দীপ্র তেজের নম্র শিখা/ দীলতাজ রহমান
দীপ্র তেজের নম্র শিখা/ দীলতাজ রহমান
ধানমন্ডি থেকে শাশুড়ি-ননদসহ বসুন্ধরা মার্কেটে আসছে শিখা। কিন্তু রাস্তার জ্যামে এইটুকু পথ আসতে প্রায় একঘণ্টা সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে, শিখার শাশুড়ি সালমা খান বললেন, আজ মনে হচ্ছে সবাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
ড্রাইভার মতিন বলল, তা না মেডাম। গাড়ির ভিড় তো পতিদিন এ্যামনিই থাকে। এইটুকু রাস্তা আসতে সিঙ্গেল কয়টা, তা দ্যাখছেন? তার জন্যিও তো থামতে অয়!
শিখা নতুন বউ। এখনো তার গলা খোলেনি শ্বশুরবাড়িতে। মাসখানেক হলো বিয়ে হয়েছে। সে ড্রাইভারকে কড়াস্বরে বলল, মতিন, সিঙ্গ্যাল নয়, সিগন্যাল। বল, সিগন্যাল!
ড্রাইভার মতিন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ওই হইছে। বাদ দ্যান, ভাবি! যাত্রীরা বোজলেই অইল!
শিখার মাথায় আগুন চড়ে যায়। তার মনে হয়, একমাস হয়েছে তার বিয়ে হয়েছে, এর ভেতর তার শাশুড়ি-ননদ তাকে অবহেলা করতে শুরু করেছে। এখনো সে অবহেলা নীরব থাকলেও ড্রাইভারও তা বুঝে গেছে, না হলে তার কথার ভেতর শিখার কথা ঝেড়ে ফেলার ভাব থাকত না!
শিখা তখন জিততে চেয়েই নরম কণ্ঠে বলল, মতিন, তুমি আমার সাথে একবার বলো, পারবে! বলো, সিগন্যাল!
মতিন, অপারগ কণ্ঠে উচ্চারণ করল, সিগন্যাল!
শিখা বলল, এই তো পারলে! তোমার যাত্রী যে-ই হোক, তুমি যদি এই একটি শব্দ শুদ্ধ করে বলতে পারো, তোমাকে সে সমীহ’র সাথে দেখবে! এখন থেকে দেখবে, ভুল শব্দটি আর মুখে আসবে না!
শিখার মনটা যখন প্রসন্ন হয়ে আসছিল, সালমা খান তখন রুষ্টস্বরে বললেন, তুমি আবার ওকে নিয়ে পড়লে কেন? বাড়িতেও সবার বাকবিতণ্ডা। আবার যাচ্ছি এক জায়গায়, পথের মধ্যে তর্কাতর্কি। কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম…।
শিখা বলল, তর্কাতর্কির কী দেখলেন মা? একজন একটা শব্দ ভুল বলছে, তাকে শুদ্ধ করে দিলাম! এটুকুই তো!
শিখার ননদ রুনা বলল, সে তো সবই ভুল বলে, তাই বলে কি খাতা-কলম নিয়ে বসবে নাকি ওকে শুদ্ধ বাক্য শেখাতে?
শিখা বলল, দেখো রুনা, ‘ও সব ভুল বলে না। ও ওর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আঞ্চলিক ভাষা যার যার মাতৃভাষা! কিন্তু ও যখন ইংরেজি শব্দটা বিকৃত করে বলছে, যে শব্দটি দিনে তাকে বহুবার উচ্চারণ করতে হয়, তা আমাদের উচিত ওকে সংশোধন করে দেওয়া!’ এরপর শিখা মতিনের উদ্দেশে, তাকে বুঝিয়ে দেওয়া বিষয়টি আবার তুলল। বলল, ‘শোনো মতিন, সিগন্যাল অর্থ সংকেত এবং যখন লালবাতি জ্বলবে, মানে তোমাকে আর না এগোনোর সংকেত দেওয়া হয়েছে। সবুজবাতি জ্বলা মানে তোমাকে যাওয়ার সংকেত দিয়েছে।’
রুনা বলল, কে দিয়েছে তোমাকে এই উচিত কাজটি ওকে বোঝানোর দায়িত্ব? ওরা ওদের মতো বুঝলেই হলো!
