দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ১০) – আফরোজা অদিতি

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ৯) - আফরোজা অদিতি

পরদিন বিকেলে চিন্তিত হয়ে পরলো অফিসের সকলে। চিন্তার কথাই। ইথিকার সই জাল করে টাকা নিয়ে গেছে কেউ একজন। কিংবা কোন চক্র। টাকার অঙ্কও কম নয়। পঞ্চাশ হাজার। ইথিকা মাসিক বিবরণীর ফাইল দেখছিল। সেকেন্ড ম্যান কুদরত আলী ডাকে ইথিকাকে।

‘ দেখুন তো এই সই আপনার কি না।’

‘আমারই তো।’ সহজভাবেই উত্তর দেয় ইথিকা।

‘ভাল করে দেখে বলেন।’ কুদরত আলী বলে।

‘আমি দেখছি, আমাকে দেন; আপা বঝতে পারছে না।’

সজিব সাহেব এগিয়ে এলেন। সজিব সাহেবই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এখানে আসার পর থেকেই ওকে সব কাজে হেল্প করে আসছে। তিনি বললেন,‘এটা আপার সই না।’

ম্যানেজার সাহেবসহ সকলেই চিন্তিত, ব্যস্ত। ম্যানেজার, রফিক সাহেব ডেকে বললেন ওকে, ‘শুনুন ইথিকা, এই বিষয়টি নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করবেন না। কারো কানে যদি এই কথা যায় তবে বিপদ হবে, আপনার আমার সকলের।’

‘ঠিক আছে।’ সায় দেয় ইথিকা। কম্পিউটারে পোস্টিং হয় এখন। ও নিশ্চয় ওর আইডি কম্পিউটারে রেখেই কোথাও গিয়েছিল। যাওয়ার মধ্যে তো খেতে যাওয়া আর বাথরুম। কিংবা ম্যানেজারের চেম্বার। উহ আজ এরকম ভুল কি করে হলো। নিজের উপর বিরক্ত হয় নিজেই। সংসারে অশান্তি, নিজের মনের টানাপোড়েন ওকে এই অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। চুপ করে বসে থাকে ও। কোন কাজ করতে আর ভাল লাগে না।

তিন দিন পর। কী দিয়ে হল ও কিছুই জানে না। ওকে কিছুই বুঝতে না দিয়েই টাকা উদ্ধার করলো ম্যানেজার সাহেব। এ যাত্রা বেঁচে গেল ইথিকা। ম্যানেজার সাহেব ওকে ডেকে বললেন, ‘রাকিব সাহেব আপনাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। আমার বন্ধু। আমরা একই সঙ্গে পড়েছি কলেজে। ও যদি না হেল্প করতো তবে আমার পক্ষেও সম্ভব ছিল না এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার।’ রাকিব বাঁচিয়েছে ওকে। কথাটা বাঁচার প্রেরণা দেয় ওকে। ধন্যবাদ দিতে হয় ভাবে ইথিকা। ধন্যবাদ দেওয়ার কথা মনে হতেই দেখতে ইচ্ছা করে ওকে।

অনেকদিন দেখা হয়নি দুজনের। সেদিনের পর থেকে আর আসেনি রাকিব। ডাকেওনি ও। অফিস শেষ হওয়ার আগে টেলিফোন করে রাকিবকে। বাকরুদ্ধ রাকিব; কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না ও। ধন্যবাদ দেয় না ইথিকা; দিতে পারেনা। ধন্যবাদ দিলে ছোট করা হবে মনে হয় ওর। তার চেয়ে থাক না ঋণী হয়ে ওর কাছে। জীবনের কিছু কিছু ঋণ শোধ করতে হয় না কখনও। দুই একটা কথা হয় দুজনের। ইথিকা লক্ষ্য করলো ওর স্বামী সন্তান ছাড়া কোন কথা জিজ্ঞাসা করলো না রাকিব। মন ভারী হয়ে থাকে ইথিকার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্ন থেকে বিষণ্ন হয়ে গেল। বেলা শেষে অবসন্ন ক্লান্ত হৃদয় নিয়ে বাসায় ফিরলো ইথিকা।

