামনে। তার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। আজ তার মধ্যে ধনী পুত্র

এই মনোভাব কাজ করছে না। তার মন স্রোতের বেগে সুহাসিনীর ঘাটে ভিড়তে চাইছে।

মন সম্পূর্ণ তার আওতার বাইরে। সে দরজায জুড়ে আঘাত করছে। ভেতর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিছুক্ষণ থেমে থেকে চিন্তা করল ফিরে যাবে কি না। পরক্ষণেই ভাবে যা খুশি ভাবুক। আজকে এর শেষ দেখতে চায় সে। সে হাতের মুষ্ঠি করে দরজায় আবার শব্দ করে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে আঘাত করছে। দরজা ছেড়ে সে জানালার কাছে আসে । কাচেঁর ভিতর দিয়ে ভিতরে দেখতে চেষ্টা করে। কিছুই দেখতে পেল না। সে বাড়ি ফিরে যায়।

ফোনে রিং হচ্ছে। ফরিদা বেগম ফোন ধরেছেন।

ছেলেরা গান বাজনা করে। নানান জনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। বাড়িতে ফোন না হলে চলে না। শওকত মিয়া বাড়িতে গত এক বছর হলো ফোনের সংযোগ লাগিয়েছেন।

“হ্যালো ” বলে ফরিদা বেগম অপেক্ষা করছেন।

অপর পাশ থেকে কোনো সাড়া নেই। তিনি ফোন রাখতে যাচ্ছেন। এমন সময় অপর পাশ থেকে শুনলেন ,”ওহ, চাচি মেঘ বলছিলাম। সুহাসিনীকে একটু দেবেন? “

“ও মেঘ। কেমন আছ বাবা? “

“জি ভালো আছি । “

” বাবা সুহাসিনী কথা বলতে ছাইছে না। কিছু মনে করো না। “

ফরিদা বেগম ফোন রেখে দেন। মেঘ রিসিভার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ একই রকম। সে ফোন রেখে সুহাসিনীদের বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।

কিছুক্ষণ ভাবে। দরজায় টোকা দেবে নাকি ফিরে যাবে?

সে সাহস করে দরজয় টোকা দেয়। দুইবার নক করতেই ফরিদা বেগম ভিতর থেকে দরজা খুললেন।

উনার মুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ ।

মেঘ অনুরোধের সুরে বললো,

“চাচি আমাকে একটু সুহাসিনীর সাথে কথা বলতে দেন। দয়া করে একটু কথা বলার সুযোগ করে দেন। “

শুকনা মুখ করে উত্তরের অপেক্ষায় আছে।

” আমি অত্যন্ত দুঃখিত মেঘ। সুহাসিনী রুমে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। আমাদের সাথেও কথা বলছে না।

আমার মনে হয় ওকে বিরক্ত করা উচিত নয়। তুমি ফিরে যাও । তুমি এসেছো ওকে বলবো ।

ফরিদা বেগম দরজা বন্ধ করে দেন।

 

আমি চেষ্টা করলাম কিছুটা আগেই শুয়ে পড়তে।

সুহাসিনীর চিন্তা সারাদিন যন্ত্রণা করেছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল বড় মূল্যবান কিছু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। কেমন একটা নাই নাই অনুভূতি কাজ করছে মনের মধ্যে। ঘুমাতে পারলে ভাল লাগত। কিন্ত আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। আমি ঘন্টা ব্যাপী জানালার পাশে বসে থাকলাম। তাকিয়ে থাকলাম সুহাসিনীর বাড়ির দিকে। আমি পথ খুঁজছিলাম। যে পথে আমার অনুভূতি তাকে দেখাতে পারি।

 

১৭

রবিবার মানেই নতুন সপ্তাহ। আমি কলেজে যাচ্ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম ,কেমন ছেলেকে আমি পছন্দ করবো ,বিয়ে করবো–

যখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জোর করে মেঘের চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। সুহাসিনী ক্লাশের বারান্দায় ওঠে। মিলি তাকে দেখে এগিয়ে গেল।

“দেখ তালিকা ?”

সুহাসিনী দেয়ালে ঝুলানো বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। কবিতা উৎসবে বিজয়ীদের নামের তালিকা। মিলি হাতে চিমটি কেটে বলে, ” দেখ তোর হিরো মেঘের নামও আছে।

তোর প্রধান খাদ্য। “

” ফাজলামো রাখ। খাদ্য আমার না তোর। “

“হুম খেতে চেয়েছিলাম। তবে পারিনি। তোর পাতে চলে গেছে। “

” জেনে রাখ, মেঘ আমার প্রধান খাদ্য নয়। “

সুহাসিনী অবজ্ঞার ঢংয়ে বললো।

” আচ্ছা তাহলে তুই খাদ্য সংযমে লেগে আছিস।

ইংরেজিতে যাকে বলে ডায়েট।

“এটা ডায়েট না মিলি। “

মিলির সুহাসিনীর ভাল বন্ধু। অনেক কিছুই তারা নিজেদের মধ্যে বলে।

“তাহলে কি ?”

“মেঘ আমার মধ্যে আর নেই। “

” ওহ , তাই? প্রফুল্ল হলাম জেনে। “

কারণ গুজব রটেছে তোর কারণে মেঘ সারাকে অপছন্দ করে। “

সারা?

সুহাসিনী মুখ ভেংচি কেটে বলে।

সেই বিকেলে, আমি নিজেকে কবিতার নিলাম, মেঘের দরকষাকষি আবাশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম। মেঘের দরকষাকষি চলছে মিলি, সারা ও আমাকে ঘিরে।

শাহানাজ শাহীন
শাহানাজ শাহীন