শিখা আশ্চর্য হয়ে বলল, দায়িত্ব দিতে হবে কেন? দায়িত্ব তো তৈরি হয়ে এমনি কাঁধে চেপে থাকে। আর সে দায়িত্ব তোমার আমার সবার! এমনকি আমার শাশুড়িমারও!
সালমা খান নিজের দায়িত্ব না বুঝলেও এটুকু বুঝেছেন, বউয়ের সাহস বাড়ছে। এতদিন উচ্চবাচ্য না করলেও রাস্তায় এসে তুচ্ছ একটা ঘটনা কেন্দ্র করে যেন বাঘের গর্জন শুনছেন বউমার কণ্ঠে। তিনি ঝাঁঝাল কণ্ঠে বললেন, আমার কিসের দায়িত্ব?
শিখা শাশুড়ির মুখের কথা শেষ হতেই বলল, আপনি ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। আর এদেশে ভাষার জন্য কত মানুষের জীবন গেছে, কত মানুষের ত্যাগ-প্রচেষ্টা এই ভাষার জন্য নিবেদিত হয়েছে, সে তো আপনার অজানা নয়?
‘আমি তো আর চাকরিবাকরি করিনি!’ সালমা খান বললেন।
চাকরি করলে কী করতেন? কাজ করতেন, বেতন পেতেন! কিন্তু মূল্য পাওয়া দায়িত্বের বাইরেও কিছু দায়িত্ব সবার ওপর অর্পিত থাকে। প্রতিটি মানুষের জীবনই অনবরত তাকে শিখিয়ে চলে, কিন্তু যেটাতে আমাদের স্বার্থ আছে, আমরা কেবল তাই আঁকড়ে ধরি। যেটাতে স্বার্থ নেই, তা এড়িয়ে চলি!
রুনা বলল, নাও মা, এবার ছেলের বউয়ের থেকে দায়িত্ব শেখো!
রুনার কথার উত্তর দেওয়ার অবকাশ আর শিখা পেল না। গাড়ি মার্কেটের সামনে এলে সবাই যে যার মতো নেমে একই গেট দিয়ে একসাথে মার্কেটে ঢুকে গেল। একসাথে ঢোকা ও একসাথে সিকি লাখ টাকার কেনাকাটাও মনে মনে শাশুড়ি ননদ বউমাকে আর একত্র করতে পারল না। একসাথে কেনাকাটা করলেও রাস্তার কথা কাটাকাটি, যতক্ষণ তারা মার্কেটে ও মার্কেট থেকে বাসায় পৌঁছুতে গাড়িতে ছিল, দু’জায়গাতেই তাদের তিনজনকে কেটে দুদিক করে দিয়েছে। শাশুড়ি-ননদ একদিকে আর শিখা একা একদিকে। বাড়িতে ফিরে সদ্য কিনে আনা জিনিস গড়গড়িয়ে বিছানা বা কার্পেটের ওপর ঢালার আগেই সালমা খান সদ্য রিটায়ার করা স্বামীর মুখোমুখি বসে বললেন, মফস্বলের মানুষ আর গ্রামের মানুষের ভেতর খুব একটা পার্থক্য হয় না এটা আমার আগে জানা ছিল না, কিন্তু তুমি জানতে না?
সালমা খানের স্বামী জামশেদ খান বললেন, এসব কী বলছ?
বউকে নিয়ে আজই তো প্রথম আমি মার্কেটে যাচ্ছিলাম। জ্যামে আটকে এমনি নাজেহাল দশা, এর ভেতরে বউ লেগে গেছে ড্রাইভারকে শুদ্ধ উচ্চারণ শেখাতে!