 

রিকশা থেকে নেমে গেট খুলে ঢুকতে যেতেই দেখতে পায় গেটের সামনে ছড়ানো গোলাপ পাপড়ি। টাটকা; টকটকে লাল গোলাপের পাপড়ি। কে ছড়ালো এ পাপড়ি। এ যেন ফুলের পাপড়ি নয় পূজার নৈবেদ্য। কুড়িয়ে নিল ইথিকা। সুন্দর সুগন্ধি। গন্ধ নিল কয়েক বার। গোলাপের গন্ধে পেল পরিচিত এক সুগন্ধি।

রাকিব।

রাকিব এসেছে, কোথায় ? একটু ঘুরে তাকায় এদিক ওদিক। চলে যাচ্ছে রাকিব। ‘রাকিব। এই রাকিব। চলে যাচ্ছ যে? এসো বাসায়।’

ওর উজ্জ্বল চোখ, প্রাণবন্ত ডাক খুশী করে রাকিবকে। ও খুশী হলেও ওর  আহবানে সাড়া দিতে পারে না রাকিব। দেয় না। বলে, ‘না থাক।’

‘আহা এসোই না।’ জোর করে, বাসায় নিয়ে আসে ওকে। চা করে। দুজনে খায় একসঙ্গে। কথা বলে, হাসে। কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ায় রাকিব। ‘চলি।’

‘এরকম পাগল কেন তুমি। এভাবে গোলাপ ছড়িয়ে রাখো আমার চলার পথে। এর আগেও পেয়েছি কয়েকবার কিন্তু ধরতে পারিনি তোমাকে। আজ পেয়েছি। শাস্তি হবে তোমার।’ ওর কথা শুনে জল ভরা চোখে একবার তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নেয় রাকিব। চোখের জল দেখাতে চায় না ওকে। কী হবে। চোখের জল, বুকের কষ্ট দেখিয়ে; কিছুই হবে না। ওই মনে তো জায়গা নেই ওর। যা জায়গা সব দখল করেছে তমিজ, তমিজের সংসার-সন্তান। ও থাক সুখে থাক। ভালো থাক। ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকাতেই আনন্দ, সুখে থাকাতেই সুখ। ভালোবাসার মানুষের কোন কষ্ট হোক তা কখনই মন থেকে চায় না রাকিব। কষ্ট হোক ওরই হোক, ওর প্রিয় মানুষটি থাক সুখে। থাক আনন্দে। যাওয়ার সময় একটি কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলে রাকিব। ‘কবিতা সন্ধ্যা, এসো।’

‘যাবো।’ সায় দেয় ইথিকা।

তারপর ফিসফিসিয়ে কন্ঠস্বরে ঘনত্ব এনে বলে, ‘আই লাভ ইউ রাকিব। আমি ভালোবাসি তোমাকে। ভালোবাসি। ভালোবাসি।’

রাকিব সময় নষ্ট করে না আর। বের হয় পথে। ইথিকার ভালোবাসি কথাটা স্নিগ্ধ নূপূরের শব্দে বেজে চলে বুকের মধ্যে। ওর মনে হয় ইথিকা যেন শ্বেতবসনা কোন এক পরী। যে নূপুর পায়ে নাচছে ওকে ঘিরে। অনেকদিন পর ভালোলাগে আজ। জীবনটাকে মনে হয় রঙিন। ভালোবাসি এই একটা শব্দ ওর ধুসর জীবনের দেয়ালে রঙিন পোষ্টার লাগিয়ে দিয়েছে অনেক অনেক। এ পোষ্টার কথা কয়, কথা কয়, কথা কয় জীবনের, ভালোবাসার, ভালোলাগার, বেঁচে ওঠার। রাকিব গুন গুন করে।

 

