ঈদুল ফিতর মুবারক-২০২২ / খায়রুল আনাম

ঈদুল ফিতর মুবারক-২০২২

ঈদুল ফিতর মুবারক-২০২২

ঈদুল ফিতর মুবারক-২০২২ / খায়রুল আনাম

 

শেষ পর্য্যন্ত আমাদের জীবনে প্রায় আবার আগের ঈদুল ফিতরটি ফিরে আসছে। গত দুই বছরে আমাদের স্মরণকালের সেই পরম আনন্দের, অতি পরিচিত উৎসবমুখর ঈদুল ফিতর আসতে পারেনি। বলতে গেলে সবাইকে বাংকারের মধ্যে থেকে ঈদুল ফিতর পালন করতে হয়েছে। আমরা সবাই যে যার ঘরে বন্দি ছিলাম। আমার মনে আছে ২০২০ সালে কেউ বাড়ি থেকে বড় একটা বেরোয় নি। তাই কোন ঈদের জামাত হয়নি। ২০২১ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি ভ্যাকসিন নেবার পর, গভর্ণমেন্টের নির্দেশনা মান্য করে ঈদ কমিটি সংক্ষিপ্ত আকারে নামাজের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু মসজিদ, ব্যাংকোয়েট হল বা কোন বিল্ডিং-এর ভেতরে নয়, উন্মুক্ত পরিবেশে। দু’টো উদাহরণ দিলে কিছুটা আন্দাজ হতে পারে। যেমন আমাদের এলাকায় বিরাট একটা শপিং মল আছে এবং সেই হেতু তার চতুর্দিকে বিরাট পার্কিং লট আছে। তো ঈদ কমিটি সেই পার্কিং লটে ৬ ফুট ব্যবধান রেখে এক একটা ব্যাকিকেড তৈরি করেছিল এবং মাত্র একটি পরিবারকে একটি ব্যারিকেডের মধ্যে থেকে নামাজ পড়তে দেওয়া হয়েছিল। তাও খুব অল্প লোকই এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, কোভিডে সংক্রামিত হবার শঙ্কায় এবং ঠান্ডার কারণে আমরা ঐ পার্কিং লটে যাই নি। আমার ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে তাদের দোতালায় জানালাগুলো খুলে দিয়ে একের সঙ্গে অন্যের মোটামুটি ৫ ফুট ব্যবধান রেখে আমরা মাত্র চারজন ঈদের নামাজ পড়েছিলাম। আমার ভাই, তার বউ, আমার আর একটা ভাই ও আমি। এবং এই প্রথমবার আমি ইমামতি করে ঈদের নামাজ পড়িয়েছিলাম। আশা করছি ওটা আমার শেষ ঈদের নামাজ পড়ানো হয়ে থাকবে।

যাই হোক, মানবজীবনের ইদানিং কালের সবচেয়ে বড় শত্রু, এই কোভিড-১৯ অতিমারি যেসব জীবনকে অসময়ে, অকারণে কেড়ে নিয়েছে, তাদের সবার আত্মার মাগফেরাতের জন্য কায়মনবাক্যে প্রার্থনা করি। এঁদের মধ্যে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ব, ধর্ম ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারি অনেক দিকপালকে আমরা হারিয়েছি যাদের স্থান কখনও পূরণ হবে কি না এবং হলে তা কতদিনে হবে, সে বিষয়ে আমাদের কোন ধারণা নেই। এঁদের জন্য ও যে সব পরিবার তাঁদের প্রিয় আত্মীয়পরিজনকে হারিয়েছেন ও যাঁরা নানা দিক থেকে পারিবারিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই। এ কারণে যাঁরা নানা শারীরিক ও মানসিক দুর্দশার মধ্যে পড়ে গেছেন, তাদের সবার জন্যও গভীর সহানুভূতি জানাই।

তবে এই কথা বিনীতভাবে তাঁদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বিপদ আসে, আবার তা চলেও যায়। কোন বিপদ, তা যতই বিধ্বংসকারীই হোক না কেন, সেটি কখনও চিরস্থায়ী হয় না। কায়দাটা হলো, খুব সাবধান হয়ে, অনেক ধৈর্য্য ধরে এই ঝাপটাটি এড়িয়ে চলতে হয়। ব্যাপারটি সহজ নয়। কিন্তু যখন কেউ কিছু করতে পারছিল না এবং যারা করতে পারে বলে আমরা মনে করতাম, তাদের নিজেদের অনেকেই যখন খসে পড়তে দেখা যাচ্ছিল, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের আর কি করার ছিল? আশা নিরাশায় চোখ কান বুজিয়ে আমরা দু’টো বছর কাটিয়ে দিয়েছি।