: তা তাতে তোমার অসুবিধা কী? কে কাকে কী শেখাবে সেটা তার বিষয়। এটা এত বড় করে দেখছ কেন? আর গ্রামের মানুষের সাথে মফস্বলের তুলনা করেও এসব ঠিক করোনি! বউমা একটি জেলা শহরে বেড়েওঠা মেয়ে। আর যেন কারও কোনো কথা না শুনি এসব নিয়ে। ভুলে যেও না বউমা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে তোমার আর তোমার মেয়ের থেকে ভালো সাবজেক্টে লেখাপড়া করেছে। নাহয় তার বাবার ঢাকাতে বাড়ি নেই। কিন্তু তাদের এই প্রজন্মের হবে!
শ্বশুর-শাশুড়ির সব কথা শুনে শিখা নিজের প্রতি কৃতার্থ বোধ করল। ভাবল যাক, এরা সবাই একই স্বভাব ও মেজাজের নয়। আর আজ যা ঘটল এবং তার জের ধরে শ্বশুরের যে নিরপেক্ষ মনোভাব টের পেল, সে বুঝতে পারল, সে সবার মুখের কথা সুন্দর করে দিতে পারবে না, কিন্তু ভাষা আন্দোলন বলে যে একটি কথা আছে, তাতে যাদের অবদান আছে, এবং আজকে দেশে যে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বৎসর উদযাপনের বর্ণাঢ্য আয়োজন চলছে, সাথে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, এ সবই সেই তখনকার প্রায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই মৃদুভাষে ফুটে পরে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তা-ই বিস্ফোরণ তৈরি করেছিল, যা আমরা ঢালাওভাবে জানি।
সেদিনের পর থেকে শিখার মাথা থেকে বিষয়টা যায় না। কিন্তু সেদিন শাশুড়ি-ননদের সাথে যা ঘটেছে, সে আর ভুলেও স্বামী ফাহিমের কাছে তা তোলেনি। শাশুড়ি-ননদের সুনজর পাওয়ার চেষ্টা সে এরই ভেতর ছেড়েছে। বুঝেছে, সব বিষয়ে মাথা নত করে কারও সুনজর পাওয়ার থেকে কোপানলে থাকাও ভালো। আর তার ভেতর থেকেই সিদ্ধি খুঁজতে হবে।
শিখাকে ফাহিম পছন্দ করে বিয়ে করেছে। ফাহিম শিখার ভাইয়ের বন্ধু-কলিগ। শিখা তার কলেজ পর্যন্ত নিজের জেলা যশোরে ছিল। তারপরে ভাই তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। অথচ দিনাজপুরের মানুষ শিখার শ্বশুর জীবনের শুরুতেই ঢাকাতে জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন। কিন্তু বিত্ত-বৈভবের ঠাঁট শ্বশুরের ভেতর নেই। স্বামী ফাহিমেরও নেই। কিন্তু শাশুড়ি-ননদের ভেতর শিখা ষোলআনাই টের পায়। কারণ শিখাকে তারা ঠিক তাদের মতো চালাতে পারে না বলে। আবার বাগেও নিতে পারে না। কারণ গ্রামীণ হোক, আর মফস্বলের হোক, একটা শেকড়ের সরাসরি তেজ তার ভেতর আছে। তার সেটুকু কেউ ছোট করে দেখে, সেটা শিখা বরদাস্ত করবে না।
সেদিনের পর থেকে শাশুড়ি-ননদের সাথে হাতে হাতে ঘরের কাজগুলো সারলেও প্রয়োজনের বাইরে কেউ তার সাথে কথা বলছে না। এমনকি শিখাও কারও সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার প্রচেষ্টা দেখায় না! একদিন সবাই বাসার বাইরে গেলে সে দাদিশাশুড়ির ঘরে গিয়ে তাকে শোয়া থেকে টেনে বসাল। তারপর বলল, দাদিম্মা, আজ আপনার সাথে নতুন ধরনের একটি গল্প করব।
বৃদ্ধা কাঁপাস্বরে বলল, আমার সাথে আর কী গল্প? আমার কি সব কথা খেয়াল করার ক্ষমতা আছে?
