দীপু আর ছোট্ট চড়ুই (৪) – অনুপা দেওয়ানজী
উঠানে বৃষ্টির জল কিছুক্ষণ আগেও থই থই করছিলো । এখন জল না থাকলেও অজস্র শুকনো আর কাঁচা পাতা, গাছের ডাল, আর বরফের টুকরোতে মাখামাখি হয়ে আছে।
দীপু মামার হাত ধরে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললো। কিছুটা বরফ কুড়িয়ে একটা ঝুড়িতে নিতে না নিতেই মার ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেলো, ‘আর বরফ কুড়াতে হবে না। চলে আয়। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে ‘
দীপু হঠাৎ মামার হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁঠাল গাছটার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকলে মামা জিজ্ঞেস করলো, ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস রে দীপু? বরফ তো অনেক কুড়ালি, এবার ঘরে চল।’
দীপু বললো, মামা চড়ুই পাখিদের কিচির মিচির শুনতে পাচ্ছি না কেন? ওরা কেমন আছে একটু দেখে আসি। এই বলে সাবধানে গাছের নিচে এসেই বিস্ফারিত দুই চোখে তাকিয়ে দেখে গাছের নিচে অজস্র চড়ুই পাখি পড়ে আছে।
দীপুর কান্না তখন দেখে কে? সে হাতের বরফের ঝুড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো , মামা কাঁঠাল গাছে আর একটাও চড়ুই পাখি নেই। সবগুলি মরে গেছে।
দীপুর মামা এই দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি তাকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে আসলে সে মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো, মা তুমি বলেছিলে চড়ুই পাখিরা নাকি বিপদ আসলে আগেই টের পায়। তাহলে পাখিগুলি মরল কেন?
দীপুর মা দীপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, হয়তো বিপদ টের পেয়েছিলো কিন্তু এতগুলি পাখি কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিতো । তাই হয়তো গাছেই লুকিয়ে ছিলো।
মা ছোটমামাকে জিজ্ঞেস করলো , গাছে কি আর পাখি নেই? সব মারা গেছে?
দীপুর মামা বললো, বোঝা যাচ্ছে না দিদি । তবে গাছের নিচে বিস্তর পাখি পড়ে আছে দেখলাম।
আর না থাকলেও ভেবো না। দীপুর জন্যে কাঁঠাল গাছে দরকার হলে অন্য গ্রাম থেকে আমি চড়ুই পাখি আনার ব্যবস্থা করবো।
এরপর মামা দীপুকে বললো, শোন তবে তোকে একটা সত্যি গল্প বলি।
চীনের নেতা মাও সে তুং একবার বলেছিলেন এক একটা চড়ুই বছরে পাঁচ কেজি শস্য খায় । চীন থেকে যদি দশ লাখ চড়ুইপাখি মেরে ফেলা হয় তাহলে সেই শস্য দিয়ে ষাট লক্ষ লোকের খাবার জোগানো যাবে।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আহা এমন নিষ্ঠুর কাজটা কেন করতে গেলেন তিনি? তারপর?
মামা বললো, তারপর আর কি? চড়ুই মারার জন্যে শুরু হল ড্রাম বাজানো। এতে চড়ুইপাখিগুলি ভয়ে উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়েএকসময়ে মাটিতে পড়ে গেলে ওদের জাল দিয়ে ধরা হল, বন্দুক দিয়ে মারা হল, এমন কি ডিমগুলি পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলা হল।
এদিকে সব চড়ুই মারা যাবার তিন বছর পরে চীনে লাগলো দুর্ভিক্ষ। এতে প্রচুর মানুষ খেতে না পেয়ে মারা গেলো।
কেন জানিস? ফসলের ক্ষেতে পোকার আক্রমণ এত বেড়ে গিয়েছিলো যে সে ফসল আর ঘরে তোলা যায়নি। এর আগে চড়ুই পাখিরা এই পোকা খেয়ে ফেলতো বলে ফসলের ক্ষতি হত না।
নিজেদের বোকামি বুঝতে পেরে এরপর নিরুপায় হয়ে প্রকৃতিকে চড়ুই পাখিকে ফিরিয়ে দেবার জন্যে রাশিয়া থেকে আবার চীনে চড়ুই পাখি আমদানি করা হল।
খেতে বসে দীপু ভালো করে খিচুড়িটা খেলোই না। মাছ ভাজা পড়ে রইলো, মাংসটাও তাই।
দীপুর মন খারাপ হলে কি হবে গ্রামের অনেকেই তখন ছুটে এসেছে দীপুদের বাড়ির কাঁঠাল গাছের নিচে। চড়ুই পাখির মাংস খাবে বলে তারা পাখি কুড়িয়ে নিতে এসেছে।
দীপু এ দৃশ্য দেখেনি। সে তখন মার সাথে ঘুমিয়ে আছে।
পরদিন সকালে আকাশ তখনও কেমন যেন ঘোলাটে ।দীপুর ছোটমামা কাঁঠাল গাছের নিচ থেকে ঘুরে এসে বললো, গাছের সব পাখি মারা যায় নি । এখনও কিছু পাখি আছে।
দেখতে দেখতে কিছুদিনের মধ্যেই দীপুদের কাঁঠাল গাছে আবার চড়ুইপাখিদের কিচিরমিচির শুরু হল । আবার পাখিরা ঘাসের ডগা, পোকামাকড় কুড়ায়, দীপু আবার তাদের চাল, মুড়ি ছুঁড়ে দেয় শুধু আকাশে মেঘ করলে দীপু আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করে সেদিনের মতো শিলাবৃষ্টি যেন আর না হয়।
Facebook Comments Sync