দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ১৪) – আফরোজা অদিতি

দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষা (পর্ব ৯) - আফরোজা অদিতি

চারদিকে ভোটের মিটিং মিছিল, ওর অফিসের সামনে নির্বাচনী প্রচারণার মিটিং। মিছিল করে আসছে দলীয় কর্মীরা। দলীয় নেতা, প্রার্থী সকলেই আছে। নির্বাচনী বক্তৃতার প্রায় শেষে দিকে কে বা কারা জর্দার কৌটার বোমা ফাটায়। এর পর থেকেই শুরু হয় পটকা, জর্দার কৌটার বোমাবাজী, লাঠালাঠি মারামারি। পুলিশ থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যায় থামাতে। পরিস্থিতি শান্ত হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। ইথিকা আটকে থাকে অফিসে। খবর শুনে ছুটে আসে রাকিব। বাসার কাছে পৌঁছে দিয়ে যায় রাকিব। দেখে ফেলে তমিজ। ওদের দেখতে পেয়ে বাসায় ঢোকে না ও।

রাকিব নামে না, ওই রিকশাতেই বাসার পথ ধরে। ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে ইথিকা; খুব ক্লান্ত লাগছে ওর। লিমা ঘরে ঢোকে। ডাকে,

‘ভাবী।’

‘কি ভাই এসো।’

‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি? ভাইজান খুব রাগ করলো; ভাঙাভাঙি করলো। আম্মা বলেছে, বাসায় ঢুকলে খুব করে শায়েস্তা করতে।’

‘তাই! কিন্তু আমি তো কোথাও যাইনি, অফিসেই ছিলাম। বোমাবাজি, মারামারিতে আটকে ছিলাম।’

‘ভাইজান বোধ হয় বিশ্বাস করবে না।’

‘না করতেই পারে! কোনদিনই বা বিশ্বাস  করেছে আমাকে। কোনদিনই করেনি; তাতে কিছু কী যায় আসে লিমা। কোনদিনই সে আমাকে এতোটুকু সম্মান দেয়নি, শুধু সে কেন এই বাড়ির কেউই দেয়নি! আর কিছু বলবে।’

‘তোমাকে আজ কিন্তু মারতেও পারে।’ লিমা কানে কানে কথা বলার মতো ফিসফিসিয়ে বলে।

‘তাই নাকি। বেশ তো মারলে মারবে! কী আর করতে পারি বলো; যার যার ভাগ্য! তা রাহা কোথায়?’

‘রাহাকে দিতে গেছে আপার বাসায়। আম্মা শিখিয়ে দিয়েছে।’

‘ঠিক আছে।’ বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

‘যাই ভাবী।’ লিমা ঘরে চলে যায় এক দরোজা দিয়ে অন্য দরোজায় ঘরে ঢোকে তমিজ। কোনরকম ভনিতা না করেই বলে, ‘কোথায় গিয়েছিলি, কোন নাগরের সাথে ছিলি? আর গিয়েছিলি যখন তখন এসেছিস ক্যান হারামজাদী।’

‘আসতে হলো তাই এসেছি।’ নির্বিকার উত্তর দেয় ইথিকা। শাশুড়ি ঘরে ঢুকেছে। বলে, ‘মাগো মা, লজ্জা নাই, আবার কথা কয়।’

‘লজ্জা কেন থাকবে আম্মা, আমি তো কোন অন্যায় করিনি।’

‘তেজ দেখ, অন্যায় করে নাই। তেজ ভাইঙা দে, তুই না পুরুষ মানুষ, ওর তেজ ভাইঙা দে। ওর তেজ আইজকা ভাঙতে না পারলে তুই আমার ব্যাটাই না। মনে করবো তুই হিজড়া, বউয়ের আঁচলধরা, মাইয়া মাইনষের অধম।’ ছেলের রাহের গোড়ায় পানি ঢালে মা। ইন্ধন জোগাতে থাকে।

তমিজ রাগে গরগর করতে থাকে! দাঁত কিড়মিড় করে দুই হাতে প্রথমে চুল ধরে টেনে তোলে ইথিকাকে তারপর চড় থাপ্পড়, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে গলা টিপে ধরে। হাত মুখ দুটোই চলে। ‘মেরেই ফেলবো হারামজাদী তোকে; আমি পাবো না, আর কেউ-ই পাবে না। আমার থাকবি না তো কারো থাকবি না। কারোর থাকতে দেব না, কারো না।’ কথা বলে আর গলা টিপে ধরে। কোনরকমে গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু হাত টেনে ধরে ফেলে তমিজ্। বলে, ‘বাচ্চা থাকবে না পেটে, থাকবে না।’ কথার সঙ্গে একটা লাত্থি দেয় পেটের ওপরে কিন্তু ইথিকা একটু সরে যাওয়াতে লাত্থিটা হালকাভাবে পেটে লাগে। ইথিকা কোন রকমে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে বাড়ির বাইরে এসে লুকিয়ে পড়ে সিঁড়ি ঘরে। ও জানে এখনই তমিজ বাইরে বেরিয়ে এসে ধরতে চাইবে ওকে। তমিজ ছাড়বে না ওকে। মাস গেলে  মুফতে এতোগুলো টাকা কি হাতছাড়া করতে চায় কেউ কখনও! কেউ চায় না। ইথিকার ভাবনাই ঠিক। ও বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই বাইরে এলো তমিজ। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তায় বের হলো। প্রায় আধঘন্টা পর ফিরে এলো তমিজ।