দাদিশাশুড়ি আর নাতবউয়ের হইচইয়ে বাড়ির বৃদ্ধা রাঁধুনি ও ফুটফরমাশ খাটা পনের বছরের কিশোর তালিম সেখানে হাজির। শিখা তাদের বলল, আপনারাও বসেন, আজ এক পুরনো গল্প নতুন করে শোনাব আপনাদের!
রাঁধুনি বলল, রাক্ষস থাকপে তো তোমার গল্পে? আহা গল্ফ শুনাত আমার নানি। বুড়ি কোহনতে যে এত রাক্ষস ধইরে আনত!
কিশোর তালিম তাকে বলল, তয় বুয়া আপনি সে গল্ফ আমারে শুনোন না ক্যা?
রাঁধুনি ঝামটা মেরে বলল, হ কাজ ফেলাইয়া আমি তোরে গল্ফ শুনোই, বাড়ির গিন্নি আমারে শক্ত কথা শুনোক! এমনি তার মুখ ঝামটা খাতি খাতি মরি। রুনা মাইয়েডারও মন পাইনে!
শিখা তাদের দুজনের বাকবিতণ্ডা থামাতে হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, বুয়া। আমিও অন্যরকম রাক্ষসের গল্প আপনাকে শোনাব। আপনি আপনার রাক্ষসের খবর ওকে অবসর যখন হবে, দেবেন! আর ওর মাথায়ও তো কিছু নতুন গল্প আছে! আপনারা ঝগড়াঝাটি না করে সেগুলো বিনিময় করবেন!’ বলে তৈয়বা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা দাদিম্মা, আপনার বয়স কত হলো?’
: তা কী করে বলি? তবে দেশভাগের আগে! আর আমাদের তো আর জন্মদিন পালনের রেওয়াজ ছিল না, যা তোমাদের বেলায় জমজমাটভাবে তোমরা করো! আগের থেকে হৈচৈ পড়ে যায়!
: এই তো আপনার বয়স বলতে পারলেন। কিন্তু দেশভাগের কত আগে তা জানেন?
: মা বলত এক বছর আগে! আর সে মাস ছিল চৈত্র মাস। মঙ্গলবার। তবে কয় তারিখ তা জানি না!
: দাদিম্মা, আপনার বয়স তাহলে ৭৫-এর একটু বেশি। এ আর এমন কী? কিন্তু আপনি এমনভাবে পড়ে থাকেন, যেন এক শ’ পঁচাত্তর বছর বয়স আপনার!
রাঁধুনি বলে উঠল, ও বউ, আমার বয়সটা হিসেব করো দিনি!
: কিছু একটা বলেন?
: কী কব?
: ওই যে খুব বড় বন্যা বা দুর্ভিক্ষ, যা মাঝে মাঝেই হয়, হয়েছে এই ভূখণ্ডে!
: অত সব কতি পারব না বউ। তুমি আমাগির মুক্তিযুদ্দু ধরো। তহন আমার বয়স, মা কতো পুনার। কোলে এক বছরের ছাওয়াল। ওই যে দ্যাখছ তো, তুমার বিয়ের সুমায় সাতদিন থাইকে খাটাখাটনি কইরে গেল!
: এই তো, দেশ স্বাধীন হলো পঞ্চাশ বছর। আর আপনার তখন ছিল পনের, তার মানে পঁয়ষট্টি চলছে। আপনার ছেলের, মোটামুটি একান্ন।
তা বউ, তুমি আমাদের বয়স মনে করিয়ে দিচ্ছ কেন? বয়স মনে থাকলেই মনে হয় আয়ু শেষ হয়ে আসছে! বললেন শিখার দাদিশাশুড়ি তৈয়বা বেগম।
: মনে না করিয়ে দিলে বুঝি বয়স থেমে থাকে দাদিম্মা?
: তা থাকে না। বরং তুমি একটা বিষয় পেলে আমার সাথে দুটো কথা বলতে!