কবিতা সন্ধ্যা।

সংগঠনের নাম সুবর্ণলতা। একটা মেয়ের জীবন বাঁচাতে ফান্ড তৈরি করার জন্য এই কবিতা সন্ধ্যা। দশ টাকা পঞ্চািশ টাকা টিকিট।

ইথিকা পঞ্চাশ টাকা করে টিকিট কাটে দুজনের। কার্ড আছে তবুও। কারণ সাহায্য। তমিজ এসেছে, এসেছে রাহাও।

ইথিকারা যখন হলে ঢোকে তখন শুরু হয়ে গেছে আবৃত্তি। আবৃত্তি করছে একটি মেয়ে। বেশ ভাল আবৃত্তি করে মেয়েটি।

মেয়েটি স্টেজ থেকে নামার পর ঘোষিত হল রাকিবের নাম। ভরাট কন্ঠ। গমগম করছে হল। পিন পতন নিস্তব্ধতা।

এবার মোছাবো মুখ তোমার আপন পতাকায়। হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যাম-কান্ত ফুল নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে। দুঃখ ভোলানিয়া গান গায় মোছাব তোমার মুখ আজ সেই পতাকায়।

স্বাধীনতার কবিতা।

কিন্তু কবিতা শুনে মনে হয় ইথিকার ওরই মুখ যেন মুছিয়ে দিচ্ছে রাকিব ওরই ভালোবাসার সবুজ পতাকায়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে ও।

রাকিব খুব সুন্দর আবৃত্তি করছে আজ। দরদ ঢেলে আবৃত্তি করেছে, আবেগি কণ্ঠে আবৃত্তি করেছে। রাকিবের বন্ধু সরোজ মন্তব্য করে খুব আস্তে প্রায় ফিসফিসিয়ে, ‘আপনি এসেছেন তো তাই কণ্ঠ খুলেছে ওর!’

লজ্জায় লাল হল ইথিকা। ও বুঝল লাল হয়ে গেছে ও কান মুখ। মুখ নিচু করে ও। আবৃত্তি সন্ধ্যা শেষ হয়। ওদের কাছে এগিয়ে আসে রাকিব। তমিজের সঙ্গে কথা বলে। ‘খুব খুশি হয়েছি এসেছেন। আসুন চা খাই।’

রাজি হয়না তমিজ। রাকিব আবারও বলে। পীড়াপীড়ি করে। ওর পীড়াপীড়িতে একটা রেষ্টুয়ারেন্টে ঢোকে ওরা। মিষ্টি সমুচা আর চা। রাহার জন্য কেক। রাহা খুব খুশী। এভাবে এই প্রথম। কেকে কামড় বসিয়ে বলে, ‘আঙ্কেল তুমি খুব ভাল।’

‘তাই নাকি বাপিমনি।’ মাথার চুল নেড়ে আদর করে দেয় রাকিব। রাহার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় রাকিব। খাওয়া শেষ হলে কোলে নেয় ওকে। ওর ঠোঁটে মুখে কপালে ছোঁয়ায় ঠোঁট। আদর করে নামিয়ে ইথিকার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমার স্পর্শ তোমার ছেলের গায়ে মাখিয়ে দিলাম, ওকে যেই ছোঁবে তুমি ছোঁবে আমাকে।’ অবশ চোখে তাকায় ইথিকা। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে হন হন করে হাঁটতে থাকে সামনে। রিকশার, কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ। “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই/ যাহা পাই তা চাই না।”

রিকশায় উঠে শুরু হয় তমিজের ব্যঙ্গোক্তি। খুব মাখামাখি হ্যাঁ। কবিতা শুনতে আসা এই জন্য। প্রেমের সাগর উপচে যাচ্ছে। আহা জোয়ার লেগেছে। ওর কথা জবাব দেয় না ইথিকা। তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে।

‘আব্বু, আঙ্কেল কত ভালো, তাই না।’ রাহার কথায় চটে যায় মনে মনে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,‘হ্যাঁ ভাল তো হতেই হবে।’

‘কেন আব্বু।’

‘বুঝবে না তুমি।’