তমিজ ফিরে এলে রিকশা নিল ও। এতোক্ষণ এই সিঁড়িঘরেই লুকিয়ে ছিল। ভাগ্যিস এখানে খোঁজ করেনি। এখানে খোঁজ না করাটাও ওর ভাগ্য। ভাগ্য এখন ওর সহায়! কিন্ত কতোক্ষণ, কতোদিন কতো মাস, বছর! ও কী ওর জীবনকে বদলাতে পারবে। ও কী ওর জীবন কাননে ফোটাতে পারবে দুপুরচন্ডি! পারবে কি পারবে না সেতো পরের কথা। চেষ্টা করে যেতে হবে। ওর জীবন কাননে দুপুরচন্ডিকে ফুটতে দিতেই হবে। ওর পেটের ওপরে আদর- সোহাগের একটি হাত রাখে। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে, ওকে আনতেই হবে এই পৃথিবীতে।

কিন্তু কোথায় যাবে এখন? এবার মায়ের বাসায় নয়, রাকিবের বাসায় নয়, পরিচিত কারো বাসায় নয়! এবার নিজের বাসায়। নিজের একটা ঘর, একটা নিজস্ব বলয়ে থাকবে; থাকবে নিশ্চিন্ত।

ইথিকা তো ওই সংসার ছেড়ে আসতে চায়নি। ও বিধবা; বিয়ের রাতেই মারা গিয়েছিল স্বামী;  গুন্ডারা মেরে ফিলেছিল। যে স্বামীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, হয়নি চেনা জানা তার জন্য সে একাকী জীবন কাটাতে মনস্থ করেছিল। স্বামীর সঙ্গে কোন স্মৃতি না থাকলেও ওই বিয়ের সময়টুকুকেই সম্বল করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল কিন্তু পরিস্থিতি ওকে বাধ্য করেছিল তমিজকে বিয়ে করতে। তমিজ এবং ওর পরিবারের সদস্যদের পীড়ন এবং ওর টাকার প্রতি লোভ মানসিকভাবে পর্যদুস্ত করেছে ওকে তবুও সংসারে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু মানসিক পীড়নের সঙ্গে ওর স্বামীর দৈহিক নিপীড়ণ সহ্য করতে পারে না ইথিকা। তবুও সংসারের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার চেষ্টা করেছিল; সংসারে ছিল কিন্তু ওই সংসার স্বামী আর সংসারের অন্যান্য লোকজন তাকে আর টানেনি কখনও, টানতে পারেনি। সংসার, স্বামী থেকে ওর মন দূরে চলে গেলেও সংসার অন্তঃপ্রাণ ইথিকা এতোদিন ত্যাগ করতে পারেনি সংসার! বারবার তার নারীত্বের অবমাননা সহ্য  করেও থেকে গিয়েছিল। কারণ বাবা মায়ের কাছে চলে গেলেও তাদের কথা ‘ঐ সংসারই তো তোমার সংসার, তোমার বাড়িঘর, এই বাড়ি তো তোমার নয়!’ পাড়াপড়শিরা নানান কথা শুনতে শুনতে ফিরে আসতে না চাইলেও সমাজের রক্তচক্ষুর জন্য ফিরে ফিরে আসতে হয়েছিল তমিজের সংসারে…….. কিন্তু এবার আর ফিরবে না…। ইথিকার মনের মধ্যে ফিরবে না ফিরবে না কথাটা অনুরণন তুলতে থাকে।

ওর রিকশা চলছে। চারদিকে ভোটের তোড়জোড় চলছে ভালোভাবেই। রাত হয়েছে। তবুও ভোটের ক্যাম্পগুলোতে বসে আছে দলীয় কর্মীরা। বাজছে গান। প্যারোডি। হঠাৎ ঝুপঝাপ বৃষ্টি শুরু  হলো। বৃষ্টির মধ্যেই ওর রিকশা চলতে থাকে; থামাতে না করে রিকশাওয়ালাকে। কোন কিছু আরম্ভ হওয়ার আগে বৃষ্টি হওয়া শুভ লক্ষণ। বৃষ্টির মধ্যেই ওর রিকশা এগিয়ে চলে। রিকশার হুড তোলে না। পর্দা টানে না। ভিজে যাচ্ছে; ভিজে ভিজেই অনির্দিষ্ট গন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু হলো ইথিকার; হোক।

 

সমাপ্ত।

%d bloggers like this: