দোপাটিতে খোঁপাটি সাজাও – সাঈফ ফাতেউর রহমান

ফুলের নামঃ দোপাটি

ইংরেজী নামঃ Balsam

অন্যান্য নামঃ Garden Balsam, Rose Balsam, Spotted Snapweed, Touch-me-not

বৈজ্ঞানিক নামঃ Impatiens balsamina

পরিবারঃ Balsaminaceae

 

‘দোল দোল দোলনী রাঙা মাথার চিরুনী

এনে দেব হাট থেকে মান তুমি করো না

নতুন নতুন খোপাটি তুলে এনে দোপাটি

রাঙা ফিতায় বেধে দিবো মান তুমি করো না’

অতি জনপ্রিয় এই পংক্তিমালা উচ্চারিত হয়নি, আর শিশুর কান্না প্রশমনে ধ্বনিত হয়নি এই নন্দন ছড়া এমন পরিবার হয়তো দুর্লভই বাংলাদেশে।

আর কবি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় গান, ‘লাজুক মেয়ে পল্লীবধু

জল নিতে যায় একলাটি

করবী নেয় কবরীতে

বেনীর শেষে দোপাটি’  তো অনেকেরই অতি প্রিয়।

 

কে না শুনেছেন মোহাম্মদ রফি’র অমিয় কন্ঠের,

“তোমার নীল দোপাটি চোখ

শ্বেত দোপাটি হাসি

আর খোপাটিতে লাল দোপাটি

দেখতে ভালবাসি….”

ছড়া, কবিতা আর জনপ্রিয় গানের কল্যাণে দোপাটির পরিচিতি নান্দনিকতার অতি উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত। আর এমনিতেই বাংলাদেশ, পশিমবঙ্গ ও পূর্বভারতীয় রাজ্যগুলিতে দোপাটির উপস্থিতি, চাষযোগ্যতা আর জনপ্রিয়তা ব্যাপক।

খুব সহজেই জন্মানোর সুযোগ আর বংশবিস্তার, পরিচর্যা অতি সহজ হওয়ায় গ্রামীন পরিবেশে খুব কম গৃহেরই দেখা মিলবে, যেখানে দোপাটির অবার প্রফুল্ল সুহাস সুমিত প্রস্ফুটন আলোকিত করছেনা পরিপার্শ্ব।

গৃহীর ঘরের আঙ্গিনায় যেমন, পথপাশে সারিবদ্ধভাবে, পরিকল্পিত বাগানেও এর দর্শন মিলবে।বর্ডার বা সীমানা চিহ্নিতকরনের জন্য দোপাটি বেশ উপযোগী। একারণে ফুলবাগানের কেয়ারীতে দোপাটি লাগানোর চল রয়েছে। পায়ে চলার পথের দু’ধারেই সুশৃঙ্খল সারিতে দোপাটির বিন্যাস আকর্ষক।

দোপাটির জনপ্রিয় দুটি জাত- ক্যামেলিয়া এবং বালসাম রোজ।

দোপাটি লাল, গোলাপী, বেগুনী, কমলা, সাদা এবং মিশ্রবর্ণেরও হয়ে থাকে। হতে পারে সিঙ্গল বা ডাবলও।

এর পরিপক্ক ফল স্পর্শ মাত্রই লাফ দিয়ে ফেটে গিয়ে ভেতরের কালো বরন ছোট ছোট বীজ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। খুব অনাচার না হলে, আর মৃদুতম অনুকূল পরিবেশ মিললে যথাযময়ে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারার উদ্গম হবে।

দর্শনধারী নান্দনিক এই ফুল, সুগন্ধবিহীন হয়েও কেবল সুরম্য মনলোভা আকর্ষণীয় সাজেই সাধারণ্যে ব্যাপকভাবে আদৃত।

অনায়াস চাষযোগ্যতা দোপাটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সব ধরনের মাটিতেই জন্মে। জমিতে যেমন, টবের মাটিতেও তেমনই স্বচ্ছন্দ্য।হালকা উর্বর দোআশ মাটিতে অপেক্ষাকৃত ভালো জন্মায়।  সব ঋতুতেই ফুলের প্রস্ফুটন হয়। তবে বর্ষা মৌসুমে ফুলের আকার অপেক্ষাকৃত বড়, কিঞ্চিৎ অধিক দর্শনধারীও।দিনের দৈর্ঘ বড় হলে এবং আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র হলে উত্তম। একটানা বৃষ্টিপাত গাছের জন্য খুব  ক্ষতিকর।সমভাবে ব্যাপ্ত ১০০-১২৫সেমি. বৃষ্টিপাত ও ৩০-৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন মরশুমি ফুলের জন্য বিশেষ অনুকূল।

গাছ আকারে তেমন বড় হয়না। ৪৫-৬০ সেন্টিমিটার বা ১.৫০-২.০০ফুট। গাছ বেশ ঝোঁপালো। এ গাছে কান্ড নরম।

দোপাটি ফুল সম্পূর্ণরুপে পেকে গেলে নিজে নিজেই ফেটে যায় এবং চারদিকে বীজ ছড়িয়ে পড়ে। একারণে ফল পাকার আগেই বীজ সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়।

উপযোগী বপনকাল জুন মাস।

থ্রিপস, লাল মাকড়সা, জাবপোকা ও শোষক পোকা দোপাটির শত্রু।কিঞ্চিৎ পরিচর্যা ও প্রতিকারেই তা নিরোধ সম্ভব।।

 

বাংলা নামঃ ম্যাগনোলিয়া, হিমচাঁপা, উদয়পদ্ম
ইংরেজি নামঃ Magnolia, Southern Magnolia, Bull Bal, Laural Magnolia
হিন্দী নামঃ হিমচাঁপা
উদ্ভিদতাত্বিক নামঃ Magnolia grandiflora

ম্যাগনোলিয়া, হিমচাঁপা, উদয়পদ্ম
ম্যাগনোলিয়া, হিমচাঁপা, উদয়পদ্ম

অপার সৌন্দর্যে সমুজ্জল শুভ্র সুন্দর নান্দনিক আকর্ষণীয় ফুল ম্যাগনোলিয়া। ফুলের প্রস্ফুটন হয় গাছের শাখার অগ্রভাগে, সূর্যের মতোই। এই ফুলের অপার মোহনীয়  নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর বিমুগ্ধ কবি বোধ করি একারণেই এই ফুলের নামকরণ করেছিলেন উদয়পদ্ম। যদিও পদ্মের সাথে কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হলেও এই ফুল আদৌ পদ্মই নয়।
ম্যাগনোলিয়ার আদিবাস কিন্তু এদেশে নয়। এই উপমহাদেশ বা এশিয়া মহাদেশেরও নয় এই ফুল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, মিসিসিপি ও লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে এর আদিবাস। লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের জাতীয় ফুল এটি। আর মিসিসিপি  অঙ্গরাজ্যে এটি জাতীয় বৃক্ষ। আমেরিকায় যখন ব্যাপক গৃহযুদ্ধ চলমান, তখন কনফেডারেট আর্মি তাদের জাতীয় ফুল হিসেবে ব্যবহার করতো ম্যাগনোলিয়াকে।
অবশ্য এখন বাংলাদেশ বা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেই ম্যাগনোলিয়ার উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়।
এই ফুল অপার সৌন্দর্যের আধার। নান্দনিক, সুপ্রভ আর মোহনীয় এর রূপশ্রী। যখন প্রস্ফুটন ঘটে এ ফুলের , গাছের শাখার অগ্রভাগে এক একটি মনমোহিণী ফুল। দেখায় যেন অবিকল ফুটে আছে এক একটি শ্বেত পদ্ম। খুব ভোরে, যখন প্রস্ফুটন ঘটে ম্যাগনোলিয়া ফুলের, তখন অসামান্য সৌন্দর্যে আলোকিত, সুপ্রভ হয়ে ওঠে পরিপার্শ্ব। এ সময়ে ফুলের পাঁপড়ি থাকে ঘন সন্নিবেশিত, অনবদ্য, সুস্মিত, মনোহর। বেলা যত বাড়ে, সূর্যের তেজ বেড়ে যায়, পাঁপড়ি গুলি ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে যেতে থাকে, বর্ণ হারায় উজ্জ্বলতা, হয়ে পড়ে নিস্প্রভ। যেন অভিমানী, খুব স্পর্শকাতর সুন্দরী আর্তনাদে কেঁদে ওঠে। এমন অসামান্য সৌন্দর্যের আধার এই ফুল বড়ই ক্ষণজীবী, ক্ষণস্থায়ী। মাত্র একদিনই এর আয়ু। বাসি হয়ে ঝরে পড়ার মেয়াদ মাত্রই একদিন।