বাবার কথা বুঝতে না পেরে কোন কথা বলল না রাহা। ওর ছোট মনে শুধু আঙ্কেলের আদরটুকুই মনে থাকলো আর কিছু নয়। শিশুরা এতো কিছু বুঝে না। জীবন সংসারের টানাপোড়েনের ঊর্দ্ধে ওরা। এসব টানাপোড়েন ওদের ছুঁতে পারে না। ওরা নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ।

 

রিকশা থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকতেই মারমুখি ছুটে আসে শাশুড়ি। ‘আমার ছেলে বউকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছ কেন। ওরা কী এমন ক্ষতি করেছে তোমার বড় বউ।’ কিছুই বুঝতে পারেনা ইথিকা। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ও! কে যায়, কোথায় যায়, কাকে কে তাড়ায় কিছুই বুঝতে পারে না। তবে প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পরেই বুঝতে পারে চলে যাচ্ছে ওর দেবর হাকিম ওদের ভাড়া করা বাড়িতে। বাইরে এই জন্য ঠেলা দেখেছে একটা। ও ভেবেছে উপর তলার কেউ বাসা পাল্টাচ্ছে। কিন্তু যাবে যখন তখন এত রাত করেছে কেন? দিনের বেলায় যায়নি কেন? কাপড় চোপড় চেঞ্জ না করেই পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় হাকিমের ঘরের দিকে। ঘরেই আছে হকিম। প্রায়ই সবই নেওয়া হয়ে গেছে এখন শেষ ঠেলাটায় অল্প যা হাঁড়ি পাতিল আছে। খাট বিছানা আছে তা নিয়ে যাবে, সঙ্গে হাকিম, রিয়া।

এতো হাঁড়ি পাতিল কিনলো কবে? একটা বস্তা ভর্তি করার পরেও আরও বাকি, ভরছে অন্য বস্তায়। ওদের যাওয়ার প্ল্যান ছিল আগে থেকেই; শুধু শুধু গন্ডগোলের সৃষ্টি করে এ বাড়ির সবার চোখে খারাপ করা ওকে। কিন্তু কেন? কী করেছে ও। কারও তো কোন ক্ষতি করেনি আজ পর্যন্ত; বাড়ির সকলের ভালই চেয়েছে সেই বিয়ের পর থেকে অথচ এরা সবসময় খারাপ চেয়েছে ওর, মন্দ করার চেষ্টায় থেকেছে। ঝগড়া হল শাশুড়ির সঙ্গে, আর দোষ হচ্ছে ওর। একি ব্যবহার। ওর মন ক্ষুব্ধ হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছা করে। কিন্তু করে না কিছুই। কি হবে? এরা তো সব জেনেশুনেই করছে! ওকে হেনস্থা না করে, কষ্ট না দিয়ে যেন সুখ নেইএদের। সব সময়ই সকলেরই একই চেষ্টা কিসে ছোট করা যায় ওকে। কী ভাবে হেনস্থা করা যায় ওকে! যাক গে!

 

ইথিকা ঘরে না ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে দরোজায়। জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা চলে যাচ্ছ।’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায়।’

‘রায়ের বাজার।’