: এ-ই ঠিক কথা বলেছেন দাদিম্মা! কথা বলতে বিষয় লাগে। বাড়ির বয়স্করা বিষয় থেকে সরে যায় বলে তারা ধীরে ধীরে অপাঙকতেয় হয়ে ওঠে। যখনি আপনার সাথে কারও কথা থাকবে, দেখবেন আপনার দরজায় মুখ বাড়িয়ে আপনার খোঁজ নিচ্ছে। আরও কী হয়, যখন আপনার পুরনো দিনের কথাগুলো কারও সাথে বলেন, তখন আপনার স্মৃতিরা সচল হয়। আপনার মাথা কাজ করে। একটা বয়সের পরে নিজেকে যে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়, তাদের শরীর হয়ত ভালো থাকে, কিন্তু মাথাকেও কিছু কাজ দিতে হয় চিন্তা-ভাবনা করতে। বিকেলে যেমন ছাদে গিয়ে হাঁটেন শরীর সচল রাখতে, তেমনি চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক হয়, তেমন বই পড়তে হয়। তাতে শরীর-মন দুই-ই ভালো থাকে। কারণএকটার সাথে আরেকটা জড়িত।
: ঠিকই বলেছ নাতবউ!
: নাতি-নাতনির সাথে আগে লুডু খেলেছি, কেরাম খেলেছি। বউমা তো রান্না করা শুরু করেছে এই সেদিন। আগে তো আমিই এসব করেছি। তারপর বই-খবরের কাগজও পড়েছি।
: দাদিম্মা, একটা কথা বলতে ইচ্ছে করল বলে এতো কথা উঠল।
: তাতে কী বউ! তোমার যত কথা বলতে ইচ্ছে করে বলো! কদিন পর তোমারও চাকরি হয়ে গেলে আর সবার মতো তোমাকেও পাব না!
: আপনি যদি চান আমি আপনার ঘরে আসি, কথা বলি, তাহলে তো আমি খুশি হয়েই আসব! এখনো তো বুঝতে পারিনি, কে আমাকে কতটুকু চায়!
: যার কাছে যতটুকু প্রয়োজন তৈরি করবে, সংসারে সে তোমাকে ততটুকুই চাইবে বলে আমার মনে হয় বউ! আর ওটাই আসল, নিজের জায়গা করে নেওয়া। আচ্ছা বলো, আসল কথা কী বলতে এসেছিলে?
: ওই যে দাদিম্মা, আমরা বলি বা ভাবি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ভাষার আন্দোলন শুরু হয়েছে…!
: না বউ এটা আমি জন্মের পর থেকে, মানে যখন থেকে আমার মনে থাকা শুরু হয়েছে, তখন থেকে শুনে আসছি। তবে জোরদার হয়েছে ৫২-তে। রফিক শফিক বরকত সালাম জব্বারের বুকে গুলি এসে বিঁধল বলে সারাদেশে প্রতিবাদ আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেই আন্দোলনেই আমাদের স্বাধীনতা পাওয়াটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল! আর সেই জন্যই ’৭১ মুক্তিযুদ্ধ! কিন্তু আমাদের বাপ-চাচাদের মুখে সব সময় শুনে আসছিলাম, আমাদের ভাষাটাকে যে পশ্চিমারা বিলুপ্ত করে দিতে চায়। বহুরকম আঘাত তারা করেছে। বহুদিক থেকে ফন্দি এঁটে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পেরে ওঠেনি বাঙালির তেজের সাথে।
শিখা তৈয়বা বেগমের কথায় বিমোহিত হয়ে যায়। সে বলে, দাদিম্মা, আপনি এতকিছু জানেন?
তৈয়বা বেগম আকর্ণ হাসিতে বলেন, ‘তুমি বুঝি ভেবেছিলে আমি বরাবর এমন চোখে জ্যোতিহীন, গায়ের কুঁচকানো চামড়ার এক জবুথবু বুড়ি ছিলাম! আরে, আমারও ঢলঢলে যৌবন ছিল। রোদের ঝিলিকের মতো রূপ ছিল। স্কুলে যাওয়ার পথে তোমার দাদাশ্বশুর নিজের কলেজ ফেলে আমার স্কুলের পথে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একুশে ফেব্রুয়ারির কত গান আমরা দুজন আরও অনেকের ভেতর গেয়েছি! তখন আমাদের একটা সময় ছিল বাংলা ভাষাকে সুন্দরভাবে সবার সামনে উপস্থাপনের। ভাষাই তখন আমাদের প্রাণ ছিল। কারণ আগে তো একসাথে এত কিছু দখল করে নেয়নি! তখন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিই প্রাণের সবটুকুজুড়ে ছিল। তখন প্রতিদিন বাড়ির কাজের লোককেও আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে বুঝিয়েছি, এই ভাষার জন্য যাদের জীবন গেছে, কেন গেছে, উর্দু ভাষাভাষীদের থেকে বাংলা ভাষায় কথা বলার মানুষ বেশি হওয়া সত্ত্বেও কেন উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল!’ এ পর্যন্ত বলতে বলতে তৈয়বা বেগম শিখার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা নাতবউ, ভাষা নিয়ে আমাদের সেই পুরনো চেতনা কী থিতিয়ে গেছে?
: না, দাদিম্মা! কারও কারও থিতিয়ে গেলেও কারও কারও ভেতর তা প্রবলভাবে জেগে আছে! নাহলে এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান পেল কী করে? দাদিম্মা, আমি আপনাকে ওই একটি কথাই বলতে চেয়েছিলাম, ভাষা অন্দোলন আসলে আপনার জন্মের সময় থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু আপনি নিজেই সে সম্পর্কে এত কিছু জানেন বলে আমার বেশ আনন্দ হচ্ছে। এই আপনি আমার দাদিম্মা এবং আপনি স্কুলেও অনেকটা লেখাপড়া করেছেন, সেই সময়ে…!
: বিয়ের পর স্কুলে পড়তে পারিনি। কিন্তু তোমার দাদাভাই আমার জন্যই বাড়িতে বইপত্র আনতেন। নিজে কী পড়লেন তা নিয়েও আমার সাথে আলোচনা করতেন।
ক’দিন ধরে শিখার যে মন খারাপ ছিল, তার পুরোটাই তখন ভালো হয়ে গেল। কিন্তু ক’দিন ধরে কেন খারাপ ছিল, তা আর সে কাউকে বলল না। সে বরং ওই কিশোর ছেলে, তালিমের দিকে ঘুরে বসে বলতে লাগল, একুশে ফেব্রুয়ারি উৎসব দেখতে যে ছুটে যাও, আনন্দ করো, জানো তো এর আড়ালে আমাদের কত বেদনা, কত বঞ্চনার কাহিনি লুকানো এবং কত রক্ত ঢেলে তা উদ্ধার করতে হয়েছে?
তালিম, দুদিকে মাথা নাড়ে, মানে সে জানে না।
শিখা তাকে শুধু শহিদমিনারের কাহিনিই নয়, স্বাধীনতার স্মৃতিসৌধসহ সব বিষয়ে বলতে শুরু করে। কাজের চাপে তাদের গল্পের মোড় থেমে যায়, ঘুরে যায়, কিন্তু আবার কোনো সূত্রে তা সামনে আসে। আর নিজের বলা এইসব গল্পকথা প্রতিধ্বনি হয়ে প্রায়ই তার কাছে ফিরে আসে, সে লক্ষ্য করে তালিম, পাশের বাসার তার মতো ছেলে-মেয়ের সাথে এইসব বিষয় নিয়ে গল্প করছে। ড্রাইভার ও রাঁধুনির সাথে এখন আর ঝগড়া নয়, সে তার অভিজ্ঞতার তহবিলে জমা হওয়া এইসব গল্পই তার মতো ভেঙেচুরে শোনাচ্ছে। আর সেসব শোনার পর ড্রাইভার ও রাঁধুনির সাধ্য কি তার সাথে ঝামটা মেরে বা ধমক দিয়ে কথা বলে! প্রতিনিয়ত এইসব ঘটনার ভেতর দিয়ে শিখা পেয়ে যায় নতুন এক দিশা! যার নাম দিকদর্শন।
Facebook Comments Sync