৬-১২ টি পাঁপড়িতে বিন্যস্ত থাকে ম্যাগনোলিয়া ফুল। পাঁপড়ির রং সাদা অথবা কিঞ্চি ঘিয়ে। পাঁপড়ি কোমল, মোলায়েম। ফুল অনেকটাই পিরিচাকৃতির। আর  আকারে বেশ বড়।। ফুলের সুগন্ধ মনে করিয়ে দেয় লেবুর গন্ধের কথা।
ম্যাগনোলিয়া বড় আকারের  উদ্যানবৃক্ষ। শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে রয়েছে এর বিশেষ সমাদর। উদ্যানের শোভা বাড়াতে এর সমাদর, কদর অনেক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নান্দনিক বৃক্ষ হিসেবে এটি সবিশেষ আদরণীয়। এশীয়ার বিভিন্ন দেশেও এটি নন্দন-বৃক্ষ হিসেবে আদরণীয়।
শতাব্দী প্রাচীন  নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের আদি প্রধান ভবনের প্রবেশ পথে  ম্যাগনোলিয়া সবাইকে স্বাগত জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল্যের কার্জন হল এলাকায়ও দেখা মিলবে ম্যাগনোলিয়ার। পাশেই বাংলাদেশ শিশু একাডেমীতেও রয়েছে ম্যাগনোলিয়া স্বমহিমায়। এর দেখা মিলবে বলধা গার্ডেনে, রমনা পার্কে আর মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনেও। বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকায় আরও কিছু ম্যাগনোলিয়া গাছ আছে।সংখ্যায় কম হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ম্যাগনোলিয়ার দেখা মিলবে।
ম্যাগনোলিয়া চিরসবুজ গাছ।  শীত প্রধান অঞ্চলে এ গাছের উচ্চত হতে পারে ২৭ মিটার পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশ, ভারতের আবহাওয়ায় ম্যাগনোলিয়া  গাছের উচ্চতা সাধারণভাবে ৬-১০ মিটার অতিক্রম করেনা। গাছের গড়ন হালকা। কিছুটা লম্বাটে। পুরোটা বছর জুড়েই ঝরতে থাকে গাছের পাতা, আর ক্রমাগতভাবে উদগম হতে থাকে নতুন পত্ররাজির। পাতার বর্ণ নান্দনিক। কিছুটা কালচে সবুজ।পাতা আকারে বড়, বিন্যাসে একক আর আয়তাকার।
ম্যাগনোলিয়া ফলের আকার ডিম্বাকার। কিঞ্চিৎ গোলাপী রঙের ফল লম্বায় ৮-১০ সেমি। ফলের ভেতরে থাকে অনেক বীজ। পাখী কুলের অতি প্রিয় আহার এই ফলের বীজ। পাখী ও প্রাণীরাই বহন করে নিয়ে  যায় এই ফলের বীজ বিভিন্ন স্থানে। তবে বড় বেশী আয়াসসাধ্য এই গাছের বংশ বিস্তার। এ কারণেই ব্যাপকতা পাচ্ছেনা গাছটি। দাবাকলমের মাধ্যমেই সাধারণত চারা তৈরি করা হয়ে থাকে।
বেশ মূল্যবান ম্যাগনোলিয়া গাছের কাঠ। কাঠ ভারী আর সুশক্ত। আসবাবপত্র তৈরীতে এর কাঠের কদর আছে। দারুমূল্য অধিক হওয়ায় আর নান্দনিক ফুলের কারণে এ গাছের ব্যাপকতা প্রত্যাশিত।
উদ্যানবিদদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলে গবেষনার মাধ্যমে এর সহজতর বংশ বিস্তার সভব হলে তা হবে অতি সুখকর।