‘আমার ওপর নাকি রাগ করে চলে যাচ্ছ তোমরা।’ ইথিকার কথার সঙ্গে ঝরে পরে কষ্ট।

‘না ভাবী কখনই না। একথা কে বলল?’ রিয়া শশব্যস্ত উত্তর দেয়।

ইথিকা জবাব দেয় না এ কথার। একটু হেসে চলে আসে নিজের ঘরে। কানে আসছে শাশুড়ির কথা। কথা তো নয় এক একটা তীক্ষ্ম খেঁজুর কাঁটা এসে বিঁধে যাচ্ছে বুকের মাঝখানে। ইথিকা এই মহিলার ভাব বুঝতে পারলো না আজ পর্যন্ত। ওর শাশুড়ি, এই মহিলা কী শুধু ওরই ভালো চায় না, নাকি ভালো চায় না কারোরই। একথা বুঝতে পারেনি আজও। শাশুড়ির গজর গজর শুনতে পাচ্ছে ইথিকা। বউ তো সব আমার আপনার। একজন থাকবে আর একজন চলে যাবে একি মেনে নেওয়া যায়, যায় না। হোক না কম পয়সার কামাই করা ছেলে, তাও তো ছেলে। ফেলে তো দেওয়া যাবে না তাকে। তাড়িয়ে তো দিতে পারি না তাকে। কিন্তু আমার পোড়া কপাল! কপাল চাপড়াতে থাকে শাশুড়ি।

আরে হাতের পাঁচ আঙুল কি সমান হয়? হয় না। তোর মতো তো বুড়ি মাগি না; কচি বউ, একরত্তি এক মাইয়া । না হয় একটু দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে তাতে কি। তাই বলে যা নয় তাই ব্যবহার করবে! বাড়ি থেকে চলে যেতে বলবে! এসব কথার অর্থ বুঝতে পারে না ইথিকা। কেন এসব কথা তাও বুঝে না। ওতো সারাদিন থাকে অফিসে। অফিস থেকে ফেরে সন্ধ্যায়। কোন কাজ থাকলে করে, না থাকলে করে না। গান শোনে বই পড়ে, টিভি দেখে সময় কাটায়। কারো সাতে পাঁচেও থাকে না।

‘ভাবী, মেজ ভাবীর বাবায় আইছে। বাইরের ঘরে বইসা রইছে।’ খবরটা দিয়েই ঘর ছেড়ে চলে যায় হাসুনি। এবারে সব বুঝতে পারে ইথিকা। রিয়ার বাবার কাছে ওকে খারাপ করার চাল এটা। ইথিকাকে খারাপ করে ভালো হবে ওর শাশুড়ি।

 

ইথিকার মন কেমন করে। ওর জীবনটা এমন কেন? কেন আর দশ জন মেয়ের মতো হলো না ওর জীবন। হলে কার কী ক্ষতি হতো? কী ক্ষতিই বা হতো ঈশ্বরের। শুয়ে থাকে ও; কয়েক মাস আগের কথা মনে পড়ে ওর।

সকালে উঠতে একটু দেরী হয়েছিল। শাশুড়ি ওকে না ডেকে ডেকেছে রিয়াকে। উঠেনি রিয়া। ধড় ফড় করে উঠে বসেছিল ও। নাস্তা বানানোর দেরী হয়ে যাবে, অফিস যেতেও। কাপড় ধুয়ে যেতে পারবে না আজ। রাজ্যের কাপড় ধুয়ে রেখে যেতে হয় রোজ। রান্না ঘরে চলে যায় ও। ওকে রান্না ঘরে যেতে দেখেই মুখ ভেংচিয়ে তজবি টিপতে শুরু করে শাশুড়ি। রিয়ার বাবা এসেছে, উঠতে হবে যেতে হবে ওই ঘরে।

শাশুড়ি বকর বকর করেই যাচ্ছিল। এবারে সহ্য হয় না ইথিকার। উঠে দাঁড়ায় শাশুড়ির ঘরের দরোজায়। ওকে দেখতে পায়নি শাশুড়ি। ‘বুইড়া ধুমসি স্বামী-খাগি মাইয়া মানুষ আমার ছেলেটার মাথা খেয়েছে, তা না হলে আমার সোনার চাঁদের মতো ছেলে কি আর ওই রকম হয়, ওর ফাঁদে পা দেয়। গেলে তুই যাবি হারামজাদী, আমার ছেলে কেন যাবে।’

‘কি হয়েছে আম্মা।’ ওকে দেখেই থতমতো খেয়ে যায় শাশুড়ি। ইতস্তত ভাব ফুটে ওঠে চোখে মুখে। জোর করে সেই ভাব কাটিয়ে ঝগড়াটে কন্ঠে কথা বলে শাশুড়ি। সে জানে এভাবে কথা বললে কথার উত্তর দেবে না ইথিকা। কিন্তু কথা বলতে ছাড়ে না ইথিকা কথার পৃষ্ঠে কথা বলে ও।

‘কি হইছে। ন্যাকা দেখতে পাও না। আমার ছেলে যাইতেছে গা।’

‘কেন যাচ্ছে?’