অবশ্য আমরা প্রথমে যে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, সে সময়ের তুলনায় এই অতিমারির ছোবল থেকে নিজেদেরকে সামলানোর ব্যাপারে আজ আমরা অনেকটা প্রস্তুত। কিছু দেশ ছাড়া, প্রায় সব দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার দু’দুবার করে ভ্যাকসিন নেওয়া ছাড়াও যাদের জন্য প্রযোজ্য তাদের প্রায় সবার বুসটার শটও নেওয়া হয়ে গেছে। এমন কি ৬০-এর উর্দ্ধের বয়স্কদের আরও একবার বুস্টার দেওয়া হবে কিনা, সে নিয়ে স্বাস্থ্যবিভাগে চিন্তা ভাবনাও হচ্ছে। সবার কাছে এখন নানা কোয়ালিটির নাক-মুখ ঢাকার মাস্ক ও গাদা গাদা হ্যান্ড স্যানিটাইজারও সঞ্চিত আছে।

অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক বিপর্যয় এড়াতে প্রতি দেশের সরকারের নির্দেশনায় এখন অফিস, আদালত, স্কুল কলেজ, উপাসনালয়, সিনেমা থিয়েটার, পার্ক, পর্যটনকেন্দ্র ইত্যাদি সব খুলে দেওয়া হয়েছে। মুস্কিল হলো, সব খুলে দিলেও কোথাও শতভাগ বিপদমুক্ত হয়েছে বলে যে খোলা হয়েছে তা নয়। মূলত কিছু রিস্ক হজম করে ব্যবসায়িক কারণে সব খুলে দিয়ে অবস্থা একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব কি তাই? কিন্তু সরকার যখন বলে দিয়েছে, তখন আর অহেতুক ভাবনা করে লাভ কি? এসব মনে করে বেশিরভাগ লোক এখন আর মাস্কও পরছে না।

কিন্ত জীবাণু কিটাণুগুলিও দিনে দিনে সেয়ানা হয়ে যাচ্ছে। এ পর্য্যন্ত অতিমারি কোভিড-১৯ একের পর এক তার রূপান্তর দেখিয়ে চলেছে এবং একটার চেয়ে পরেরটার ভাইরাস আরো শক্তিশালী ও দ্রুত সংক্রমণশীল হয়ে উঠছে। এমন কি, যেসব এলাকায় এগুলো সম্পূর্ণ নির্মুল হয়ে গিয়েছে বলে ধরা হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে সেখানেও আবার মানুষ এই সব ভেরিয়েন্ট বা রূপান্তরে নতুন করে সংক্রমিত হচ্ছে। এমনকি যে সব এলাকা, দেশ বা সামাজিক স্তরকে আমরা মোটামুটি সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করেছিলাম, দেখা যাচ্ছে তারাও আদৌ নিরাপদ নয়। উদাহরণ স্বরূপ খোদ চীনের কথাই ধরা যায়। এবং আরো কাছের উদাহরণ হলো, ইদানিং প্রেসিডেন্ট ওবামা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল (১০ইং এপ্রিল) শোনা গেল, আমেরিকার ৮২ বয়স্ক হাউস স্পিকার ন্যান্সী পেলোসী, অ্যাটর্নি জেনারেল, কমার্স সেক্রেটারী ও আরো কিছু সিনিয়র কংগ্রেস ম্যান ছাড়া ওয়াশিংটিন ডিসির মেয়রও আক্রান্ত হয়েছেন। এঁদের সবাই দুই ডোজ ভ্যাক্সিন এবং বুস্টার নিয়েছিলেন। সেন্টার ফর ডিজিজ কনট্রোল বা সিডিসি থেকে বলাও হয়েছিল যে ওগুলো নেওয়া হয়ে গিয়ে থাকলে নাকে আর মাস্ক পরতে হবে না। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। কাজেই এখনও খুব বেশি ডেস্পারেট হওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও শংকাজনক।

তবে সুখের বিষয় ও ঐতিহাসিক সত্য এই যে, কোন ভয়ংকর বিপদই চিরদিন থাকে না। একের তুলনায় অন্যটি দেরিতে হলেও এক সময় তা নিরাময় হয়, তা সে অতিমারি, মহামারি, ভূমিকম্প, সাইক্লোন, টর্নাডো, মহাপ্লাবন হোক,  আর যাই হোক। আমরা মানুষরা হলাম “আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। প্রকৃতির নানা ঘাতপ্রতিঘাতের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা বাঁচতে শিখেছি এবং এ যাবৎ তাকে সদা পরাস্ত করে আসছি। যত নতুন নতুন বিপদ আসবে, মানুষও তত নতুন নতুন প্রতিকার আবিষ্কার করবে। আজ কেবল ভ্যাকসিন ও ম্যাস্ক নয়, কোভিড প্রতিষেধক ট্যাবলেট বাজারে চালু হতে চলেছে। কিছুদিন পরে মানুষ এমন ভয়ংকর অতিমারিতে এত শংকিত না হয়ে এটাকে একটা রুটিন অসুখের পর্যায়ে নিয়ে ফেলবে, অনেকটা সর্দিজ্বর বা ফ্লুর মত; যেমন হয়েছিল ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের বেলা। এমনকি ভাগ্য ভালো থাকলে পরের কোন প্যান্ডেমিক আসার আগেই তার প্রতিষেধক বাজারে চলে আসতে পারে।

আমাদের এই আশা সত্য কি না বা এর ব্যবহারিক কোন ভিত্তি আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সেই ১৬৫-১৮০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে আজকের ২০২২ খ্রীষ্টাব্দের গোড়ার দিক পর্যন্ত অতিমারীর (প্যান্ডেমিক) ছোবলের কাল ও তাতে মানুষের জীবনাবসানের একটা ইতিহাস অথবা খতিয়ান দেওয়া হলো। এটি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এক একবার প্যানডেমিক এসে কয়েক লাখ থেকে কয়েক কোটি মানুষকে সমাজ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বটে, কিন্তু তারা নিজেরাও চিরস্থায়ী হতে পারেনি, এমনকি কোন কোনটি বারবার আসলেও। নিচে তাদের তালিকা দেওয়া হলো: 

১) অ্যান্টোনিন প্লেগ                             ১৬৫-১৮০ খ্রীস্টাব্দ           মৃত ৫০ লাখ

২) জাস্টিনিয়ান প্লেগ.                           ৫৪১-৫৪২ খ্রীঃ                           ৩ – ৫ কোটি

৩) জাপানী গুটিবসন্ত                           ৭৩৫- ৭৩৭ খ্রীঃ                                   ১০ লাখ

৪) কালা মৃত্যু (বিউবনিক প্লেগ)             ১৩৪৭-১৩৫১ খ্রীঃ                 ৭.৫ থেকে ২০ কোটি।

৫) গুটি বসন্ত                                                 ১৫২০ খ্রীঃ                           ৫ কোটি ৬০ লাখ

৬) ১৭০০ শতাব্দির গ্রেট প্লেগ               ১৬০০ খ্রীঃ                                     ৩০ লাখ              

৭) ১৮০০ শতাব্দির গ্রেট প্লেগ                ১৭০০ খ্রীঃ                                     ৬ লাখ

৮) ৬ দফা কলেরার প্রাদুর্ভাব           ১৮১৭- ১৯২৩                           ১০ লাখ

৯) তৃতীয় দফা প্লেগ                            ১৮৫৫                                                ১ কোটি ২০ লাখ

১০) হলুদ জ্বর (ন্যাবা)                                         ১৮০০-এর শেষদিক             ১ থেকে ১.৫ লাখ

১১) রাশিয়ান ফ্লু                                                  ১৮৮৯-১৮৯০                                     ১০ লক্ষ

১২) স্প্যানিশ ফ্লু                                                 ১৯১৮-১৯১৯                                      ৪ থেকে কোটি

১৩) এশিয়ান ফ্লু                                              ১৯৫৭- ১৯৫৮                           ১১ লাখ

১৪) হংকং ফ্লু                                                 ১৯৬৮-১৯৭০                                ১০ লাখ

১৫) এইচআইভি(এইডস)                ১৯৮১- চলছে                           ২.৫ থেকে ৩.৫ কোটি

১৬) সারস                                          ২০০২-২০০৩                                     ৭৭০

১৭) সোয়াইন ফ্লু                                                 ২০০৯-২০১০                                     ২ লাখ

১৮) মারস                                          ২০১২ – চলছে                                    ৮৫০

১৯) ইবোলা                                                      ২০১৪-২০১৬                                      ১১ হাজার ২ শ।

২০) করোনা(কোভিড-১৯)                   নভেম্বর,২০১৯- এপ্রিল ২০২২ প্রায় ৬২ লাখ (এখনও চলছে)

দেখা যাচ্ছে মহামারি, অতিমারির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোগ ছিল কালা রোগ বা কালা মৃত্যু। তারপর নিম্নগামী সংখ্যা অনুযায়ী গুটি বসন্ত, স্প্যানিশ ফ্লু, জাস্টিনিয়ান প্লেগ, তৃতীয় দফা প্লেগ ও হলুদ জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়েছিল। বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত ইনশাল্লাহ আমাদের মৃত্যু সংখ্যা কয়েক লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। এখনও পর্যন্ত ভয়ের যে অসুখ দুটি আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে, তা হলো এইচআইভি বা এইডস এবং বর্তমান কোভিড-১৯-এর আগামী নানা রূপান্তর। আশা করা যায় এ দুটোকেও আমরা শীঘ্রই পরাস্ত করে ফেলব।

খায়রুল আনাম
খায়রুল আনাম