‘তোমার জন্য।’ এই কথা শুনে স্থির থাকতে পারে না ইথিকা। এতোদিনে বঝতে পেরেছে চুপ করে থাকাটা কোন সলিউশন হতে পারে না। কথা পিঠে কথা না বললে ওকে ওরা চাপতেই থাকবে, চাপতেই থাকবে। ‘আমার জন্য না আম্মা। আপনার জন্য পরশুর কথা মনে নেই। পরশু আপনারা দুজনে মিলে মারতে গিয়েছিলেন।’ একটু জোরেই বলে ইথিকা যাতে ওঘরে রিয়ার বাবা শুনতে পায়।

‘কি মুখে মুখে কথা। অপায়া, অলক্ষ্মী চলে যা আমার বাড়ি থেকে।’

‘বেশতো আপনার ছেলে বললেই যাবো।’

‘ওতো একটা ভেড়া, ও আর কি বলবে।’ চিল-চিৎকার করে শাশুড়ি।

‘বেশ তো শিখিয়ে দিন।’ কথা বলে আর ওখানে দাঁড়ায়নি ইথিকা। চলে এসেছিল ঘরে।

 

পরশু রিয়ার সঙ্গে হয়েছে একচোট। রিয়া না বলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল তাতেই শাশুড়ির রাগ। বলেছিল, ‘আলাদা বাড়িতে চলে যেতে। মারতেও গিয়েছিল।’ রিয়ারা এই যৌথ পরিবারে থাকতে চায়নি কখনই। আগেই ঠিক করা ছিল বাসা। শুধু এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারছিল না; চক্ষুলজ্জায় বাধছিল। পরশুর ঘটনায় সে ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। রিয়া থাক বা না থাক এতে কিছুই যায় আসে না ইথিকার। সকলের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসী ও। কিন্তু ওর কথা হলো ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কেন যাবে? ওর দোষ হবে কেন সব কাজেই! ঘরে শুয়ে ছিল ইথিকা। ভালো লাগছে না কিছুই। মনে পড়ে রাকিবের কথা। রিসিভার উঠিয়ে ডায়াল করে। বাড়ি নেই ও। রিসিভার রেখে চালু করে মিউজিক। “মরমিয়া তুমি চলে গেলে, দরদী আমি কোথা পাব কারে আমি এ ব্যথা জানাব।” গানটা শেষ হতে রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট দেয়। “দাঁড়াও আমার আঁখির আগে তোমার দৃষ্টি হৃদয়ে লাগে।

সমুখ আকাশে চরাচর লোকে এই অপরূপ

আকুল ও আলোকে দাঁড়াও হে

আমার পরান পলকে পলকে চোখে চোখে এর পরময় মাগে…

এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে ইহার মাধুরী তাড়াও হে

ধুলায় বিছানো শ্যাম অ লে দাঁড়াও হে নাথ দাঁড়াও হে।

যাহা কিছু আছে সকলই ঝাঁপিয়া, ভূবন ছাপিয়ে জীবন ব্যাপিয়া দাঁড়াও হে।

দাঁড়াও যেখানে বিরহী হিয়া তোমারি লাগিয়া একলা জাগে।”  গান শুনতে শুনতে অনুভব করে ভীষণ প্রয়োজন রাকিবকে আজ। মন চাইছে  রাকিবকে, জীবন চাইছে রাকিবের জীবনকে, হৃদয় চাইছে হৃদয়। আকুল প্রাণে, আলুথালু প্রাণে চাইছে মন-মোহিনী রাকিবের হৃদয়, মন বলছে দাও রাকিব তোমার হৃদয়খানা আজ আমাকে দাও, আমাকে দাও।

ও গুণগুণিয়ে সুর তোলে। “হৃদয়েতে পথ কেটেছি সেথায় চরণ পড়ে তোমার সেথায় চরণ পড়ে।”

 

গান শুনতে শুনতে বিষণ্নতা কেটে যায় ওর। ও চলে যায় এ বাড়ি ছেড়ে, এ বাড়ির আবহাওয়া, পরিবেশ থেকে অনেক অনেক দূরে। যেখানে ইটের পর ইট নেই, চার দেয়াল নেই, যেখানে নেই কথা, ঝগড়া, ফ্যাসাদ। যেখানে নেই ছোটখাট স্বার্থের দেন-দরবার, ওর মন চলে যায় সেখানে। ও সন্ধান পায় নীল আকাশের। স্বচ্ছ কাক চক্ষু জলের। স্বচ্ছ নীল আকাশের ছায়া পড়েছে কাক চক্ষু জলে। জলে ভাসছে আকাশের গায়ে উড়ন্ত বালিহাঁস, আবাবিল পাখির ছায়া। ওদের ডানায় ঝিকিয়ে ওঠা সোনালী রোদ পিছলে যাচ্ছে জলের ওপর।

ওর চারদিকে এখন শুধু সুগন্ধি হাওয়া আর হাওয়া। বাতাসে যেন ফুলে হাজার হাজার গন্ধ বিলাসী পুষ্প; ওর ভালোলাগে গান শুনতে। ভালো লাগে রাকিবের ভাবনাতে ভাসিয়ে দিতে নিজেকে! ওর স্বচ্ছ নীলাকাশ ওর ভালোবাসা, ওর হৃদয়। যে হৃদয়ের নাম, যে ভালোবাসার নাম রাকিব। রাকিব হে প্রিয় আমার, এসো এসো কাছে; দুবাহু বাড়িয়ে হৃদয় পেতে রেখেছি শুধু তোমারই জন্য; এসো প্রিয় এসো আমার কৃষ্ণ, হৃদবল্লভ এসো।

‘কি ব্যাপার শুয়ে যে, চলে যাচ্ছে ওরা, ঠেকালেও তো পারো।’ আচমকা কথায় ধূলায় আছড়ে পড়ে ইথিকা। তমিজের কথা বুঝতে সময় লাগে ওর। ‘কি বোকা সেজে গেছো যে, বুঝতে পারছ না আমার কথা।’ রাগের সঙ্গে কথা বলে তমিজ।

‘কেন পারবো না।’ একটু স্থির হয় সামলে নিতে; তারপর নিজের মধ্যে ফিরিয়ে আনে নিজেকে। তমিজের কথার জবাব শান্ত কন্ঠেই দেয়।

‘ তোমার ভাই, ভাই-এর বউ শুনবে কি আমার কথা। আমি কে? তুমি বলো, তোমার মা আছেন, তিনি বলুন। না হয় তোমার বোনকে ডাকো, তিনি বলবেন। তোমরা সবাই মিলে বলো।’ ওর কথা শুনে রুক্ষ্ম চোখে তাকায় তমিজ। বের হয়ে যায় ঘর থেকে। ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে ইথিকা।

ওর স্বামী। এরই সঙ্গে এক ছাদের তলে একই বিছানায় চার চারটা বছর পার করে দিয়েছে ও। সব কিছুতেই দোষ ধরার জন্য মুখিয়েই আছে। বাড়ির কারো যেন কোন দোষ নেই, সব দোষ ওর; শুধুই ওর! একটু আগের ভালোলাগাটুকু একটু একটু করে বিষণ্নতার অতল জলে ডুবে যেতে থাকে। নিঃশ্বাস আটকে আসে ওর। মনে হয় কেউ যেন ওর মুখে বালিশ চাপা দিয়েছে এমন ভাবে ওর নিঃশ্বাস আটকে আসছে, ওর ফুসফুস কাজ করছে না। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাতাস টানতে কষ্ট হচ্ছে! জোর করে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে বুকটা ব্যাথায় টনটন করে। এই মুহূর্তে রাকিবকে মনে করতে চায়, মনে করতে চায় রাকিবের সব কথা।

‘উঠে এসো রাকিব; উঠে এস আমার মনের কাছে, হৃদয়ের নাগালে, নিঃশ্বাসের ঘনত্বে আমার। উঠে এসো।

 

ক্যারাম খেলছিল শরিফা।

শরিফা জানে না এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে হাকিম-রিয়া। শরীফা, তমিজের বড় বোন। শরীফা আর ওর স্বামী  বিরাজউদ্দিন আর পাশের বাড়ির দুই মহিলা ক্যারাম খেলছে; খুব প্রাণবন্ত খেলা চলছে। ভাইকে দেখে মুখ তোলে শরীফা।

‘কি রে মুখ শুকনা কেন? খাস নি কিছু নাকি বলবি কিছু।’

‘বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে হাকিম। বাসা নিয়েছে রায়ের বাজার।’ কোন রকম ভনিতা না করেই বলে তমিজ।

‘যাচ্ছে যেতে দে। যে চলে যেতে চায় তাকে আটকে রাখা যায় কখনও। নাকি রাখতে হয়।’ কথা বলেই খেলায় মন দেয় শরীফা।

‘খেলা বাদ দাও তো আপা, চলো। আমার আসলে কেউ নেই। ভাই-এর অভিমানে খেলা বন্ধ করে বোন। একটু রাগ করে খেলা ভেঙে দিতে হল বলে। ‘আমি গেলে কি যাওয়া আটকে যাবে ওদের। বাসা নিয়েছে, অ্যাডভান্স করেছে।’ বোনের কথায় তমিজ বলে, ‘বাসা নিক টাকা অ্যাডভান্স করুক, তবুও চলো তুমি। আরে তাই তো টাকা অ্যাডভান্স করেছে এই কথা কে বলল তোমাকে?’

‘কেউ না এটা তো বুঝাই যায়, বাসা নিলে টাকা অ্যাডভান্স করতে হয়।’

‘কোন কোন বাসায় লাগে না অ্যাডভান্স।’ জেদী অবুঝ বালকের মতো জিদ করে তমিজ। শরীফা এই ভাইকে খুবই ভালোবাসে। ওর কথা কখনই ফেলতে পারে না। পড়শিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভাই-এর সঙ্গে হাঁটতে থাকে। হাকিমের সঙ্গে দেখা হয় পথে। যাচ্ছে ঠেলার সঙ্গে, পেছনে রিয়া। রিয়ার কোলে মেয়ে, এষনা। ফুফুকে দেখে মায়ের কোল থেকে হাত বাড়ায় এষণা। ভ্রুকুটি করে রিয়া। ভ্রুকুটির ধার ধারে না এষণা। তাছাড়া ভ্রুকুটি বুঝার মতো বয়সও হয়নি ওর। চিৎকার শুরু করে এষণা। ফুফুর সঙ্গে যাবে। রিয়া বাধ্য হয় মেয়েকে ছেড়ে দিতে। এষণাকে নিয়ে বাড়ি ঢোকে ওরা।

 

রাহা কাঁদছিল। চলে গেছে এষণা। এষণা ওর খেলার সঙ্গি। প্রায় সমবয়সী। এষণাকে পেয়ে খুব খুশী রাহা। কান্না বন্ধ করে ও। তুমি আর যাবে নাতো। ওর হাত ধরে টানে। এষণা হাসে। ফুফুর কোল থেকে হাচড়ে পাঁচড়ে নেমে ছুটে যায় রাহার কাছে। শরীফা মায়ের ঘরে ঢোকে, পিছনে তমিজ। ইথিকা ওদের দেখেছে কিন্তু ওঠে না। যায় না ওই ঘরে। কি হবে গিয়ে! ওরা মুখে এক, অন্তর আর এক। ওরা সত্য বলে না কখনও। অন্তত ওর সঙ্গে নয়।

%d bloggers like this: